আয-যারিয়াত আয়াত ২৩
فَوَرَبِّ السَّمَاۤءِ وَالْاَرْضِ اِنَّهٗ لَحَقٌّ مِّثْلَ مَآ اَنَّكُمْ تَنْطِقُوْنَ ࣖ ( الذاريات: ٢٣ )
Fawa Rabbis samaaa'i wal ardi innahoo lahaqqum misla maa annakum tantiqoon (aḏ-Ḏāriyāt ৫১:২৩)
English Sahih:
Then by the Lord of the heaven and earth, indeed, it is truth – just as [sure as] it is that you are speaking. (Adh-Dhariyat [51] : 23)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আকাশ ও যমীনের প্রতিপালকের শপথ! এ সব অবশ্যই সত্য, এমনই দৃঢ় সত্য যেমন তোমরা (যে কথাবার্তা) বলে থাক (সেই কথাবার্তা বলার ব্যাপারটা যেমন নিঃসন্দেহে সত্য)। (আয-যারিয়াত [৫১] : ২৩)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিপালকের শপথ! অবশ্যই তোমাদের কথা বলার মতই তা[১] সত্য।
[১] إِنَّهُ তে সর্বনাম (তা) থেকে বুঝানো সেই সমস্ত জিনিস ও নিদর্শনগুলো, যেগুলো উল্লিখিত হয়েছে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
অতএব আসমান ও যমীনের রবের শপথ ! নিশ্চয় তোমরা যে কথা বলে থাক তার মতই এটি সত্য [১]।
[১] অর্থাৎ তোমরা যেমন নিজেদের কথাবার্তা বলার মাধ্যমে কোন সন্দেহ কর না, কেয়ামতের আগমনও তেমনি সুস্পষ্ট ও সন্দেহমুক্ত, এতে সন্দেহ ও সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। দেখাশোনা, আস্বাদন করা, স্পর্শ করা ও ঘ্রাণ লওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত অনুভূত বিষয়সমূহের মধ্য থেকে এখানে বিশেষভাবে কথা বলাকে মনোনীত করার কারণ সম্ভবত এই যে, উপরোক্ত অনুভূত বিষয়সমূহের মধ্যে মাঝে মাঝে রোগ-ব্যাধি ইত্যাদির কারণে ধোঁকা হয়ে যায়। দেখা ও শোনার মধ্যে পার্থক্য হওয়া সুবিদিত। অসুস্থ অবস্থায় মাঝে মাঝে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে মিষ্ট বস্তুও তিক্ত লাগে, কিন্তু বাকশক্তিতে কখনও কোন ধোঁকা ও ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। [কুরতুবী;ইবন কাসীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
অতএব আসমান ও যমীনের রবের কসম, তোমরা যে কথা বলে থাক তার মতই এটি সত্য।
4 Muhiuddin Khan
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পালনকর্তার কসম, তোমাদের কথাবার্তার মতই এটা সত্য।
5 Zohurul Hoque
অতএব মহাকাশ ও পৃথিবীর প্রভুর শপথ -- নিঃসন্দেহ এ আলবৎ সত্য, যেমনটা তোমরা বস্তুত বাক্যালাপ কর।
6 Mufti Taqi Usmani
সুতরাং আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিপালকের শপথ! নিশ্চয়ই এটা সত্য, যেমন (সত্য) তোমাদের কথা বলাটা।
7 Mujibur Rahman
আকাশ ও পৃথিবীর রবের শপথ! অবশ্যই তোমাদের বাক স্ফুর্তির মতই এ সব সত্য।
8 Tafsir Fathul Mazid
২০-২৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মানুষ যেন প্রকৃত মা‘বূদ ও স্রষ্টাকে চিনতে পারে সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে অনেক নিদর্শন দিয়েছেন যা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
খুঁটিবিহীন বিশাল প্রশস্ত আকাশ, ধু-ধু মরুভূমিকে বৃষ্টির পানি দ্বারা সবুজ-শ্যামল ও ফসলের উপযোগী করে দেয়া ইত্যাদি সব কিছুর মাঝে নিদর্শন রয়েছে যে- আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র মা‘বূদ, তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। তাই আরবিতে বলা হয় :
وفي كل شئ له أية + تدل علي أنه واحد
অর্থাৎ প্রত্যেকটি জিনিসের মাঝে তাঁর নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি এক। (শরহুল আকীদাহ আত তাহাবীয়াহ পৃ. :২৫)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তোমাদের নিজেদের মাঝেও নিদর্শন রয়েছে তোমরা কি দেখো না? কী সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, প্রত্যেকটি অঙ্গ উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করে করেছেন। যেমন একটাই জিহ্বা যা বিভিন্ন স্বাদের জিনিস অনুধাবন করতে পারে ইত্যাদি।
(وَفِي السَّمَا۬ءِ رِزْقُكُمْ)
অর্থাৎ আকাশে তোমাদের জীবিকা তথা বৃষ্টি রয়েছে যা নাযিল হয়ে ফসল উৎপন্ন করে এবং তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছে অর্থাৎ জান্নাত। ইবনু আব্বাস (রহঃ)-সহ অনেকে এ তাফসীর করেছেন। (ইবনু কাসীর- অত্র আয়াতের তাফসীর)
(إِنَّه۫ لَحَقٌّ مِّثْلَ مَآ أَنَّكُمْ تَنْطِقُوْنَ)
‘অবশ্যই এ-কথা তোমাদের কথোপকথনের মতই সত্য’ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় স্বত্তার শপথ করে বলছেন, তিনি তোমাদেরকে যে ওয়াদা করেছেন তা সত্য। অতএব এ ব্যাপারে সে রকম সন্দেহ করো না যেমন তোমাদের পরস্পরের কোন কথার ব্যাপারে তোমরা সন্দেহ করে থাকো।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পৃথিবীতে মহান আল্লাহ এমন নিদর্শন রেখেছেন যা তাঁর একত্বের প্রমাণ বহন করে।
২. মানুষ চিন্তা করলে সহজেই আল্লাহাকে চিনতে পারবে এবং তাঁর মহত্বের কাছে নতি স্বীকার করবে।
৩. কিয়ামত নির্ধারিত সময়ে সংঘটিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
9 Fozlur Rahman
তাই আসমান ও জমিনের প্রভুর শপথ! এসব কথা তোমাদের কথাবার্তার মতই নিশ্চিত সত্য।
10 Mokhtasar Bangla
২৩. আসমান ও যমীনের প্রতিপালকের শপথ! অবশ্যই পুনরুত্থান সত্য; তাতে কোনরূপ সন্দেহ নেই। যেমন তোমাদের কথা বলার সময় কথা বলতে কোনরূপ সন্দেহ থাকে না।
11 Tafsir Ibn Kathir
১৫-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা আল্লাহভীরু লোকদের পরিণামের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের দিন তারা প্রস্রবণ বিশিষ্ট জান্নাতে অবস্থান করবে। তাদের অবস্থা হবে ঐ অসৎ লোকেদের অবস্থার বিপরীত যারা শাস্তি-সাজার মধ্যে, শংখল-জিঞ্জীরের মধ্যে এবং কঠিন মারপিটের মধ্যে থাকবে। এই মুমিনদের নিকট আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এসেছিল তা তারা যথাযথভাবে পালন করতো। আর এর পূর্বেও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতো। কিন্তু দুই কারণে এই তাফসীরের ব্যাপারে কিছু চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। প্রথম কারণ এই যে, এ তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) করেছেন এ কথা বলা হয়। কিন্তু সহীহ সনদে এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পর্যন্ত পৌঁছে না। ওর এ সনদটি সম্পূর্ণরূপে দুর্বল। দ্বিতীয় কারণ এই যে, اٰخِذِيْنَ পূর্বের বাক্য হতে حَال হয়েছে। সুতরাং ভাবার্থ হবেঃ আল্লাহভীরু লোকেরা জান্নাতে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতরাশি লাভ করবে। ইতিপূর্বে অর্থাৎ দুনিয়ায় তারা ভাল কাজ করতো। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ
كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا هَنِیْٓـئًۢا بِمَاۤ اَسْلَفْتُمْ فِی الْاَیَّامِ الْخَالِیَةِ
অর্থাৎ “ (তাদেরকে বলা হবেঃ) তোমরা পানাহার কর তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (৬৯:২৪)।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন যে, তারা রাত্রির সামান্য অংশই অতিবাহিত করতে নিদ্রায়। কোন কোন মুফাসসির বলেন যে, এখানে مَا শব্দটি نَافِيَة বা নেতিবাচক। তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজনের উক্তি হিসেবে অর্থ হবেঃ তাদের উপর এমন কোন রাত্রি অতিবাহিত হতো না যার কিছু অংশ তারা আল্লাহর স্মরণে না কাটাতেন। হয় রাত্রির প্রথমাংশে কিছু নফল পড়তেন, না হয় রাত্রির মধ্যভাগে পড়তেন। অর্থাৎ প্রত্যেক রাত্রের কোন না কোন সময় কিছু না কিছু নামায অবশ্যই পড়তেন। সারা রাত তারা শুয়ে কাটিয়ে দিতেন না।
হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, এ লোকগুলো মাগরিব ও ইশার নামাযের মাঝে কিছু নফল নামায পড়তেন। হযরত ইমাম আবু জাফর বাকির (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তারা ইশার নামাযের পূর্বে ঘুমাতেন না।
কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে, এখানে مَا শব্দটি مَوْصُوْلَهহয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের দ্রিা রাত্রে খুব কম হতো। কিছু সময় ঘুমাতেন এবং কিছু সময় জেগে থাকতেন। আর যখন ইবাদতে মনোযোগ দিতেন তখন সকাল হয়ে যেতো।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো। হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস (রঃ) এই আয়াতের এই ভাবার্থ বর্ণনা করার পর বলতেনঃ “বড়ই দুঃখজনক ব্যাপার যে, আমার মধ্যে এটা নেই।” তার ছাত্র খাজা হাসান বসরী (রঃ)-এর উক্তি রয়েছে যে, তিনি প্রায়ই বলতেনঃ “আমি যখন আমার আমল জান্নাতীদের আমলের সামনে রাখি তখন আমার আমলকে তাদের আমলের তুলনায় অতি নগণ্য দেখি। পক্ষান্তরে, যখন আমি আমার আমল জাহান্নামীদের আমলের সামনে রাখি তখন দেখি যে, তারা তো কল্যাণ হতে সম্পূর্ণরূপে দূরে ছিল। তারা ছিল আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকারকারী এবং মৃত্যুর পর পুনর্জীবনকে অবিশ্বাসকারী। সুতরাং আমার অবস্থা ঐ লোকেদের মত যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ خَلَطُوْا عَمَلًا صَالِحًا وَّ اٰخَرَ سَیِّئًا অর্থাৎ “তারা ভাল ও মন্দ আমল মিশ্রিত করেছে।” (৯:১০২)
বানু তামীম গোত্রের একটি লোক হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ)-কে বললোঃ “হে আবু সালমা (রঃ)! এই গুণ তো আমাদের মধ্যে নেই যে, আমরা রাত্রে খুব কম ঘুমাই? আমরা তো খুব কম সময় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে থাকি।” তখন তিনি বললেনঃ “ঐ ব্যক্তিও বড় ভাগ্যবান যে ঘুম আসলে শুয়ে পড়ে এবং যখন জেগে ওঠে তখন আল্লাহকে ভয় করতে থাকে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেন, প্রথম যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় আগমন করেন তখন জনগণ তাঁকে দেখার জন্যে ভীড় জমায়। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আল্লাহর কসম। তার চেহারা মুবারকে আমার দৃষ্টি পড়া মাত্রই আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এই জ্যোতির্ময় চেহারা কোন মিথ্যাবাদী লোকের হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সর্বপ্রথম যে কথা আমার কানে পৌঁছেছিল তা ছিলঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমরা (দরিদ্রদেরকে) খাদ্য খাওয়াতে থাকো, আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখো, (মানুষকে) সালাম দিতে থাকো এবং রাত্রে নামায আদায় করো যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে এমন কক্ষ রয়েছে যার ভিতরের অংশ বাহির হতে এবং বাহিরের অংশ ভিতর হতে দেখা যায়।” একথা শুনে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কাদের জন্যে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাদের জন্যে, যারা নরম কথা বলে, (দরিদ্রদেরকে) খানা খেতে দেয় এবং রাত্রে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত যুহরী (রঃ) এবং হাসান (রঃ) বলেনঃ “এই আয়াতের ভাবার্থ এই যে, তারা রাত্রির অধিকাংশ তাহাজ্জুদে কাটিয়ে দেয়।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ “তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে।” হযরত যহহাক (রঃ) كَانُوْ قَلِيْلًا কে এর পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে মিলিয়ে দেন এবং مِنَ الَّيْلِ হতে শুরু বলে থাকেন। কিন্তু এই উক্তিতে বড় কৃত্রিমতা রয়েছে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতো।' মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ ‘তারা নামায পড়ে। অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলেন, এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘তারা রাত্রে (ইবাদতে) দাঁড়িয়ে থাকে এবং সকাল হলে তারা নিজেদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ وَ الْمُسْتَغْفِرِیْنَ بِالْاَسْحَارِ অর্থাৎ “সকালে তারা ক্ষমা প্রার্থনাকারী।” (৩:১৭) এই ক্ষমা প্রার্থনা যদি নামাযেই হয় তবে তো খুবই ভাল।
সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহে সাহাবীদের একটি জামাআতের কয়েকটি রিওয়াইয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন শেষ তৃতীয়াংশ রাত্রি অবশিষ্ট থাকে তখন প্রতি রাত্রে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেনঃ “কোন তাওবাকারী আছে কি? আমি তার তাওবা কবুল করবে। কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে। ক্ষমা করে দিবো। কোন যাজ্ঞাকারী আছে কি? আমি তাকে প্রদান করবে।” ফজর হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা এরূপই বলতে থাকেন।”
আল্লাহ তাআলা যে হযরত ইয়াকূব (আঃ) সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাঁর পুত্রদেরকে বলেছিলেনঃ سَوْفَ اَسْتَغْفِرُ لَكُمْ رَبِّىْ অর্থাৎ “আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।” এ ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসীরকার বলেন যে, তাঁর এই ক্ষমা প্রার্থনা রাত্রির শেষ প্রহরেই ছিল।
এরপর আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের আর একটি গুণের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাঁরা যেমন নামায পড়ে আল্লাহর হক আদায় করেন, অনুরূপভাবে মানুষের হকের কথাও তারা ভুলে যান না। তাঁরা যাকাত আদায় করে থাকেন। তারা জনগণের সঙ্গে সদাচরণ করেন, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখেন। তাদের ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। যেমন হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ভিক্ষুকের হক রয়েছে যদিও সে ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতে আসে। (এ হাদীস ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এর মতে মাহরূম বা বঞ্চিত হলো ঐ ব্যক্তি যার ইসলামে কোন অংশ নেই অর্থাৎ বায়তুল মালে কোন অংশ নেই, কোন কাজ-কামও হাতে নেই এবং কোন শিল্প ও কলা-কৌশলও তার জানা নেই যার দ্বারা সে জীবিকা উপার্জন করতে পারে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন যে, মাহরাম দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা কাজ-কাম কিছু জানে বটে, কিন্তু তা দ্বারা যা সে উপার্জন করে তা তাদের জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট হয় না। যহহাক (রঃ) বলেন যে, মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যে পূর্বে ধনী ছিল; কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন ইয়ামামায় যখন জলোচ্ছাস হলো এবং এক ব্যক্তির সমস্ত মাল-ধন ও আসবাব পত্র পানিতে ভেসে গেল তখন একজন সাহাবী (রাঃ) বললেনঃ “এ লোকটি মাহরূম বা বঞ্চিত। অন্যান্য বুযুর্গ মুফাসসিরগণ বলেন যে, মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যে অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে না।
একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তি মিসকীন নয় যে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং যাকে তুমি দু' এক গ্রাস খাবার বা দু' একটি খেজুর প্রদান করে থাকো, বরং মিসকীন ঐ ব্যক্তি যে এই পরিমাণ উপার্জন করে যা তার জন্যে যথেষ্ট নয় বা যা তার প্রয়োজন মিটায় না এবং তার এমন অবস্থা প্রকাশ পায় না যে, মানুষ তার অভাবের কথা জানতে পেরে তাকে কিছু দান করে।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) মক্কা যাচ্ছিলেন। পথে একটি কুকুর এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি যবেহকৃত একটি বকরীর কাঁধ কেটে কুকুরটির সামনে নিক্ষেপ করেন এবং বলেনঃ “লোকেরা বলে যে, এটাও মাহরূম বা বঞ্চিত।” হযরত শাবী (রঃ) বলেনঃ “আমি ‘মাহরূম এর অর্থ জানতে অপারগ হয়ে গেছি।”
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ “মাহরূম হলো ঐ ব্যক্তি যার মাল নেই, তা যে কারণেই হোক না কেন। অর্থাৎ সে হয়তো মাল উপার্জন করতেই সক্ষম নয়, কিংবা হয়তো তার মাল ধ্বংস হয়ে গেছে কোন দুর্যোগের কারণে।”
হযরত হাসান ইবনে মুহাম্মাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাফিরদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করেন এবং তাঁরা গানীমাতও লাভ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এমন কতগুলো লোক আগমন করে যারা গানীমতের মাল বন্টনের সময় উপস্থিত ছিল না। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। এই ঘটনা দ্বারা তো বুঝা যায় যে, এই আয়াতটি মাদানী। কিন্তু আসলে তা নয়, বরং এটি মক্কী আয়াত।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্যে ধরিত্রীতে নিদর্শন রয়েছে। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহ তা'আলার ব্যাপক ক্ষমতার বহু নিদর্শন রয়েছে। এগুলো মহান সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও বিরাটত্ব প্রমাণ করে। গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, কিভাবে তিনি দুনিয়ায় জীব-জন্তু ও গাছ-পালা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিভাবে তিনি পর্বতরাজিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, মাঠ-ময়দানকে করেছেন বিস্তৃত এবং সমুদ্র ও নদ-নদীকে করে রেখেছেন প্রবাহিত। মানুষের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি তাদের বর্ণ, আকৃতি, ভাষা, কামনা-বাসনা, বিবেক-বুদ্ধি, শক্তি-সামর্থ্য বিভিন্ন প্রকারের করেছেন। তাদের অঙ্গ-ভঙ্গী তাদের পাপ পুণ্য এবং দৈহিক গঠনের কথা চিন্তা করলেও বিস্মিত হতে হয়। প্রত্যেক অঙ্গ কেমন উপযুক্ত জায়গায় রয়েছে। এ জন্যেই এরপরেই বলেছেনঃ “তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (নিদর্শন রয়েছে)। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি নিজের সৃষ্টির কথা চিন্তা করবে, নিজের গ্রন্থীগুলোর বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে সে অবশ্যই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে, তাকে আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্যেই ।
মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ “আকাশে রয়েছে তোমাদের জীবিকার উৎস অর্থাৎ বৃষ্টি এবং প্রতিশ্রুত সবকিছু অর্থাৎ জান্নাত।' হযরত ওয়াসিল আহদাব (রঃ) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেনঃ “আমার রিযক তো রয়েছে আসমানে, অথচ আমি তা অনুসন্ধান করছি যমীনে, এটা বড়ই দুঃখজনক ব্যাপারই বটে।” একথা বলে তিনি লোকালয় ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে চলে যান। তিনি তিন দিন পর্যন্ত তো কিছুই পেলেন না। কিন্তু তৃতীয় দিনে দেখেন যে, টাটকা খেজুরের একটি গুচ্ছ তার পার্শ্বে আছে। তাঁর ভাই, যিনি তাঁর চেয়েও বেশী বিশুদ্ধ ও খাটি অন্তকরণ বিশিষ্ট লোক ছিলেন, তার সাথেই বেরিয়ে এসেছিলেন এবং তারা দুই ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত জঙ্গলেই জীবন কাটিয়ে দেন।
অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা স্বয়ং নিজেরই শপথ করে বলেনঃ আমি তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছি অর্থাৎ কিয়ামত, পুনরুত্থান, শাস্তি ও পুরস্কার ইত্যাদি সবই সত্য। যেমন তোমাদের মুখ হতে বের হওয়া কথায় তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে না, অনুরূপভাবে এসব বিষয়েও তোমাদের সন্দেহ করা মোটেই উচিত নয়। হযরত মুআয (রাঃ) যখন কোন কথা বলতেন তখন তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে বলতেনঃ “নিশ্চয়ই এটা সত্য যেমন তুমি এখানে রয়েছে।”
হযরত হাসান বসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলা ঐ কওমগুলোকে ধ্বংস করুন যাদের জন্যে তাদের প্রতিপালক (আল্লাহ) শপথ করেছেন, অতঃপর তারা তা বিশ্বাস করেনি।” (এ হাদীসটি মুরসাল। কেননা, হযরত হাসান বসরী (রঃ) একজন তাবেয়ী। তিনি কোন সাহাবীর (রাঃ) নাম না নিয়ে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন)