আল মায়িদাহ আয়াত ২৬
قَالَ فَاِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ اَرْبَعِيْنَ سَنَةً ۚيَتِيْهُوْنَ فِى الْاَرْضِۗ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفٰسِقِيْنَ ࣖ ( المائدة: ٢٦ )
Qaala fa innahaa muhar ramatun 'alaihim arba'eena sanah; yateehoona fil ard; falaa taasa 'alal qawmil faasiqeen (al-Māʾidah ৫:২৬)
English Sahih:
[Allah] said, "Then indeed, it is forbidden to them for forty years [in which] they will wander throughout the land. So do not grieve over the defiantly disobedient people." (Al-Ma'idah [5] : 26)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আল্লাহ বললেন, তবে তা চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ হল, উদভ্রান্তের মত তারা যমীনে ঘুরে বেড়াবে, কাজেই এই অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য হা-হুতাশ করো না। (আল মায়িদাহ [৫] : ২৬)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
(আল্লাহ) বললেন, ‘তবে এ (ভূমি) চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ রইল। তারা ভূ-পৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে,[১] সুতরাং তুমি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না।’ [২]
[১] এই ভূ-পৃষ্ঠকে ময়দানে 'তীহ' বলা হয়। ('তীহ' গোলক-ধাঁধার ময়দানকে বলে।) এই ময়দানে চল্লিশ বছর পর্যন্ত এই জাতি নিজেদের বিদ্রোহের ও জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করার কারণে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এর পরেও (আল্লাহর পক্ষ থেকে) এই ময়দানে 'মান্ন্' ও 'সালওয়া' অবতরণ হয়। যা (খেতে খেতে) বিরক্ত হয়ে তারা তাদের নবী (মূসা (আঃ))-কে বলে, 'প্রতিদিন একই খাবার খাওয়ার কারণে আমাদের অরুচি হয়ে গেছে। অতএব আপনি আপনার প্রভুর নিকট দু'আ করুন যে, তিনি যেন আমাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সবজী ও ডাল উৎপন্ন করেন।' এই ময়দানেই তাদের উপর মেঘ দ্বারা ছায়া দান করা হয়। এখানেই মূসা (আঃ) লাঠি দ্বারা পাথরকে আঘাত করলে বারো গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণা নিঃসৃত হয় এবং অনুরূপ তারা আরো বহুভাবে নিয়ামতপ্রাপ্ত হতে থাকে। পরিশেষে চল্লিশ বছর পর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, তখন তারা বায়তুল মাকদিস প্রবেশ করে।
[২] নবী (মূসা (আঃ)) দাওয়াত ও তাবলীগ করার পর যখন দেখেন যে, তাঁর গোত্র সোজা ও সরল পথ অবলম্বনে প্রস্তুত নয়; যার মধ্যে তাদের ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে, তখন প্রকৃতিগতভাবে তিনি বড় আক্ষেপ ও আন্তরিকভাবে দুঃখ-দুশ্চিন্তার শিকার হয়ে পড়েন। ঠিক একই অবস্থা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হত, যা কুরআন শরীফের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে মূসা (আঃ)-কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে যে, যখন তুমি তাবলীগের গুরুভার আদায় করেছ এবং আল্লাহর পয়গাম লোকদের নিকট পৌঁঁছে দিয়েছ, তুমি তোমার জাতিকে এক মহান সফলতার দ্বার প্রান্তে উপস্থিত করেছ, কিন্তু তারা তাদের হীনন্মন্যতা ও দুর্মতির কারণে তোমার কথা মান্য করে না, তখন তুমি তোমার কর্তব্য পালনের দায়িত্ব হতে নিষ্কৃতি পেয়ে গেছ। সুতরাং তোমাকে এ ব্যাপারে দুঃখিত ও চিন্তিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এমন পরিস্থিতিতে দুঃখিত ও চিন্তিত হওয়াটা একটা প্রকৃতগত ব্যাপার ছিল। কিন্তু সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, দাওয়াত ও তাবলীগের পর আল্লাহর নিকটে তুমি দায়িত্বমুক্ত।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আল্লাহ বললেন, ‘তবে তা [১] চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হল, তারা যমীনে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, কাজেই আপনি ফাসিক সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করবেন না [২] ।’
[১] অর্থাৎ সে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করার অধিকার তারা চল্লিশ বছরের জন্য হারিয়েছে। কারণ তারা অবাধ্যতা করেছিল। এটা ছিল তাদের জন্য নির্ধারিত দুনিয়ার শাস্তি। হয়ত এর মাধ্যমে তাদের উপর আপতিত কোন কঠোর শাস্তি লাঘব করা হয়েছিল। চল্লিশ বছর নির্ধারনের কারণ সম্ভবত; এই ছিল যে, এ সময়ের মধ্যে সে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মৃত্যু সংঘটিত হবে, যারা ফিরআউনের দাসত্ব ও তাবেদারীর কারণে ইজ্জতের যিন্দেগী যাপন করার মত হিম্মত অবশিষ্ট ছিল না। পরবর্তীতে যারা সেই কঠোর প্রতিকুল অবস্থায় জন্মলাভ করেছিল তারাই শক্রদের পরাভূত করার মত সাহসী হতে পেরেছিল। [সা’দী]
[২] মহান আল্লাহ যখন জানলেন যে, মূসা ‘আলাইহিস সালাম সম্ভবত; তার কাওমের জন্য দয়াপরবশ হবেন এবং তাদের প্রতি নাযিলকৃত শাস্তির জন্য দুঃখবোধ করতে থাকবেন, তখন আল্লাহ্ তা'আলা মূসা ‘আলাইহিস সালামকে এ ব্যাপারে আফসোস না করার নির্দেশ দিলেন। যাতে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, এ শাস্তিটুকু তাদের অপরাধের কারণে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা বান্দার উপর সামান্যও জুলুম করেন নি। [সা’দী]
3 Tafsir Bayaan Foundation
তিনি বললেন, ‘তাহলে নিশ্চয় তা তাদের জন্য চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ; তারা যমীনে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে। সুতরাং তুমি ফাসিক কওমের জন্য আফসোস করো না’।
4 Muhiuddin Khan
বললেনঃ এ দেশ চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্যে হারাম করা হল। তারা ভুপৃষ্ঠে উদভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব, আপনি অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্যে দুঃখ করবেন না।
5 Zohurul Hoque
তিনি বললেন -- ''তবে নিঃসন্দেহ এটি তাদের জন্য হারাম থাকবে চল্লিশ বৎসর কাল, তারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। অতএব দুঃখ করো না এই দুষ্কৃতিপরায়ণ জাতির জন্য।
6 Mufti Taqi Usmani
আল্লাহ বললেন, তবে সে ভূমি তাদের জন্য চল্লিশ বছর কাল নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। (এ সময়) তারা যমীনে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে। সুতরাং (হে মূসা!) তুমি অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না।
7 Mujibur Rahman
তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ (তাহলে মীমাংসা এই যে) এই দেশ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এদের হস্তগত হবেনা, এ রূপেই তারা ভূ-পৃষ্ঠে উদভ্রান্ত হয়ে ফিরবে, সুতরাং তুমি অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য (একটুও) বিষন্ন হয়োনা।
8 Tafsir Fathul Mazid
২০-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মূসা (আঃ)-এর সময়ের কথা স্মরণ করতে বলছেন যখন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও তাঁর জাতিকে ফির‘আউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিযার্তন ও দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে অনুগ্রহ করেছিলেন। তারা মুক্তি পাবার পর তাদের মাতৃভূমি বাইতুল মুক্বাদ্দাস ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা দখলে আনার জন্য বের হয়েছিল, তাদের মাতৃভূমি থেকে শত্র“দেরকে হটানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর জিহাদ ফরয করে দিলেন। সে সময় মূসা (আঃ) জাতিকে নসিহত করলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন যাতে তারা জিহাদে বের হয়।
(اذْكُرُوْا نِعْمَةَ اللّٰهِ عَلَيْكُمْ)
‘তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর’অর্থাৎ মূসা (আঃ) বললেন: তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যে নেয়ামত দান করেছেন তা স্মরণ কর আর আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অমান্য করো না। বাণী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন, এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪৯-৫৭ নং আয়াতের তাফসীরে আলোচনা করা হয়েছে।
(إِذْ جَعَلَ فِيْكُمْ أَنْۭـبِيَا۬ءَ)
‘যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন’অর্থাৎ বানী ইসরাঈলের যে সকল নেয়ামত দান করা হয়েছে, তার অন্যতম হল ধারাবাহিকভাবে তাদের মধ্য থেকে নাবী রাসূলগণের আগমন। এ সকল নাবী-রাসূল তাদেরকে হিদায়াত ও কল্যাণের দিকে আহ্বান করতেন এবং অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে আদেশ করতেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ
বানী ইসরাঈলের মাঝে ধারাবাহিকভাবে নাবীগণ আগমন করেছেন, যখনই কোন নাবী মারা গেছেন তখনই আরেকজন নাবী এসেছেন। কিন্তু আমার পর আর কোন নাবী আসবে না। তবে অনেক খলীফা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৫৫) আর তাদেরকে আধিপত্য ও তৎকালীন পৃথিবীর এমন সব জিনিস দান করেছিলেন যা অন্য কাউকে প্রদান করেননি।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন,
(وَجَعَلَكُمْ مُّلُوْكًا)
তোমাদেরকে বাদশা বানিয়েছেন, এর অর্থ হল: একজন খাদেম, স্ত্রী ও বাড়ি দিয়েছেন। কেননা যার খাদেম, স্ত্রী ও বাড়ি আছে তাকে বাদশা বলা হয়। (তাবারী ৯/১০৬)
তাছাড়া যখন ফির‘আউনের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেল তখন তাদের সব কিছুর মালিকানা ফিরে পেল, দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল এবং নিজেদের দীন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اٰتَيْنَا بَنِيْٓ إِسْرَا۬ئِيْلَ الْكِتٰبَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنٰهُمْ مِّنَ الطَّيِّبٰتِ وَفَضَّلْنٰهُمْ عَلَي الْعٰلَمِيْنَ)
“আমি বানী ইসরাঈলকে কিতাব (তাওরাত) বিধান ও নবুওয়াত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে উত্তম রিযিক ও বিশ্বজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।”(সূরা জাসিয়া ৪৫:১৬)
এসব নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলকে পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্য জিহাদ করার নির্দেশ দিলেন। পবিত্র ভূমি বলতে কেউ বলেছেন, তুর পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, কেউ বলেছেন, আরিহা। তবে অধিকাংশরাই বলেছেন, বাইতুল মুক্বাদ্দাস। বাইতুল মুক্বাদ্দাস ইয়া‘কূব (আঃ)-এর আবাসস্থল। কিন্তু ইউসুফ (আঃ) মিসরের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর তারা সকলেই মিসরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরিশেষে মূসা (আঃ) ফির‘আউনের কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য গোপনিয়ভাবে রাতারাতি বানী ইসরাঈলকে নিয়ে মিসরে চলে আসেন। সে সময় বাইতুল মুক্বাদ্দাস আমালিকা জাতির শাসনে ছিল। যারা বীর বাহাদুর ছিল। যখন মূসা (আঃ) বাইতুল মুক্বাদ্দাস গিয়ে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করলেন তখন আমালিকা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যোঘণা করলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা জিহাদ ফরয করে দিলেন এবং এ জিহাদে পিছপা হতে বারণ করলেন। সাথে সাথে সুসংবাদ দিলেন যে, (الَّتِيْ كَتَبَ اللّٰهُ لَكُمْ) এ ভূমির তোমরাই উত্তরাধিকারী হবে এ ওয়াদা বানী ইসরাঈলেরকে আল্লাহ তা‘আলা প্রদান করেছেন। সুতরাং তোমরা বিজয়ী হবে। কিন্তু তারপরেও মূসা (আঃ)-এর সাথে তাঁর সম্প্রদায় এ বেআদবীপূর্ণ আচরণ করল। তারা অবাধ্য হয়ে গেল।
(مَّا دَامُوْا فِيْهَا)
‘যতক্ষণ তারা সেখানে থাকবে।’অর্থাৎ তারা বলল: শক্তিশালী আমালিকা জাতি সেখান থেকে বের না হলে আমরা সেখানে প্রবেশ করব না।
(قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ)
‘যারা (আল্লাহকে) ভয় করত, তাদের মধ্য থেকে দু’ব্যক্তি বলল’ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তারা হলেন, ইউশা বিন নূন ও কালিব বিন ইউফানা। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) অর্থাৎ তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করল যে, যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা দিয়েছেন সুতরাং যাও, জিহাদ কর, তোমরা অবশ্যই বিজয়ী হবে। তোমরা যদি মু’মিন হও তাহলে আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা উচিত। কারণ, তোমরা কোন্ জাতি বা শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করছ সেটা লক্ষ্য করার বিষয় নয়, বরং ঈমান ও ভরসা নিয়ে জিহাদ করলে অবশ্যই বিজয় লাভ করবে। এ উম্মতকেও আল্লাহ তা‘আলা সে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَهِنُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ)
আর তোমরা হীনবল ও দুঃখিত হয়ো না বস্তুত যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে তোমরাই জয়ী হবে। (সূরা আলি-ইমরান ৩:১৩৯)
সুতরাং মুসলিমরা যদি সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর অটল থাকে তাহলে পৃথিবীর যত বড় পরাশক্তিই হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে তাদের ওপর বিজয় দান করবেন।
তারপরেও তাদের ঔদ্ধত্য আরো বেড়ে গেল। তারা বলল:
(فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقٰتِلَا)
‘অতএব তুমি ও তোমার প্রতিপালক যাও এবং দু’জনে লড়াই কর’ অর্থাৎ তাদেরকে বিজয়ের প্রতিশ্র“তি দেয়ার পরেও তারা কাপুরুষতা, অবাধ্যতা ও বিদ্রƒপ প্রকাশ করে বলল যে, তুমি ও তোমার প্রভু যাও, যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম।
কিন্তু নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীরা এরূপ ছিলেন না। বদরের দিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। আবূ বকর (রাঃ) উত্তম পরামর্শ দিলেন, এভাবে সকল মুহাজির সাহাবী উত্তম পরামর্শ দিলেন। তারপর আনসারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কারণ আনসারদের সংখ্যা বেশি ছিল। সা‘দ বিন মুয়ায (রাঃ) বললেন: হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! হয়তো আপনি আমাদের মনের ইচ্ছা জানতে চাইছেন। তাহলে শুনুন! যে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ করে বলছি: আপনি যদি আমাদেরকে সমুদ্রের তীরে দাঁড় করিয়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন তাহলে আমরা আপনার কথামত নির্দ্বিধায় তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আপনি দেখবেন যে, একজন ব্যক্তিও তীরে দাঁড়িয়ে নেই। আপনি আগ্রহের সাথে আমাদেরকে শত্র“র মোকাবিলার জন্য নিয়ে চলুন। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে স্থির পদে টিকে থাকবো তা আপনি দেখতে পাবেন। আপনি আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে চলুন; আমাদের বীরত্ব ও ধৈর্য দেখে আপনার চক্ষু শীতল হবে ইনশা-আল্লাহ। আমরা সেরূপ কথা বলব না যেমন বানী ইসলাঈল মূসা (আঃ)-কে বলেছিল যে, “অতএব তুমি ও তোমার প্রতিপালক যাও এবং দু’জনে লড়াই কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম।”(ইবনু হিশাম ২/২১৯)
(فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ)
‘তাদের জন্য এ দেশ চল্লিশ বছর পর্যন্ত অবৈধ করা হল’দেশ বলতে তীহ ময়দানকে বুঝানো হয়েছে। তাদের এরূপ আচরণের কারণে তীহ ময়দানে চল্লিশ বছর উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তি বদ্ধমূল করে দিলেন। এরপরেও এ ময়দানে মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করা হয়।
মূলত তাদেরকে কোন প্রাচীর দ্বারা ঘেরাও করা হয়নি এবং হাত পায়ে শিকল দ্বারা বাধাও ছিল না। বরং তারা ছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে। তারা নিজ দেশ মিসরে ফিরে আসার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথ চলত কিন্তু তারা নিজেদেরকে সেখানেই দেখতে পেত যেখান থেকে রওয়ানা করেছিল। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (রহঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এ অবাধ্য জাতির জন্য কোন দুঃখ কর না। এ তীহ প্রান্তরে মূসা ও হারুন (আঃ) ইনতেকাল করেন। তারপর ইউশা বিন নূনের নেতৃত্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস জয় করে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পূর্ববর্তী নাবীদের সাথে তাদের উম্মাতের লোকেরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিল।
২. নাবীদের অনুসরণে রয়েছে সফলতা। আর বিরোধীতায় রয়েছে অকল্যাণ।
৩. প্রত্যেক যুগেই সৎ ব্যক্তি বিদ্যমান ছিল।
৪. পাপাচারীদের ওপর শাস্তি নেমে আসলে তাতে আফসোস করা অনুচিত।
৫. মু’মিনরা ঈমানে ও আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসায় অটল থাকলে যেকোন শক্তিশালী জাতির বিরুদ্ধে জিহাদ করে বিজয়ী হবে ইনশা-আল্লাহ।
9 Fozlur Rahman
আল্লাহ বললেন, “তাহলে এই পবিত্র ভূমি তাদের জন্য চল্লিশ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে। তারা পৃথিবীতে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরবে। সুতরাং তুমি (এই) অবাধ্য লোকদের জন্য দুঃখ করো না।”
10 Mokhtasar Bangla
২৬. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মূসা (আলাইহিস-সালাম) কে বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের উপর চল্লিশ বছরের জন্য এ পবিত্র ভ‚মিতে প্রবেশ হারাম করেছেন। তারা এ সময় মরুভ‚মিতে পথ না পেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরবে। তাই হে মূসা! আপনি আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হওয়া সম্প্রদায়ের জন্য কোন হা-হুতাশ করবেন না। কারণ, তারা যে শাস্তি পাচ্ছে তা তাদের পাপের ফসল।
11 Tafsir Ibn Kathir
২০-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে আল্লাহর নিয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এরই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বললেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ঐ নিয়ামতের একথা স্মরণ কর যে, তিনি তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই মধ্য হতে একের পর এক নবী পাঠাতে রয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর পর হতে আজ পর্যন্ত তাঁরই বংশধরের মধ্যে নবুওয়াত রয়েছে। এসব নবী তোমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে রয়েছেন।
এ ক্রমপরম্পরা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর শেষ হয়েছে। অতঃপর নবী ও রাসূলদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে পরিপূর্ণ নবুওয়াত দান করা হয়। তিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনিই ছিলেন সমস্ত নবী ও রাসূলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাঁর উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন। হে আমার কওম! তোমরা আরও স্মরণ কর যে, মহান আল্লাহ তোমাদেরকে বাদশাহ বানিয়ে দিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এখানে বাদশাহ বানিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাদেরকে খাদেম, স্ত্রী এবং ঘরবাড়ী দান করেছেন। তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে কোন লোকের স্ত্রী, খাদেম ও ঘরবাড়ী থাকলেই তাকে বাদশাহ বলা হতো। ইবনে জারীর (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তাকে একটি লোক জিজ্ঞেস করেনঃ “আমি কি মুহাজির দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত নই।” তিনি (আবদুল্লাহ) উত্তরে বলেনঃ “তোমার কি স্ত্রী রয়েছে?" তিনি বলেনঃ ‘হ্যা। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার কি ঘরবাড়ী রয়েছে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা”; তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “তাহলে তো তুমি ধনীদেরই অন্তর্ভুক্ত।” লোকটি তখন বললেনঃ “আমার খাদেমও রয়েছে।” এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেনঃ “তুমি তাহলে বাদশাহদেরই অন্তর্ভুক্ত। হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেন যে, যার সওয়ারী, খাদেম ও ঘরবাড়ী রয়েছে সেই বাদশাহ। কাতাদার (রঃ) উক্তি এই যে, প্রথম প্রথম বানী ইসরাঈলের মধ্যেই খাদেমদের প্রচলন হয়েছিল। একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, তাদের মধ্যে যার কাছে খাদেম, সওয়ারী ও স্ত্রী থাকতো তাকেই বাদশাহ বলা হতো। আর একটি মারফু হাদীসে আছে যে, যার ঘরবাড়ী ও খাদেম রয়েছে সে বাদশাহ। এ হাদীসটি মুরসাল’ ও ‘গারীব। একটি হাদীসে আছে- “যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় সকাল করলো যে, তার শরীর সুস্থ, তার প্রাণে শান্তি ও নিরাপত্তা রয়েছে এবং সারাদিনের জন্যে যথেষ্ট হয় এ পরিমাণ খাবারও তার কাছে রয়েছে, সে যেন সারা দুনিয়াকেই পেয়ে বসেছে। সেই সময় যে ইউনানী, কিবতী ইত্যাদি ছিল তাদের চেয়ে এদেরকে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর আয়াতে রয়েছে- আমি বানী ইসরাঈলকে কিতাব, হিকমত ও নবুওয়াত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে সারা বিশ্বের উপর মর্যাদা দিয়েছিলাম। যখন বানী ইসরাঈল মুশরিকদের দেখাদেখি হযরত মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ বানাতে বললো তখন হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে উত্তরে বলেছিলেনঃ “তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর মর্যাদা দান করেছেন।” এর ভাবার্থ সব জায়গায় একই যে, আল্লাহ পাক বানী ইসরাঈলকে সেই যুগের সমস্ত মানুষের উপর ফযীলত দান করেছিলেন। কেননা, এটাতো প্রমাণিত বিষয় যে, উম্মতে মুহাম্মাদী তাদের অপেক্ষা সবদিক দিয়েই উত্তম। কেননা, স্বয়ং কুরআন কারীমে ঘোষণা করা হচ্ছে- وَكُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ (৩:১১০) এবং অন্য জায়গায় বলা হয়েছে- وَجَعَلْنَا كُمْ اُمّةً وَّسَطًا (২:১২৪)
একথাও বলা হয়েছে যে, এ ফযীলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকেও বানী ইসরাঈলদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন মান’ ও ‘সালওয়া’ নামক খাদ্য অবতরণ করা, মেঘ দ্বারা ছায়া দান করা ইত্যাদি, যা ছিল সত্যিই অস্বাভাবিক ব্যাপার। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের উক্তি ওটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে-- তাদেরকে সেই সময়ের লোকদের উপর ফযীলত দেয়া হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তাদের দাদা হযরত ইয়াকূব (আঃ)- এর যুগে বায়তুল মুকাদ্দাস প্রকৃতপক্ষে তাদেরই দখলে ছিল এবং যখন তারা সপরিবারে মিসরে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর নিকট চলে গিয়েছিল তখন তথায় আমালেকা জাতি তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তাদের হাত পা ছিল অত্যন্ত শক্ত। তখন হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের উপর জয়যুক্ত করবেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরায় তোমাদের দখলে এনে দেবেন। কিন্তু বানী ইসরাঈল ভীরুতা প্রদর্শন করতঃ হযরত মূসা (আঃ)-এর কথা অমান্য করলো। এরই শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে তীহ ময়দানে উদ্বিগ্ন অবস্থায় অবস্থান করতে হলো مُقَدَّسَةٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্র। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, اَرْضٌ مُقَدَّسَةٌ দ্বারা তূর পর্বত ও ওর চার পাশের ভূমিকে বুঝানো হয়েছে এবং ওটাকে ‘ঈলিয়া’ বলা হয়। একটি বর্ণনায় اَرِحَاءُ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু এটা ঠিক নয়। কেননা, اَرِحَاءُ কে জয় করা উদ্দেশ্যও ছিল না এবং ওটা তাদের পথের উপরেও ছিল না। কারণ, ফিরাউনের ধ্বংস সাধনের পর তারা মিসর শহর থেকেই আসছিল এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের পথে ভ্রমণ করছিল। এটা হতে পারে যে, ওটা ঐ বিখ্যাত শহরই হবে যা তূর পর্বতের দিকে বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল।
‘যা আল্লাহ তোমাদের জন্যে লিখে দিয়েছেন’-এর ভাবার্থ এই যে, বানী ইসরাঈলকে বলা হচ্ছে- তোমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসরাঈল (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ পাক ওয়াদা করেছিলেন যে, ঐ পুণ্যভূমি তিনি তার পরবর্তী মুমিন সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রদান করবেন। সুতরাং হে বানী ইসরাঈল! তোমরা যখন ওটাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছ তখন তোমরা ধর্মত্যাগী হয়ে যেয়ো না। অর্থাৎ জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে পড়ো না, নতুবা তোমরা ভীষণ ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাবে।
তারা তখন উত্তরে হযরত মূসা (আঃ)-কে বললোঃ আপনি আমাদেরকে যে শহরে যেতে বলেছেন এবং যে শহরবাসীদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছেন, সে সম্পর্কে আমাদের অভিমত এই যে, তারা যে খুব শক্তিশালী বীর পুরুষ তা আমাদের বেশ ভালভাবেই জানা আছে। সুতরাং আমরা তাদের সাথে মোকাবিলা করতে পারবো না। আর যে পর্যন্ত তারা ঐ শহরে বিদ্যমান থাকবে। সে পর্যন্ত আমরা ওর মধ্যে প্রবেশ করতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম থাকবো। তবে যদি তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে আমরা তথায় প্রবেশ করবো। এটা ছাড়া আপনার নির্দেশ পালন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, যখন হযরত মূসা (আঃ)‘আরীহা'র নিকটবর্তী হলেন তখন তিনি বারোজন গুপ্তচর নিযুক্ত করলেন। বানী ইসরাঈলের প্রত্যেক গোত্র থেকে তিনি একজন করে গুপ্তচর গ্রহণ করলেন। অতঃপর সঠিক সংবাদ আনয়নের জন্যে তাদেরকে আরীহায় প্রেরণ করলেন। এ লোকগুলো তথায় গিয়ে তাদের মোটা দেহ ও শক্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তারা সবাই একটা বাগানে অবস্থান করছিল। ঘটনাক্রমে বাগানের মালিক ফল পাড়ার জন্যে তথায় আগমন করলো। সে ফল পেড়ে নিয়ে ফলের সাথে সাথে ঐগুলোকেও গাঁঠরির মধ্যে ভরে নিলো এবং বাদশাহর সামনে হাযির হয়ে ফলের গাঠরি খুলে ফেললো। গাঠরির মধ্যে এরা সবাই ছিল। বাদশাহ তাদেরকে বললেনঃ “এখন তো আমাদের শক্তি অনুমান করতে পেরেছো। আমি তোমাদেরকে হত্যা করছি না। যাও, তোমাদের লোকদের কাছে ফিরে আমাদের সম্পর্কে অবহিত কর।” সুতরাং তারা ফিরে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো, যার ফলে বানী ইসরাঈল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু এ হাদীসটির ইসনাদ ঠিক নয়।
আর একটি বর্ণনায় আছে যে, তাদের মধ্যে একটি লোক ঐ বারোজন লোককে ধরে ফেললো এবং স্বীয় চাদরের গাঠরিতে তাদেরকে বেঁধে ফেললো এবং শহরে নিয়ে গিয়ে জনগণের সামনে তাদেরকে নিক্ষেপ করলো। তারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলোঃ “তোমরা কোথাকার লোক?” তারা উত্তরে বললোঃ “আমরা হযরত মূসা (আঃ)-এর কওমের লোক। আপনাদের খবরাখবর নেয়ার জন্যে আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। তারা এমন একটি আঙ্গুর তাদেরকে প্রদান করলো যা একটি লোকের জন্যে যথেষ্ট ছিল। আর তারা তাদেরকে বললোঃ “যাও, তোমরা তোমাদের লোকদেরকে বলে দাও যে, এটা হচ্ছে তাদের ফল।” তারা ফিরে গিয়ে স্বীয় কওমের নিকট সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো। তখন হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে ঐ শহরে প্রবেশ করার ও শহরবাসীদের সাথে জিহাদ করার নির্দেশ দিলেন। তারা তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলো-আপনি ও আপনার প্রভু গমন করুন, অতঃপর যুদ্ধ করুন, আমরা এখান হতে নড়ছি না।
হযরত আনাস (রাঃ) একটি বাঁশ মেপে নেন যার দৈর্ঘ্য ছিল পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন হাত। অতঃপর তিনি ওটা গেড়ে দিয়ে বলেনঃ “ঐ আমালীকদের দেহ এ পরিমাণ লম্বা ছিল।” মুফাসসিরগণ অনেক ইসরাঈলী রিওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন যে, ঐ লোকগুলোর এ পরিমাণ শক্তি ছিল, তারা এ পরিমাণ মোটা ছিল এবং এতোটা লম্বা ছিল। আওজ ইবনে আনাক ইবনে হযরত আদম (আঃ) তাদেরই মধ্যে একজন ছিল যার দেহ ছিল তিন হাজার তিনশ তেত্রিশ গজ লম্বা এবং দেহের প্রস্থ ছিল তিন গজ। কিন্তু এসব একেবারেই বাজে কথা এবং এ কথা উল্লেখ করাই লজ্জাজনক ব্যাপার। এগুলো সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)-কে ষাট হাত লম্বা করে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর আজ পর্যন্ত মখলুকের দেহের দৈর্ঘ হ্রাস পেতে আছে। এই ইসরাঈলী রিওয়ায়াতগুলোতে এও রয়েছে যে, আওজ ইবনে আনাক কাফির ও জারজ ছিল। সে হযরত নূহ (আঃ)-এর তুফানের সময় বিদ্যামান ছিল। সে নূহ (আঃ)-এর সাথে নৌকায় উঠেনি। তথাপি পানি তার জানু পর্যন্ত পৌছেনি। এটাও একেবারে ভিত্তিহীন, বাজে ও মিথ্যা কথা। কুরআন কারীমের এটা সম্পূর্ণ উলটো। কুরআন মাজীদে হযরত নূহ (আঃ)-এর প্রার্থনার উল্লেখ আছে। তিনি প্রার্থনায় বলেছিলেনঃ “হে আমার প্রভু! ভূ-পৃষ্ঠে একজন কাফিরও যেন রক্ষা না পায়।” প্রার্থনা কবুলও হয়েছিল। আর হয়েছিলও তা-ই। কুরআনে কারীমে ঘোষিত হয়েছে- “আমি নূহ (আঃ)-কে এবং তার নৌকার আরোহীদেরকে রক্ষা করেছিলাম এবং সমস্ত কাফিরকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম।” স্বয়ং কুরআনে উল্লিখিত রয়েছে- “যাদের উপর আল্লাহর রহমত রয়েছে তারা ছাড়া আজকের দিন কেউই রক্ষা পাবে না।” বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, স্বয়ং নূহ (আঃ)-এর ছেলেও ঈমানদার ছিল না বলে রক্ষা পায়নি, অথচ কাফির ও জারজ সন্তান আওজ ইবনে আনাক বেঁচে গেল। এটা আকল ও নাকল উভয়েরই বিপরীত। বরং আওজ ইবনে আনাক বলে যে কোন লোক ছিল এটাই তো আমরা বিশ্বাস করি না। আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
বানী ইসরাঈল যখন তাদের নবীকে মানলো না বরং বেআদবী করলো, তখন যে দু’ব্যক্তির উপর আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছিল তারা তাদেরকে বুঝাতে লাগলেন। তাঁদের অন্তরে আল্লাহর ভয় ছিল যে, বানী ইসরাঈলের শয়তানীর কারণে না জানি আল্লাহর শাস্তি এসে পড়ে। এক কিরআতে يَخَافُوْنَ শব্দের পরিবর্তে يَحَابُوْنَ শব্দ রয়েছে, যার ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, কওমের মধ্যে ঐ দু’ব্যক্তির ইজ্জত ও সম্মান ছিল। একজনের নাম ছিল হযরত ইউশা ইবনে নূন এবং অপরজনের নাম ছিল হযরত কালিব ইবনে ইউফনা। তারা দু'জন তাদেরকে বললেনঃ “যদি তোমরা আল্লাহর উপর ভরসা কর, তাঁর রাসূলের অনুগত হও, তবে আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে ঐ শক্রদের উপর জয়যুক্ত করবেন এবং স্বয়ং তিনি তোমাদেরকে শক্তি ও সাহায্য দান করবেন। তোমরা এই শহরে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করবে। তোমরা দরজা পর্যন্ত তো চল এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখ যে, বিজয় লাভ তোমাদেরই হবে।” ঐ কাপুরুষের দল তখন তাদের প্রথম উত্তরকে আরও মজবুত করে বললোঃ “এই প্রতাপশালী কওমের বিদ্যমানতায় আমরা একটি কদমও বাড়াতে পারবো না।” হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ) তাদের এই অবস্থা দেখে তাদেরকে অনেক বুঝালেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে বিনয়ও প্রকাশ করলেন। কিন্তু তারা কোনক্রমেই মানলো না। এই অবস্থা দেখে হযরত ইউশা এবং হযরত কালিব নিজেদের কাপড় ফেড়ে ফেললেন এবং তাদেরকে অনেক ভৎসনা করলেন। কিন্তু সেই হতভাগার দল অবাধ্যতার উপর অটল থাকলো। এমনকি এটাও বলা হয়েছে যে, তারা ঐ মহান ব্যক্তিদ্বয়কে পাথর মেরে শহীদ করে দিয়েছিল। হঠকারিতার তুফান শুরু হয়ে গেল এবং তারা রাসূলের বিরুদ্ধাচরণে অবিচল থাকলো।
হযরত মূসা (আঃ)-এর কওম বানী ইসরাঈলের এই অবস্থাকে সামনে রেখে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবায়ে কিরামের প্রতি লক্ষ্য করা যাক। মক্কার ৯০০ বা ১০০০ কাফির যখন তাদের বাণিজ্যিক কাফেলাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গমন করলো, তখন সেই কাফেলা তো অন্য পথ ধরে মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে গেল, কিন্তু তাদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গমনকারী কাফিররা নিজেদের শক্তির দাপটের কারণে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ক্ষতি সাধন ব্যতিরেকে মক্কা ফিরে যাওয়া অপমানজনক মনে করে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে পদতলে পিষ্ট করার ইচ্ছায় মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন এই অবস্থা অবগত হলেন তখন তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সাহাবীদের নিকট পরামর্শ চাইলেন। তারা তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে নিজেদের জান, মাল এবং স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে রেখে দিয়ে বললেনঃ “আপনিই এগুলোর মালিক। আমরা সংখ্যাও দেখতে চাই না, বিজয়ও দেখতে চাই না, বরং আমরা চাই শুধু আপনার নির্দেশের প্রতি নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে।” সর্বপ্রথম হযরত আবূ বকর (রাঃ) এ ধরনের বক্তব্য পেশ করলেন। তারপর মুহাজির সাহাবীদের মধ্য থেকে কয়েকজন এ প্রকারের ভাষণ দিলেন। কিন্তু এর পরেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে মুসলমানগণ! আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।” এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল আনসারদের আন্তরিক বাসনা অবগত হওয়া। কেননা, ওটা স্থান ছিল তাদেরই স্থান এবং তাঁরা ছিলেন মুহাজিরদের অপেক্ষা সংখ্যায় বেশী। তখন হযরত সা'দ ইবনে 'মুআয (রাঃ) নামক আনসারী দাড়িয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মনে হয় আপনি আমাদের (আনসারদের) মনের ইচ্ছা জানতে চাচ্ছেন। তাহলে শুনুন! যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ! যদি আপনি আমাদেরকে সমুদ্রের তীরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তাহলে আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তাতে ঝাপিয়ে পড়বে। আপনি দেখবেন যে, আমাদের মধ্যে একজনও এমন থাকবে না যে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আপনি আগ্রহের সাথে আমাদেরকে শত্রুর মোকাবিলার জন্যে নিয়ে চলুন, আমরা যে যুদ্ধক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে স্থির পদে টিকে থাকি তা আপনি দেখতে পাবেন। আপনি জেনে নেবেন যে, আমরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হওয়াকে সত্য বলে জানি। আপনি আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পড়ন। আমাদের বীরত্ব ও ধৈর্য দেখে ইনশাআল্লাহ আপনার চক্ষু ঠাণ্ডা হবে।”এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সঃ) খুশী হয়ে যান এবং আনসারদের এই কথা তার কাছে খুবই ভাল মনে হয় (আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন)। এক রিওয়ায়াতে আছে যে, বদরের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুসলমানদের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করেন। হযরত উমার (রাঃ) কিছু বক্তব্য পেশ করেন। তার পর আনসারগণ বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি আমাদের নিকট থেকে কিছু শুনতে চান তবে শুনুন! আমরা বানী ইসরাঈলদের মত নই যে, বলবো- আপনি এবং আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানে বসে থাকছি। বরং আমাদের উত্তর হচ্ছে- আপনি আল্লাহর সাহায্য নিয়ে জিহাদের জন্যে চলুন। আমরা আমাদের জান ও মালসহ আপনার সাথে রয়েছি।” হযরত মিকদাদ আনসারীও (রাঃ) দাঁড়িয়ে গিয়ে এ কথাই বলেছিলেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর এই কথায় খুবই খুশী হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যুদ্ধের সময় আপনি দেখে নেবেন যে, আপনার সামনে, পিছনে, ডানে ও বামে আমরাই রয়েছি।” (হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন) “যদি আমি এমন সুযোগ পেতাম যাতে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে এ রকম সন্তুষ্ট করতে পারতাম (তবে কতই না ভাল হতো)।”একটি বর্ণনায় হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর এই উক্তিটি হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে বর্ণিত আছে, যখন মুশরিকরা তাঁকে উমরার জন্যে বায়তুল্লাহর দিকে যাওয়ার পথে বাধা প্রদান করেছিল এবং কুরবানীর জন্তুও যবেহ স্থলে পৌছতে পারেনি। সেই সময় তিনি বলেছিলেনঃ “আমি তো আমার কুরবানীর জন্তু নিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফে পৌছে কুরবানী করতে চাই।” তখন হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাঃ) বলেনঃ আমরা হযরত মূসা (আঃ)-এর আসহাবের মত নই। এটা ওদের জন্যেই সম্ভব হয়েছে যে, ওরা ওদের নবীকে বলেছিল- “আপনি এবং আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানে বসে রয়েছি।” বরং আমরা বলি- হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি চলুন, আপনার প্রতি আল্লাহর সাহায্য থাকবে এবং আমরা সবাই আপনার সাথে রয়েছি। এ কথা শুনে অন্যান্য সাহাবীগণও তাঁর কাছে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার ওয়াদা করতে শুরু করলেন। সুতরাং এই বর্ণনায় যদি হুদায়বিয়ার কথাই উল্লেখ থাকে তবে হতে পারে যে, তিনি (মিকদাদ) বদরের দিনও এ কথা বলেছিলেন এবং হুদায়বিয়ার দিনও এটা বলেছিলেন। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এ কথা শুনে হযরত মূসা (আঃ)-এর তার উম্মতের উপর ভীষণ রাগ হয়। এবং তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতঃ, আল্লাহ তা'আলার নিকট প্রার্থনা জানান। “হে রাব্বল আলামীন! আমার অধিকার তো শুধু নিজের উপর এবং ভাই-এর উপর রয়েছে। সুতরাং আপনি আমাদের উভয়ের এবং এ অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসা করে দিন। মহান আল্লাহ তাঁর এ প্রার্থনা কবুল করলেন এবং বললেনঃ এরা চল্লিশ বছর পর্যন্ত এখান থেকে যেতে পারবে না। তারা তীহ’ ময়দানে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কোনক্রমেই তারা এর সীমানার বাইরে যেতে পারবে না। এখানে তারা কতগুলো বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক বিষয়। অবলোকন করলো। যেমন তাদের উপর মেঘ দ্বারা ছায়া দান করণ, মান ও ‘সালওয়া' অবতরণ, তাদের কাছে বিদ্যমান একটি পাথর হতে পানি বের হওয়া ইত্যাদি। হযরত মূসা (আঃ) ঐ পাথরকে লাঠি দ্বারা আঘাত করা মাত্রই ওর মধ্য হতে বারোটি প্রস্রবণ বেরিয়ে পড়লো। প্রত্যেক গোত্রের দিকে একটি করে ঝরণা বয়ে যেতে লাগলো। এ ছাড়াও বানী ইসরাঈল তথায় আরও মুজিযা দেখলো। এখানে তাওরাত অবতীর্ণ হলো, আল্লাহর আহকাম নাযিল হলো ইত্যাদি। চল্লিশ বছর পর্যন্ত তারা উদ্বিগ্নভাবে ঐ ময়দানেই ঘুরাফেরা করলো এবং সেখান থেকে বের হবার কোন পথ পেলো না। হ্যাঁ, তবে তাদের উপর মেঘ দ্বারা ছায়া করা হয়েছিল এবং মান’ ও ‘সালওয়া তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। ফুনুনের লম্বা চওড়া হাদীসে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এসব বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর হযরত হারূনের মৃত্যু হয় এবং তার মৃত্যুর তিন বছর পর কালীমুল্লাহ হযরত মূসা (আঃ) ইন্তেকাল করেন। তারপর তাঁর খলীফা হযরত ইউশা ইবনে নূন (আঃ)-কে নবী করা হয়। এ সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে বহু বানী ইসরাঈলের মৃত্যু ঘটে। এমনকি বলা হয় যে, শুধুমাত্র হযরত ইউশা (আঃ) ও কালিব (আঃ) অবশিষ্ট থাকেন।
কোন কোন মুফাসসির ‘সানাতান' শব্দের উপর পূর্ণভাবে وَقْف করেন এবং আরবায়ীনা সানাতান শব্দ দুটিকে نَصَب -এর অবস্থা মেনে থাকেন এবং বলেন যে, এর عَامِل হচ্ছে ইয়াতীহুনা ফিল আরযে শব্দগুলো। এ চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যে কয়জন বানী ইসরাঈল অবশিষ্ট ছিল তাদেরকে নিয়ে হযরত ইউশা (আঃ) বেরিয়ে পড়েন। অন্যান্য পাহাড় থেকেও বাকী বানী ইসরাঈল তাঁর সাথী হয়ে যায়। হযতর ইউশা (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন। জুমআর দিন আসরের পরে যখন বিজয়ের সময় উপস্থিত হয় তখন শক্রদের পাগুলো অচল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত যাওয়ার উপক্রম হয়। জুমআর দিনের মর্যাদার কারণে সে যুগে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে সেই দিন আর যুদ্ধ করা চলতো না। এ জন্যে আল্লাহর নবী (হযরত ইউশা) বললেনঃ “হে সূর্য! তুমিও তো আল্লাহরই দাস। আর আমি তারই অধীনস্থ বান্দা। হে আল্লাহ একে আরও কিছুক্ষণ আটকিয়ে রাখুন। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশক্রমে সূর্য থেমে গেল এবং তিনি মনমত যুদ্ধ করে বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করে নিলেন। আল্লাহ পাকের নির্দেশ হলোঃ বানী ইসরাঈলকে বলে দাও যে, তারা যেন সিজদা করা অবস্থায় এ শহরের দরজায় প্রবেশ করে এবং حِطَّةٌ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের পাপ মার্জনা করুন!) বলে। কিন্তু তারা আল্লাহর এ হুকুমকে বদলিয়ে দিলো এবং হামাগুড়ি দিয়ে চললো, আর মুখে حَبَّةٌ فِىْ شَعْرَةٍ এ শব্দগুলো উচ্চারণ করতে থাকলো। বিস্তারিত ব্যাখ্যা সূরা বাকারায় করা হয়েছে। অপর এক বর্ণনায় এটুকু বেশী রয়েছে যে, বানী ইসরাঈল এ যুদ্ধে এতো বেশী গনীমতের মাল লাভ করেছিল যা তারা ইতিপূর্বে কখনও দেখেনি। আল্লাহ তাআলার নির্দেশানুযায়ী ওগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্যে আগুনের পার্শ্বে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু ওগুলো আগুনে পুড়লো না। তখন হযরত ইউশা (আঃ) তাদেরকে বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ অবশ্যই এ মাল থেকে কিছু চুরি করেছে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেক গোত্রের নেতা যেন আমার নিকট এসে আমার হাতে হাত রাখে।” তাই করা হলো। একটি গোত্রের নেতার হাত নবীর হাতের সাথে লেগে গেলো। নবী (ইউশা আঃ) বললেনঃ এ খিয়ানতের জিনিস তোমার নিকট রয়েছে সুতরাং তুমি ওটা নিয়ে আসো।' সে সোনার তৈরী গরুর একটি মাথা নিয়ে আসলো যার চক্ষুগুলো ছিল ইয়াকুতের তৈরী এবং দাঁতগুলো ছিল মুক্তার তৈরী। অন্য মালের সাথে ওটিকেও যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হলো তখন সমস্তই আগুনে পুড়ে গেল। ইমাম ইবনে জারীরও (রাঃ) এ উক্তিটি পছন্দ করেছেন।
আরবাঈনা সানাতান-এর عَامِل হচ্ছে فَاِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ শব্দগুলো। বানী ইসরাঈলের এ দলটি চল্লিশ বছর পর্যন্ত ঐ তীহের ময়দানে উদ্বিগ্নভাবে ফিরতে থাকে। তারপর মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়ে এবং বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করে। পূর্ববর্তী ইয়াহূদী আলেমদের ইজমাই হচ্ছে এর দলীল যে, আউজ ইবনে আনাককে হযরত মূসাই (আঃ) হত্যা করেছিলেন। তাহলে যদি তার হত্যা আমালীকের এ যুদ্ধের পূর্বের ঘটনা হতো তবে বানী ইসরাঈলের আমলীকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করার কোনই কারণ থাকতো না। সুতরাং বুঝা গেল যে, এটা হচ্ছে ‘তীহ' হতে পরিত্রাণ পাওয়ার পরবর্তী ঘটনা।
ইয়াহুদী আলেমদের এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে যে, বালআম ইবনে বাউর আমালীক সম্প্রদায়ের প্রতাপশালীদেরকে সাহায্য করেছিল এবং সে হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর বদদু'আ করেছিল। এ ঘটনাটিও ঐ ময়দান থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ঘটেছিল। কেননা, এর পূর্বে তো প্রতাপশালীদের হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর কওম হতে ভয়ই ছিল না। ইবনে জারীর (রঃ)-এর এটাই দলীল। তিনি এ কথাও বলেন যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠি ছিল দশ হাত এবং তার দেহও ছিল দশ হাত। তিনি ভূমি হতে দশ হাত লাফিয়ে গিয়ে আউজ ইবনে আনাককে ঐ লাঠি দ্বারা মেরেছিলেন যা তার পায়ের গিটে লেগেছিল এবং তাতেই সে মারা গিয়েছিল। তার দেহ দ্বারা নীল নদের সাঁকো বানানো হয়েছিল যার উপর দিয়ে বহু বছর ধরে নীলবাসী যাতায়াত করতো। নাওফ বাককালী বলেন যে, তার সিংহাসনটি তিনশ গজের ছিল।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেনঃ তুমি তোমার কওম বানী ইসরাঈলের জন্যে কোন দুঃখ করো না। তারা ঐ জেলখানারই যোগ্য।
সুতরাং এ ঘটনায় ইয়াহূদীদেরকে ধমক দেয়া হয়েছে এবং এতে তাদের বিরুদ্ধাচরণের ও দুষ্টামির বর্ণনা রয়েছে যে, আল্লাহর এ শক্ররা বিপদের সময়ও তাঁর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকছে না। তারা রাসূলদের আনুগত্য স্বীকার করছে না ও আল্লাহর পথে জিহাদ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। যে সম্মানিত রাসূলের সঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ কথা বলেছিলেন তার বিদ্যমানতায় তার অঙ্গীকার ও আদেশের কোনই গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিন রাত তারা তাঁর মুজিযা দেখতে রয়েছে এবং ফেরাউনের বিধ্বস্তি স্বচক্ষে দেখেছে, অথচ অল্প দিনও অতিবাহিত হয়নি এবং স্বয়ং সম্মানিত নবী সঙ্গে রয়েছেন, তথাপি তারা ভীরুতা ও কাপুরুষতাই প্রদর্শন করছে। তারা আল্লাহর নবীর সাথে বে-আদবী করছে এবং স্পষ্টভাবে জবাব দিয়ে দিচ্ছে। তারা তো স্বচক্ষে দেখেছে যে, আল্লাহ তা'আলা ফিরাউনের ন্যায় সাজ-সরঞ্জামপূর্ণ বাদশাহকেও তার সাজ-সরঞ্জাম, লোক-লস্কর ও প্রজাসহ ডুবিয়ে মেরেছেন! তথাপি তারা সেই আল্লাহর উপর ভরসা করে ঐ গ্রামবাসীর দিকে ধাবিত হচ্ছে না এবং তাঁর হুকুম পালন করছে না। অথচ তারা তো ফিরাউনের দশ ভাগের একভাগও ছিল না। ফলে তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে তাদের কাপুরুষতা প্রকাশ পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তাদের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা আরও বৃদ্ধি পাবে তারা নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র বলে মনে করলেও তা ছিল প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে তারা বেরিয়ে পড়েছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রকার শাস্তিতে তারা পতিত হয়েছিল। তাদেরকে শূকর ও বানরে পরিণত করা হয়েছিল। এখানে তারা চিরস্থায়ী অভিশাপে পতিত হয়ে পারলৌকিক স্থায়ী শাস্তির শিকারে পরিণত হয়েছে। অতএব, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে যাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে সমস্ত কল্যাণের চাবিকাঠি।