৭৮-৮১ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতগুলোতে কাফির-মুশরিকদের চক্রান্ত ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করার পর অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে সকলকে সঠিক সময়ে সালাত আদায় করার নির্দেশ প্রদান করছেন সে সাথে সালাতের সময়সীমাও উল্লেখ করে দিয়েছেন।
(لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ) – لِدُلُوْكِ
শব্দের অর্থ ঢলা বা ঢলে পড়া। অর্থাৎ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর সালাত আদায় কর। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যুহর ও আসরের সালাতের ওয়াক্ত। এবং غَسَقِ اللَّيْلِ অর্থ রাতের অন্ধকার অর্থাৎ সূর্যাস্তের পর রাতের অন্ধকার আগমন কালে মাগরিব ও এশার সালাত আদায় কর। আর قُرْاٰنَ الْفَجْرِ বলে ফজরের সালাতের কথা বুঝানো হয়েছে। ফজরের সালাতকে এজন্য কুরআন বলা হয়েছে, কারণ এতে লম্বা কিরাত পাঠ করা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ط إِنَّ الْحَسَنٰتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّاٰتِ ط ذٰلِكَ ذِكْرٰي لِلذّٰكِرِيْنَ)
“তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দু’ প্রান্তে রজনীর কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।” (সূরা হূদ ১১:১১৪)
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা বর্ণনা করেছেন এবং বিশেষ করে ফজরের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা এ সময় ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করার মর্যাদা পঁচিশ গুণ বেশি। আর ফজরের সালাতের সময় দিনের ও রাতের ফেরেশতারা একত্রিত হয়। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে পারে। (সহীহ বুখারী: ৪৭১৭, সহীহ মুসলিম: ৬৪৯)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাহাজ্জুদ বলা হয়, রাতের শেষ প্রহরে ঘুম থেকে উঠে যে সালাত আদায় করা হয়। একে কিয়ামুল লাইলও বলা হয়। রমযান মাসে এ সালাতকেই তারাবীর সালাত বলা হয়।
نَافِلَةً لَّكَ শব্দের অর্থ আপনার জন্য অতিরিক্ত, এখানে نَافِلَةً এর অর্থ নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেন, এটা শুধুমাত্র রাসূলের জন্য অতিরিক্ত ফরয ছিল, অন্য কারো জন্য নয়। এখানে نَافِلَةً শব্দ দ্বারা ফরযকেই বুঝানো হয়েছে।
আর কেউ বলেন, এখানে নফল দ্বারা নফলই বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ অন্য কারো ওপর পাঁচ ওয়াক্ত ছাড়া কোন সালাত ফরয ছিল না। (ইবনে কাসীর ৫ম খণ্ড, পৃ. ১০৮)
তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর প্রথমে রাতের সালাত ফরয ছিল যেমন সূরা মুযযাম্মিলে বলা হয়েছে। তারপর এ আয়াত দ্বারা নফল করে দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো রাতের সালাত ছাড়তেন না। রাতের সালাতের যেমন ফযীলত রয়েছে তেমনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে দায়িত্ব মনে করে তা আদায় করতেন। ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১১৬৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যত্র বলেন: মানুষ যখন ঘুমিয়ে যায় তখন সালাত আদায় কর, নিরাপদে জান্নাতে যাবে। (সহীহ, তিরমিযী হা: ১৮৫৫)
রাতে সালাত আদায় করতে করতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পা মুবারক ফুলে যেত। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার অগ্র-পশ্চাত সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তারপরেও আপনি এত কষ্ট করেন কেন? তিনি বললেন:
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
আমি কি আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না! (সহীহ বুখারী হা: ১১৩০)
(مَقَامًا مَّحْمُوْدًا)
এখানে عَسٰٓي অর্থ নিশ্চিত, অর্থাৎ অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন। এ প্রশংসিত স্থানটি কি তা নিয়ে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে চারটি মত নিয়ে এসেছেন। সঠিক কথা হল কিয়ামতের দিন যখন মানুষ দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করবে কিন্তু তাদের বিচার ফায়সালা শুরু হবে না তখন সকলে মিলে আদম (عليه السلام)-এর আছে যাবে, যাতে তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করে বিচার-ফায়সালার কাজ শুরু করান। এভাবে তারা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসাসহ সকল নাবীদের কাছে যাবে কিন্তু কেউ সুপারিশ করার দুঃসাহস পাবেন না। তখন সকলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসবে, আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। কী চাও? বল, তোমাকে দেয়া হবে। সুপারিশ কর, কবুল করা হবে। তখন সকল মানুষের বিচার ফায়সালা শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এমন একটি স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন যা পাওয়ার জন্য আদম সন্তানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই কামনা করবে। এটাকেই বলা হয় বড় শাফাআত।
(وَقُلْ رَّبِّ أَدْخِلْنِيْ مُدْخَلَ صِدْقٍ)
‘বল: ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সাথে’ কেউ বলেছেন, এটা হিজরতের সময় অবতীর্ণ হয়েছিল। যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মক্কা থেকে বের হওয়ার এবং মদীনাতে প্রবেশ করার সময় উপস্থিত হয়েছিল। কেউ বলেছেন: এর অর্থ হল সত্যের ওপর আমার মৃত্যু দিও এবং সত্যের ওপর আমাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করো। আবার কেউ বলেছেন: সত্যতার সাথে আমাকে কবরে প্রবিষ্ট করো এবং কিয়ামতের দিন সত্যতার সাথে আমাকে কবর থেকে বের করো ইত্যাদি। ইমাম শাওকানী বলেছেন: এটা যেহেতু দু‘আ, বিধায় এর ব্যাপকতায় উল্লিখিত সব কথাই এসে যায়।
الْحَقُّ সত্য হল তাওহীদ, সত্য হল ইসলাম এবং সত্য হল আল্লাহ তা‘আলা যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে ওয়াহী করেছেন যা কোন দিন দূরীভূত হওয়ার নয় ও মুছে যাওয়ার নয়। আর মিথ্যা হল শিরক ও ইসলামদ্রোহী যাবতীয় কাজ। সত্যের মুকাবেলায় বাতিল সর্বদা বিপর্যস্ত ও পরাভূত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَي الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُه۫ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ)
“কিন্তু আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার ওপর; ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ“ হয়ে যায়।” (সূরা আম্বিয়া ২১:১৮)
হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় প্রবেশ করেন এমতাবস্থায় যে, তখন কা‘বার চারপাশে তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিল। তখন তিনি তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা সেগুলোকে ভাঙ্গতে লাগলেন এবং এই আয়াতটি পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী: ৪৭২০, সহীহ মুসলিম: ১৭৮১)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এ আয়াতে দলীল রয়েছে যে, যদি কোন এলাকার ওপর মুসলিমরা জয়ী হয়, অথবা তাদের কর্র্তৃত্বে চলে আসে তাহলে তারা সে এলাকার মুশরিকদের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলবে এবং যত ভাস্কর্য রয়েছে ও ইবাদত করা হয় এমন প্রতিমা রয়েছে সব ভেঙ্গে চূরমার করে দেবে। (তাফসীর কুরতুবী)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা জানতে পারলাম।
২. ফজরের সালাতের ফযীলত জানা গেল।
৩. তাহাজ্জুদ সালাত পড়ার ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।
৪. সত্য সর্বদা বিজয়ী হয় এবং মিথ্যা সর্বদা পরাভূত হয়।
৫. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদা জানতে পারলাম।