১৬৪-১৬৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দেন যে, বল: আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাকে রব ও মা‘বূদ হিসেবে অন্বেষণ করব? অথচ তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও পরিচালনাকারী। এখানে যদিও রব বা প্রতিপালকের কথা বলা হয়েছে উদ্দেশ্য হল তাওহীদে উলুহিয়্যাহ। কেননা এ কথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুশরিকরা সব কিছুর মালিক, স্রষ্টা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে মানত। তারা স্বীকার করত আল্লাহ তা‘আলা আছেন, তিনি রিযিকদাতা, জীবন-মৃত্যুর মালিক। কিন্তু সমস্যা ছিল তাওহীদে উলুহিয়্যাতে। কিছু চাইলে সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার কাছে না চেয়ে মূর্তির কাছে চাইত। মানত মানলে মূর্তির নামে মানত। সুতরাং যিনি সব কিছুর মালিক, তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার। তাই আমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে মা‘বূদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না।
(وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرٰي)
‘কেউ অন্য কারো (পাপের) ভার বহন করবে না।’অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। এমনকি পিতা-মাতাও সন্তানের কোন পাপের বোঝা বহন করবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلٰي حِمْلِهَا لَا يُحْمَلْ مِنْهُ شَيْءٌ وَّلَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰي)
“যদি কোন বোঝা ভারাক্রান্ত ব্যক্তি কাউকে তার বোঝা বহন করতে ডাকে, তবে তা থেকে কিছুই বহন করা হবে না, যদিও সে তার নিকটাত্মীয় হয়।”(সূরা ফাতির ৩৫:১৮)
বরং সে বোঝা নিজের ঘাড়েই বহন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِه۪ ج وَمَنْ أَسَا۬ءَ فَعَلَيْهَا ط وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيْدِ )
“যে সৎ আমল করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ আমল করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক তাঁর বান্দাদের প্রতি কোন জুলুম করেন না।”(সূরা হা-মীম আস-সিজদাহ ৪১:৪৬)
তবে যদি দুনিয়াতে কোন ব্যক্তি এমন পাপ কাজের রীতি-নীতি চালু করে, যার অনুসরণ করে মানুষ পাপ কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের পাপের সমপরিমাণ বোঝা সে ব্যক্তিকেও বহন করতে হবে, যে ব্যক্তি সে রীতি-নীতি চালু করেছে।
(وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ مَّاذَآ أَنْزَلَ رَبُّكُمْ لا قَالُوْآ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ)
যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমাদের প্রতিপালক কী অবতীর্ণ করেছেন?’ তখন তারা বলে, ‘পূর্ববর্তীদের উপকথা!’ (সূরা নাহল ১৬:২৫)
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ دَعَا إِلَي هُدًي كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَي ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا
যে ব্যক্তি মানুষকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করবে, সে ব্যক্তি তেমন প্রতিদান পাবে যেমন প্রতিদান পাবে সে পথের অনুসারীরা; তবে তাদের প্রতিদান থেকে কোন কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে সে ব্যক্তি তেমন গুনাহগার হবে যেমন গুনাহগার হবে সে পথের অনুসারীরা। তবে তাদের গুনাহ থেকে কম করা হবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ৬৯৮০)
কিয়ামতের দিন সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا تُسْأَلُوْنَ عَمَّآ أَجْرَمْنَا وَلَا نُسْأَلُ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ قُلْ يَجْمَعُ بَيْنَنَا رَبُّنَا ثُمَّ يَفْتَحُ بَيْنَنَا بِالْحَقِّ ط وَهُوَ الْفَتَّاحُ الْعَلِيْمُ)
“বল, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে একত্রিত করবেন, অতঃপর তিনি আমাদের মধ্যে বিচার করবেন সঠিকভাবে, আর তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী, সর্বজ্ঞ। বল: আমরা যে অপরাধ করেছি সেজন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কর তার জন্য আমরাও জিজ্ঞাসিত হব না ” (সূরা সাবা ৩৪:২৫-২৬)
(خَلٰ۬ئِفَ الْأَرْضِ)
‘দুনিয়ার প্রতিনিধি’ খলিফা বা প্রতিনিধি এর দু’টি অর্থ: ১. শাসক, কর্তৃত্বশীল। যারা অন্যদের নেতৃত্ব দেয় ও পরিচালনা করে। ২. উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত। একজন চলে গেলে অন্যজনের আগমন করা। এখানে দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এক জাতি চলে যাবে আবার নতুন জাতি দুনিয়া আবাদ করবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عَسٰي رَبُّكُمْ أَنْ يُّهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُوْنَ)
‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্র“ ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে জমিনে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, অতঃপর তোমরা কী কর তা তিনি লক্ষ করবেন।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১২৯)
(وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ)
‘তোমাদের কতককে কতকের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।’অর্থাৎ জীবিকা, চরিত্র, সৌন্দর্য, দৃশ্য, দৈহিক গঠন, রং ইত্যাদিতে একজনকে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَّعِيْشَتَهُمْ فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا ط وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ)
“আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরের দ্বারা খেদমত লাভ করতে পারে এবং তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্রতিপালকের রহমত উৎকৃষ্টতর।”(সূরা যুখরুফ ৪৩:২)
(لِّيَبْلُوَكُمْ فِيْ مَآ اٰتٰكُمْ)
‘যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন সে সম্বন্ধে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষকে যা দিয়েছেন তার দ্বারা তাকে পরীক্ষা করেন। কে ধন-সম্পদ, সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে ও তাঁর দীনের ওপর অটল থাকে আর কে আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী করে ও দীন থেকে সরে যায়।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দুনিয়া হচ্ছে সুমিষ্ট, শ্যামল ও সবুজ। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে অন্যান্যদের পরে দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন। এখন তিনি দেখতে চান তোমরা কিরূপ আমল কর। অতএব দুনিয়া থেকে বেঁচে চল এবং মেয়েদের থেকেও বেঁচে চল। কেননা বানী ইসরাঈলগণ সর্বপ্রথম মহিলাদের ফেতনায় পড়েছিলেন। (সহীহ মুসলিম হা: ৭১২৪, তিরমিযী হাঃ ২১৯১, ইবনু মাযাহ হা: ৪০০০)
(إِنَّ رَبَّكَ سَرِيْعُ الْعِقَابِ)
‘তোমার প্রতিপালক তো শাস্তি প্রদানে তৎপর’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেমন শাস্তি দিতে তৎপর আবার তেমন তিনি দয়ালুও বটে।
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি যে কত কঠিন তা যদি মু’মিনরা জানত তাহলে কেউ জান্নাতের আশা করত না আর কাফিররা যদি জানত যে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে কী পরিমাণ রহমত রয়েছে তাহলে তারা কেউ জান্নাতের আশা ছাড়ত না। আল্লাহ তা‘আলা একশত রহমত সৃষ্টি করেছেন। তার এক ভাগ সৃষ্টির মাঝে দিয়েছেন যার দ্বারা পরস্পর পরস্পরকে দয়া করে থাকে। আর নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২৭৫৫, তিরমিযী হা: ৩৫৪২)
সুতরাং আশা ও ভয় উভয়ের সমন্বয়ে ঈমান আনয়ন ও ইবাদত করা। জান্নাতের আশায় আমল করতে হবে আর জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতামূলক কাজ-কর্ম বর্জন করতে হবে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যিনি সব কিছুর মালিক তিনিই একমাত্র সব ইবাদত পাবার যোগ্য।
২. মক্কার মুশরিকরাও আল্লাহ তা‘আলাকে সব কিছুর মালিক বলে জানত কিন্তু এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করত না।
৩. যে যা কর্ম করবে তার পাপের বোঝা তাকেই বহন করতে হবে। কোন নিকটাত্মীয়ও বহন করবে না।
৪. আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ, উত্তম অবয়ব ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন।