এ সূরাটি যে মক্কী সূরা তার প্রমাণ এই যে, হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “নবী করীম (সঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে যারা সর্ব প্রথম আমাদের নিকট (মদীনায়) আসেন তারা হলেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রাঃ) এবং হযরত ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)। তাঁরা আমাদেরকে কুরআন পড়াতে শুরু করেন। অতঃপর হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত আম্মার (রাঃ) এবং হযরত সা'দ (রাঃ) আগমন করেন। তারপর হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বিশজন সাহাবী সমভিব্যাহারে আমাদের কছে আসেন। তারপর নবী করীম (সঃ) আসেন। আমি মদিনাবাসীকে অন্য কোন ব্যাপারে এতো বেশী খুশী হতে দেখিনি যতোটা খুশী তারা নবী (সঃ) এবং তাঁর সহচরদের আগমনে হয়েছিলেন। ছোট ছোট শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকরা পর্যন্ত আনন্দে কোলাহল শুরু করে যে, ইনি হলেন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) রাসুলুল্লাহ্ (সঃ)-এর আগমনের পূর্বেই আমি سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى সূরাটি, এ ধরনের অন্যান্য সূরাগুলোর সাথে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম।”
মুসনাদে আহমদে হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى এই সূরাটিকে খুবই ভালবাসতেন।
সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত মুআয (রাঃ)-কে বলেনঃ “কেন তুমি নামাযে وَالشَّمْسِ وَضُحٰهَا ـ سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى এবং وَالَّيْلِ اِذَا يَغْشٰى এই সূরাগুলো পড় না?” মুসনাদে আহমদে আরও বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) উভয় ঈদের নামাযে , سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى এবং هَلْ اَتٰكَ حَدِيْثُ الْغَاشِيَةِ এ সূরা দুটি পাঠ করতেন। যদি ঘটনাক্রমে একই দিনে জুমআ ও ঈদের নামায পড়ে যেতো তবে তিনি উভয় নামাযেই এই সূরা দুটি পড়তেন। (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম, সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী এবং সুনানে ইবনে মাজাহতেও বর্ণিত হয়েছে)
মুসনাদে আহমদে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বেতরের নামাযে قُلْ يٰٓاَيُّهَا الْكٰفِرُوْنَ ـ سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى এবং قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ এই সূরাগুলো পাঠ করতেন। অন্য একটি বর্ণনায় আরো বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে, قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ এবং قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ এই সূরা দু’টিও পড়তেন। (এই হাদীসটিও নানাভাবে বহুসংখ্যক সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তবে, এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)
১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর
মুসনাদে আহমদে হযরত উকবা ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيْمِ অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “এটাকে তোমরা রুকুর মধ্যে গ্রহণ করে নাও।” তারপর যখন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى অবতীর্ণ হলো তখন তিনি বললেনঃ “এটাকে তোমরা তোমাদের সিজদাহ্নর মধ্যে গ্রহণ কর।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজা (রঃ) ও বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যখন سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى পাঠ করতেন তখন তিনি سُبْحَانَ رَبِّىَ الْاَعْلٰى বলতেন। [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ)]
হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى পাঠ করে سُبْحَانَ رَبِّىَ الْاَعْلٰى বলতেন এবং যখন তিনি لَآ اُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ এ সূরাটি পাঠ করতেন এবং শেষে, اَلَیْسَ ذٰلِكَ بِقٰدِرٍ عَلٰۤى اَنْ یُّحْیَِۧ الْمَوْتٰى পড়তেন তখন سُبْحٰنَكَ وَبَلٰى বলতেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ্ তা'আলা এখানে বলেনঃ তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যিনি সমস্ত মাখলুককে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকে সুন্দর ও উন্নত আকৃতি দান করেছেন। যিনি মানুষকে সৌভাগ্যের বলতেন পনির্দেৰেছেন। যিনি পশুদের চারণভূমিতে তৃণ ও সবুজ ঘাসের ব্যবস্থা ফোন আল্লাহ্ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
رَبُّنَا الَّذِیْۤ اَعْطٰى كُلَّ شَیْءٍ خَلْقَهٗ ثُمَّ هَدٰى
অর্থাৎ “(হযরত মুসা বললেন) আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথ নির্দেশ করেছেন।” (২০:৫০) যেমন সহীহ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সৃষ্ট জীবের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছেন। সেই সময় তার আরশ ছিল পানির উপর।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ “যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন, পরে ওকে ধূসর আবর্জনায় পরিণত করেন।
আরবের কোন কোন ভাষা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, এখানে اَحْوٰى শব্দটিকে যদিও শেষে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে এটাকে প্রথমে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ যিনি ঘাস, তৃণ, শস্য, গাঢ় সবুজ রঙের করে সৃষ্টি করেছেন, তারপর ওকে বিশুদ্ধ করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাকে আমি নিশ্চয়ই পাঠ করাবো, ফলে তুমি বিস্মৃত হবে না। তবে হ্যা যদি স্বয়ং আল্লাহ্ কোন আয়াত ভুলিয়ে দিতে চান তবে সেটা স্বতন্ত্র কথা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ অর্থই পছন্দ করেন এবং তাতে এ আয়াতের অর্থ হবেঃ যে কুরআন আমি তোমাকে পড়াচ্ছি তা ভুলে যেয়ো না। তবে হ্যা, আমি যে অংশ মানসুখ করে দেই সেটা ভিন্ন কথা। অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সমস্ত আমল বা কাজ এবং আকীদা বা বিশ্বাস সবই সুস্পষ্ট। হে নবী (সঃ)! আমি তোমার উপর ভাল কাজ, ভাল কথা, শরীয়তের হুকুম-আহকাম সহজ করে দিবো। এতে কোন প্রকার সংকীর্ণতা ও কাঠিন্য থাকবে না। থাকবে না কোন প্রকার বক্রতা। তুমি এমন জায়গায় উপদেশ দাও যেখানে উপদেশ হয় ফলপ্রসূ। এতে বুঝা যায় যে, অযোগ্য নালায়েকদেরকে শিক্ষাদান করা উচিত নয়। যেমন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “যদি তোমরা কারো সাথে এমন কথা বল যা তার জন্যে বোধগম্য নয়, তবে তোমাদের কল্যাণকর কথা তার জন্যে অকল্যাণ বয়ে আনবে। তাতে ফিত্না-ফাসা ব। বরং মানুষের সাথে তোমরা তাদের বোধগম্য বিষয়ে কথা বলো, যাতে মানুষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে না পারে।”
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এই কুরআন থেকে তারাই নসীহত বা উপদেশ লাভ করবে যাদের অন্তরে আল্লাহ্ ভীতি রয়েছে এবং যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় মনে পোষণ করে। পক্ষান্তরে, যারা হতভাগ্য তারা এ কুরআন থেকে কোন শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে না। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। যেখানে কোনরূপ আরাম-আয়েশ ও শান্তি-সুখ নেই, বরং আছে চিরস্থায়ী আযাব ও নানা প্রকার যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
যারা আসল জাহান্নামী তারা না মৃত্যুবরণ করবে, না শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পাবে। তবে যাদের প্রতি আল্লাহ্ তা'আলা দয়া করার ইচ্ছা রাখেন তারা জাহান্নামের আগুনে পতিত হবার সাথে সাথেই পুড়ে মারা যাবে। তারপর সুপারিশকারী লোকেরা গিয়ে তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম হতে বের করে এনে জীবনদানকারী ঝর্ণায় ফেলে দিবেন। তাদের উপর জান্নাতের ঐ ঝর্ণাধারা পানি ঢেলে দেয়া হবে। ফলে তারা সজীব হয়ে উঠবে যেমনভাবে বন্যায় নিক্ষেপিত বস্তুর (আবর্জনা স্কুপের) মাঝে বীজ গজিয়ে ওঠে।” তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা দেখো না যে, ঐ উদ্ভিদ প্রথমে সবুজ হয়, তারপর হলদে হয় এবং শেষে পূর্ণ সজীবতা লাভ করে থাকে?” তখন সাহাবীদের কোন একজন বললেনঃ “নবীপাক (সঃ), কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে, যেন তিনি জঙ্গলেই ছিলেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তাছাড়া এটা বিভিন্ন শব্দে আরো বহু হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)
আল্লাহ্ তা'আলা জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে কুরআন কারীমে বলেছেনঃ
وَ نَادَوْا یٰمٰلِكُ لِیَقْضِ عَلَیْنَا رَبُّكَ قَالَ اِنَّكُمْ مّٰكِثُوْنَ
অর্থাৎ “জাহান্নামীরা চীৎকার করে বলবেঃ হে (জাহান্নামের দারোগা) মালিক! আপনার প্রতিপালককে বলুন যে, তিনি যেন আমাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। তখন জবাবে তাদেরকে বলা হবেঃ তোমাদেরকে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।” (৪৩:৭৭) আর এক জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ
لَا یُقْضٰى عَلَیْهِمْ فَیَمُوْتُوْا وَ لَا یُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِّنْ عَذَابِهَا
তাদের মৃত্যুও ঘটানো হবে না এবং তাদের আযাবও হালকা করা করেন। (৩৫:৩৬)এই অর্থ সম্বলিত আরো আয়াত রয়েছে।