৫৫-৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:
মানুষের কাছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, ঈমানের পথ ও কুফরীর পথের পার্থক্য নির্ণয়ক হিদায়াত নিয়ে আসার পরেও ঈমান আনে না এবং পূর্বের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে না। কারণ হল তারা সীমালংঘণকারী ও অবাধ্য, তারা বাকীতে বিশ্বাসী নয়। তবে তারা ঈমান আনবে যদি পূর্ববর্তীদের মত তাদের ওপরেও আল্লাহ তা‘আলার সুন্নাত চলে আসে। অর্থাৎ ঈমান না আনার কারণে পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন শাস্তি এসেছিল, শাস্তি দেখে ঈমান এনেছিল, এরাও সে অপেক্ষা করছে। অথবা সরাসরি শাস্তি আসলে ঈমান আনবে কিন্তু তখন ঈমান এনে কোন লাভ হবে না। যেমন শাস্তির কবলে পড়ে ফির‘আউন মুমূর্ষু অবস্থায় ঈমান এনেছিল, কিন্তু তার ঈমান কাজে আসেনি তেমনি মানুষ শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর মুমূর্ষু অবস্থায় ঈমান আনলে তা কাজে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّاٰتِ ج حَتّٰيٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّيْ تُبْتُ الْئٰنَ)
“আর তাদের জন্য কোন তাওবাহ কবূল করা হয় না যারা পাপ কাজ করতেই থাকে এমনকি তাদের নিকট যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে আমি এখন তাওবা করছি।” (সূরা নিসা ৪:১৮)
(مُبَشِّرِيْنَ وَمُنْذِرِيْنَ)
অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূল দুটি জিনিস নিয়ে আগমন করেছেন এক, যারা তার অনুসারী হবে, ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে তাদের জন্য রাসূল জান্নাতের সুসংবাদ দেবেন। আর যারা অবাধ্য হবে ঈমান ও আমলের পরওয়া করবে না তাদের জন্য জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করবেন।
ادحض-يدحض
অর্থ বাতিল করা, ব্যর্থ করা, নস্যাৎ করা। অর্থাৎ কাফিরদের কাছে সত্য আগমন করলে তারা বাতিল কথা-বার্তা ও চিন্তা-চেতনা দিয়ে সত্যকে ব্যর্থ করা ও নস্যাৎ করার জন্য তর্ক-বিতর্ক করতো। আর তারা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন এবং যে বিষয়ে তাদেরকে ভয় দেখানো হত তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রƒপ করতো। যেমন হাজ্জ ও হাজ্জের স্থান আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন, আযান আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন নিদর্শন, এরূপ শরীয়তের সব আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন ও রাসূলরা যেসব বিষয়ে ভয় দেখাতেন তা নিয়ে ঠাট্টা করা যেমন জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছু নেই, কবরের শাস্তি বলতে কিছু নেই, এরূপ গায়েবের সকল কিছু এর মধ্যে শামিল। এ সকল নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে থাকে একমাত্র কাফিররাই। কোন মুসলিম এসব ইসলামের কোন নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করলে তার ঈমান থাকবে না। সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
অতঃপর আল্লাহ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালিমের পরিচয় দিয়ে বলেন: সবচেয়ে বড় জালিম হল তারা যাদেরকে আমাদের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ইতোপূর্বে যে সকল অপরাধ করেছে তা স্মরণই করে না। মূলত এদের অন্তর আল্লাহ তা‘আলা আচ্ছাদিত করে দিয়েছেন এবং কানে পর্দা দিয়েছেন। ফলে তারা সত্য অনুধাবণ করতে পারে না এবং শুনতেও পায় না। তাদেরকে হিদায়াতের দিকে আহ্বান করলে তারা হিদায়াতের দিকে আসবে না।
(لَوْ يُؤَاخِذُهُمْ بِمَا كَسَبُوْا)
অর্থাৎ মানুষ যে অপরাধসমূহ করে থাকে আল্লাহ তা‘আলা যদি দয়াময় না হতেন তাহলে অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতেই তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতেন। যেহেতু বিচার ফায়সালার একটি নির্দিষ্ট সময়ের ওয়াদা দেয়া আছে তাই দিচ্ছেন না। مَوْئِلً শব্দের অর্থ আশ্রয়স্থল।
(وَتِلْكَ الْقُرٰٓي أَهْلَكْنٰهُمْ)
এ থেকে ‘আদ, সামূদ ও শুআইব (عليه السلام)-এর অবাধ্য সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে। যারা হিজাযবাসীদের নিকটে এবং তাদের পথের ধারে আবাদ করত। তাদের জুলুমের কারণে তাদেকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের ওপর শাস্তি আপতিত হওয়ার পূর্বে অনেক সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তারা অবাধ্যতার ওপর বহাল থেকেই গেল। যখন একথা পরিস্কার হয়ে গেল যে, তারা অবাধ্যতা থেকে ঈমানের পথে ফিরে আসবে না তখন শাস্তি দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হল। তাদের ধ্বংসাবশেষ রেখে দেয়া হয়েছে যাতে পৃথিবীর সকল অবাধ্য জাতি তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হতে পারে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অধিকাংশ মানুষ শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনে না, তবে শাস্তি দেখে ঈমান আনলে তা কাজে আসবে না।
২. বাতিল দ্বারা সত্যকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা আল্লাহ তা‘আলার সাথে বিদ্রোহ করার শামিল।
৩. ইসলামের কোন নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা কুফরী কাজ, কেউ তা করলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
৪. যাদের অন্তরকে আল্লাহ কুফরী দ্বারা আচ্ছাদিত করে দিয়েছেন তাদেরকে হিদায়াত দেয়া যাবে না।
৫. পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত যে, কেন তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল।