১১-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে ইউসুফ (عليه السلام)-এর এগার ভাই তাঁর ক্ষতিসাধন করার জন্য যে মিথ্যা কাহিনী তাঁর পিতার নিকট বানিয়ে বলেছিল সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
ইউসুফ (عليه السلام) এর দশ বৈমাত্রেয় ভাই তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ইউসুফ (عليه السلام)-কে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিল। তারা একদিন পিতা ইয়া‘কূব (عليه السلام) এর কাছে এসে ইউসুফকে সাথে নিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আনন্দ ভ্রমণে যাবার প্রস্তাব পেশ করল। তারা পিতাকে বলল, আগামীকাল আপনি ইউসুফকে আমাদের সাথে মাঠে যেতে দিন। সেখানে সবার সাথে সে ফল-মূল খাবে, খেলা-ধূলা করবে এবং আনন্দ-উল্লাস করবে। আমরা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করব। তাদের কথার উত্তরে ইয়া‘কূব (عليه السلام) বললেন, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে, আমি দুশ্চিন্তায় থাকব আর আমার ভয় হয় যে, তোমরা তাঁকে রেখে খেলা-ধূলা করতে যাবে তখন নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে। তারা বলল, আমাদের সাথে ইউসুফকে পাঠাতে আপনি নিরাপদ মনে করছেন না কেন? ইউসুফের ব্যাপারে আপনি কি আমাদের প্রতি অবিশ্বাস করছেন? অথচ আমরা তাঁর ভাই; আমরা তাঁর কল্যাণকামী। আমরা এতগুলো ভাই থাকতে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে তাহলে তো আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব। উল্লেখ্য যে, কেন‘আন অঞ্চলে সে সময়ে বাঘের আক্রমণের ভয় বেশি ছিল। তাছাড়াও ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইয়া‘কূব (عليه السلام) পূর্বরাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি পাহাড়ের ওপরে আছেন আর নীচে ইউসুফ (عليه السلام) খেলা করছে। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তন্মধ্যে একটি বাঘ এসে তাকে মুক্ত করে দেয়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: উক্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইয়া‘কূব (عليه السلام) তার দশ পুত্রকেই বাঘ গণ্য করেছিলেন (কুরতুবী)। তখন তারা ছলে বলে কৌশলে পিতাকে এসব কথা বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল এবং ছেলেদের পীড়াপীড়িতে এক পর্যায় তিনি রাযী হলেন। কিন্তু তাদের থেকে অঙ্গীকার নিলেন যাতে তারা ইউসুফের কোনরূপ কষ্ট না দেয় এবং সর্বদা তার প্রতি খেয়াল রাখে। অতঃপর যখন ইউসুফ (عليه السلام) কে তাদের সাথে নিয়ে যেতে সক্ষম হল তখন তারা তাদের সিদ্ধান্ত অনুপাতে ইউসুফ (عليه السلام) কে কূপে নিক্ষেপ করল। আর এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি ওয়াহী করলেন যে, তুমি ঘাবড়ে যেও না; আমি তোমাকে সংরক্ষণ তো করবই বরং তোমাকে এমন মর্যাদার অধিকারী বানাব যে, তোমার ভাইয়েরা তোমার নিকট সাহায্যের জন্য আসবে। তখন তুমি তাদেরকে এই কর্মের কথা বলে দেবে আর তারা তোমাকে চিনতে পারবে না। যেমন অত্র সূরার ৮৯ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে এবং ৫৮ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে যে, যখন দুর্ভিক্ষের সময় তারা মিসরে যায় ইউসুফ (عليه السلام) তাদেরকে চিনতে পারেন কিন্তু তারা ইউসুফ (عليه السلام) কে চিনতে পারেনি।
(وَأَوْحَيْنَآ إِلَيْهِ) ‘আমি তাকে ওয়াহী করলাম’ যদিও ইউসুফ (عليه السلام) তখন ছোট কিন্তু যাকে আল্লাহ তা‘আলা নবুওয়াত দেবেন তাদের অনেককে শৈশবেও ওয়াহী প্রেরণ করেন। তবে এ ওয়াহী নবুওয়াতী ওয়াহী ছিল না। কেননা সাধারণতঃ চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে নাবী করেন না। এ ওয়াহী ছিল সেরূপ, যেরূপ ওয়াহী বা ইলহাম এসেছিল শিশু মূসার মায়ের কাছে এবং ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর কাছে। ইমাম কুরতুবী বলেন: কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই অথবা পরে ইউসুফকে সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদস্বরূপ এ ওয়াহী নাযিল হয়েছিল।
পিতার নিকটে ভাইদের কৈফিয়ত:
ইউসুফ (عليه السلام)-কে অন্ধকূপে ফেলে দিয়ে একটা ছাগলছানা জবেহ করে তার রক্ত ইউসুফ (عليه السلام) এর পরিত্যক্ত জামায় মেখে তারা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল এবং কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে হাযির হয়ে কৈফিয়ত পেশ করে বলল: হে আমাদের পিতা! আমরা যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় মত্ত ছিলাম এমতাবস্থায় ইউসুফ আমাদের মালপত্রের নিকট ছিল আর তখন নেকড়ে বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলে। আমরা জানি আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না যদিও আমরা সত্যবাদী। প্রমাণস্বরূপ ইউসুফ (عليه السلام) এর রক্তমাখা জামা পেশ করল। কিন্তু তারা এটা বুুঝতে পারেনি যে, বাঘে খেয়ে ফেললে কি জামা অক্ষত থাকে? তাই যখন রক্তমাখা অক্ষত জামা পিতার কাছে নিয়ে আসল তখন ইয়া‘কূব (عليه السلام) বুঝতে পারলেন এটা তাদের সাজানো ঘটনা। প্রকৃত ঘটনা এটা নয়। সুতরাং এখন ধৈর্য ধারণ করা ব্যতীত আর কোন উপায় নেই। আল্লাহ তা‘আলাই এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন। তখন ইয়া‘কূব (عليه السلام) সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করলেন। মদীনার মুনাফিকরা আয়িশাহ কে যখন মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে আয়িশাহ কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন: আল্লাহ তা‘আলার কসম! আমি আমার ও আপনাদের জন্য ইউসুফের বাবার ঐ উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং আমার পক্ষে পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই আমার সাহায্যস্থল। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৫০)
عُصْبَةٌ অর্থাৎ শক্তিশালী দল, سَوَّلَتْ চাকচিক্য করে দেয়া, আকর্ষণীয় করে দেয়া।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদে বিচলিত না হয়ে বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য চাইতে হবে।
২. মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে, মিথ্যার পরিণতি ভয়াবহ।
৩. যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সহযোগিতা করেন।
৪. দৌড়, তীর নিক্ষেপ ও কুস্তী ইসলামে বৈধ খেলা তবে যেন সীমালংঘন না হয়।
৫. কোন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার দিকে সোপর্দ করে দেয়া উচিত।