১৭০ ও ১৭১ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়াহূদীদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন, তার প্রতি উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির ভয় দেখালেন। তখন রাফী বিন হুরাইমালা ও মালিক বিন আউফ দু’জন ইয়াহূদী বলল: আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে যে ধর্মের ওপর পেয়েছি তারই অনুসরণ করব। তারা আমাদের চেয়ে বেশি জানতেন এবং আমাদের চেয়ে ভাল ছিলেন। তখন উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়। (লুুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল, পৃঃ ৩৫)
কাফির-মুশরিকদেরকে যখন বলা হত- আল্লাহ তা‘আলা যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর। তখন তারা বলত- আমরা আমাদের বাপ-দাদার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা-ই অনুসরণ করব।
কুরআনে এরূপ অনেক আয়াত রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, কাফির-মুশরিকদেরকে যখনই ইসলামের দাওয়াত দেয়া হত তখনই তারা এ কথা বলত। যেমন সূরা মায়েদার ১০৪ নং আয়াতে, সূরা লুকমানের ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এমনকি যদি কোন খারাপ কাজ করত তখনও তারা বলত, এটাও আমাদের বাপ-দাদার কাছ থেকে পেয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَآءَنَا)
“যখন তারা কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষকে এটা করতে দেখেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭: ২৮)
এটা যে শুধু তৎকালীন কাফির মুশরিকদের মাঝে ছিল তা নয়, বরং আজও এক শ্রেণির মুসলিম রয়েছে যাদের কাছে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দাওয়াত দেয়া হলে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদারা কি বুঝেনি, তারা কি ভুল করেছেন, তারা কি কম জানতেন? আপনারা এখন নতুন নতুন হাদীস নিয়ে আসছেন।
যারা কাফির ও মুশরিকদের মত বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে নিজেদের মতাদর্শে অটল থাকতে চায় তাদেরকে জানাতে চাই কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর দিকে আসুন। বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে যেমন মক্কার কাফির-মুশরিকরা রেহাই পায়নি, তেমনি যারাই বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে চলবে তাদেরও পরিণতি শুভ হবে না। প্রকৃত পক্ষে এটা কখনও মুসলিমদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
মানুষ যাতে বাপ-দাদার দোহাই না দিতে পারে সেজন্য দুনিয়াতে প্রেরণ করার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছ থেকে শপথ নিয়েছেন। যেমন উল্লেখ করা হয়েছে সূরা আ‘রাফ: ১৭২ ও ১৭৩ নং আয়াতে-
(وَاِذْ اَخَذَ رَبُّکَ مِنْۭ بَنِیْٓ اٰدَمَ مِنْ ظُھُوْرِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَاَشْھَدَھُمْ عَلٰٓی اَنْفُسِھِمْﺆ اَلَسْتُ بِرَبِّکُمْﺚ قَالُوْا بَلٰیﹱ شَھِدْنَاﹱ اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا کُنَّا عَنْ ھٰذَا غٰفِلِیْنَ)
“স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’তারা বলে, ‘হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষী রইলাম।’এটা এজন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, ‘আমরা তো এ বিষয়ে গাফিল ছিলাম।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৭২)
বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে যে পার হওয়া যাবে না, সে কথা এ আয়াতের শেষাংশেই বলে দেয়া হয়েছে-
(أَوَلَوْ كَانَ آبَآؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ)
“অথচ যদিও তাদের পিতৃপুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা হিদায়াত প্রাপ্ত ছিল না। তবুও কি (তারা তাদের অনুসরণ করবে)।”(সূরা বাকারাহ ২:১৭০)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَوَلَوْ كَانَ آبَآؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ)
“যদিও তাদের পূর্বপুরুষগণ কিছুই জানত না এবং সৎ পথপ্রাপ্তও ছিল না, তবুও কি?” (সূরা মায়িদা ৫:১০৪)
তাই সকল মু’মিন-মুসলিমদের উচিত বাপ-দাদার দোহাই বর্জন করে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করা। এর মধ্যে রয়েছে নাজাত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। (আমীন)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা সেসব লোকের দৃষ্টান্ত পেশ করছেন, যারা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করে নিজেদের বিবেক বুদ্ধিকে অকেজো করে রাখে। তারা হল ঐসব পশুর মত যাদেরকে রাখাল ডাকে ও আওয়াজ দেয়, আর তারা সে ডাক ও আওয়াজ শোনে কিন্তু বুঝে না যে তাদেরকে কী জন্য ডাকা হচ্ছে।
যারা অন্ধ অনুসারী তারা বধির, সত্যের ডাক শুনে না, তারা বাকশক্তিহীন, সত্যের কথা মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। তারা অন্ধ, সত্যের পথ দেখতে পায় না। তাই তারা সত্যের দাওয়াত, তাওহীদ ও সুন্নাহ বুঝতে পারে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হক শুধু কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণে। বাপ-দাদার অনুসরণে নয়।
২. পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ নাজাতের কারণ হতে পারে না।
৩. কথায় কথায় পূর্বপুরুষদের দোহাই দেয়া ইয়াহূদী-কাফির-মুশরিকদের স্বভাব।
৪. যারা সত্যবিচ্যুত তাদেরকে সত্যের দাওয়াত দিলেও সত্য জিনিস বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না।