১৫৪-১৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
ثُمَّ اٰتَیْنَا مُوْسَى الْكِتٰبَ এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে-হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আমার সম্পর্কে আবার বলে দাও, আমি মূসা (আঃ)-কে কিতাব দিয়েছিলাম। এটা قُلْ تَعَالَوْا -এই উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু এটা চিন্তা ভাবনার বিষয় বটে ثُمَّ শব্দটি এখানে শুধুমাত্র একটি خَبَر -এর পর আর একটি خَبَر –এর عَطْف বা সংযোগের জন্যে এসেছে। تَرْتِيْب বুঝাবার জন্যে নয়। ثُمَّ শব্দটি সাধারণতঃ تَرْتِيْب বুঝাবার জন্যেই এসে থাকে)
এখানে আল্লাহ তা'আলা যখন স্বীয় উক্তি وَاَنَّ هٰذَا صِرَاطِىْ مُسْتَقِيْمًا -এর মাধ্যমে কুরআন সম্পর্কে খবর দিলেন, তখন তিনি تَوْرَات -এর প্রশংসায় ثُمَّ দ্বারা عَطْف করে বললেনঃ এখন আমি তোমাকে এ সংবাদও দিচ্ছি যে, আমি মূসা (আঃ)-কেও কিতাব দিয়েছিলাম। অধিকাংশ স্থানে আল্লাহ পাক মিলিতভাবে কুরআন ও তাওরাতের বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ “এর পূর্বে মূসা (আঃ)-এর কিতাব ইমাম ও রহমত স্বরূপ ছিল, আর এই কিতাব (কুরআন) আরবী ভাষায় এর সত্যতা প্রতিপাদন করছে।” এই সূরার প্রথম দিকে তিনি বলেছেনঃ “হে নবী (সঃ) তুমি জিজ্ঞেস কর-যে কিতাব আমি মূসা (আঃ)-কে দিয়েছিলাম, যেটাকে আমি লোকদের জন্যে নূর ও হিদায়াত করে পেশ করেছিলাম সেটা কে অবতীর্ণ করেছিলেন ? যেটাকে তোমরা কাগজে লিখছো, যার মধ্য থেকে তোমরা কিছু গোপন করছে এবং কিছু ঠিক প্রকাশ করছো?”
এর পরেই তিনি বলেনঃ “এই কুরআনকে আমি কল্যাণময় রূপে পেশ করেছি।” এখন মুশরিকদের ব্যাপারে বলছেনঃ “যখন আমার পক্ষ থেকে সত্য অর্থাৎ কুরআন তাদের কাছে পেশ করা হলো তখন তারা বলতে লাগলো -যেরূপ কিতাব মূসা (আঃ)-কে দেয়া হয়েছিল সেরূপ কিতাব আমাদেরকে কেন দেয়া হয়নি?” তাই আল্লাহ তা'আলা এখন বলছেনঃ “মূসা (আঃ)-এর কিতাবের সাথে কি কুফরী করা হয়নি এবং এ কথা কি বলা হয়নি যে, এ দু’জন (মূসা আঃ ও হারূন আঃ) তো যাদুকর, আমরা তো তাদেরকে মানবো না?” এরপর মহান আল্লাহ জ্বিনদের সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন, তারা তাদের কওমকে বলেছিলঃ “হে আমাদের কওম! আমরা একটা কিতাব শুনেছি যা মূসা (আঃ)-এর পরে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তাওরাতের বিষয়বস্তুর সত্যতা প্রতিপাদন করছে; আর হকের পথ প্রদর্শন করছে।” অতঃপর কুরআন সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে- تَمَامًا عَلَى الَّذِیْۤ اَحْسَنَ وَ تَفْصِیْلًا অর্থাৎ “এতে সমস্ত কথা সুন্দর ও বিস্তারিতভাবে লিখিত আছে এবং শরীয়তের সব কিছুরই উল্লেখ আছে। যেমন তিনি বলেছেনঃ “তাওরাতে আমি সমস্ত কথা বর্ণনা করে দিয়েছিলাম।” অনুরূপভাবে কুরআনকে عَلَى الَّذِیْۤ اَحْسَنَ বলেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ وَ اِذِ ابْتَلٰۤى اِبْرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِكَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّؕ-قَالَ اِنِّیْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ اِمَامًا অর্থাৎ “যখন ইবরাহীম (আঃ)-কে তার প্রভু কতগুলো কথা দ্বারা পরীক্ষা করলেন তখন তিনি তা পূর্ণ করলেন, আল্লাহ বললেন-আমি তোমাকে লোকদের ইমাম নিযুক্তকারী।” (২:১২৪) আর এক জায়গায় বলেনঃ وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ اَئِمَّةً يَّهْدُوْنَ অর্থাৎ “আমি তাদের মধ্যে বহু ধর্মীয় নেতা করেছিলাম-যারা আমার নির্দেশক্রমে হিদায়াত করতো, যখন তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল, আর তারা আমার আয়াতসমূহকে বিশ্বাস করতো।”
ثُمَّ اٰتَيْنَا مُوْسَى الْكِتَابَ تَمَامًا عَلَى الذِّىْ اَحْسَنَ অর্থাৎ আমি মূসা (আঃ)কে এমন কিতাব দিয়েছিলাম যা দানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দান ছিল, যা দুনিয়াতেও উত্তম এবং পরকালেও কামিল বা পূর্ণ। ইবনে জারীর (রঃ) এর অন্তর্নিহিত ভাষা تَمَامًا عَلٰى اِحْسَانِهٖ বলেছেন। তিনি যেন اَلَّذِىْ -কে مَصْدَرِيَّة ধরেছেন। অর্থাৎ ঐ কিতাবটি কামিল বা পূর্ণ ছিল اَحْسَنَ বা উত্তম হওয়ার দিক দিয়ে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ خُضْتُمْ كَالَّذِىْ خَاضُوْا এখন এখানে اَلَّذِىْ خَاضُوْا এর خَوْضٌ হয়ে গেল। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এখানে اَلَّذِىْ শব্দটি اَلَّذِيْنَ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) تَمَامَا عَلَى الَّذِيْنَ اَحْسَنُوْا এরূপ কিরআত করতেন। মুজাহিদ (রঃ) اَحْسَنَ দ্বারা مُؤْمِنِيْنَ ও مُحْسِنِيْنَ উদ্দেশ্য গ্রহণ করতেন। বাগাভী (রঃ) مُحْسِنِيْنَ এবং اَنْبِيَاء উদ্দেশ্য নিতেন। অর্থাৎ আমি মুমিন ও মুহসিনদের উপর তাওরাতের ফযীলত প্রকাশ করে দিয়েছিলাম। যেমন তিনি বলেছেনঃ قَالَ يٰمُوْسٰى اِنِّىْ اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِسٰلٰتِىْ وَبِكَلَامِىْ অর্থাৎ “হে মূসা (আঃ)! আমি তোমাকে স্বীয় রিসালাত ও কালামের মাধ্যমে সমস্ত লোকের উপর মনোনীত করেছি।” (৭:১৪৪) আল্লাহ তা'আলার এ উক্তি দ্বারা এটা অবশ্যম্ভাবী হচ্ছে না যে, হযরত মূসার এই ফযীলত হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এবং হযরত ইবরাহীম খলীল (আঃ)-এর উপরও রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার (রঃ) اَحْسَنَ -কে زَبَرْ -এর পরিবর্তে فِيْش (পেশ) দিয়ে আহসানু পড়তেন এবং বলতেন যে, এটা اَلَّذِىْ هُوَ اَحْسَنُ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং نُوْن কে فِيْش (পেশ) দিয়ে পড়াই যুক্তিযুক্ত। আবার কেউ এ কথাও বলেন যে, আরবী ভাষা হিসেবে এটা একটা বিশুদ্ধ রূপ হলেও এভাবে فِيْش (পেশ) দিয়ে পড়া উচিত নয়। কেউ কেউ একথাও বলেছেন যে, এটা تَمَامًا عَلٰى اِحْسَانِ اللهِ اِلَيْهِ-এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইরশাদ হচ্ছে-এতে প্রত্যেকটি বস্তুর বিশদ বিবরণ রয়েছে। আর একটা হচ্ছে হিদায়াত ও রহমত । আশা যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া সম্বন্ধে পূর্ণ বিশ্বাস লাভ করবে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি তা হচ্ছে বরকতময় ও কল্যাণময়, সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ করে চল এবং আল্লাহকে ভয় কর। তাহলে তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। এতে কুরআনের অনুসরণ করার প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদেরকে স্বীয় কিতাবের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং এতে চিন্তা ও গবেষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেন।