আরবী ভাষাবিদগণ বলেন যে, প্রথম বাক্যটির ভাবার্থ হচ্ছে-হজ্ব হলো ঐ মাসগুলোর হজ্ব যা সুবিদিত ও নির্দিষ্ট। সুতরাং হজ্বের মাসগুলোতে ইহরাম বাঁধা অন্যান্য মাসে ইহরাম বাঁধা হতে বেশী পূর্ণতা প্রদানকারী। তবে অন্যান্য মাসের ইহরামও সঠিক। ইমাম মালিক (রঃ), ইমাম আবু হানীফা (রাঃ), ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম ইবরাহীম নাখঈ (রাঃ), ইমাম সাওরী (রঃ) ও ইমাম লায়েস (রঃ) বলেন যে, বছরের যে কোন মাসে ইহরাম বাঁধা যেতে পারে। তাদের দলীল یَسْـئَـلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ এই আয়াতটি। অর্থাৎ '(হে নবী সঃ!) তারা তোমাকে নব চন্দ্ৰসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে; তুমি বল-এগুলো হচ্ছে জনসমাজের উপকারের জন্যে ও হজ্বের জন্যে সময় নিরূপক। (২:১৮৯) نُسُكٌ তাঁদের দ্বিতীয় দলীল হচ্ছে এই যে, হজ্ব ও উমরাহ এ দু’টোকেই বলা হয়েছে, আর উমরাহর ইহরাম প্রত্যেক মাসেই বাঁধা যায়; সুতরাং হজ্বের ইহরামও প্রত্যেক মাসেই বাঁধা যাবে। তবে হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেন যে, হজ্বের ইহরাম শুধুমাত্র হজ্বের মাসগুলোতেই বাঁধতে হবে এবং অন্যান্য মাসে ইহরাম বাধলৈ তা সঠিক হবে না। কিন্তু ওর দ্বারা উমরাহও হতে পারে কিনা এ সম্বন্ধে তার দুটি উক্তি রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত জাবির (রাঃ), হযরত আতা’ (রঃ) এবং হযরত মুজাহিদেরও (রঃ) এটাই মাযহাব যে, হজ্বের ইহরাম হজের মাস ছাড়া অন্যান্য মাসে বাধা সঠিক নয়। তাদের দলীল হচ্ছে اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمَاتٌ এই আয়াতটি। আরবী ভাষাবিদগণের আর একটি দলের মতে আয়াতটির এই শব্দগুলোর ভাবার্থ এই যে, হজ্বের সময় হচ্ছে নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস। সুতরাং সাব্যস্ত হচ্ছে যে, এই মাসগুলোর পূর্বে ইহরাম বাঁধা ঠিক হবে না। যেমন নামাযের সময়ের পূর্বে কেউ নামায পড়ে নিলে নামায ঠিক হয় না। ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেন, আমাকে মুসলিম বিন খালিদ সংবাদ দিয়েছেন, তিনি ইবনে জুরাইজের নিকট হতে শুনেছেন, তাঁকে উমার বিন আতা’ বলেছেন, তাঁর কাছে ইকরামা বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন যে, হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন কোন ব্যক্তির জন্যে এটা উচিত নয় যে, সে হজ্বের মাসগুলো ছাড়া অন্য মাসে হজ্বের ইহরাম বাঁধে। কেননা, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمَاتٌ অর্থাৎ হজ্বের মাসগুলো সুবিদিত।' এই বর্ণনাটির আরও বহু সনদ রয়েছে। একটি সনদে আছে যে, এটাই সুন্নাত।
সহীহ ইবনে খুজাইমার মধ্যেও এই বর্ণনাটি নকল করা হয়েছে। উসূলের গ্রন্থসমূহেও এই জিজ্ঞাস্য বিষয়টির এভাবে নিস্পত্তি করা হয়েছে যে, এটা সাহাবীর (রাঃ) উক্তি এবং তিনি সেই সাহাবী যিনি কুরআন কারীমের ব্যাখ্যাতা। সুতরাং এ উক্তি যেন রাসূলুল্লাহরই (সঃ) উক্তি। তাছাড়া তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই এর একটি মারফু হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন- হজ্বের মাস ছাড়া অন্য মাসে ইহরাম বাঁধা কারও জন্যে উচিত নয়।' এর ইসনাদও উত্তম। কিন্তু ইমাম শাফিঈ (রঃ) ও ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেন যে, এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হচ্ছেন হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ), তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, হজ্বের মাসগুলোর পূর্বে হজ্বের ইহরাম বাঁধা যেতে পারে কি: তিনি উত্তরে বলেন, 'না।' হাদীসটি মাওকুফ হওয়াই সঠিক কথা। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাসের (রাঃ) সুন্নাত এটাই’-এই উক্তি দ্বারা সাহাবীর (রাঃ) এই ফতওয়ার গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে।
اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمَاتٌ-এর ভাবার্থ হযরত আবদুল্লাহ বিন উমার বর্ণনা করেন, শাওয়াল, যুলকা'দা এবং যিলহজ্ব মাসের দশদিন (সহীহ বুখারী)।' এই বর্ণনাটি তাফসীর-ই-ইবনে জারীর এবং তাফসীর-ই-মুস্তাদরিক-ই-হাকিম এর মধ্যেও রয়েছে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ্ বিন যুবাইর (রাঃ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। হযরত আতা' (রঃ) হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত ইবরাহিম নাখঈ (রঃ), হযরত শা'বী (রঃ), হযরত হাসান বসরী (রঃ), হযরত ইবনে সীরীন (রঃ), হযরত মাকহুল (রঃ), হযরত কাতাদাহ (রঃ), হযরত যহাক বিন মাযাহিম (রঃ), হযরত রাবী' বিন আনাস (রঃ) এবং হযরত কাতাদাহ (রঃ), হযরত যহ্হাক বিন মাযাহিম (রঃ) এবং হযরত মুকাতিল বিন হিব্বানও (রঃ) এ কথাই বলেন। হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ), ইমাম আবু হানীফা (রঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) এবং আবু সাউরেরও (রঃ) মাযহাব এটাই। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেন। اَشْهُرٌ শব্দটি বহুবচন। এর ব্যবহার পূর্ণ দু'মাস এবং তৃতীয় মাসের কিছু অংশের উপরেও হতে পারে। যেমন বলা হয়-“আমি এই বছর বা আজকে তাকে দেখেছি। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে সারা বছর ধরে বা সারা দিন ধরে তো তাকে দেখেনি। বরং দেখার সময় অল্পই হয়ে থাকে। কিন্তু প্রায়ই এ কথাই বলা হয়ে থাকে। এই নিয়মে এখানেও তৃতীয় মাসের উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের মধ্যেও فَمَنْ تَعَجَّلَ فِىْ يَوْمَيْنِ (২:২০৩) রয়েছে। অর্থাৎ যে দু’দিনে তাড়াতাড়ি করে। অথচ ঐ তাড়াতাড়ি দেড় দিনের হয়ে থাকে। কিন্তু গণনায় দু’দিন বলা হয়েছে।' ইমাম মালিক (রঃ) এবং ইমাম শাফিঈর (রঃ) প্রথম উক্তি এটাও রয়েছে যে, শাওয়াল, যুলকা'দা এবং যুলহাজির পুরো মাসই। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। ইবনে শিহাব (রঃ) আতা (রঃ), জাবির বিন আবদুল্লাহ (রঃ), তাউস (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), উরওয়াহ (রঃ), রাবী (রঃ )এবং কাতাদা (রঃ) হতে এটাই বর্ণিত রয়েছে। একটি মারফু হাদীসেও এটা এসেছে। কিন্তু ওটা মাওযূ। কেননা, এর বর্ণনাকারী হচ্ছে হুসাইন বিন মুখারিক, যার উপরে এই দুর্নাম রয়েছে যে, সে হাদীস বানিয়ে থাকে। সুতরাং হাদীসটির মারফু হওয়া সাব্যস্ত হয় না। ইমাম মালিকের (রঃ) এই উক্তিকে মেনে নেয়ার পর এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যুল-হাজ্ব মাসে উমরা করা ঠিক হবে না। এটা ভাবার্থ নয় যে, দশই যুলহাজ্বের পরেও হজ্ব হতে পারে।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হজ্বের মাসগুলোতে উমরা করা ঠিক নয়। ইবনে জারীরও (রঃ) এ উক্তিগুলির এই ভাবার্থই বর্ণনা করেছেন যে, হজের সময় তো মিনার দিন (দশই যিল হজ্ব) অতিক্রান্ত হওয়া মাত্রই শেষ হয়ে যায়। মুহাম্মদ ইবনে সীরীন বর্ণনা করেন-‘আমার জানা মতে এমন কোন আলেম নেই যিনি হজ্বের মাসগুলো ছাড়া অন্যান্য মাসে উমরাহ করাকে এই মাসগুলোর মধ্যে উমরাহ করা অপেক্ষা উত্তম মনে করতে সন্দেহ করে থাকেনঃ কাসিম বিন মুহাম্মদ (রঃ) কে ইবনে আউন হজ্বের মাসগুলিতে উমরাহ করা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন-মনীষীগণ একে পূর্ণ উমরাহ মনে করতেন না।' হযরত উমার (রাঃ) এবং উসমান (রাঃ) হজ্বের মাসগুলো ছাড়া অন্যান্য মাসে উমরাহ করাকে পছন্দ করতেন। এমনকি তারা হজ্বের মাসগুলোতে উমরাহ করতে নিষেধ করতেন। (পূর্ব আয়াতটির তাফসীরে এটা বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুলকা'দা মাসে চারটি উমরাহ আদায় করেছেন। অথচ যুলকা'দা মাসও হচ্ছে হজ্বের মাস। সুতরাং হজ্বের মাসগুলোতে উমরাহ করা জায়েয প্রমাণিত হলো, এ সম্পর্কে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন-অনুবাদক)
অতঃপর ইরশাদ হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি এই মাসগুলোতে হজ্বের সংকল্প করে অর্থাৎ হজ্বের ইহরাম বাঁধে। এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, হজ্বের ইহরাম বাঁধা ও তা পুরো করা অবশ্য কর্তব্য। ফরয’ শব্দের এখানে অর্থ হচ্ছে সংকল্প করা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ওদেরকে বুঝান হয়েছে যারা হজ্ব ও উমরাহর ইহরাম বেঁধেছে। আতা’ (রঃ) বলেন যে, এখানে ফরয’ এর ভাবার্থ হচ্ছে ইহরাম। ইবরাহীম (রঃ) ও যহ্হাক (রঃ)-এরও উক্তি এটাই। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বায়েক' পাঠের পর কোন স্থানে থেমে যাওয়া উচিত নয়। অন্যান্য মনীষীদেরও এটাই উক্তি। কোন কোন মনীষী বলেন যে, ‘ফরয’ শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে ‘লাব্বায়েক' পাঠ।رَفَثٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে সহবাস। যেমন কুরআন কারীমের মধ্যে অন্য জায়গায় রয়েছেঃ اُحِلَّ لَكُمْ لَیْلَةَ الصِّیَامِ الرَّفَثُ اِلٰى نِسَآىٕكُمْ
অর্থাৎ রোযার রাত্রে স্ত্রী সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করা হলো।' (২:১৮৭) ইহরামের অবস্থায় সহবাস এবং ওর পূর্ববর্তী সমস্ত কার্যই হারাম। যেমন প্রেমালাপ করা, চুম্বন দেয়া এবং স্ত্রীদের বিদ্যমানতায় এসব কথা আলোচনা করা। কেউ কেউ পুরুষদের মজলিসেও এসব কথা আলোচনা করাকে رَفَثٌ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এর বিপরীত বর্ণিত হয়েছে। একদা তিনি ইহরামের অবস্থায় এই ধরনেরই একটি কবিতা পাঠ করেন। এ সম্বন্ধে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, স্ত্রী লোকদের সামনে এই প্রকারের কথা বললে رَفَثٌ হয়ে থাকে। رَفَثٌ এর নিম্নতম পর্যায় এই যে, সহবাস প্রভৃতির আলোচনা করা, কটু কথা বলা, ইশারা ইঙ্গিতে সহবাস করা, নিজ স্ত্রীকে বলা যে ইহরাম ভেঙ্গে গেলেই সহবাস করা হবে, আলিঙ্গন করা, চুম্বন দেয়া ইত্যাদি সব কিছুই رَفَثٌ-এর অন্তর্গত। ইহরামের অবস্থায় এসব করা হারাম। বিভিন্ন ব্যাখ্যাতার বিভিন্ন উক্তির সমষ্টি এই।
فُسُوْقٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে অবাধ্য হওয়া, শিকার করা, গালি দেয়া ইত্যাদি। যেমন হাদীস শরীফে রয়েছে যে, মুসলমানকে গালি দেয়া হলো ফিস্ক এবং তাকে হত্যা করা হলো কুফর। আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জন্তু, যবাহ করাও হচ্ছে ফিস্ক। যেমন কুরআন মাজীদের মধ্যে রয়েছেঃ اَوْ فِسْقًا اُهِلَّ لِغَیْرِ اللّٰهِ بِهٖ অর্থাৎ ‘অথবা ফিস্ক যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবাহ করা হয়েছে।' (৬:১৪৫) খারাপ উপাধি দ্বারা ডাক দেয়াও ফিস্ক। যেমন কুরআন পাকে ঘোষিত হয়েছে।وَلَاتَنَابَزُوْا بِالْاَلْقَابِ অর্থাৎ “তোমরা অন্যকে কলংক যুক্ত উপাধিতে সম্বোধন করো না।' (৪৯:১১) সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, আল্লাহ তা'আলার প্রত্যেক অবাধ্যতাই ফিকের অন্তর্গত। এটা সর্বদাই অবৈধ বটে; কিন্তু সম্মানিত মাসগুলিতে এর অবৈধতা আরও বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ অর্থাৎ ‘তোমরা এই সম্মানিত মাসগুলোতে তোমাদের আত্মার উপর অত্যাচার করো না।' (৯:৩৬) অনুরূপভাবে হারাম শরীফের মধ্যে এর অবৈধতা বৃদ্ধি পায়। যেমন ইরশাদ হচ্ছে, وَ مَنْ یُّرِدْ فِیْهِ بِاِلْحَادٍۭ بِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ اَلِیْمٍ অর্থাৎ ‘হারামের মধ্যে যে ব্যক্তি ধর্মদ্রোহীতার ইচ্ছে করবে, তাকে আমি বেদনাদায়ক শাস্তি দেবো।' (২২:২৫) ইমাম ইবনে
জারীর (রঃ) বলেন যে, এখানে ‘ফিক’ এর ভাবার্থ হচ্ছে ঐ কাজ যা ইহরামের অবস্থায় নিষিদ্ধ। যেমন শিকার করা, মস্তক মুণ্ডন করা বা ঘেঁটে দেয়া এবং নখ কাটা ইত্যাদি। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। কিন্তু সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হচ্ছে ওটাই যা আমরা বর্ণনা করেছি। অর্থাৎ প্রত্যেক পাপের কাজ হতে বিরত রাখা হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে-যে ব্যক্তি এই বায়তুল্লাহর হজ্ব করে সে যেন ‘রাফাস’ এবং ‘ ফিক’ না করে, তবে সে পাপ হতে এমনই মুক্ত হয়ে যাবে যেমন তার জন্মের দিন ছিল।
এর পরে ইরশাদ হচ্ছে-হজ্বে কলহ নেই।' অর্থাৎ হজ্বের সময় এবং হজ্বের আরকান ইত্যাদির মধ্যে তোমরা কলহ করো না। এর পূর্ণ বর্ণনা আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন যে, হজ্বের মাসগুলো নির্ধারিত রয়েছে। সুতরাং তাতে কম-বেশী করা চলবে না এবং পূর্বেও পরেও করা চলবে না। মুশরিকরা এরূপ করে থাকতো। কুরআন মাজীদের মধ্যে অন্য জায়গায় এর নিন্দে করা হয়েছে। অনুরূপভাবে কুরাইশরা মাশআর-ই-হারামের পাশে মুযদালিফায় অবস্থান করতো এবং আরবের বাকি লোক আরাফায় অবস্থান করতো। অতঃপর তারা পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়তো এবং একে অপরকে বলতো, আমরা সঠিক পথের উপর এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর পথের উপর রয়েছি। এখানে এটা হতে নিষেধ করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীর (সঃ) মাধ্যমে হজ্বের সময়, আরকান ও আহকাম এবং অবস্থানের স্থান ইত্যাদি সব কিছু বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এখন আর কেউ অপরের উপর কোন গৌরব প্রকাশ করতে পারবে না বা হজ্বের দিন পরিবর্তন করতে পারবে না। কাজেই সকলকেই এখন কলহ-বিবাদ হতে বিরত থাকতে হবে। ভাবার্থ এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমরা হজ্বের সফরে পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করো না, একে অপরকে রাগান্বিত করো না এবং কেউ কাউকেও গালি দিয়ো না। বহু মুফাসসিরের এই উক্তিও রয়েছে, আবার অনেকের পূর্বের উক্তিও রয়েছে। হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন, কারও নিজের দাসকে শাসন গর্জন করা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে মারতে পারে না। কিন্তু আমি বলি যে, যদি নিজের ক্রীতদাসকে মেরেও দেয় তবুও কোন দোষ নেই। এর প্রমাণ মুসনাদ-ই -আহমাদের নিম্নের এই হাদীসটি-হযরত আবু বকরের (রাঃ) কন্যা হযরত আসমা (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হজ্বের সফরে ছিলাম। আমরা ‘আরায’ নামক স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলাম। হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পাশে বসেছিলেন এবং আমি আমার জনক হযরত আবু বকরের (রাঃ) নিকটে বসেছিলাম। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উটের আসবাবপত্র হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পরিচারকের নিকট ছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) তার অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর সে এসে পড়ে। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, উট কোথায়: সে বলে, ‘গত রাত্রে উটটি হারিয়ে গেছে। হযরত আবু বকর (রাঃ) এতে অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন একটি মাত্র উট তুমি দেখতে পারলে না, হারিয়ে দিলে:' একথা বলে তিনি তাকে প্রহার করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন মুচকি হেসে বলেন, ‘তোমরা দেখ, তিনি ইহরামের অবস্থায় কি কাজ করছেন: এই হাদীসটি সুনান-ই-আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ্নর মধ্যেও রয়েছে। পূর্ববর্তী কোন একজন মনীষী হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, এই প্রহার ছিল হজ্ব শেষ হওয়ার পর। কিন্তু এটাও স্মরণীয় বিষয় যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহর (সঃ) “দেখ, তিনি ইহরামের অবস্থায় কি করছেন!’-একথা বলার মধ্যে খুবই সূক্ষ্ম অস্বীকৃতি। রয়েছে এবং এর মধ্যে এইভাব নিহিত রয়েছে যে, তাকে ছেড়ে দেয়াই উত্তম ছিল।
তাফসীর-ই-মুসনাদ-ই-আবদ বিন হামীদের মধ্যে একটি হাদীস রয়েছে, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি এরূপ অবস্থায় হজ্ব পূর্ণ করলো যে, কোন মুসলমান তার হাতের দ্বারা এবং মুখের দ্বারা কষ্ট পেলো না, তার পূর্বের সমস্ত পাপ মোচন হয়ে গেলো। অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন-“তোমরা যে কোন সকার্য কর না কেন আল্লাহ তা অবগত আছেন। উপরে যেহেতু অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে বাধা দেয়া হয়েছে, কাজেই এখানে পুণ্যের কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন প্রতিটি সত্ত্বার্যের পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে ।
আল্লাহ তা'আলা বলেন-“তোমরা হজ্বের সফরে নিজেদের সাথে পাথেয় নিয়ে যাও। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, জনগণ পাথেয় ছাড়াই হজ্বের সফরে বেরিয়ে পড়তো। পরে তারা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়াতো। এজন্যেই এই নিদের্শ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পাথেয় সাথে নিয়ে যায়। হযরত ইকরামা (রাঃ) এবং হযরত উয়াইনাও (রঃ) একথাই বলেন। সহীহ্ বুখারী, সুনান -ই-নাসাঈ প্রভৃতির মধ্যেও এই বর্ণনাগুলো রয়েছে। একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, ইয়ামনবাসীরা এরূপ করতো এবং বলতো-‘আমরা আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরশীল।' হযরত আবদুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) হতে এও বর্ণিত আছে যে, যখন তারা ইহরাম বাঁধতো তখন তাদের কাছে যে পাথেয় থাকতো তা তারা ফেলে দিতে এবং পুনরায় নতুনভাবে পাথেয় গ্রহণ করতো। এজন্যেই তাদের উপর এই নির্দেশ হয় যে, তারা যেন এরূপ না করে এবং আটা, ছাতু ইত্যাদি। খাদ্য যেন পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে। অন্যান্য আরও বহু বিশ্বস্ত মুফাসপ্রিও এরকমই বলেছেন। এমনকি হযরত ইবনে উমার (রাঃ) তো একথাও বলেছেন যে, সফরে উত্তম পাথেয় রাখার মধ্যেই মানুষের মর্যাদা নিহিত রয়েছে। সাথীদের প্রতি মন খুলে খরচ করারও তিনি শর্ত আরোপ করতেন। ইহলৌকিক পাথেয়ের বর্ণনার সাথে আল্লাহ তা'আলা পারলৌকিক পাথেয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থাৎ বান্দী যেন তার কবর রূপ সফরে আল্লাহ তা'আলার ভয়কে পাথেয় হিসেবে সাথে নিয়ে যায়। যেমন অন্য স্থানে পোষাকের বর্ণনা দিয়ে বলেন وَلِبَاسُ التَّقْوٰى ذٰلِكَ خَيْرٌ অর্থাৎ এবং খোদা -ভীরুতার পোষাকই হচ্ছে উত্তম।' (৭:২৬) অর্থাৎ বান্দা যেন বিনয়, নম্রতা, আনুগত্য এবং খোদা-ভীরুতার গোপনীয় পোষাক হতে শূন্য না থাকে। এমনকি এই গোপনীয় পোষাক বাহ্যিক পোষাক হতে বহু গুণে শ্রেয়।
একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় পাথেয় গ্রহণ করে তা আখেরাতে তার উপকারে আসবে (তাবরানীর হাদীস)। এ নির্দেশ শুনে একজন দরিদ্র সাহাবী (রাঃ) বলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার নিকট তো কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, এতটুকু তো রয়েছে যে, তোমাকে কারও কাছে ভিক্ষে করতে হয় না এবং উত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়।' (তাফসীর ই- ইবনে-আবি হাতিম)।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'হে জ্ঞানবানগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর।' অর্থাৎ আমার শাস্তি ও পাকড়াওকে ভয় করতঃ তোমরা আমার নির্দেশকে অমান্য করো না তা হলেই মুক্তি পেয়ে যাবে এবং এটাই হবে জ্ঞানের পরিচায়ক।