আল হাক্বক্বাহ আয়াত ১২
لِنَجْعَلَهَا لَكُمْ تَذْكِرَةً وَّتَعِيَهَآ اُذُنٌ وَّاعِيَةٌ ( الحاقة: ١٢ )
Linaj'alahaa lakum tazki ratanw-wa ta'iyahaa unzununw waa'iyah (al-Ḥāq̈q̈ah ৬৯:১২)
English Sahih:
That We might make it for you a reminder and [that] a conscious ear would be conscious of it. (Al-Haqqah [69] : 12)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যেন এ ঘটনাটিকে আমি তোমাদের জন্য শিক্ষাপ্রদ-স্মারক করে রাখি আর সংরক্ষণকারী কান তা সংরক্ষণ করে। (আল হাক্বক্বাহ [৬৯] : ১২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আমি এটা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্য[১] এবং যাতে স্মৃতিধর কর্ণ এটা স্মরণ রাখে। [২]
[১] অর্থাৎ, কাফেরদেরকে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া এবং মু'মিনদেরকে নৌকায় আরোহণ করিয়ে বাঁচিয়ে নেওয়ার কাজ হল তোমাদের জন্য নসীহত ও উপদেশস্বরূপ। তোমরা এ থেকে উপদেশ গ্রহণ কর এবং আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে দূরে থাক।
[২] অর্থাৎ, শ্রবণকারী তা শ্রবণ করে যেন স্মরণে রাখে এবং সেও যেন এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আমরা এটা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্য এবং এজন্যে যে, যাতে শ্রুতিধর কান এটা সংরক্ষণ করে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
একে তোমাদের নিমিত্তে উপদেশ বানানোর জন্য এবং সংরক্ষণকারী কান তা সংরক্ষণ করার জন্য।
4 Muhiuddin Khan
যাতে এ ঘটনা তোমাদের জন্যে স্মৃতির বিষয় এবং কান এটাকে উপদেশ গ্রহণের উপযোগী রূপে গ্রহণ করে।
5 Zohurul Hoque
যেন আমরা এটিকে তোমাদের জন্য বানাতে পারি স্মরণীয় বিষয়, এবং শ্রুতিধর কান যেন এটি মনে রাখতে পারে।
6 Mufti Taqi Usmani
এই ঘটনাকে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বানানোর জন্য এবং যাতে এটা (শুনে) সংরক্ষণ করে সংরক্ষণকারী কান।
7 Mujibur Rahman
আমি উহা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্য এবং এ জন্য যে, শ্রুতিধর কর্ণ ইহা সংরক্ষণ করে।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ :
الحاقة কিয়ামতের নামসমূহের অন্যতম একটি নাম। এই দিনে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ বাস্তবায়িত হবে, তাই এটাকে الحاقة বলা হয়। এ সূরার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরার শুরুর দিকে পূর্ববর্তী কয়েকটি অবাধ্য জাতির ধ্বংসের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তারপর কিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, অতঃপর ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ ও বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সীমাহীন আফসোসের কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং সর্বশেষে আল্লাহ তা‘আলা শপথ করে বলেছেন যে- এ কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা কবির কথা নয় বরং তা তাঁরই বাণী।
১-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আলোচ্য আয়াতগুলোতে কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং পূর্ববর্তী জাতি সামূদ, ‘আদ ও ফির‘আউনকে যে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করেছেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
الحاقة শব্দটি حق মূলধাতু থেকে গৃহীত, যার অর্থ : সত্য, অর্থাৎ কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে, এটা দিবালোকের ন্যায় সত্য। এখানে প্রশ্নাকারে তুলে ধরার উদ্দেশ্য, কিয়ামতের ভয়াবহতা বুঝোনো। সালেহ ও হূদ (আঃ)-এর জাতির নাম সামূদ ও ‘আদ। তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করত, ফলে তারা অপরাধমূলক কাজ করতে এবং নাবীদের অবাধ্য হওয়াকে পরওয়া করত না। যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা সামূদ জাতিকে এমন এক বিকট আওয়াজ দ্বারা ধ্বংস করলেন যা অন্তরকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। বিকট আওয়াজ শুনেই তারা মারা গিয়েছিল। হেজায ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী ‘আল-হিজর’ নামক স্থানে তাদের বসবাস ছিল। কুরআনে একাধিক জায়গায় তাদের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। তবে এখানে এ বিকট আওয়াজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘তাগিয়া’। এ শব্দ দ্বারা পূর্বের ও পরের আয়াতগুলোর সাথে ধ্বনি ও ছন্দগত মিল যেমন রক্ষা করা হয়েছে তেমনি এ সূরার প্রেক্ষাপট ও পরিবেশের সাথে এর সংযোগ রক্ষা করা হয়েছে।
আর ‘আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন প্রচণ্ড ঝড়ো হওয়া দ্বারা। ‘আদ জাতির আবাসভূমি ছিল দক্ষিণ আরব, ইয়ামান ও হাজরামাওতের মধ্যবর্তী আহকাফ নামক স্থানে। ‘আদ জাতি অত্যন্ত হিংস্র, লড়াকু ও শক্তিশালী ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাত দিন আট রাত ধরে প্রচণ্ড ঝড় দ্বারা শাস্তি দিলেন। صرصر অর্থ হল : অত্যধিক হিমশীতল প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৬৫-৭২ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
عاتية হল এমন কিছু যা দমন করা যায় না, এ ঝড়ো হাওয়া সাত রাত আট দিন প্রবাহিত হয়েছিল। حسوما অর্থ : ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : متتابعات বা ধারাবহিকভাবে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী রবী (রহঃ) বলেন : জুমার দিন শাস্তি শুরু হয়েছিল।
صرعي অর্থ : মৃতদেহ, اعجاز النخل অর্থ : খেজুরের কান্ড, ডাল। خاوية অর্থ : কালি, শূন্য। অর্থাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত তাদের দেহকে সারশূন্য খেজুর কাণ্ড বা ডালের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেমন আমাদের দেশে ধান মাড়াই করার পর আঁটি বা নাড়াকে গরুর পা দ্বারা পীষে মলা হয় তাদের অবস্থা তেমনই হয়েছিল।
অনুরূপভাবে ফির‘আউন, তার পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতি এবং উল্টে দেওয়া জাতি তথা লূত (রাঃ)-এর জাতিকে পাপকাজ করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করেছেন। লূত (রাঃ)-এর জাতিকে المؤتفكات বলার কারণ হল তাদেরকে জমিন উল্টিয়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেটা হচ্ছে, বর্তমান ইসরাঈল সীমান্তবর্তী এলাকায় সাগরের বেলাভূমিতে- যার নাম হল ‘ডেড সী বা মৃত সাগর’। এদের অপরাধ হচ্ছে-তারা সমকামীতায় লিপ্ত ছিল। তাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহ তা‘আলার নাবী লূত (আঃ) তাদেরকে এ জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকতে বললেন কিন্তু তারা মানল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوْطِ نِالْمُرْسَلِيْنَ إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوْهُمْ لُوْطٌ أَلَا تَتَّقُوْنَ إِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ أَمِيْنٌ فَاتَّقُوا اللهَ وَأَطِيْعُوْنِ وَمَآ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ ج إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلٰي رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ أَتَأْتُوْنَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعٰلَمِيْنَ وَتَذَرُوْنَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِّنْ أَزْوَاجِكُمْ ط بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ عٰدُوْنَ قَالُوْا لَئِنْ لَّمْ تَنْتَهِ يٰلُوْطُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِيْنَ قَالَ إِنِّيْ لِعَمَلِكُمْ مِّنَ الْقَالِيْنَ )
“লূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে অস্বীকার করেছিল, যখন তাদের ভ্রাতা লূত তাদেরকে বলল : ‘তোমরা কি সাবধান হবে না? ‘আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। ‘আমি তার জন্য তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে। ‘বিশ্বজগতের মধ্যে তো তোমরাই পুরুষের সাথে কুকর্ম কর, ‘এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে তোমরা বর্জন করে থাক। তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।’ তারা বলল : ‘হে লূত! তুমি যদি বিরত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে।’ লূত, বলল : ‘আমি তোমাদের এ কর্মকে ঘৃণা করি।” (সূরা শুআরা ২৬ : ১৬০-১৬৬)
প্রতœতাত্ত্বিক আবিস্কার ও খননকার্য থেকে এ সত্য বেরিয়ে এসেছে যে, এ শহর ইসরাইল ও জর্ডানের সীমান্তবর্তী এলাকায় মৃত সাগরের তীরে অবস্থিত। এ জায়গাটির নাম ওল্ড টেস্টামেন্টে সুডুম (ঝঙউঙগ) নামে উল্লেখ রয়েছে। প্রতœতত্ত্ববিদরা এখানে খুঁজে পেয়েছেন ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার অসংখ্য নমুনা। চূর্ণ-বিচূর্ণ কংকালই বলে দেয় সেখানকার ভয়াবহ দুর্যোগের কথা।
رابية শব্দটির অর্থ : অতিরিক্ত। অর্থাৎ পরিমাণের বেশি শাস্তি দ্বারা তাদেরকে পাকড়াও করেছিলাম।
لَمَّا طَغَا الْمَا۬ءُ
অর্থাৎ নূহ (আঃ) এর যুগে প্লাবন দ্বারা মুুমিনদের ব্যতীত অবাধ্যদেরকে ডুুবিয়ে মেরেছিলেন। মক্কার কাফিরদের সম্বোধন করে বলছেন যে, তারা ছিল তোমাদের পূর্ব পুরুষ, তারা ছিল মু’মিন আর তোমরা এখন কুফরী করছো। তোমরা এ থেকে উপদেশ গ্রহণ কর।
সুতরাং আমাদের উচিত হবে পূর্ববর্তী জাতিদের মত আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের অবাধ্য না হয়ে তাদের আদেশ মেনে চলা আর নিষেধ থেকে বিরত থাকা। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যদি কোন সমাজে খারাপ ও আল্লাহদ্রোহী কাজ হয় আর তা পরিবর্তন করার মত লোক থাকে কিন্তু তা পরিবর্তন না করে তাহলে মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করবেন। (আবূ দাঊদ হা. ৪৩৩৯, ইবনু মাযাহ হা. ৪০০৯, হাসান)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. ‘আদ, সামুদ, ফির‘আউন ও অন্যান্য পাপিষ্ঠ জাতির ধ্বংসের কারণ ও আযাবের ধরণ জানলাম।
২. তাদের থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।
9 Fozlur Rahman
যাতে সে ঘটনা তোমাদের জন্য একটি শিক্ষার বিষয় হয় এবং শ্রবণকারী কান তা শুনে রাখে।
10 Mokhtasar Bangla
১২. যাতে করে আমি কিশতী ও তার কাহিনীকে এমন উপদেশে পরিণত করি যা কাফিরদেরকে ধ্বংস ও ঈমনদারদেরকে রক্ষার নিদর্শন হিসাবে রয়ে যায় এবং সেটিকে শ্রবণকারী কান স্মরণ রাখে।
11 Tafsir Ibn Kathir
১-১২ নং আয়াতের তাফসীর
‘হাককাহ কিয়ামতের একটি নাম। আর এ নামের কারণ এই যে, জান্নাতে শান্তি দানের অঙ্গীকার এবং জাহান্নামে শাস্তি প্রদানের প্রতিজ্ঞার সত্যতা ও যথার্থতার দিন এটাই। এ জন্যেই এ দিনের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এই হাক্কাহর সঠিক অবস্থা অবগত নও।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ ঐ লোকদের বর্ণনা দিচ্ছেন যারা এই কিয়ামতকে অবিশ্বাস করার ফলে প্রতিফল প্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি বলেনঃ সামূদ সম্প্রদায়ের অবস্থা দেখো, একদিকে ফেরেশতাদের প্রলয়ংকারী শব্দ আসে, আর অপরদিকে ভয়াবহ ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়, ফলে সব নীচ-উপর হয়ে যায়। সুতরাং হযরত কাতাদা (রাঃ)-এর উক্তি অনুসারে طَاغِيَة শব্দের অর্থ হলো ভীষণ চীৎকার। আর হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা গুনাহ্ বা পাপ। উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তারা পাপের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। হযরত রাবী' ইবনে আনাস (রঃ) ও হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ)-এর উক্তি এই যে, এর দ্বারা তাদের ঔদ্ধত্যপনা উদ্দেশ্য। ইবনে যায়েদ (রঃ)-এর প্রমাণ হিসেবে কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতটি পেশ করেছেনঃ
كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ بِطَغْوٰىهَاۤ অর্থাৎ “সামূদ সম্প্রদায় অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্য বশতঃ অবিশ্বাস করেছিল।”(৯১:১১) অর্থাৎ উষ্ট্ৰীকে কেটে ফেলেছিল। আর আ’দ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচন্ড ঝঞাবায়ু দ্বারা। ঐ ঝঞা বায়ু কল্যাণ ও বরকত শূন্য ছিল এবং ফেরেশতাদের হস্ত দ্বারা বের করা হচ্ছিল। ওটা পর্যায়ক্রমে সাত রাত ও আট দিন ধরে প্রবাহিত হয়েছিল। এতে তাদের জন্যে অমঙ্গল ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যেমন আল্লাহ্ তা'আলার উক্তিঃ فِىْ اَيَّامٍ نَّحِسَاتٍ অর্থাৎ “অমঙ্গলজনক দিনগুলোতে।" হযরত রাবী (রঃ) বলেন যে, এই ঝঞা বায়ু শুক্রবার হতে বইতে শুরু করে। কারো কারো মতে বুধবার হতে শুরু হয়। আরবরা এই বায়ুকে اَعْجَاز এ জন্যেও বলে থাকে যে, কুরআন কারীমে বলা হয়েছেঃ আ'দ সম্প্রদায়ের অবস্থা সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায় হয়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ এটাও যে, সাধারণতঃ এই বায়ু শীতের শেষে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর عَجَز বলা হয় শেষকে। এ কারণও বর্ণনা করা হয়েছে যে, আ'দ সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধা মহিলা একটি গুহায় ঢুকে পড়ে এবং অষ্টম দিবসে এই ঝঞা বায়ু তাকে ধ্বংস করে দেয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
خَاوِيَة শব্দের অর্থ হলো খারাপ, সড়া ও ফাঁপা বা সারশূন্য। ভাবার্থ এই যে, এ ঝঞাবায়ু তাদেরকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে নীচে ফেলে দেয়। তাদের মস্তক ফেটে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর দেহের বাকী অংশ এরূপ হয়ে যায় যে, তা যেন সারশূন্য খর্জুর-খাণ্ড। সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাকে ‘সাবা' অর্থাৎ পূবালী বাতাস দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, আর আ’দ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে পশ্চিমা বাতাস দ্বারী।”
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আ'দ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্যে বায়ুর ভাণ্ডারের মধ্য হতে শুধুমাত্র আংটি পরিমাণ স্থান খুলে দেয়া হয়, যেখান দিয়ে বাতাস বের হতে থাকে। প্রথমে ঐ বায়ু গ্রাম ও পল্লীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং গ্রামবাসী ছোট, বড়, নারী, পুরুষ সবর্কে তাদের মালধন ও জীব-জন্তুসহ উঠিয়ে নিয়ে আসমান ও যমীনের মধ্যস্থলে লটকিয়ে দেয়। এগুলো খুবই উঁচুতে ছিল বলে শহরবাসীদের কাছে কালো রঙএর মেঘ বলে মনে হয়। তারা খুবই খুশী হয় এই মনে করে যে, অত্যাধিক গরমের কারণে তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে, সুতরাং এই মেঘ হতে পানি বর্ষিত হলে তারা শান্তি লাভ করবে। ইতিমধ্যে আল্লাহ্ পাকের হুকুমে বাতাস ঐগুলোকে শহরবাসীর উপর নিক্ষেপ করে এবং তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।” হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ঐ বাতাসের পালক এবং লেজ ছিল।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ এরপর বলেনঃ বলতো, এরপর তাদের কাউকেও তুমি বিদ্যমান দেখতে পাও কি? অর্থাৎ তাদের কেউই মুক্তি পায়নি, বরং সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ ফিরাউন, তার পূর্ববর্তীরা এবং লূত সম্প্রদায় পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তারা তাদের প্রতিপালকের রাসূলকে অমান্য করেছিল, ফলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দিলেন- কঠোর শাস্তি।
قَبْلَهٗ-এর দ্বিতীয় কিরআত قِبْلَهٗ ও রয়েছে অর্থাৎ قَاف-এর নীচে যের দিয়েও পড়া হয়েছে। তখন অর্থ হবেঃ ফিরাউন এবং তার পাশের ও তার যুগের তার অনুসারী কাফির কিবতী সবাই। مُوْتَفِكَات দ্বারা রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী পূর্ববর্তী উম্মতদেরকে বুঝানো হয়েছে।
خَاطِئَة-এর অর্থ হলো অবাধ্যতা ও অপরাধ। সুতরাং অর্থ হলোঃ তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যুগের রাসূলকে অবিশ্বাস করেছিল। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
كُلٌّ كَذَّبَ الرُّسُلَ فَحَقَّ وَعِیْدِ
অর্থাৎ “তারা সবাই রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করে, ফলে তাদের উপর শাস্তি এসে পড়ে।”(৫০:১৪) এটাও স্মরণ রাখার বিষয় যে, একজন নবীকে অস্বীকার করার অর্থ সমস্ত নবীকেই অস্বীকার করা। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوْحٍ اِلْمُرْسَلِیْنَ
অর্থাৎ “নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল।”(২৬:১০৫) كَذَّبَتْ عَادٌ اِلْمُرْسَلِیْنَ
অর্থাৎ “আ'দ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল।”(২৬:১২৩) كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ الْمُرْسَلِیْنَ
অর্থাৎ “সামূদ সম্প্রদায় রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল।”(২৬:১৪১) অথচ সকলের নিকট অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতের নিকট একজন রাসূলই এসেছিলেন।
এখানেও অর্থ এটাই যে, তারা তাদের প্রতিপালকের রাসূলকে অমান্য করেছিল। ফলে আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে কঠিনভাবে পাকড়াও করেছিলেন এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিয়েছিলেন।
এরপর মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ দেখো, যখন নূহ (আঃ)-এর দু'আর কারণে ভূ-পৃষ্ঠে তূফান আসলো ও পানি সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে চতুর্দিক প্লাবিত করলো এবং আশ্রয় লাভের কোন স্থান থাকলো না তখন আমি নূহ (আঃ) ও তার অনুসারীদেরকে নৌযানে আরোহণ করালাম।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যখন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় তাকে অবিশ্বাস করলো, বিরোধিতা শুরু করলো এবং উৎপীড়ন করতে লাগলো তখন অতিষ্ঠ হয়ে তাদের ধ্বংসের জন্যে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রার্থনা কবূল করলেন এবং ভয়াবহ তুফান নাযিল করলেন। হযরত নূহ (আঃ) এবং যারা তাঁর নৌযানে আরোহণ করেছিল তারা ছাড়া ভূপৃষ্ঠের একটি লোকও বাঁচেনি, সবাই পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। সুতরাং এখনকার সমস্ত মানুষ হযরত নূহ (আঃ)-এর বংশধর এবং তাঁর সন্তানদেরই অন্তর্ভুক্ত।
হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, পানির এক একটি ফোঁটা আল্লাহ্ তা'আলার অনুমতিক্রমে পানির রক্ষক ফেরেশতার মাপের মাধ্যমে বর্ষিত হয়। অনুরূপভাবে বাতাসের একটা হালকা প্রবাহও বিনা মাপে প্রবাহিত হয় না। কিন্তু আ’দ সম্প্রদায়ের উপর দিয়ে যে বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল এবং হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমের উপর যে পানি বর্ষিত ও উথিত হয়েছিল তা বিনা মাপেই ছিল। আল্লাহ্ নির্দেশক্রমে পানি ও বাতাস এতো জোরে চলেছিল যে, রক্ষক ফেরেশতাদের তা আওতার বাইরে ছিল। এ জন্যই আল্লাহ তা'আলা নিজের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে বলেনঃ
اِنَّا لَمَّا طَغَا الْمَآءُ حَمَلْنٰكُمْ فِی الْجَارِیَةِ ـ لِنَجْعَلَهَا لَكُمْ تَذْكِرَةً وَّ تَعِیَهَاۤ اُذُنٌ وَّاعِیَةٌ
অর্থাৎ যখন জলোচ্ছাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে অর্থাৎ (পূর্ব পুরুষদেরকে) আরোহণ করিয়েছিলাম নৌযানে। যাতে এ নৌযান তোমাদের জন্যে একটা নমুনারূপে থেকে যায় এবং শ্রুতিধর কর্ণ এটা সংরক্ষণ করে। আজও তোমরা ঐ রকমই নৌযানে আরোহণ করে সমুদ্রের লম্বা-চওড়া সফর করে থাকো। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَ جَعَلَ لَكُمْ مِّنَ الْفُلْكِ وَ الْاَنْعَامِ مَا تَرْكَبُوْنَ ـ لِتَسْتَوٗا عَلٰى ظُهُوْرِهٖ ثُمَّ تَذْكُرُوْا نِعْمَةَ رَبِّكُمْ اِذَا اسْتَوَیْتُمْ عَلَیْهِ
অর্থাৎ “আমি তোমাদের আরোহণের জন্যে নৌকা ও চতুষ্পদ জন্তু বানিয়েছি, যাতে তোমরা ওগুলোর উপর আরোহণ করে তোমাদের প্রতিপালকের নিয়ামত স্মরণ করতে পারো।” (৪৩:১২-১৩) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَ اٰیَةٌ لَّهُمْ اَنَّا حَمَلْنَا ذُرِّیَّتَهُمْ فِی الْفُلْكِ الْمَشْحُوْنِ ـ وَ خَلَقْنَا لَهُمْ مِّنْ مِّثْلِهٖ مَا یَرْكَبُوْنَ
অর্থাৎ “তাদের জন্যে এক নিদর্শন এই যে, আমি তাদের বংশধরদেরকে বোঝাই নৌযানে আরোহণ করিয়েছিলাম এবং তাদের জন্যে অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি যাতে তারা আরোহণ করে।” (৩৬:৪১-৪২)
হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) উপরের এ আয়াতের এ ভাবার্থও বর্ণনা করেছেন যে, হযরত নূহ (আঃ)-এর ঐ নৌযানটিই বাকী ছিল, যেটাকে এই উম্মতের পূর্ববর্তী লোকেরাও দেখেছিল। কিন্তু সঠিক ভাবার্থ প্রথমটিই বটে।
মহান আল্লাহ বলেন যে, আমি এটা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্যে এবং এই জন্যে যে, শ্রুতিধর কর্ণ এটা সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ তারা যেন এই নিয়ামতকে ভুলে না যায়। অর্থাৎ যাদের সঠিক বোধ ও স্থির জ্ঞান রয়েছে, যারা আল্লাহর কথা ও তাঁর নিয়ামতের প্রতি বেপরোয়া ভাব প্রকাশ করে না, তাদের উপদেশ ও শিক্ষার এটাও একটা মাধ্যম হয়ে গেল।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে বর্ণিত আছে যে, হযরত মাকহুল (রঃ) বলেনঃ যখন এ শব্দগুলো অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করেছি যে, তিনি যেন হযরত আলী (রাঃ)-কে এরূপও করে দেন।” হযরত আলী (রাঃ) বলতেনঃ “এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে কিছু শ্রবণ করার পর আমি তা ভুলিনি।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা মুরসাল)
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হ্যরত বুরাইদাহ্ আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেনঃ “আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন তোমাকে নিকটে রাখি, দূরে না রাখি, তোমাকে শিক্ষাদান করি ও তুমি তা মুখস্থ রাখে এবং মুখস্থ রাখা তোমার জন্যে উচিতও বটে।” তখন وَتَعِيَهَا اُذُنٌ وَّاعِيَةٌ (শ্রুতিধর কর্ণ এটা সংরক্ষণ করে) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (এ রিওয়াইয়াটি অন্য সনদেও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটাও সঠক নয়)