নামকরণ :
الْجَاثِيَةُ শব্দের অর্থ- অবনত হওয়া, নতজানু হওয়া। কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেকেই ভয়ে আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে নতজানু অবস্থায় থাকবে। অত্র সূরার ২৮ নম্বর আয়াতে الْجَاثِيَة শব্দটি থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলাকে চেনার ও জানার কয়েকটি নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলার একত্বতার ওপর প্রমাণ বহন করে। যারা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে তাদের পরিণতি, মানুষের ভাল-মন্দ আমলের ফলাফল তার ওপর বর্তাবে এবং বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যে শরীয়ত প্রদান করেছেন তার অনুসরণ, পাপীদের নাজাত পাওয়ার ভুল ধারণা, বস্তুবাদে বিশ্বাসী লোকদের বিবরণ এবং কিয়ামতের নিশ্চয়তা ও সেদিন কাফিরদের ভয়াবহ পরিণতির কথা তুলে ধরা হয়েছে।
১-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরার প্রথমেই তাঁর ক্ষমতার ও এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে এমন কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা ছয়টি জিনিষের বর্ণনা করেছেন যা প্রমাণ করে যে, তিনিই একমাত্র প্রতিপালক, আর ইবাদতের যোগ্যও তিনিই, অন্য কেউ নয়, বিষয়গুলো হলো- (১) আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি। (২) মানব জাতির সৃষ্টি। (৩) চতুষ্পদ জন্তুর সৃষ্টি। (৪) দিবা-রাত্রির পরিবর্তন। (৫) আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত জমিনকে জীবিতকরণ এবং (৬) বায়ুর পরিবর্তন- এ প্রত্যেকটিই আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন : “তারা কি কখনও তাদের ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিভাবে আমি তা তৈরি করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোন (সূক্ষ্মতম) ফাটলও নেই। আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি ও সেখানে উৎপন্ন করেছি চোখ জুড়ানো সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী ব্যক্তির জন্য জ্ঞান আহরণ ও উপদেশ স্বরূপ।” (সূরা কাফ ৫০ : ৬-৮)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন এ ব্যাপারে তিনি বলেন,
(وَمِنْ اٰيَاتِه۪ٓ أَنْ خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِذَآ أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُوْنَ )
“আর তাঁর দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে (অন্যতম) এই যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর এখন তোমরা মানুষ সব জায়গায় বিস্তার লাভ করেছ।” (সূরা রূম ৩০ : ২০)
চতুষ্পদ জন্তু জমিনে বিস্তার করার ব্যাপারে তিনি বলেন,
(وَمِنْ اٰيٰتِه۪ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَثَّ فِيْهِمَا مِنْ دَا۬بَّةٍ ط وَهُوَ عَلٰي جَمْعِهِمْ إِذَا يَشَا۬ءُ قَدِيْرٌ)
“তাঁর মহা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এতদুভয়ের মধ্যে তিনি যেসব জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলো; তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাদেরকে সমবেত করতে সক্ষম।” (সূরা শূরা- ৪২ : ২৯)
দিবা-রাত্রির পরিবর্তন হওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :
(إِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَاٰيٰتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ)
“নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩ : ১৯০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(يُقَلِّبُ اللّٰهُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِي الْأَبْصَارِ )
“আল্লাহ দিন ও রাতের পরিবর্তন ঘটান, নিশ্চয়ই এতে শিক্ষা রয়েছে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য।” (সূরা নূর ২৪ : ৪৪) আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত জমিনকে জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَا۬ءِ مِنْ مَّا۬ءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا)
“আর আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন ।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৬৪) এবং বাতাসের গতি পরিবর্তন করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَّتَصْرِيْفِ الرِّيٰحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَآءِ وَالْأَرْضِ لَاٰيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ )
“এবং বাতাসের গতি পরিবর্তনে আর আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় (এসবগুলোর মধ্যে) জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা বাকারাহ্ ২ : ১৬৪)
এ ব্যাপারে অনেক দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান যেগুলো প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কেউ নয়।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : যারা এ সকল নিদর্শন ও দলীল-প্রমাণ দেখার পরও বিশ্বাস স্থাপন করেনা, বরং অস্বীকার করত ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে এবং আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সাথে উপহাস করে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন নিয়ে শত্র“দের শহরে সফর করতে নিষেধ করেছেন এ আশঙ্কায় যে, তারা হয়তো কুরআনের অবমাননা করবে। (সহীহ বুখারী হা. ২৯৯০, সহীহ মুসলিম হা. ১৪৯১)
এরাই হলো দুর্ভাগা জাতি, আর এদের জন্যই রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। তাদের আমলসমূহ তাদের কোনই উপকারে আসবে না এবং তারা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে যাদের ইবাদত করত তারাও তাদের কোন উপকারে আসবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না।
৩. অহঙ্কার পোষণ করা যাবে না।
৪. কুরআন মানুষকে সৎ পথের সন্ধান দেয়।