আদিয়াত আয়াত ১১
اِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ يَوْمَىِٕذٍ لَّخَبِيْرٌ ࣖ ( العاديات: ١١ )
Inna rabbahum bihim yauma 'izil la khabeer (al-ʿĀdiyāt ১০০:১১)
English Sahih:
Indeed, their Lord with them, that Day, is [fully] Aware. (Al-'Adiyat [100] : 11)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
নিঃসন্দেহে তাদের প্রতিপালক সেদিন তাদের সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত থাকবেন। (আদিয়াত [১০০] : ১১)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
সেদিনে তাদের সম্পর্কে তাদের প্রতিপালক অবশ্যই সবিশেষ অবহিত।[১]
[১] অর্থাৎ, যে প্রভু তাকে কবর থেকে বের করবেন এবং তার অন্তরের রহস্য উদঘাটন করে দেবেন তাঁর ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারে যে, তিনি কত খবর রাখেন? আর তাঁর নিকটে কোন কিছু গোপন থাকতে পারে না। সুতরাং তিনি প্রত্যেককে তার নিজ আমলানুযায়ী ভাল অথবা মন্দ প্রতিফল দেবেন। এটা যেন ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের জন্য সতর্কবাণী, যারা আল্লাহর নিয়ামত দ্বারা উপকৃত তো হয়, কিন্তু তাঁর কৃতজ্ঞতা না করে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। অনুরূপ মাল-ধনের আসক্তিতে বন্দী হয়ে তার সেই হকসমূহ আদায় করে না, যা আল্লাহ অন্যের প্রাপ্য হিসাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
নিশ্চয় তাদের রব সেদিন তাদের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত [১]।
[১] অর্থাৎ তাদের রব তাদের ব্যাপারে অবশ্যই যথেষ্ট অবহিত, তাদের কোন কাজই তার নিকট গোপন নয়। তাদের প্রকাশ্য-অপ্ৰকাশ্য বা গোপন সব কাজ-কর্মই তিনি জানেন। তিনি তাদেরকে এগুলোর উপযুক্ত প্রতিদানও দেবেন। আল্লাহ্ তা‘আলা সবসময়েই তাদের ব্যাপারে জানা সত্ত্বেও এখানে শুধুমাত্র হাশরের দিন তাদের ব্যাপারে অবহিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, এ-দিন তার জ্ঞানের মাধ্যমেই তিনি সকল গোপন প্রকাশ করে দেবেন, কাফেরদের শাস্তি দেবেন, কাজকর্মের প্রতিদান দেবেন। [সা’দী, ফাতহুল কাদীর, আদ্ওয়াউল বায়ান]
3 Tafsir Bayaan Foundation
নিশ্চয় তোমার রব সেদিন তাদের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।
4 Muhiuddin Khan
সেদিন তাদের কি হবে, সে সম্পর্কে তাদের পালনকর্তা সবিশেষ জ্ঞাত।
5 Zohurul Hoque
নিঃসন্দেহ তাদের প্রভু সেইদিন তাদের সন্বন্ধে সবিশেষে অবহিত থাকবেন।
6 Mufti Taqi Usmani
নিশ্চয়ই তাদের প্রতিপালক সে দিন তাদের (যে অবস্থা হবে, সে) সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত।
7 Mujibur Rahman
সেদিন তাদের কি ঘটবে, তাদের রাব্ব অবশ্যই তা সবিশেষ অবহিত।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ:
الْعٰدِيٰتِ হলো عادية এর বহুবচন। এর মূল ধাতু হলো عدو। যেমন غزو ধাতু হতে غازيات শব্দ থেকে এসেছে। মূল শব্দের و কে ى দ্বারা পরির্বতন করা হয়েছে। এর অর্থ : ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্ব বা ঘোড়া। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরায় মানুষের আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও সে ধন-সম্পদের মায়ায় অন্ধ এবং আখিরাতে তার জবাবদিহিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার সূচনাতেই আল্লাহ তা‘আলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ ও মালিকের আনুগত্যশীল অশ্বের শপথ করেছেন যেসব অশ্ব দুঃসাহসিকতার সাথে শত্রুপক্ষের ওপর হামলা করে। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, অবলা চতুষ্পদ জন্তু সর্বদা মালিকের কথা মেনে চলে কিন্তু মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের প্রতি আনুগত্যশীল হয় না।
ضبح শব্দের অর্থ হলো : হাঁপানো, ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ঘোড়া যখন দৌড়ায় তখন যে আওয়াজ করে সে আওয়াজকে ضبح বলা হয়। (ইবনু কাসীর)
উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা সেই ঘোড়ার শপথ করেছেন যে ঘোড়া দৌড়ে গিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ করে।
الْمُوْرِيٰتِ শব্দটির উৎপত্তি ايراء থেকে, অর্থ : অগ্নি প্রজ্জ্বলনকারী। قدح শব্দের অর্থ : চলাচল কালে হাঁটু বা গোড়ালির সংঘর্ষ হওয়া অথবা ক্ষুর দ্বারা আঘাত করা। অর্থ হলো : সে ঘোড়ার শপথ, যার ক্ষুরের ঘর্ষণে পাথর থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়।
الْمُغِيْرٰتِ শব্দটি يغير-أغار থেকে এসেছে, অর্থ হলো : হামলা করা। صبح অর্থ : সকাল, প্রভাত। অর্থ হলো : সকালে আক্রমণকারী ঘোড়ার শপথ। ইসলামে বিধান হলো কোন বসতি বা দেশের মানুষকে সতর্ক করার পরেও ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করলে বা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করলে তাদের ওপর রাতে আক্রমণ করা যাবে না। বরং দেখতে হবে সেখানে ফজরের আযান হয় কিনা, আযান না হলে বিসমিল্লাহ বলে হামলা করবে। আরবরা সাধারণত সকালেই হামলা করত।
أَثَرْنَ শব্দটির মূল ক্রিয়া হলো : أثار। অর্থ হলো : উৎক্ষিপ্ত করা, অবশিষ্ট অংশ। نفع শব্দের অর্থ : ধূলোবালি। অর্থাৎ যখন দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটে যায় অথবা হামলা করে তখন সে স্থান ধূলোবালিতে একাকার হয়ে যায়।
وسطن শব্দটি وسط থেকে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ : মাঝে, মধ্যে। جَمْعًا একত্র করা এখানে উদ্দেশ্য সেনা দলের সমষ্টি। অর্থাৎ যে ঘোড়াসমূহ সৈন্যদলের মাঝে প্রবেশ করে হামলা করে।
لَكَنُوْدٌ পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা যে শপথ করেছেন এ আয়াত হতে তার জবাব শুরু। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা প্রাগুক্ত বিষয়গুলোর শপথ করে বলছেন : নিশ্চয়ই মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। ফলে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অবাধ্য হওয়াটাই যেন মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوْعًا إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوْعًا وَّإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوْعًا)
“নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থিরমনারূপে; যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় অতি কৃপণ; (সূরা মা‘আরিজ ৭০: ১৯-২১) অতএব আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া এক বড় ধরণের গুনাহ। এ থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
(وَإِنَّه عَلٰي ذٰلِكَ لَشَهِيْدٌ)
অর্থাৎ মানুষ তার অকৃতজ্ঞতার ব্যাপারে নিজেই সাক্ষ্য দেয়। অনেকে এখানে إِنَّه দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বুঝিয়েছেন, কিন্তু প্রথমটাই সঠিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَّوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ )
“যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের চরণ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে” (সূরা নূর ২৪: ২৪)
خَيْرِ দ্বারা ধন-সম্পদ উদ্দেশ্য। যেমন সূরা বাক্বারাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(کُتِبَ عَلَیْکُمْ اِذَا حَضَرَ اَحَدَکُمُ الْمَوْتُ اِنْ تَرَکَ خَیْرَاﺊ اۨلْوَصِیَّةُ لِلْوَالِدَیْنِ وَالْاَقْرَبِیْنَ بِالْمَعْرُوْفِﺆ حَقًّا عَلَی الْمُتَّقِیْنَ)
“তোমাদের ওপর এ বিধান দেয়া হল যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় সে যদি কোনো ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তাহলে সে যেন ইনসাফের ভিত্তিতে মাতা-পিতা ও আত্মীয়দের জন্য অসিয়ত করে যায়। মুত্তাক্বীদের জন্য এটা কর্তব্য।” (সূরা বাক্বারাহ ২: ১৮০)
মূলত এখানে মানুষের সম্পদের প্রতি এ আসক্তিকে নিন্দা জানানো হয়েছে।
(أَفَلَا يَعْلَمُ إِذَا بُعْثِرَ مَا فِي الْقُبُوْرِ)
অর্থাৎ মানুষ কি দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, কবরে যা আছে তথা মানুষকে হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত হতে হবে? বরং প্রত্যেক আত্মাকে পুনরুত্থিত হতে হবে। এতে কোন সংশয় নেই।
حُصِّلَ অর্থ হলো: অন্তরে যা কিছু গোপন আছে তা প্রকাশ করে দেয়া হবে। এখানে সবাইকে অন্তরের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বিশেষ করে মুনাফিকদেরকে, কারণ তারা দুনিয়াতে মু’মিনদের মতই আচরণ প্রকাশ করে থাকে। ফলে প্রকৃত সত্য বা অবস্থা জানা যায় না। তাই আল্লাহ তা‘আলা মনের কথা প্রকাশ করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরবেন।
(إِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ)
অর্থাৎ মানুষ প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যা কিছু করে সব কিছু সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবগত। তিনি তাদের ভাল মন্দ কর্মের পুরোপুরি প্রতিদান প্রদান করবেন। সূরায় জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা ও জিহাদের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করার প্রতিও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জিহাদ ও তার সরঞ্জামাদী তৈরি করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
২. মানুষের চিরন্তন স্বভাব, তারা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়।
৩. অধিকাংশ মানুষই পার্থিব সম্পদের প্রতি মোহিত।
9 Fozlur Rahman
তাদের প্রভু তাদের সেদিনের অবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই অবগত রয়েছেন।
10 Mokhtasar Bangla
১১. তাদের প্রতিপালক এ দিবসে তাদের ব্যাপারে অবশ্যই পরিজ্ঞাত। তাঁর নিকট তাঁর বান্দাদের কোন বিষয়ই গোপন নয়। তিনি অচিরেই এগুলোর প্রতিদান দিবেন।
11 Tafsir Ibn Kathir
১-১১ নং আয়াতের তাফসীর
মুজাহিদের ঘোড়া যখন আল্লাহর পথে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এবং হ্রেষাধ্বনি দিতে দিতে দৌড়ায়, আল্লাহ তা'আলা ঐ ঘোড়ার শপথ করছেন। তারপর শপথ করছেন, ঐ ঘোড়াসমূহের যারা পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত করতে থাকে। তারপর প্রভাতকালে অভিযান শুরু করে। অনন্তর ধুলি উড়ায়, তারপর শত্রুদলে ঢুকে পড়ে।
রাসূলুল্লাহর (সঃ) পবিত্র অভ্যাস ছিল এই যে, তিনি শত্রু বেষ্টিত কোন জনপদে গমন করলে সেখানে রাত্রে অবস্থান করে আযানের শব্দ কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করতেন। আযানের শব্দ কানে এলে তিনি থেমে যেতেন, আর তা কানে না এলে তিনি সঙ্গীয় সৈন্যদেরকে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিতেন।
অতঃপর সেই ঘোড়াসমূহের ধুলি উড়ানো এবং শত্রু দলের মধ্যে প্রবেশকরণের শপথ করে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা প্রকৃত প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, اَلْعَادِيَات এর অর্থ হলো উট। হযরত আলী (রাঃ) এ কথাই বলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ শব্দের অর্থ হলো ঘোড়া। হযরত আলী (রাঃ) এটা শোনার পর বলেনঃ “বদরের দিন আমাদের সাথে ঘোড়া ছিল কোথায়? ঘোড়া তো ছিল সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে যা শত্রুদের খবরের জন্যে বা ছোট খাট ব্যাপারে পাঠানো হয়েছে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) একদা হাতিমে বসেছিলেন এমন সময় একজন লোকে এসে তাঁর কাছে এ আয়াতের তাফসীর জানতে চাইলো। তিনি লোকটিকে বললেনঃ “এর অর্থ হলোঃ মুজাহিদদের ঘোড়াসমূহ, যেগুলো যুদ্ধের সময় শক্রদের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। তারপর রাত্রিকালে সেই ঘোড়ার আরোহী মুজাহিদ নিজের শিবিরে এসে খাবার রান্নার জন্যে আগুন জ্বালিয়ে বসে।” লোকটি এ জবাব শুনে হযরত আলীর (রাঃ) কাছে গেল। হযরত আলী (রাঃ) ঐ সময় জনগণকে যমযমের পানি পান করাচ্ছিলেন। লোকটি হযরত আলী (রাঃ)-এর কাছেও একই প্রশ্ন করলো। হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ “আমার পূর্বে তুমি এটা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করেছো কি?” জবাবে লোকটি বললেনঃ “হ্যা, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন যে, এর অর্থ হলোঃ মুজাহিদদের ঘোড়া, যেগুলো যুদ্ধের সময় শত্রুদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে ধাবিত হয়।" হযরত আলী (রাঃ) তখন লোকটিকে বললেনঃ “যাও, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এলে হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ তুমি না জেনে মানুষকে ফতোয়া দিচ্ছ? আল্লাহর কসম! ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমাদের। সাথে মাত্র দুটি ঘোড়া ছিল। একটি হ্যরত যুবায়ের (রাঃ)-এর এবং অন্যটি হযরত মিকদাদ (রাঃ)-এর। কাজেই عادِياتِ ضَبْحًا এ যুদ্ধ হতে পারে কি করে? এখানে আরাফাত থেকে মুযদালাফার দিকে যাওয়া এবং মুযদালাফা থেকে মিনার দিকে যাওয়ার কথাই বুঝানো হয়েছে।” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন “এ কথা শুনে আমি আমার প্রথম কথা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। হযরত আলী (রাঃ) যা বলেছেন সেটাই আমিও বলতে শুরু করেছি।” মুযদালাফায় পৌঁছে হাজীরাও নিজেদের হাঁড়িতে রুটি তৈরীর জন্যে আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। মোটকথা হযরত আলী (রাঃ)-এর বক্তব্য হলো:عادِياتِ ضَبْحًا দ্বারা উটকে বুঝানো হয়েছে। ইব্রাহীম (রঃ), উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও একথাই বলেছেন। পক্ষান্তরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত আতা (রঃ) এবং হযরত যহহাক (রঃ) বলেছেন যে, এখানে ঘোড়াকেই বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন। উপরন্ত হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), এবং হযরত আতা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ضَبْح অর্থাৎ হাঁপাননা, ঘোড়ার ও কুকুর ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, হাঁপানোর সময় তাদের মুখ থেকে যে উহ্ উহ্ শব্দ বের হয় ওটাকেই ضَبْح বলে।
পরবর্তী আয়াতের অর্থ হলো ঐ সব ঘোড়ার পা পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়া। অন্য একটি অর্থ হচ্ছেঃ ঐ ঘোড়ার আরোহীর যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা। আবার যুদ্ধের সময় ধােকা বা প্রতারণা অর্থেও এটা ব্যবহৃত হয়েছে। কারো কারো মতে এর অর্থ হলোঃ রাত্রিকালে নিজেদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে আগুন জ্বালানো এবং মুযদালাফায় হাজীদের মাগরিবের পর পৌঁছে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ আমার মতে সবচেয়ে নির্ভুল এবং যথার্থ বক্তব্য হলোঃ ঘোড়ার পা এবং ক্ষুরের পাথরের সাথে ঘর্ষণ লেগে আগুন সৃষ্টি করা। তারপর সকাল বেলায় মুজাহিদদের শত্রুদের উপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। যারা এ শব্দের অর্থ উট বলেছেন তারা বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ সকাল বেলায় মুযদালাফা হতে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। তারপর সবাই একটা কথার উপর একমত যে, যেই স্থানে তারা অবতরণ করেছেন, যুদ্ধের জন্যেই হোক অথবা হজ্বের জন্যেই হোক, তারা ধূলি উড়িয়ে পৌঁছেছেন। তারপর মুজাহিদীনের শত্রু শিবিরে পৌঁছে যাওয়া। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, সবাই একত্রিত হয়ে মধ্যবর্তী স্থানে হাযির হওয়া।
এ ব্যাপারে আবু বকর বাযযার (রঃ) একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উসূলে হাদীসের পরিভাষায় হাদীসটিকে গারীব বা দুর্বল বলা হয়েছে। ঐ হাদীসটিতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি সৈন্যদল পাঠান। কিন্তু একমাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের কোন খবর আসেনি। এই সময়ে এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। এতে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ঐ মুজাহিদদের কথা বলা হয়েছে যাদের ঘোড়া হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছে। তাদের পদাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়েছে। সকাল বেলা তারা শত্রুদলের উপর পূর্ণ বিক্রমের সাথে আক্রমণ করেছে। তাদের ক্ষুর থেকে ধূলি উড়ছিল। তারপর তারা জয়লাভ করতঃ সবাই একত্রিত হয়ে অবস্থান করেছে।
এসব শপথের পর এবার যে উদ্দেশ্যে শপথ করা হয়েছে আল্লাহ সে সব ব্যক্ত করছেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ এবং সে এটা নিজেও জানে। কোন দুঃখ কষ্ট ভোগ করলে সে দিব্যি মনে রাখে, কিন্তু আল্লাহ তা'আলার বেহিসাব নিয়ামতের কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে একটি হাদীস রয়েছে যে, كَنُوْد তাকে বলা হয় যে একাকী খায়, ভৃত্যদেরকে প্রহার করে এবং কারো সাথে ভাল ব্যবহার করে না। তবে এ হাদীসের সনদ উসূলে হাদীসের পরিভাষায় দুর্বল ।
এরপর আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ আল্লাহ্ অবশ্যই সেটা অবহিত আছেন। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, এটা সে নিজেও অবহিত আছে। তার অকৃতজ্ঞতা কথা ও কাজে প্রকাশ পায়। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِیْنَ اَنْ یَّعْمُرُوْا مَسٰجِدَ اللّٰهِ شٰهِدِیْنَ عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ
অর্থাৎ “মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী স্বীকার করে তখন তারা আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন হতে পারে না।” (৯:১৭)।
অতঃপর আল্লাহপাক বলেনঃ অবশ্যই সে ধন সম্পদের আসক্তিতে প্রবল। তার কি ঐ সময়টির কথা জানা নেই যখন কবরে যা আছে তা উথিত হবে? অর্থাৎ তার ধন সম্পদের মোহ খুব বেশী! সেই মোহে পড়ে সে আমার পথে আসতে অনীহা প্রকাশ করে। পরকালের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ সমাধিস্থ মৃতদেরকে যখন জীবিত করা হবে তখনকার কথা কি তার জানা নেই? যা অন্তরসমূহে আছে তা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। নিঃসন্দেহে তাদের প্রতিপালক তাদের অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সমস্ত আমলের পূর্ণ প্রতিদান তাদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রদান করবেন। এক বিন্দু পরিমাণও জুলুম বা অবিচার করা হবে না। সকলেরই প্রাপ্যের ব্যাপারে তিনি সুবিচারের পরিচয় দিবেন।