১২-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এখানে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী কয়েকটি জাতির কথা তুলে ধরছেন যারা তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, ফলে তাদের ওপর শাস্তি নেমে এসেছিল। যেমন-
নূহ (রহঃ)-এর জাতির কাছে তাঁকে, সামুদ জাতির কাছে সালেহ (রহঃ)-কে, আ‘দ জাতির কাছে হূদ (রহঃ)-কে, লূত (রহঃ)-এর জাতির কাছে লূত (রহঃ)-কে, “আসহাবে আইকাহ” বা জঙ্গলের অধিবাসীদের কাছে শু‘আইব (রহঃ)-কে এবং তুব্বা সম্প্রদায়ের কাছে নাবী প্রেরণ করেছেন। তারা তাদের কাছে আগত নাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। আইকাহ বলা হয় জঙ্গলকে, এটা বলার কারণ হল, এ অবাধ্য জাতি প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকাহ’ বলে একটা গাছকে তারা পূজো করত।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত সূরা আ‘রাফের ৮৫-৯৩ ও হূদের ৮৪-৯৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
রাস্ জাতি বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায় তবে ইমাম ইবনু জারীর প্রাধান্য দিয়ে বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য “আসহাবুল উখদূদ”। এদের সম্পর্কে সূরা আল বুরূজ-এ আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা।
কুরআনে দুজায়গায় তুব্বার উল্লেখ রয়েছে- এখানে এবং সূরা দুখানে। কিন্তু উভয় জায়গায় কেবল নামই উল্লেখ করা হয়েছে- বিস্তারিত কোন ঘটনা বিবৃত হয়নি। তাই এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। মূলত তুব্বা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়, বরং এটা ইয়ামানের হিমইয়ারী সম্রাটের উপাধি বিশেষ। যেমন পারস্যের বাদশাকে কিসরা, রোমের বাদশাদেরকে কায়সার, মিশরের বাদশাদেরকে ফির‘আউন এবং হাবশা অর্থাৎ ইথিওপিয়ার রাজাদেরকে নাজ্জাসী বলা হত। তারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইয়ামানের পশ্চিমাংশকে রাজধানী বানিয়ে আরব, শাম, ইরাক আফ্রিকার কিছু অংশ শাসন করেছিল।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা তুব্বাকে গালি দিও না। কারণ তিনি মু’মিন ছিলেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২৪৩৩) এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, তুব্বা কোন ব্যক্তির নাম যিনি মু’মিন ছিলেন। মোটকথা তারা কালক্রমে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয়ে যায়, মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজা শুরু করে ফলে আল্লাহ তা‘আলা আযাব দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।
(فَحَقَّ وَعِيدِ) অর্থাৎ তারা নাবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে তাদের ওপর শাস্তি আপতিত হয়েছিল।
এর মাধ্যমে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা ও মক্কাবাসীসহ সারা পৃথিবীর কাফিরদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, যারাই ইতোপূর্বে নাবীদের অবাধ্য হয়েছে তারাই ধ্বংস হয়েছে তাই তোমরাও যদি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে এমন আচরণ কর তাহলে তোমাদের পরিণতি তাই হবে যা হয়েছিল তাদের।
(أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ)
অর্থাৎ প্রথমবার সৃষ্টি করা যখন আমার জন্য কোন ব্যাপার ছিল না, তখন দ্বিতীয়বার জীবিত করা তো প্রথমবারের তুলনায় আমার জন্য আরো সহজ। মহান আল্লাহ বলেন :
(وَهُوَ الَّذِيْ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُه۫ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ ط وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلٰي فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ج وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)
“তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনিই আবার তা পুনরাবৃত্তি করবেন এটা তার জন্য খুবই সহজ। আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই। আর তিনিই প্রতাপশালী মহাবিজ্ঞ।” (সূরা রূম ৩০ :২৭)
হাদীসে কুদ্সীতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন : আদম সন্তান আমাকে এই বলে কষ্ট দেয় যে, আমি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম না যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছি। অথচ প্রথমবার সৃষ্টি করা দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার চেয়ে বেশি সহজ নয়। (সহীহ বুখারী, সূরা আল ইখলাস-এর তাফসীর)
সুতরাং রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে পূর্বের জাতিরা যে শাস্তি ভোগ করেছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যেন আমাদের দ্বারা এমন আচরণ প্রকাশ না পায়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান ও কাফিরদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
২. পূর্ববর্তী নাবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী জাতিদের কয়েকটির বর্ণনা পেলাম।
৩. নাবীদের বর্জন করার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পরিণতি কী হয়েছিল তা জানলাম।
৪. পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।