আল লায়ল আয়াত ১১
وَمَا يُغْنِيْ عَنْهُ مَالُهٗٓ اِذَا تَرَدّٰىٓۙ ( الليل: ١١ )
Wa maa yughnee 'anhu maaluhooo izaa taraddaa (al-Layl ৯২:১১)
English Sahih:
And what will his wealth avail him when he falls? (Al-Layl [92] : 11)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যখন সে ধ্বংস হবে (অর্থাৎ মরবে) তখন তার (সঞ্চিত) ধন-সম্পদ কোনই কাজে আসবে না। (আল লায়ল [৯২] : ১১)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যখন সে ধ্বংস হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না।[১]
[১] অর্থাৎ, যখন সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন এই মাল-ধন, যা সে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করত না, তা সেদিন কোন কাজে আসবে না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে ধ্বংস হবে [১]।
[১] تردى এর শাব্দিক অর্থ অধঃপতিত হওয়া ও ধ্বংস হওয়া। অর্থাৎ একদিন তাকে অবশ্যি মরতে হবে। তখন দুনিয়াতে যেসব ধন-সম্পদে কৃপণতা করেছিল তা তার কোনও কাজে আসবে না। [মুয়াসসার]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে অধঃপতিত হবে।
4 Muhiuddin Khan
যখন সে অধঃপতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না।
5 Zohurul Hoque
আর তার ধনসম্পদ তার কোনো কাজে আসবে না যখন সে অধঃপাতে পড়বে।
6 Mufti Taqi Usmani
সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না।
7 Mujibur Rahman
এবং তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবেনা যখন সে ধ্বংস হবে।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ:
اللَّيْلِ শব্দের অর্থ : রাত। সূরার প্রথম আয়াতের اللَّيْلِ শব্দ থেকেই উক্ত নামে সুরার নামকরণ করা হয়েছে।
১-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
সূরাটির শুরুতেই মহান আল্লাহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের শপথ করেছেন যে সময়গুলোতে মানুষ বিভিন্ন আমল করে থাকে। কর্ম প্রচেষ্টার দিক দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ দু’ধরণের হতে পারে। এক. যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সঠিক পথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরাই সফলকাম এবং তাদের তিনটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। দুই. যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভ্রান্তপথে চলার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এরা ব্যর্থকাম এবং এদের তিনটি দোষ বর্ণনা করা হয়েছে।
(إِذَا يَغْشٰي) অর্থ: يعم الخلق بظلامه
বা সমস্ত সৃষ্টি জীবকে রাত তার অন্ধকার দ্বারা আচ্ছাদিত করে নেয়। ফলে সবাই স্বীয় আশ্রয়স্থলে আশ্রয় নেয় এবং সারাদিনের ক্লেশ ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করে।
تَجَلّٰي অর্থাৎ সৃষ্টি জীবের জন্য যখন দিন আলোকজ্জ্বল হয়ে যায়। ফলে সবকিছু তার আলোয় আলোকিত হয় এবং সবাই কর্মস্থলে চলে যায়। আলকামাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদের কতক ছাত্রদের একটি দলের সাথে শামে গেলাম। আবূ দারদা আমাদের আগমনের কথা শুনতে পেয়ে কাছে এসে বললেন : তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে কুরআন পড়তে পারে? আমরা বললাম : হ্যাঁ, তিনি বললেন : কে অধিক ভাল পড়তে পারে? (আলকামাহ) বললেন: সবাই আমার দিকে ইশারা করল। তিনি বললেন: পড়! আমি পড়লাম,
(وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰي .......الذَّكَرَ وَالْأُنْثٰٓي)
তুমি কি তোমার সাথীর (ইবনু মাসঊদ) মুখ থেকে শুনেছ? আমি বললাম: হ্যাঁ, তিনি বললেন: আমিও তা নাবী (সাঃ)-এর মুখ থেকে শুনেছি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৩) রাতের আচ্ছন্ন করা এবং দিনের আলোকিত হওয়ার শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা এ দুয়ের কল্যাণকর বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি যেমন বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তেমনি দুনিয়ায় নেক আমলের মাধ্যমে আখিরাতে মুক্তির পথ বেছে নেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
(وَمَا خَلَقَ) এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজ সত্ত্বার শপথ করেছেন। কেননা তিনি হলেন নর নারী উভয়ের সৃষ্টিকর্তা। এ ক্ষেত্রে ما মাওসূলা الذي বা যিনি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ما মাসদার বা ক্রিয়ামূল হলে অর্থ হবে শপথ নর নারী সৃষ্টির। (তাফসীর সা‘দী) মোট কথা আল্লাহ তা‘আলা নর নারী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ)
“আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিয়াত ৫১: ৪৯)
(إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتّٰي)
এটা হলো পূর্ববর্তী শপথসমূহের জবাব। মানুষ বিভিন্ন রকম আমল করে থাকে। যে ব্যক্তি ভাল আমল করবে তার প্রতিদান জান্নাত আর যে খারাপ আমল করবে তার প্রতিদান জাহান্নাম।
অথবা আয়াতের অর্থ হলো তোমাদের কাজকর্ম ভিন্ন ভিন্ন। কেউ চাকুরী করে, কেউ কৃষি কাজ করে ইত্যাদি। তবে যে যাই করুক সব ধরনের কাজের হিসাব দিতে হবে।
(مَنْ أَعْطٰي وَاتَّقٰي)
অর্থাৎ সম্পদ ব্যয় করে যেসব ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেমন যাকাত প্রদান করা, সাদকাহ করা ও ভাল কাজে ব্যয় করা ইত্যাদি। আর যে সকল শারীরিক ইবাদত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যেমন সালাত আদায় করা, সিয়াম পালন করা। যে সকল ইবাদত অর্থ ব্যয় ও শারীরিক পরিশ্রম উভয়ের সমন্নয়ে হয়ে থাকে; যেমন হাজ্জ, উমরা ইত্যাদি। এসব ইবাদত যারা করে থাকে এবং হারাম কাজ বর্জন ও নিদের্শমূলক কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আর আমলের হিসাব ও নেকীর বিশ্বাস রাখে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : صدق بالحسني বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং এটা যার ওপর প্রমাণ বহন করে সব সত্য বলে বিশ্বাস করে। (তাফসীর সা‘দী)
لِلْيُسْرٰي ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : কল্যাণকর কাজের পথ সহজ করে দেব। জায়েদ বিন আসলাম (রহঃ) বলেন : জান্নাতের পথ সহজ করে দেব। মোট কথা তার জন্য এমন সব কাজ সহজ করে দেয়া হবে যা করলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি بَخِلَ অর্থাৎ সম্পদ সম্পর্কীয় ও শারীরিকসহ সকল ফরয বিধান পালন করে না এবং الحسني (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তা অস্বীকার করে তার জন্য জাহান্নামের কাজ সহজ করে দেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ)
“তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।” (সূরা আনআম ৬: ১১০)
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা কোন এক জানাযায় নাবী (সাঃ)-এর সাথে আমরা ছিলাম। তখন নাবী (সাঃ) বললেন :
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ كُتِبَ مَقْعَدُهُ مِنَ الجَنَّةِ، وَمَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ
তোমাদের প্রত্যেকের স্থান জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্ধারিত করা আছে। সাহাবী বললেন : তার ওপর নির্ভর করে থাকব না? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন:
اعْمَلُوا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ
তোমরা আমল করে যাও কারণ প্রত্যেকের জন্য সেই আমলই সহজ করে দেয়া হয়েছে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর নাবী (সাঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৫)
আলী (রাঃ) থেকেই অন্য বর্ণনায় রয়েছে জনৈক ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! আমরা কি আমাদের লিপিবদ্ধ কিতাবের ওপর নির্ভর করে আমল করা ছেড়ে দেব না? আমাদের মধ্যে যে সৌভাগ্যবান সে সৌভাগ্যবানদের আমলের দিকেই ধাবিত হবে। আর যে দুর্ভাগ্যবান সে দুর্ভাগ্যবানদের আমলের দিকেই ধাবিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : যারা সৌভাগ্যবান তাদের জন্য সৌভাগ্যবানদের আমল করা সহজ হয়ে যাবে। তারপর
(فَأَمَّا مَنْ أَعْطٰي.... لِلْيُسْرٰي)
আয়াতগুলো পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৮)
(إِذَا تَرَدّٰي) মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: অর্থ হলো إذا مات বা যখন মারা যাবে। জায়েদ বিন আসলাম বলেন:
إِذَا تَرَدّٰي في النار
বা যখন সে জাহান্নামে পতিত হবে তখন তার সম্পদ কোন উপকারে আসবে না। কেননা মানুষ মারা গেলে তার আমলই কেবল সাথে যায়, অন্যদিকে দুনিয়াতে যে সম্পদ রেখে গেছে যার হক আদায় করেনি তা তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অতএব এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই, আমার তাকদীর তো পূর্বে লেখাই আছে আর আমল করার কোন প্রয়োজন নেই। না, এরূপ ধারণা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরণ করছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে সৎ আমলে উত্তম।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা সৎ আমল করে এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে তাদের জন্য তিনি জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। পক্ষান্তরে যারা এর বিপরীত আমল করে তাদের জন্য জাহান্নামের পথ সহজ করে দেন।
২. তাকদীর পূর্ব থেকেই লিপিবদ্ধ রয়েছে বলে আমল ছেড়ে বসে থাকা যাবে না।
9 Fozlur Rahman
আর তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না, যখন সে ধ্বংস হয়ে যাবে।
10 Mokhtasar Bangla
১১. সে যখন ধ্বংস হয়ে যাবে ও জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন এ সম্পদ তার কোন উপকারে আসবে না। যা ব্যয় করার ক্ষেত্রে সে কার্পণ্য করেছে।
11 Tafsir Ibn Kathir
নবী করীম (সঃ) হযরত মুআযের (রঃ) প্রতি যে উক্তিটি করেছিলেন তা পূর্বেই গত হয়েছে। তাহলো “কেন তমি নামাযে وَالشَّمْسِ وَضُحٰهَا ـ سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى এবং وَالَّيْلِ اِذَا يَغْشٰى এই সূরাগুলো পাঠ কর না?”
১-১১ নং আয়াতের তাফসীর
মুসনাদে আহমদে হযরত আলকামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি সিরিয়ায় আগমন করেন এবং দামেস্কের মসজিদে গিয়ে দুই রাকআত নামায পড়েন। অতঃপর দুআ করেনঃ
اَللّٰهُمَّ ارْزُقْنِىْ جَلِيْسًا صَالِحًا
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে একজন উত্তম সাথী দান করুন!” এরপর হযরত আবুদ দারদা'র (রাঃ) সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কোথাকার লোক? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি একজন কুফার অধিবাসী।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) প্রশ্ন করলেনঃ “আপনি ইবনে উমি আবৃদ (রাঃ)-কে وَ الَّیْلِ اِذَا یَغْشٰى ـ وَ النَّهَارِ اِذَا تَجَلّٰى এ সূরাটি কিভাবে পড়তে শুনেছেন?” জবাবে হযরত আলকামা (রাঃ) বলেনঃ “তিনি وَالذَّكَرِ وَالْاُنْثٰى পড়তেন।” তখন হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) বললেনঃ “আমিও রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে এ সূরাটি এ ভাবেই পড়তে শুনেছি। অথচ জনগণ আমাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “আপনাদের মধ্যে কি বালিশ ওয়ালা (অর্থাৎ সফরে যার কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিছানাপত্র থাকতো) এবং যিনি এমন কিছু গোপনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে জ্ঞান অন্য কারো ছিল না এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ভাষায় যিনি শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) নেই?”
হযরত ইবরাহীম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর সঙ্গী-সাথীগণ হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)-এর খোঁজে আগমন করেন। হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)ও তাদেরকে খোঁজ করতে করতে পেয়ে যান। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর কিরআত অনুযায়ী কুরআন পাঠকারী কেউ আছেন কি? উত্তরে তারা বললেনঃ “আমরা সবাই (তার কিরআতের অনুসারী)।” তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহর কিরআত অধিক স্মরণকারী কে আছেন?” তাঁরা জবাবে হযরত আলকামা (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। তখন হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনি হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাঃ)-কে وَ الَّیْلِ اِذَا یَغْشٰى এ সূরাটি কিভাবে পড়তে শুনেছেন? তিনি وَالذَّكَرِ وَالْاُنْثٰى উত্তরে বললেন, “তিনি পাঠ করতেন।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) একথা শুনে বললেনঃ “আমিও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এভাবেই পড়তে শুনেছি। অথচ জনগণ চায় যে, আমি যেন وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْاُنْثٰى পাঠ করি। আল্লাহর কসম! তাদের কথা আমি মানব না’’’’ (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এভাবে বর্ণনা করেছেন) মোট কথা, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আবুদ দারদা (রাঃ)-এর কিরআত এরূপ। হযরত আবুদ দারদা এ বর্ণনাকে উসূলে হাদীসের পরিভাষায় মারফু বলেও উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য জমহূরের কিরআত বর্তমানে কুরআনে উল্লিখিত কিরআতের অনুরূপ।
আল্লাহ তা'আলা সমগ্র সৃষ্টি জগতের উপর ছেয়ে যাওয়া রাত্রির শপথ করছেন, সব কিছুকে আলোকমণ্ডিত করে দেয়া দিবসের শপথ করেছেন এবং সমস্ত নর-নারী, নর ও মাদী জীবসমূহের স্রষ্টা হিসেবে নিজের সত্ত্বার শপথ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ وَخَلَقْنٰكُمْ اَزْوَاجًا অর্থাৎ “আমি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।” (৭৮:৮) আরো বলেছেনঃ وَ مِنْ كُلِّ شَیْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَیْنِ অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক জিনিসের জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (৫১:৪৯) এই শপথ করার পর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলছেনঃ অবশ্যই তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকৃতির। অর্থাৎ তোমাদের প্রচেষ্টা এবং আমলসমূহ পরস্পরবিরোধী, একটি অন্যটির বিপরীত। যারা ভাল কাজ করছে তারাও আছে এবং যারা মন্দ কাজে লিপ্ত রয়েছে তারাও আছে।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যে ব্যক্তি দান করলো ও মুত্তাকী হলো অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার পথে খরচ করলো, মেপে মেপে পা বাড়ালো, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর ভয় রাখলো আল্লাহর ওয়াদাকৃত পুরস্কারকে সত্য বলে জানলো এবং তাঁর পুণ্যের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাস করলো, আর যা উত্তম। গ্রহণ করলো, আমি তার জন্যে সহজ পথ সুগম করে দিবো।
حُسْنٰى শব্দের অর্থ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, করা হয়েছে। কেউ কেউ এর অর্থ ‘নিয়ামত’ করেছেন। আবার কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, এর ভার্থ হলোঃ নামায, রোযা, যাকাত, সাদকা, সাদকায়ে ফিত্র এবং জান্নাত।
মহান আল্লাহ বলে আমি তার জন্যে সহজ পথ সুগম করে দিবো। অর্থাৎ কল্যাণ, অত এ উত্তম বিনিময়ের পথ।
পারে সে ব্যক্তি কার্পণ্য করলো এবং নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলো এবং হুসন’ অর্থাৎ কিয়ামতের বিনিময়কে অবিশ্বাস করলো, তার জন্যে আমি সুগম করে দিবো কঠোর পরিণামের পথ। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَ نُقَلِّبُ اَفْئِدَتَهُمْ وَ اَبْصَارَهُمْ كَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِهٖۤ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّ نَذَرُهُمْ فِیْ طُغْیَانِهِمْ یَعْمَهُوْنَ
অর্থাৎ “আমি তাদের অন্তঃকরণ ও তাদের চক্ষু উল্টিয়ে দিবো, যেমন তারা প্রথমবার কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি এবং তাদেরকে আমি অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দিবো।" (৬:১১০) প্রত্যেক আমলের বিনিময় যে সেই আমলের অনুরূপ হয়ে থাকে এ সম্পর্কিত আয়াত কুরআন কারীমের মধ্যে বহু রয়েছে। যে ভাল কাজ করতে চায় তাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়। পক্ষান্তরে যে মন্দ কাজ করতে চায় তাকে মন্দ কাজ করার সামর্থ্য প্রদান করা হয়। এ অর্থের সমর্থনে বহু হাদীসও রয়েছে। একটি হাদীস এই যে, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের আমলসমূহ কি তকদীরের লিখন অনুযায়ী হয়ে থাকে?" রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বলেনঃ “হ্যা তকদীরের লিখন অনুযায়ীই আমল হয়ে থাকে।” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ) তাহলে আমলের প্রয়োজন কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সেই আমল সহজ হবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা বাকী’ গারকাদে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে এক জানাযায় শরীক ছিলাম। তিনি বললেনঃ “জেনে রেখো যে তোমাদের প্রত্যেকের স্থানই জান্নাতে অথবা জাহান্নামে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং লিপিবদ্ধ রয়েছে।” একথা শুনে জনগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে আমরা তো সেই ভরসায় নিষ্ক্রীয় হয়ে থাকলেই পারি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ তোমরা আমল করে যাও, কারণ প্রত্যেক লোকের জন্য সেই আমলই সহজ করা হবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অতঃপর তিনি فَاَمَّا مَنْ اَعْطٰى وَ اتَّقٰى ـ وَ صَدَّقَ بِالْحُسْنٰى ـ فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْیُسْرٰى ـ وَ اَمَّا مَنْۢ بَخِلَ وَ اسْتَغْنٰى ـ وَ كَذَّبَ بِالْحُسْنٰى ـ فَسَنُیَسِّرُهٗ لِلْعُسْرٰى হতে لِلْعُسْرٰى পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এ বর্ণনাটিই অন্যভাবেও বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে এক টুকরো কাঠি ছিল এবং মাথা নীচু করে তিনি তা এদিক ওদিক করছিলেন। শব্দের মধ্যে কিছু কম বেশীও রয়েছে। উপরে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর প্রশ্ন সম্বলিত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। মুসনাদে আহমদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)-এর একই ধরনের প্রশ্ন সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং নবী করীমের (সঃ) উত্তরও প্রায় একই রকমের রয়েছে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হযরত জাবির (রাঃ) হতেও একই ধরনের বর্ণনার উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনে জারীরেরই (রঃ) অন্য একটি বর্ণনায় দু'জন যুবকের একই রকম প্রশ্ন এবং রাসূলুল্লাহ (স)-এর একই রকম উত্তর বর্ণিত রয়েছে। তারপর সেই দুই যুবকের নিম্নের উক্তিও উল্লিখিত রয়েছেঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় সৎ আমল করতে থাকবো।” হযরত আবুদ দারদা (রাঃ) হতেও একইভাবে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে কারীম (সঃ) বলেনঃ “প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় সূর্যের উভয় পাশে দু’জন ফেরেশতা উপস্থিত হন এবং উচ্চস্বরে দু'আ করেন, যে দু’আ মানুষ ও জ্বিন ছাড়া সকল সৃষ্টি জীবই শুনতে পায়। তারা দু'আ করেনঃ “হে আল্লাহ! দানশীলকে পূর্ণ বিনিময় প্রদান করুন এবং কৃপণের মাল ধ্বংস করে দিন।” কুরআনে এ চারটি আয়াতের অর্থ এটাই।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোকের একটি খেজুরের বাগান ছিল। ঐ বাগানের একটি খেজুর গাছের শাখা একটি দরিদ্রলোকের ঘরের উপর ঝুঁকেছিল। ঐ দরিদ্র লোকটি ছিল পুণ্যবান। তার সন্তান সন্ততিও ছিল। বাগানের মালিক খেজুর নামাতে এসে ঝুঁকে থাকা শাখার খেজুরও নির্দ্বিধায় নামিয়ে নিতো। নীচে দরিদ্র লোকটির আঙ্গিনায় পড়া খেজুরও সে কুড়িয়ে নিতো। এমনকি দরিদ্র লোকটির ছেলে মেয়েদের কেউ দু একটা খেজুর মুখে দিলে বাগানের ঐ মালিক তার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঐ খেজুর বের করে নিতো। দরিদ্র লোকটি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অভিযোগ করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, তুমি যাও (আমি এর সুব্যবস্থা করছি)।” অতঃপর তিনি বাগানের মালিকের সাথে দেখা করে বললেনঃ “তোমার যেই খেজুর গাছের শাখা অমুক দরিদ্রলোকের ঘরের উপর ঝুঁকে আছে সেই খেজুর গাছটি আমাকে দিয়ে দাও, আল্লাহ তা'আলা তোমাকে সেই গাছের বিনিময়ে জান্নাতে একটি গাছ দিবেন।” বাগানের মালিক বললোঃ “ঠিক আছে, দিয়ে দিলাম। কিন্তু উক্ত গাছের খেজুর আমার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়। আমার বাগানে বহু গাছ আছে, কিন্তু ঐ গাছের মত সুস্বাদু খেজুর গাছ আর একটিও নেই।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) চুপচাপ ফিরে আসলেন। একটি লোক গোপনে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)এবং ঐ লোকেটির কথােপকথন শুনছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ গাছটি যদি আমার হয়ে যায় এবং আমি ওটা আপনাকে দিয়ে দিই তবে কি ঐ গাছের বিনিময়ে আমিও জান্নাতে একটি গাছ পেতে পারি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হা (অবশ্যই)। লোকটি তখন বাগান মালিকের কাছে গেলেন। তার নিজেরও একটি বাগান ছিল। প্রথমোক্ত বাগান-মালিক তাকে বললোঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে আমার অমুক খেজুর গাছের বিনিময়ে জান্নাতের একটি গাছ দিতে চেয়েছেন। আমি তাঁকে এই জবাব দিয়েছি। তার একথা শুনে আগন্তুক লোকটি তাকে বললেনঃ “তুমি কি গাছটি বিক্রি করতে চাও?" উত্তরে লোকটি বললোঃ “না। তবে হ্যা, ইতি মূল্য কেউ যদি দেয় তবে ভেবে দেখতে পারি। কিন্তু কে দিবে সেই মূল্য?" তখন আগন্তুক লোকটি জিজ্ঞেস করলেনঃ “কত মূল্য তুমি চাও?”বাগান মালিক জবাব দিলোঃ “এর বিনিময়ে আমি চল্লিশটি খেজুর গাছ চাই।” আগন্তুক বললেনঃ “এটা তো খুব বেশী হয়ে যায়। একটি গাছের বিনিময়ে চল্লিশটি গাছ।” তারপর উভয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর আগন্তুক তাকে বললেনঃ “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমার ইপ্সিত মূল্যেই তোমার খেজুর গাছ ক্রয় করলাম।" মালিক বললোঃ “যদি তাই হয় তবে সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করে কথা পাকাপাকি করে নাও।” সুতরাং কয়েকজন লোক ডেকে নিয়ে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করা হলো এবং এইভাবে ক্রয় বিক্রয়ের কাজ পাকাপাকি হয়ে গেল। কিন্তু এতেও বাগান-মালিকের খুৎ খুঁৎ মনোভাব কাটলো না। সে বললোঃ “দেখো ভাই, আমরা এখান হতে পৃথক না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু বেচা কেনা সিদ্ধ হবে না?” ক্রেতা বললেনঃ “ঠিক আছে, তাই হবে।”বাগানের মালিক বললোঃ “আমি সম্মত হয়ে গেলাম যে তুমি আমাকে আমার এই খেজুর গাছের বিনিময়ে তোমার চল্লিশটি খেজুর গাছ প্রদান করবে। কিন্তু ভাই গাছগুলো ঘনশাখা বিশিষ্ট হওয়া চাই।” ক্রেতা বললেনঃ “আচ্ছা তা দিবো।” তারপর সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে এ বেচাকেনা সম্পন্ন হলো। তারপর তারা দুজন পৃথক হয়ে গেল (ক্রেতা লোকটি তখন আনন্দিত চিত্তে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)। আমি ঐ বৃক্ষের মালিকানা লাভ করেছি এবং ওটা আপনাকে দিয়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ঐ দরিদ্র লোকটির নিকট গিয়ে বললেনঃ “এই খেজুর গাছ তোমার এবং তোমার সন্তানদের মালিকানাভুক্ত হয়ে গেল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ সম্পর্কেই এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতসমূহ হযরত আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় তিনি বৃদ্ধ ও দুর্বল দাস-দাসীদেরকে মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর আযাদ করে দিতেন। এ ব্যাপারে একবার তাঁর পিতা আবু কাহাফা (তিনি তখনো মুসলমান হননি) বলেনঃ “তুমি দুর্বল ও বৃদ্ধদেরকে মুক্ত করছো, অথচ যদি সকল যুবকদেরকে মুক্ত করতে তবে তারা তোমার কাজে আসততা। তারা তোমাকে সাহায্য করতে পারতো এবং শত্রুদের সাথে লড়াই করতে পারতো।” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন “আব্বাজান! ইহলৌকিক লাভালাভ আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করি।" এরপর এখান হতে সূরা শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।
تَرَدّٰى শব্দের অর্থ হলো মৃত্যুবরণ করা এবং আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া, এই উভয় অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।