আত-তাকভীর আয়াত ১৪
عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّآ اَحْضَرَتْۗ ( التكوير: ١٤ )
'Alimat nafsum maaa ahdarat (at-Takwīr ৮১:১৪)
English Sahih:
A soul will [then] know what it has brought [with it]. (At-Takwir [81] : 14)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তখন প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারবে সে কী (সঙ্গে) নিয়ে এসেছে। (আত-তাকভীর [৮১] : ১৪)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে, সে কি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।[১]
[১] এটা হল জওয়াবী বাক্য। অর্থাৎ, যখন উল্লিখিত বিষয়সমূহ প্রকাশ পাবে। তার মধ্যে ছয়টি বিষয় দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এবং অন্য ছয়টি আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত। তখন প্রত্যেকের সামনে তার প্রকৃতত্ব এসে যাবে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তখন প্ৰত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি উপস্থিত করেছে [১]।
[১] অর্থাৎ কেয়ামতের উপরোক্ত পরিস্থিতিতে প্রত্যেকই জেনে নিবে সে কি নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ সৎকর্ম কিংবা অসৎকর্ম সব তার দৃষ্টির সামনে এসে যাবে। [মুয়াসিসার]
3 Tafsir Bayaan Foundation
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতে পারবে সে কী উপস্থিত করেছে!
4 Muhiuddin Khan
তখন প্রত্যেকেই জেনে নিবে সে কি উপস্থিত করেছে।
5 Zohurul Hoque
সত্ত্বা জানতে পারবে কী সে হাজির করেছে।
6 Mufti Taqi Usmani
তখন প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারবে সে (ভালো-মন্দ) যা কিছু হাজির করেছে।
7 Mujibur Rahman
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি নিয়ে এসেছে।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ ও প্রেক্ষাপট:
প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ كورت এর মূল উৎস تكوير (তাকভীর)। যার অর্থ : গোলাকার করা, গুটিয়ে নেয়া ইত্যাদি। তাই আরবীতে কাপড় ইস্ত্রী করাকে كوي বলা হয়। কারণ ইস্ত্রী করার মাধ্যমে কাপড় ভাঁজ করে নেয়া হয়। كورت শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরাতে বিশেষ করে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব মূহূর্তে চন্দ্র-সূর্য, তারকা, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির যে একটি ভয়াবহ অবস্থা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, কিয়ামতের দৃশ্যকে স্বচক্ষে দেখবে সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পাঠ করে। (তিরমিযী হা. ৩৩৩৩, সিলসিলা সহীহাহ হা. ১০৮১)
বিশিষ্ট সাহাবী উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলেন : (১) মানুষ হাট-বাজারে মশগুল থাকবে, (২) নক্ষত্রসমূহ খসে পড়বে, (৩) পাহাড়সমূহ মাটির ওপর ভেঙ্গে পড়বে ও সারা পৃথিবী কম্পিত ও আন্দোলিত হবে, (৪) এ সময় জিন-ইনসান সব ভয়ে ছুটোছুটি করবে, (৫) পশু-পক্ষি সব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে, (৬) সমুদ্র সব অগ্নিময় হয়ে একাকার হয়ে যাবে। এরপর একটি বায়ূ প্রবাহিত হবে, যা সকল মানুষকে মেরে ফেলবে। (ইবনু কাসীর, কুরতুবী)
১-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : كورت অর্থ أظلمت বা অন্ধকার হয়ে যাবে। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : তার আলো চলে যাবে। যায়েদ বিন আসলাম (রহঃ) বলেন : সূর্য জমিনের ওপর পড়ে যাবে। আল্লামা ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন : এ ব্যাপারে আমাদের নিকট সঠিক কথা হলো : تكوير অর্থ : একটি জিনিসের এক অংশ অন্য অংশের সাথে ভাঁজ করা। তাই মাথায় লেপটিয়ে পাগড়ী ভাঁজ করে নেয়াকে تكوير বলা হয়। অতএব আয়াতের অর্থ হলো : সূর্যকে গুটিয়ে নিয়ে নিক্ষেপ করা হবে ফলে তার আলো চলে যাবে। (ইবনু কাসীর)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাঃ) বলেন :
الشَّمْسُ وَالقَمَرُ مُكَوَّرَانِ يَوْمَ القِيَامَةِ
কিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে ভাঁজ করে নেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩২০০)
انْكَدَرَتْ অর্থ : انتثرت বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। ফলে তারকার আলো চলে যাবে। কালবী ও আতা (রহঃ) বলেন : সেদিন আকাশ থেকে তারকার বৃষ্টি বর্ষিত হবে ফলে আকাশে কোন তারকা থাকবে না। (ফাতহুল কাদীর)
এগুলো আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন। তাঁর নির্দেশে আলো দিচ্ছে আর তাঁর নির্দেশেই কিয়ামতের পূর্বে আলোহীন হয়ে যাবে। তাই চন্দ্র-সূর্যসহ যেকোন বড় ধরণের নিদর্শনের ইবাদত করা যাবে না, বরং ইবাদত করবে এসব মাখলূকের সৃষ্টিকর্তার জন্য। শুধু তাই নয়, সূর্য-চন্দ্র ও অন্য যেসব বস্তুকে লোকেরা পূজা করত, সবগুলিকে আল্লাহ তা‘আলা ঐদিন জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এসব জিনিসকে শাস্তিদানের জন্য নয় বরং যারা তাদের পূজা করত তাদের ধিক্কার দেয়ার জন্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ ط أَنْتُمْ لَهَا وَارِدُوْنَ )
“তোমরা ও আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১: ৯৮)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : সূর্য ও চন্দ্র কিয়ামতের দিন দু’টি ষাঁড়ের আকৃতিতে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩২০০) সুতরাং যারা সূর্যের পূজা করে তাদের এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, সূর্য একটি মাখলূক তা কখনও মা‘বূদ হতে পারে না।
سُيِّرَتْ অর্থাৎ জমিন থেকে মূলোৎপাটন করা হবে এবং শূন্যে চালিত করা হবে ফলে পর্বতসমূহ বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার ন্যায় হয়ে যাবে। কিয়ামতের পূর্বে পাহাড়ের কী অবস্থা হবে এ সম্পর্কে সূরা নাবায় আলোচনা করা হয়েছে।
الْعِشَارُ শব্দটি عشراء এর বহুবচন। অর্থ : এমন গর্ভবতী উটনী যার গর্ভধারণের দশমাস পূর্ণ হয়ে গেছে।
عُطِّلَتْ অর্থাৎ ছেড়ে দেয়া হবে, কোন রাখাল থাকবে না। এখানে দশমাসের গর্ভবতী উটনীকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো : এরূপ গর্ভবতী উটনী আরবদের নিকট খুবই প্রিয়। এত প্রিয় বস্তু হওয়ার পরেও কিয়ামতের আতংক তাদেরকে এ সম্পর্কে গাফেল করে ফেলবে। এত মূল্যবান জিনিস কি হয়ে গেল বা কোথায় চলে গেল কোন খোঁজ খবর থাকবে না। অথবা বলা হয়, এটা উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়েছে কেননা কিয়ামত দিবসে কোন গর্ভবতী উটনী থাকবেনা। উদ্দেশ্য হলো : যদি কিয়ামতের দিন কোন মানুষের এরূপ মূল্যবান সম্পদ থাকত তাহলে এরূপ মূল্যবান সম্পদও ছেড়ে দিত, কিয়ামতের ভয়াবহতা দেখে তার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করত না ।
حُشِرَتْ অর্থাৎ প্রাণীগুলোকে কিসাস আদায় করার জন্য পুনর্জীবিত করে একত্রিত করা হবে । ফলে দুনিয়াতে যে প্রাণীর শিং ছিল না আর তাকে শিংওয়ালা প্রাণী শিং দ্বারা আঘাত করে ছিল সে প্রাণী কিয়ামতের দিন শিংওয়ালা প্রাণীকে অনুরূপ আঘাত করে কিসাস আদায় করে নেবে। পরে তারা আবার মাটিতে পরিণত হয়ে যাবে। এ অবস্থা দেখে কাফিররা বলবে হায়! আমরা যদি এরূপ হয়ে যেতাম।
سُجِّرَتْ অর্থ :
أوقدت فصارت نارا تضطرم
বা আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে ফলে সাগর আগুনে প্রজ্বলিত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
لَا يَرْكَبُ الْبَحْرَ إِلَّا حَاجٌّ، أَوْ مُعْتَمِرٌ، أَوْ غَازٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، فَإِنَّ تَحْتَ الْبَحْرِ نَارًا، وَتَحْتَ النَّارِ بَحْرًا
সমুদ্রে হাজ্জে বা উমরায় গমনকারী অথবা জিহাদ হতে প্রত্যাবর্তনকারী গাজী ব্যতীত যেন কেহ আরোহণ না করে। কেননা সমুদ্রের নীচে আগুন আর আগুনের নীচে পানি। (আবূ দাঊদ হা. ২৪৮৯ দুর্বল)
زُوِّجَتْ অর্থাৎ প্রত্যেক আমলকারীকে তার অনুরূপ আমলকারীর সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হবে। ফলে ভাল ব্যক্তিরা ভাল ব্যক্তিদের সাথে থাকবে, খারাপ ব্যক্তিরা খারাপ ব্যক্তিদের সাথে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اُحْشُرُوا الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوْا يَعْبُدُوْنَ)
“(ফেরেশতাদেরকে বলা হবে : ) একত্র কর জালিমদেরকে এবং তাদের সাথীদেরকে আর তাদেরকে যাদের তারা ‘ইবাদত করত।” (সূরা সফফাত ৩৭ : ২২) তাই উমার (রাঃ) খুৎবায় বলতেন : يقرن الفاجر مع الفاجر ويقرن الصالح مع الصالح অসৎ লোাকদেরকে অসৎ ব্যক্তির সাথে এবং সৎ লোকদেরকে সৎ ব্যক্তির সাথে মিলিয়ে দেয়া হবে। (ইবনু কাসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ
কিয়ামতের দিন মানুষ তার সাথে থাকবে, যাকে সে দুনিয়াতে ভালবাসতো। (সহীহ বুখারী হা. ৬১৬৮) সুতরাং আমাদের উচিত হবে নাবী, সিদ্দীক, শহীদ, সৎ ও তাক্বওয়াবান ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা এবং তাদেরকেই ভালবাসা, তাহলে আশা করা যায় তাদের সাথে আমাদের হাশর হবে।
الْمَوْؤ۫دَةُ বলা হয় المدفونة حية বা জীবন্ত প্রোথিত সন্তানকে। অর্থাৎ জাহিলী যুগের মানুষেরা কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত প্রোথিত করত। কারণ কন্যা সন্তান তাদের নিকট অপমানজনক বলে মনে করত। জাহেলী যুগের আরবরা কয়েকভাবে কন্যা সন্তান হত্যা করত।
১. প্রসবের পূর্বক্ষণে ঘরের মধ্যে গর্ত খনন করে রাখত, কন্যা সন্তান হলে সাথে সাথে গর্তে পুঁতে দিত।
২. মেয়ে একটু বড় হলে বাবা তাকে নিয়ে কোন কুয়ায় নিক্ষেপ করত।
৩. কন্যার বয়স ছয় থেকে সাত বছর হলে পিতা কন্যার মাকে বলত মেয়েকে ভালভাবে সাজিয়ে দিতে। তারপর আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে মুরুভুমিতে গর্ত খুড়ে পুঁতে দিত। এসব জীবন্ত প্রোথিত কন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে কি কারণে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এটা জানা কথা যাদেরকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছে তাদের কোন অপরাধ নেই, মূলত উদ্দেশ্য হলো হত্যাকারীরদেরকে ভর্ৎসনা করা।
উক্কাশ (রাঃ)-এর বোন জুদামাহ বিনতু ওহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হাযির হলাম তখন তিনি লোকজনকে বলছিলেন : আমি গর্ভাবস্থায় স্ত্রী সহবাস করতে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম রূম ও পারস্যবাসীরা গর্ভাবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে এবং তাতে তাদের সন্তানের কোন ক্ষতি হয় না। তখন সাহাবীগণ আযল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। (আযল হলো স্ত্রী সহবাসের সময় পুরুষাঙ্গ স্ত্রীর গোপাঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেওয়া যাতে বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে যেতে না পারে।) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বললেন : এটা গুপ্ত হত্যার নামান্তর। আর এরূপ গুপ্ত হত্যাকৃত সন্তানকে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ হা. ৩৮৮২)
এ অপরাধ তখন হবে যখন দারিদ্রতার ভয়ে বা কন্যা সন্তানের লজ্জায় হত্যা করবে। কিন্তু যদি স্ত্রীর বাচ্চা নিলে ক্ষতি হয় বা যে বাচ্চা আছে তার ক্ষতি হয় তাহলে এতে অপরাধী হবে না।
نُشِرَتْ যহহাক (রহঃ) বলেন : প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আমলনামা প্রদান করা হবে হয় ডান হাতে অথবা বাম হাতে। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা পড়তে পারবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِقْرَأْ كِتٰبَكَ ط كَفٰي بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا)
‘তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসেব নিকেশের জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ১৪) আমলনামা পড়ে মানুষ আশ্চর্য হয়ে বলবে:
(يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَّلَا كَبِيْرَةً إِلَّآ أَحْصَاهَا)
“হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! যে ছোট বড় কিছুই বাদ দেয়া হয়নি; বরং সমস্তই হিসেব রেখেছে।’ (সূরা কাহ্ফ ১৮: ৪৯)
كُشِطَتْ অর্থ : أزليت বা অপসারণ করা হবে, সরিয়ে দেয়া হবে।
سُعِّرَتْ অর্থ : প্রজ্জ্বলিত করা। সেদিন জাহান্নামকে এত প্রজ্জ্বলিত করা হবে যা পূর্বে কখনও করা হয়নি। أُزْلِفَتْ অর্থাৎ قربت إلي أهلها জান্নাতকে জান্নাতীদের নিকটবর্তী করা হবে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ )
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের জন্য, কোন দূরত্ব থাকবে না। ” (সূরা ক্বাফ ৫০ : ৩১)
হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হল মুত্তাকীদেরকে জান্নাতের নিকটে নেয়া হবে। এটা নয় যে, জান্নাত তার স্থান থেকে সরে আসবে। (কুরতুবী)
مَّآ أَحْضَرَتْ অর্থাৎ সে সকল আমলনামা তার সামনে উপস্থিত হয়েছে যা সে দুনিয়াতে করেছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন
(وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا)
“তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৪৯) যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন তার কৃত আমলের আমলনামা দেয়া হবে সেহেতু প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তিকে সৎআমল করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের পূর্বে যে সকল ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে সে সম্পর্কে জানলাম।
২. প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফলাফল সামনে উপস্থিত পাবে।
৩. বিনা প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত সন্তান না নেয়া জীবন্ত প্রোথিত করার নামান্তর।
9 Fozlur Rahman
তখন (সেই কেয়ামতে) প্রত্যেকে যা উপস্থিত করেছে (যে কর্ম করেছে) তা জানতে পারবে।
10 Mokhtasar Bangla
১৪. এ সব যে দিন সংঘটিত হবে সে দিন প্রত্যেকে জানতে পারবে, সে আমল হিসাবে এ দিনের জন্য অগ্রিম কী পাঠিয়েছে।
11 Tafsir Ibn Kathir
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি চায় যে, কিয়ামতকে যেন সে স্বচক্ষে দেখছে সে যেন اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ ـ اِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ ـ اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ (এই সূরাগুলো) পাঠ করে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর
اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ-এ আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ অর্থাৎ সূর্য আলোহীন হবে। আওফী (রঃ) বলেনঃ অর্থাৎ আলো চলে যাবে। আরো অন্যান্য গুরুজন বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সূর্যের আলো যেতে থাকবে এবং উপুড় করে মাটিতে নিক্ষেপ করা হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্ররাজিকে একত্রিত করে নিষ্প্রভ করে দেয়া হবে, অতঃপর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর উত্তপ্ত বাতাস প্রবাহিত হবে এবং আগুন লেগে যাবে।
হযরত আবু মরিয়ম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ সম্পর্কে বলেনঃ “সূর্যকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য একটি হাদীসে সূর্যের সাথে চাঁদেরও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ঐ হাদীসটি দুর্বল। সহীহ্ বুখারীতে শব্দের কিছু পরিবর্তনসহ এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে জড়িয়ে নেয়া হবে। ইমাম বুখারী (রঃ) এ হাদীসটি كِتَابُ بَدْءِ الْخَلْقِ এর মধ্যে আনয়ন করেছেন। কিন্তু এখানে উল্লেখ করাই ছিল বেশী যুক্তিযুক্ত। অথবা এখানে ওখানে উভয় স্থানে আনয়ন করলেই তাঁর অভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) যখন এ হাদীসটি বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন এরূপ হবে তখন হযরত হাসান (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ওদের অপরাধ কি?” তখন হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ আমি হাদীস বর্ণনা করছি আর তুমি এর মধ্যে কথা তুলছো? কিয়ামতের দিন সূর্যের এ অবস্থা হবে, সমস্ত নক্ষত্র বিকৃত হয়ে খসে পড়বে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
وَاِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ
অর্থাৎ “যখন নক্ষত্রমণ্ডলী বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে।”
হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) বলেন যে, কিয়ামতের পূর্বে ছয়টি নিদর্শন পরিলক্ষিত হবে। জনগণ বাজারে থাকবে এমতাবস্থায় হঠাৎ সূর্যের আলো হারিয়ে যাবে। তারপর নক্ষত্ররাজি খসে খসে পড়তে থাকবে। এরপর অকস্মাৎ পর্বতরাজি মাটিতে ঢলে পড়বে এবং যমীন ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করবে। মানব, দানব ও বন্য জন্তুসমূহ সবাই পরস্পর মিলিত হয়ে যাবে। যেসব পশু মানুষকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যেতো তারা মানুষেরই কাছে নিরাপত্তার জন্যে ছুটে আসবে। মানুষ এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে যে, তারা তাদের প্রিয় ও মূল্যবান গর্ভবতী উষ্ট্রীর খবর পর্যন্তও নেবে না। জ্বিনেরা বলবেঃ আমরা যাই, খবর নিয়ে আসি, দেখি কি হচ্ছে কিন্তু তারা দেখবে যে, সমুদ্রেও আগুন লেগে গেছে। ঐ অবস্থাতেই যমীন ফেটে যাবে এবং আকাশ ফাটতে শুরু করবে। সপ্ত যমীন ও সপ্ত আকাশের একই অবস্থা হবে। একদিক থেকে গরম বাতাস প্রবাহিত হবে, যে বাতাসে সব প্রাণী মারা যাবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইয়াযীদ ইবনে আবী মরিয়ম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ সম্পর্কে বলেনঃ “নক্ষত্ররাজি জাহান্নামে খসে পড়বে এবং আল্লাহ্ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়েছে তাদের সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, শুধু হযরত ঈসা (আঃ) এবং তাঁর মাতা মরিয়ম (আঃ) বাকী থাকবেন। এঁরা যদি তাদের ইবাদতে খুশী হতেন তবে এঁদেরকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হতো। [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ)]
পাহাড় নিজ জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে নাম নিশানাহীন হয়ে পড়বে। সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ সমতল প্রান্তরে পরিণত হবে। উট-উষ্ট্ৰীসমূহের প্রতি কেউ লক্ষ্য রাখবে না। অযত্নে অনাদরে ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া হবে। কেউ ওগুলোর দুধও দোহন করবে না এবং ওগুলোকে সওয়ারী হিসেবেও ব্যবহার করবে না।
عِشَار শব্দটি عُشَرَاء শব্দের বহুবচন। দশ মাসের গর্ভবতী উষ্টীকে বলা হয়। উদ্বেগ, عُشَرَاء ভয়-ভীতি, ত্রাস এবং হতবুদ্ধিতা এতো বেশী হবে যে, ভাল ভাল মাল-ধনের প্রতিও কেউ হৃক্ষেপ করবে না। কিয়ামতের সেই ভয়াবহতা হৃদয়কে প্রকম্পিত করে দিবে। মানুষ এতদূর ভীত-বিহবল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিচলিত হয়ে পড়বে যে, তার কলিজা মুখের মধ্যে এসে পড়বে। কেউ কেউ বলেন যে, কিয়ামতের এই দিনে এ অবস্থায় কারো কিছু বলার বা বলার মত অবস্থা থাকবে না। যদিও তারা সবই প্রত্যক্ষ করবে। এই উক্তিকারী عِشَار শব্দের কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। একটি অর্থ হলো মেঘ, যা দুনিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্তির ফলে আসমান ও যমীনের মাঝে শূন্যে বিচরণ করবে। কারো কারো মতে এর দ্বারা ঐ জমিনকে বুঝানো হয়েছে যার উশুর দেয়া হয়। আবার অন্য কারো মতে এর দ্বারা ঐ ঘর উদ্দেশ্য যা পূর্বে আবাদ ছিল, কিন্তু এখন বিরাণ হয়ে গেছে। এসব উক্তি উদ্ধৃত করে ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উস্ত্রীকে বুঝানো হয়েছে এবং তিনি এই অর্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অধিকাংশ তাফসীরকারও এটাকেই সমর্থন করেছেন। আমি বলি যে, পূর্বযুগীয় উলামায়ে কিরামের নিকট থেকে এ ছাড়া অন্য কোন অভিমত পাওয়া যায়নি। আল্লাহ তাআলাই এর সবচেয়ে উত্তম তাৎপর্য সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত।
আল্লাহ্ তা'আলা আরও বলেনঃ এবং যখন বন্য পশু একত্রিত করা হবে।' যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ
وَ مَا مِنْ دَآبَّةٍ فِی الْاَرْضِ وَ لَا طٰٓئِرٍ یَّطِیْرُ بِجَنَاحَیْهِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِی الْكِتٰبِ مِنْ شَیْءٍ ثُمَّ اِلٰى رَبِّهِمْ یُحْشَرُوْنَ
অর্থাৎ “ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকল পশু এবং বাতাসে উড্ডয়নশীল সকল পাখীও তোমাদের মতই দলবদ্ধ। আমি আমার কিতাবে সবকিছুর উল্লেখ করেছি, কোন কিছুই ছাড়িনি, অতঃপর তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট একত্রিত হবে।” (৬:৩৮) সব কিছুর হাশর তাঁরই নিকটে হবে, এমনকি মাছিরও। আল্লাহ্ তা'আলা সবারই সুবিচারপূর্ণ ফায়সালা করবেন। এসব প্রাণীর হাশর হলো তাদের মৃত্যু। তবে দানব ও মানবের সকলকে আল্লাহ্ তা'আলার সামনে হাযির করা হবে এবং তাদের হিসাব-নিকাশ হবে। রাবী' ইবনে হায়সাম (রঃ) বলেন যে, বন্য জন্তুর হাশর দ্বারা তাদের উপর আল্লাহর হুকুম হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা তাদের মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এসব প্রাণীও অন্যদের সাথে হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। কুরআন কারীমে রয়েছেঃ وَالطَّيْرَ مَحْشُوْرَةً অর্থাৎ “পাখীদেরকে একত্রিত করা হবে।” (৩৮:১৯) এই আয়াতের প্রকৃত অর্থও হলো এই যে, বন্য জন্তুগুলোকে সমবেত বা একত্রিত করা হবে।
হযরত আলী (রাঃ) এক ইয়াহূদীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “জাহান্নাম কোথায়?” ইয়াহূদী উত্তরে বলেঃ “সমুদ্রে।” হযরত আলী (রাঃ) তখন বলেনঃ “আমার মনে হয় একথা সত্য।” কুরআন কারীমে বলা হয়েছেঃ
وَالْبَحْرُ الْمَسْجُوْرُ
অর্থাৎ “শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের।” (৫২:৬) আরও রয়েছেঃ وَاِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ অর্থাৎ “সমুদ্র যখন স্ফীত হবে।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, আল্লাহ্ তা'আলা উত্তপ্ত বাতাস প্রেরণ করবেন। ঐ বাতাস সমুদ্রের পানি তোলপাড় করে ফেলবে। তারপর তা এক শিখাময় আগুনে পরিণত হবে।
وَالْبَحْرُ الْمَسْجُوْرُ-এ আয়াতের তাফসীরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
হযরত মুআবিয়া ইবনে সাঈদ (রাঃ) বলেন যে, ভূমধ্য সাগর বরকতপূর্ণ। এ সাগর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সব সাগর তাতে মিলিত হয়। এমনকি সবচেয়ে বড় সাগরও এই সাগরে গিয়ে মিলিত হয়। এই সাগরের নীচে ঝর্ণা রয়েছে। সেই ঝর্ণার মুখ তামা দিয়ে বন্ধ করা রয়েছে। কিয়ামতের দিন সেই মুখ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন জ্বলে উঠবে। এটা খুবই বিস্ময়কর। তবে সুনানে আবু দাউদে একটি হাদীস রয়েছে যে, হজ্জ ও উমরাহ পালনকারীরা, জিহাদকারীরা বা গাযীরা যেন দুধ-সমুদ্রে সফর করে। কেননা, সমুদ্রের নীচে আগুন এবং সেই আগুনের নীচে পানি রয়েছে। সূরা ফাতিরের তাফসীরে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
سُجِّرَتْ-এর অর্থ ‘শুকিয়ে দেয়া হবে’ এটাও করা হয়েছে। অর্থাৎ এক বিন্দুও পানি থাকবে না। আবার প্রবাহিত করে দেয়া হবে এবং এদিক-ওদিক প্রবাহিত হয়ে যাবে’ এ অর্থও কেউ কেউ করেছেন।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ প্রত্যেক প্রকারের লোককে (তাদের সহচর সহ) মিলিত করা হবে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ
اُحْشُرُوا الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا وَ اَزْوَاجَهُمْ
অর্থাৎ “একত্রিত কর জালিমদেরকে ও তাদের সহচরদেরকে।” (৩৭:২২)
হাদীস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির হাশর করা হবে তার কওমের সাথে যারা তার মতই আমল করে থাকে। (এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে) আল্লাহ্ তা'আলার নিম্নের উক্তি দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছেঃ
وَكُنْتُمْ اَزْوَاجًا ثَلٰثَةً ـ فَاَصْحٰبُ الْمَیْمَنَةِ مَاۤ اَصْحٰبُ الْمَیْمَنَةِ ـ وَ اَصْحٰبُ الْمَشْئَمَةِ مَاۤ اَصْحٰبُ الْمَشْئَمَةِ ـ وَ السّٰبِقُوْنَ السّٰبِقُوْنَ
অর্থাৎ “তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেণীতে-ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! এবং বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী। (৫৬:৭-১০)
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) খুৎবাহ্ পাঠ করার সময় এ আয়াত পাঠ করেন এবং বলেনঃ “প্রত্যেক জামাআত বা দল তাদের মত জামাআত বা দলের সাথে মিলিত হবে।” অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, একই রকম আমলকারী দুই ব্যক্তি হয় তো একত্রে জান্নাতে থাকবে অথবা জাহান্নামে পাশাপাশি জ্বলবে।
হযরত উমার (রাঃ)-কে এ আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “পুণ্যবান পুন্যবানের সাথে জান্নাতে মিলিত হবে এবং পাপী পাপীর সাথে জাহান্নামে মিলিত হবে।” অর্থাৎ জান্নাতে এবং জাহান্নামে সম আমলের মানুষ জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সব মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত হবে। ডান দিকের দল, বাম দিকের দল এবং অগ্রবর্তী দল। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, একই ধরনের লোক এক সাথে থাকবে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এ কথা পছন্দ করেন।
দ্বিতীয় উক্তি হলো এই যে, আরশের কিনারা থেকে পানির একটা সমুদ্র আত্মপ্রকাশ করবে এবং তা চল্লিশ বছর পর্যন্ত প্রশস্ত আকারে প্রবাহিত হবে। সেই সমুদ্র থেকে সকল মৃত পচা গলা ভেসে উঠবে। এটা এভাবে হবে যে, যারা তাদেরকে চিনে তারা তাদেরকে এক নজর দেখলেই চিনতে পারবে। তারপর রূহসমূহ ছেড়ে দেয়া হবে এবং প্রত্যেক রূহ তার দেহ অধিকার করবে।وَاِذَا النُّفُوْسُ زُوِّجَت-এ আয়াতের অর্থ এটাই যে, দেহে আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে। আবার এ অর্থও করা হয়েছে যে, মুমিনদের জোড়া হ্রদের সাথে লাগিয়ে দেয়া হবে এবং কাফিরদের জোড়া লাগিয়ে দেয়া হবে শয়তানের সাথে। (এটা ইমাম কুরতুবী (রঃ) তাকিরাহ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ্ তা'আলার উক্তিঃ وَاِذَا الْمَوْءُوْدَةُ سُئِلَتْ ـ بِاَىِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْ এটা জমহুরের কিরআত। জাহিলিয়াতের যুগে জনগণ কন্যা সন্তানদেরকে অপছন্দ করতো এবং তাদেরকে জীবন্ত দাফন করতো। তাদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবেঃ এরা কেন নিহত হয়েছে? যাতে এদেরকে হত্যাকারীদের অধিক ধমক দেয়া হয় ও লজ্জিত করা হয়। আর এটাও জানার বিষয় যে, অত্যাচারিতকে প্রশ্ন করা হলে অত্যাচারী স্বভাবতই অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হবে।
এটাও বলা হয়েছে যে, তারা নিজেরাই জিজ্ঞেস করবেঃ ‘তাদেরকে কিসের ভিত্তিতে বা কি কারণে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছে?
এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ :
উকাশার ভগ্নী জুযামাহ্ বিনতু অহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে জনগণের মধ্যে বলতে শুনেনঃ “আমি গর্ভাবস্থায় স্ত্রী সহবাস হতে জনগণকে নিষেধ করার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম যে, রোমক ও পারসিকরা গর্ভাবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে থাকে এবং তাতে তাদের সন্তানের কোন ক্ষতি হয় না।" তখন জনগণ তাকে বীর্য বাইরে ফেলে দেয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এটা গোপনীয়ভাবে জীবন্ত দাফন করারই নামান্তর। আর وَاِذَا الْمَوْءُوْدَةُ سُئِلَتْ এর মধ্যে এরই বর্ণনা রয়েছে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম ইবনে মাজাহ্ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সালমা ইবনে ইয়াযীদ আরাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি এবং আমার ভাই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মাতা মুলাইকা আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখতেন, অতিথি সেবা করতেন, এ ছাড়া অন্যান্য নেক আমলও করতেন। তিনি অজ্ঞতার যুগে মারা গেছেন। এসব সৎ আমল তার কোন কাজে আসবে কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “না।” আমরা বললামঃ তিনি জাহিলিয়াতের যুগে আমাদের এক বোনকে জীবন্ত প্রোথিত করেছিলেন। এতে তার কোন কুফল হবে কি? তিনি জবাব দিলেনঃ “যাকে জীবন্ত দাফন করা হয়েছে এবং যে দাফন করেছে উভয়েই জাহান্নামে যাবে। তবে হ্যা, পরে ইসলাম গ্রহণ করলে সেটা অন্য কথা।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে জীবন্ত দাফন করে এবং যাকে জীবন্ত দাফন করা হয় তারা উভয়েই জাহান্নামী।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
খানসা বিনতে মুআবিয়া সারীমিয়্যহ্ (রাঃ) তাঁর চাচা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! জান্নাতে কারা যাবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “নবী, শহীদ, শিশু এবং যাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় দাফন করা হয়েছে তারা জান্নাতে যাবে।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, মুশরিকদের শিশুরা জান্নাতে যাবে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) যারা বলে যে, তারা (মুশরিকদের শিশুরা) জাহান্নামে যাবে তারা মিথ্যাবাদী। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
وَاِذَا الْمَوْءُوْدَةُ سُئِلَتْ ـ بِاَىِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْ-এর দ্বারা জীবিত প্রোথিত কন্যা শিশুকে বুঝানো হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত কায়েস ইবনে আসিম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জাহিলিয়াতের যুগে আমি আমার কন্যাদেরকে জীবিত প্রোথিত করেছি (এখন কি করবো?)।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি প্রত্যেকটি কন্যার বিনিময়ে একটি করে গোলাম আযাদ করে দাও।” তখন হযরত কায়েস (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তো উটের মালিক (গোলামের মালিক তো আমি নই?)।” তিনি বললেনঃ “তাহলে তুমি প্রত্যেকের বিনিময়ে একটি করে উট আল্লাহর নামে কুরবানী করে দাও।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আবদির রাযযাকে বর্ণিত হয়েছে)
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, হযরত কায়েস (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি বারো বা তেরোটি কন্যাকে জীবন্ত দাফন করেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তাদের সংখ্যা অনুযায়ী গোলাম আযাদ করে দাও। তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে, আমি তাই করবো।” পরবর্তী বছর তিনি একশটি উট নিয়ে এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি মুসলমানদের সাথে যা করেছি তার জন্যে আমার কওমের পক্ষ থেকে এই সাদকা নিয়ে এসেছি।”
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আমি ঐ উটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতাম। ঐগুলোর নাম কায়সিয়্যাহ্ রেখেছিলাম।”
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ “যখন আমলনামা উন্মোচিত হবে। অর্থাৎ আমলনামা বন্টন করা হবে। কারো ডান হাতে দেয়া হবে এবং কারো বাম হাতে দেয়া হবে। কাতাদাহ্ (রঃ) বলেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি যা লিখাচ্ছো সেটা কিয়ামতের দিন একত্রিতাবস্থায় তোমাকে প্রদান করা হবে। সুতরাং মানুষ কি লিখাচ্ছে এটা তার চিন্তা করে দেখা উচিত।
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ আসমানকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নেয়া হবে, তারপর গুটিয়ে নিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে। জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হবে। আল্লাহর গযবে ও বানী আদমের পাপে জাহান্নামের আগুন তেজদীপ্ত হয়ে যাবে। এসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেক মানুষ পার্থিব জীবনে কি আমল করেছে তা জেনে নিবে। সব আমল তার সামনে বিদ্যমান থাকবে। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
یَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَیْرٍ مُّحْضَرًا وَّ مَا عَمِلَتْ مِنْ سُوْٓءٍ تَوَدُّ لَوْ اَنَّ بَیْنَهَا وَ بَیْنَهٗۤ اَمَدًۢا بَعِیْدًا
অর্থাৎ “সেদিন প্রত্যেকে সে যে ভাল কাজ করেছে এবং সে যে মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে, সে দিন সে তার ও ওর (মন্দ কর্মফলের) মধ্যে দূর ব্যবধান কামনা করবে।” (৩:৩০) আল্লাহ্ তা'আলা আরো বলেনঃ
یُنَبَّؤُا الْاِنْسَانُ یَوْمَئِذٍۭ بِمَا قَدَّمَ وَ اَخَّرَ
অর্থাৎ “সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কি অগ্রে পাঠিয়েছে এবং কি পশ্চাতে রেখে গেছে।” (৭৫:১৩)
হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, যখন اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ সূরাটি নাযিল হয় এবং عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّآ اَحْضَرَتْ পর্যন্ত পৌছে তখন হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “পূর্ববর্তী সকল কথা এ জন্যেই বর্ণনা করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)