২৭০-২৭১ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি প্রত্যেকটি দান, প্রতিজ্ঞা (নর) ও ভাল কাজের খবর রাখেন। তাঁর যেসব বান্দা তাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলে, স্বীয় সত্ত্বার্যের পুণ্যের প্রতি আশা রাখে, তার ওয়াদার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখে, তাদেরকে তিনি উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন। পক্ষান্তরে যারা তার আদেশ ও নিষেধ অমান্য করবে, তার সাথে অন্যদেরও উপাসনা করবে তারা অত্যাচারী। কিয়ামতের দিন তাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হবে এবং সেই দিন এমন কেউ থাকবে না যে তাদেরকে ঐ শাস্তি হতে মুক্তি দিতে পারে বা কোন সাহায্য করতে পারে। তারপরে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ ‘প্রকাশ্যভাবে দান করাও ভাল এবং গোপনে দরিদ্র ও মিসকীনদেরকে দেয়াও উত্তম। কেননা, গোপন দানে রিয়াকারী বহু দূরে সরে থাকে। তবে যদি প্রকাশ্য দানের ব্যাপারে দাতার মহৎ কোন উদ্দেশ্য থাকে তবে সেটা অন্য কথা। যেমন তার উদ্দেশ্য এই যে, তার দেখাদেখি অন্যরাও দান করবে ইত্যাদি। হাদীস শরীফে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘প্রকাশ্যদানকারী উচ্চ শব্দে কুরআন পাঠকের ন্যায় এবং গোপনে দানকারী ধীরে ধীরে কুরআন পাঠকের ন্যায়। কুরআন মাজীদের এই আয়াত দ্বারা গোপন দানের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হচ্ছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা সাত প্রকারের লোককে তার ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন, যেই দিন তার ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। (১) ন্যায় বিচারক বাদশাহ। (২) সেই নব-যুবক যে তার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করেছে। (৩) ঐ দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্যই পরস্পর ভালবাসা রেখেছে, ঐ জন্যেই তারা একত্রিত থাকে এবং ঐ জন্যেই পৃথক হয় (৪) ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ হতে বের হওয়া থেকে নিয়ে পুনরায় ফিরে আসা পর্যন্ত মসজিদের সাথে সংলগ্ন থাকে। (৫) ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকির করে, অতঃপর তার নয়নযুগল হতে অশ্রুধারা নেমে আসে (৬) ঐ ব্যক্তি যাকে একজন বংশ মর্যাদা ও সৌন্দর্যের অধিকারিণী নারী (নির্লজ্জতার কাজে) আহবান করে, তখন সে বলে নিশ্চয় আমি সারা জগতের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি ।(৭) ঐ ব্যক্তি যে এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানতে পারে না।' মুসনাদ-ইআহমাদে হাদীস রয়েছে যে, যখন আল্লাহ তা'আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন তখন পৃথিবী দুলতে আরম্ভ করে। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা পর্বত সৃষ্টি করে পৃথিবীর মধ্যে গেড়ে দেন। ফলে পৃথিবীর কম্পন থেমে যায়। আল্লাহ তাআলা পর্বতরাজিকে এত শক্ত করে সৃষ্টি করেছেন দেখে ফেরেশতাগণ আল্লাহ তাআলাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহ! আপনার সষ্ট বস্তসমূহের মধ্যে পর্বত অপেক্ষা শক্ত আর কিছু আছে কি: আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হ্যা লৌহ রয়েছে, ওর চেয়ে শক্ত হচ্ছে অগ্নি ওর চেয়ে শক্ত পানি, ওর চেয়ে শক্ত বাতাস। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করেনঃ হে আল্লাহ! বাতাস অপেক্ষা শক্ত অন্য কিছু আছে কি: আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হ্যা, সেই আদম সন্তান যে এমন গোপনে দান করে যে, তার দক্ষিণ হস্ত যা খরচ করে বাম হস্ত তা জানতে পারে না।' আয়াতুল কুরসীর তাফসীরে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, উত্তম দান হচ্ছে ওটাই যা গোপনে কোন অভাবগ্রস্তকে দেয়া হয় এবং মালের স্বল্পতা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে খরচ করা হয়। অতঃপর তিনি এই আয়াতটিই পাঠ করেন। (ইবনে আবি হাতিম)। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘গোপন দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে। হযরত শা'বী (রঃ) বলেন যে, : এই আয়াতটি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং হযরত উমার ফারূক (রাঃ)-এর সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়। হযরত উমার (রাঃ) তো তাঁর অর্ধেক মাল রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর খিদমতে এনে হাজির করেন। আর হযরত আবু বকর (রাঃ) বাড়ীতে যা ছিল সবই এনে উপস্থিত করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘পরিবারবর্গের জন্যে কিছু রেখে এসেছো কি: হযরত উমার (রাঃ) উত্তর দেনঃ এতটিই ছেড়ে এসেছি।' হযরত আবু বকরের (রাঃ) এটা প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল না এবং গোপনে সবকিছু তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকেও যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করেন তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সঃ) অঙ্গীকারই যথেষ্ট।' একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেনঃ “হে আবূ বকর (রাঃ)! যে কোন সকার্যের দিকে আমরা অগ্রসর হয়েছি, আপনাকে অগ্রেই দেখেছি।' এই আয়াতের শব্দগুলো সাধারণ। দান ফরয হোক, নফল হোক, যাকাত হোক বা খয়রাত হোক, প্রকাশ্যে দান করার চেয়ে গোপনে দান করা উত্তম। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নফল দান গোপনে দেয়ার ফযীলত সত্তরগুণ; কিন্তু ফরয দান অর্থাৎ যাকাত প্রকাশ্যে দেয়ার ফযীলত পঞ্চাশগুণ। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ ‘দানের বিনিময়ে আল্লাহ তোমাদের পাপ ও অন্যায় দূর করে দেবেন, বিশেষ করে যখন গোপনে দান করা হবে। এর বিনিময়ে তোমরা বহু সুফল প্রাপ্ত হবে। এর দ্বারা তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং পাপসমূহ মোচন হয়ে যাবে। ব্যুকাফেরু শব্দকে ঝুকাফের পড়া হয়েছে। এতে বাহ্যতঃ এটা শর্তের জওয়াবের স্থলে عطف হবে, যা হচ্ছে فَنِعِمَّا هِىَ শব্দটি। যেমন فَاَصَّدَّقَ وَاَكُنْ-এর মধ্যে اَكُنْ শব্দটি হয়েছে। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “তোমাদের কোন পাপ ও পুণ্যের কাজ,দানশীলতা ও কার্পণ্য, গোপনীয় ও প্রকাশ্য, সৎ উদ্দেশ্য ও দুনিয়া অনুসন্ধান প্রভৃতি কিছুই আল্লাহ তা'আলার নিকট অজানা নেই। সুতরাং তিনি পূর্ণভাবে প্রতিদান প্রদান করবেন।