আল বাকারা আয়াত ৩
الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ ۙ ( البقرة: ٣ )
Allazeena yu'minoona bilghaibi wa yuqeemoonas salaata wa mimmaa razaqnaahum yunfiqoon (al-Baq̈arah ২:৩)
English Sahih:
Who believe in the unseen, establish prayer, and spend out of what We have provided for them, (Al-Baqarah [2] : 3)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। (আল বাকারা [২] : ৩)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, [১] যথাযথভাবে নামায পড়ে[২] ও তাদেরকে যা দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। [৩]
[১] গায়বী, অদৃশ্য তথা অদেখা বিষয়সমূহ হল এমন সব জিনিস যার উপলব্ধি জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা সম্ভব নয়। যেমন মহান আল্লাহর সত্তা, তাঁর অহী (প্রত্যাদেশ), জান্নাত ও জাহান্নাম, ফিরিশতা, কবরের আযাব এবং মৃত দেহের পুনরুত্থান ইত্যাদি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এমন কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের অংশ যা জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। আর তা অস্বীকার করা কুফরী ও ভ্রষ্টতা।
[২] যথাযথভাবে নামায পড়া বা নামায কায়েম করার অর্থ হল, নিয়মিতভাবে রসূল (সাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী নামায আদায়ের প্রতি যত্ন নেওয়া। নচেৎ নামায তো মুনাফিকরাও পড়তো।
[৩] 'ব্যয় করা' কথাটি ব্যাপক; যাতে ফরয ও নফল উভয় প্রকার (ব্যয়, খরচ, দান বা সদকা)ই শামিল। ঈমানদাররা তাদের সামর্থ্যানুযায়ী উভয় প্রকার সদকার ব্যাপারে কোন প্রকার কৃপণতা করে না। এমনকি পিতা-মাতা এবং পরিবার ও সন্তান-সন্ততির উপর ব্যয় করাও এই 'ব্যয় করা'র মধ্যে শামিল এবং তাও নেকী লাভের মাধ্যম।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
যারা গায়েবের [১] প্রতি ঈমান আনে, [২] সালাত কায়েম করে [৩] এবং তাদেরকে আমরা যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে [৪]।
[১] (غيب)- এর অর্থ হচ্ছে এমনসব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের উর্ধের্ব এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘাণ নিতে পারে না, জিহ্বা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে পারে না। কুরআনে (غيب) শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যেগুলোর সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন এবং মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম। এখানে (غيب) শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তাকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা, কেয়ামত এবং কেয়ামতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশ্তাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা আল-বাকারাহ্র (اٰمَنَ الرَّسُوْلُ) আয়াতে দেয়া হয়েছে। এখানে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আর এ সূরারই শেষে ২৮৫ নং আয়াতে ঈমানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
[২] ঈমান এবং গায়েব। শব্দ দু’টির অর্থ যথার্থভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘কোন বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়া’। ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায় ইমান বলতে বুঝায়, কোন বিষয়ে মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা এবং তা কাজে পরিণত করা। এখানে ঈমানের তিনটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমতঃ অন্তরে অকপট চিত্তে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা। দ্বিতীয়তঃ সে বিষয়ের স্বীকৃতি মুখে দেয়া। তৃতীয়তঃ কর্মকাণ্ডে তার বাস্তবায়ন করা। শুধু বিশ্বাসের নামই ঈমান নয়। কেননা খোদ ইব্লিস, ফির’আউন এবং অনেক কাফেরও মনে মনে বিশ্বাস করত। কিন্তু না মানার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। তদ্রুপ শুধু মুখে স্বীকৃতির নামও ঈমান নয়। কারণ মুনাফেকরা মুখে স্বীকৃতি দিত। বরং ঈমান হচ্ছে জানা ও মানার নাম। বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া এবং কার্যে পরিণত করা -এ তিনটির সমষ্টির নাম ঈমান। তাছাড়া ঈমান বাড়ে ও কমে। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে ঈমান বিল-গায়েব অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হেদায়াত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সে সবগুলোকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া। তবে শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহ্লে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ট দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। [ইবনে কাসীর]
‘ঈমান বিল গায়েব’ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘গায়েবের বিষয়াদির উপর ঈমান আনার চেয়ে উত্তম ঈমান আর কারও হতে পারে না। তারপর তিনি এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন।‘ [মুস্তাদরাকে হাকিম; ২/২৬০]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে উত্তম কি কেউ আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন একটি জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার উপর ঈমান আনবে [সুনান দারমী; ২/৩০৮, মুস্তাদরাকে হাকিম; ৪/৮৫]
মূলত; এটি ‘ঈমান বিল গায়েব’ এর একটি উদাহরণ। সাহাবা, তাবে’য়ীনদের থেকে বিভিন্ন বর্ণনায় ঈমান বিল গায়েবের বিভিন্ন উদাহরন পেশ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, কুরআন। আবার কেউ বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নাম। [আত-তাফসীরুস সহীহ;৯৯] এ সবগুলোই ঈমান বিল গায়েবের উদাহরণ। ঈমানের ছয়টি রুকন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি ঈমান বিল গায়েবের মূল অংশ।
[৩] ‘সালাত’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা বা দো'আ। শরী’আতের পরিভাষায় সে বিশেষ ইবাদাত, যা আমাদের নিকট ‘নামায’ হিসেবে পরিচিত। কুরআনুল কারীমে যতবার সালাতের তাকীদ দেয়া হয়েছে - সাধারণতঃ ইকামত' শব্দের দ্বারাই দেয়া হয়েছে। সালাত আদায়ের কথা শুধু দু’এক জায়গায় বলা হয়েছে। এ জন্য ‘ইকামাতুস সালাত’ (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। ‘ইকামত’ এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণতঃ যেসব খুঁটি, দেয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকে। এজন্য ‘ইকামত' স্থায়ী ও স্থিতিশীল অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় ‘ইকামাতুস সালাত’ অর্থ, নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্তাদি ও নিয়মাবলী রক্ষা করে সালাত আদায় করা। শুধু সালাত আদায় করাকে ‘ইকামাতুস সালাত’ বলা হয় না। সালাতের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কুরআন হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই ‘ইকামাতুস সালাত’ (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, কুরআনুল কারীমে আছে – ‘নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও গৰ্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। [সূরা আল-আনকাবুত;৪৫]
বস্তুত; সালাতের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন সালাত উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অনেক সালাত আদায়কারীকে অশ্লীল ও নেক্কারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মর্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা সালাত আদায় করেছে বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি। সুতরাং সালাতকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হবে। ‘ইকামত’ অর্থে সালাতে সকল ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়। তাছাড়া সময়মত আদায় করা। সালাতের রুকু, সাজদাহ, তিলাওয়াত, খুশু, খুযু ঠিক রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত। [ইবনে কাসীর] ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল প্রভৃতি সকল সালাতের জন্য একই শর্ত। এক কথায় সালাতে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরী’আতের নিয়মানুযায়ী আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইকামতে সালাত। তন্মধ্যে রয়েছে - জামাআতের মাধ্যমে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করা। আর তা বাস্তাবায়নের জন্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকির ব্যবস্থা করা। আল্লাহ্ তা'আলা ইসলামী কল্যাণ-রাষ্ট্রের যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তার মধ্যে সালাত কায়েম করাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের অন্যতম কর্ম বলে ঘোষণা করে বলেনঃ “যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। " [সূরা আল-হাজ্জঃ ৪১]
[৪] আল্লাহ্র পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফরয যাকাত, ওয়াজিব সদকা এবং নফল দান-সদকা প্রভৃতি যা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে। [তাফসীর তাবারী]
কুরআনে সাধারণত ‘ইনফাক’ নফল দান-সদকার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফরয যাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে "যাকাত" শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে গায়েবের উপর ঈমান, এরপর সালাত প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহ্র পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
4 Muhiuddin Khan
যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে
5 Zohurul Hoque
যারা গায়েবে ঈমান আনে, আর নামায কায়েম করে, আর আমরা যে রিযেক তাদের দিয়েছি তা থেকে তারা খরচ করে থাকে।
6 Mufti Taqi Usmani
যারা অদৃশ্য জিনিসসমূহে ঈমান রাখে এবং সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা-কিছু দিয়েছি, তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।
7 Mujibur Rahman
যারা অদৃশ্য বিষয়গুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে উপজীবিকা প্রদান করেছি তা হতে দান করে থাকে ।
8 Tafsir Fathul Mazid
Please check ayah 2:5 for complete tafsir.
9 Fozlur Rahman
যারা অদৃশ্য সত্যকে বিশ্বাস করে, নামায আদায় করে, আর আমি তাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে;
10 Mokhtasar Bangla
৩. মুত্তাকী হচ্ছে ওরা যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে। আর তা হলো প্রত্যেক এমন জিনিস যে ব্যাপারে আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসূল সংবাদ দিয়েছেন। কিন্তু মানুষের বাহ্যেন্দ্রীয় দিয়ে তা অনুধাবন করা যায় না। উপরন্তু তা থাকে মানুষের চোখের আড়ালে। যেমন: শেষ দিবস। যারা শরীয়তসম্মতভাবে শর্ত, রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নতসহ সালাত আদায় করে। যারা আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে ফরয যাকাত কিংবা নফল সাদাকা আদায়ের মাধ্যমে তাঁরই প্রতিদানের আশায় তাঁর পথে খরচ করে।
11 Tafsir Ibn Kathir
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, সত্য বলে স্বীকার করাকে ঈমান বলে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এটাই বলেন। হযরত যুহরী (রঃ) বলেন যে, ‘আমলকে ঈমান বলা হয়। হযরত রাবী’ বিন আনাস (রাঃ) বলেন যে, ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এসব মতের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। এগুলোর একই অর্থ। ভাবার্থ এই যে, তারা মুখের দ্বারা, অন্তর দ্বারা ও আমল দ্বারা অদৃশ্যের উপর ঈমান আনে এবং আল্লাহর ভয় রাখে। 'ঈমান' শব্দটি আল্লাহর উপর, তার কিতাব সমূহের উপর এবং তাঁর রাসূলগণের (আঃ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করা-এ কয়টির সমষ্টিকে বুঝিয়ে থাকে। আমি বলি যে, আভিধানিক অর্থে শুধু সত্য বলে স্বীকার করাকেই ঈমান বলে। কুরআন মাজীদের মধ্যেও এ অর্থের ব্যবহার এসেছে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ یُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِیْنَ
অর্থাৎ তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং ঈমানদারগণকে সত্য বলে স্বীকার করে। (৯:৬১) হযরত ইউসুফ (আঃ) এর ভ্রাতাগণ তাদের পিতাকে বলেছিলেনঃ وَ مَاۤ اَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَ لَوْ كُنَّا صٰدِقِیْنَ অর্থাৎ আমরা সত্যবাদী হলেও আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না। (১২:১৭)
এভাবে ‘ঈমান শব্দটি ইয়াকীনের অর্থেও এসে থাকে যখন ওটা আমলের বর্ণনার সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ (১০৩:৩) اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ কিন্তু যখন ওটা সাধারণভাবে ব্যবহৃত হবে তখন ঈমানে শরঈ' হবে-অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকারোক্তি এবং কার্যসাধনা এই তিনের সমষ্টির নাম। অধিকাংশ ইমামের এটাই মাযহাব। ইমাম শাফিঈ (রঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ), ইমাম আবু উবাইদাহ (রঃ) প্রভৃতি ইমামগণ একমত হয়ে বর্ণনা করেছেন। যে, মুখে উচ্চাণ করা ও কার্যসাধন করার নাম হচ্ছে ঈমান এবং ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এর প্রমাণ আছে বহু হাদীসে যা আমরা বুখারী শরীফের শরাহতে বর্ণনা করেছি।
কেউ কেউ ঈমানের অর্থ করেছেন আল্লাহর ভয়।' যেমন আল্লাহ পাক বলেছেনঃ اِنَّ الَّذِیْنَ یَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَیْبِ অর্থাৎ “নিশ্চয় যারা তাদের প্রভুকে না দেখেই ভয় করে।' (৬৭:১২) অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেনঃ مَنْ خَشِیَ الرَّحْمٰنَ بِالْغَیْبِ وَ جَآءَ بِقَلْبٍ مُّنِیْب অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহকে না দেখেই ভয় করেছে এবং (আল্লাহর দিকে) প্রত্যাবর্তনকারী অন্তর নিয়ে এসেছে।' (৫০:৩৩) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ভয়ই হচ্ছে ঈমান ও ইলমের সারাংশ। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ اِنَّمَا یَخْشَى اللّٰهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহকে তাঁর আলেম বান্দাগণই ভয় করে থাকে। (৩৫:২৮) কেউ কেউ বলেছেন যে, তারা বাহ্যিকভাবে যেমন ঈমান আনে তদ্রুপ ভিতরেও ঈমান এনে থাকে। তারা ঐ মুনাফিকদের মত নয় যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْۤا اٰمَنَّاۚۖ-وَ اِذَا خَلَوْا اِلٰى شَیٰطِیْنِهِمْۙ-قَالُوْۤا اِنَّا مَعَكُمْۙ-اِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُوْنَ
অর্থাৎ যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং যখন তারা তাদের শয়তানদের সন্নিকটে একাকী হয় তখন বলে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আমরা শুধু উপহাস করছিলাম।' (২:১৪) অন্য জায়গায় মুনাফিকদের অবস্থা নিম্নরূপ বর্ণিত হয়েছেঃ اِذَا جَآءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللّٰهِۘ-وَ اللّٰهُ یَعْلَمُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُهٗؕ-وَ اللّٰهُ یَشْهَدُ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ لَكٰذِبُوْنَ
অর্থাৎ মুনাফিকেরা যখন তোমার নিকট আগমন করে তখন বলে আমরা (অন্তরের সঙ্গে) সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল, আর এটা তো আল্লাহ ভালভাবে অবগত আছেন যে, তুমি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় মুনাফিকরাই মিথ্যাবাদী।' (৬৩:১)
এই অর্থ হিসেবে بِالْغَيْبِ শব্দটি حَال হবে, অর্থাৎ তারা ঈমান আনয়ন করে এমন অবস্থায় যে, মানুষ হতে তা পোগন থাকে। এখানে আয়াতে যে غَيْب শব্দটি রয়েছে তার অর্থ সম্বন্ধেও মুফাসৃসিরগণের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। কিন্তু ঐ সবগুলোই সঠিক এবং সব অর্থই নেয়া যেতে পারে। আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উপর, ফেরেশতাদের উপর, কিতাবসমূহের উপর, কিয়ামতের উপর, বেহেশতের উপর, দোযখের উপর, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। কাতাদাহ্ বিন দায়মারও (রঃ) এটাই মত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে ঐ সব গোপনীয় জিনিস যা দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি যা কুরআন মাজীদে উল্লিখিত আছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যা এসেছে সবই بِالْغَيْبِ এর অন্তর্গত। হযরত জার (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ কুরআন'। আতা’ বিন আবু রাবাহ্ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীই হচ্ছে অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী। ইসমাঈল বিন আবু খালিদ (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে ইসলামের সমুদয় গোপনীয় বিষয়সমূহ। যায়েদ বিন আসলাম (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে ভাগ্যের উপর বিশ্বাস স্থাপন। সুতরাং এ সমস্ত কথা অর্থ হিসেবে একই। কেননা এসব জিনিসই অদৃশ্য এবং بِالْغَيْبِ এর তাফসীরের মধ্যে এসবই জড়িত রয়েছে এবং সবগুলোর উপরেই ঈমান আনা ওয়াজিব।
একদা হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদের (রাঃ) মজলিসে সাহাবীগণের (রাঃ) গুণাবলীর আলোচনা চলছিল। তিনি বলেনঃ যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে দেখেছেন। তাদের তো কর্তব্যই হলো তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা; কিন্তু আল্লাহর শপথ! ঈমানী মর্যাদার দিক দিয়ে তাঁরাই উত্তম যারা না দেখেই তাঁকে বিশ্বাস করে থাকেন। অতঃপর তিনি الم থেকে শুরু করে مُفْلِحُوْنَ পর্যন্ত পাঠ করলেন। (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম ও তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই) ইমাম হাকিম (রঃ) এই বর্ণনাটিকে সঠিক বলে থাকেন। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যেও এ বিষয়ের একটি হাদীস আছে। ইবনে মাহীরীজ (রঃ) আবূ জুমআ’ (রাঃ) নামক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এমন একটি হাদীস আমাকে শুনিয়ে দিন যা আপনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছেন। তিনি বলেনঃ আচ্ছা, আমি আপনাকে খুবই ভাল একটা হাদীস শুনাচ্ছি। একবার আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সঙ্গে নাশতা করছিলাম। আমাদের সঙ্গে হযরত আবু উবাইদাহ বিন জাররাহও (রাঃ) ছিলেন। তিনি বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের চেয়েও উত্তম আর কেউ আছে কি? আমরা আপনার সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সঙ্গে ধর্ম যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।' তিনি বলেনঃ হাঁ, আছে। ঐ সমুদয় লোক তোমাদের চেয়ে উত্তম যারা তোমাদের পরে আসবে এবং আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে অথচ তারা আমাকে দেখতেও পাবে না।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে হযরত সালিহ বিন জুবাইর (রঃ) বলেন হযরত আবু জুমআ আনসারী বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের নিকট আগমন করেন। রিযা বিন হাইঅহও (রাঃ) আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি ফিরে যেতে লাগলে আমরা তাঁকে পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলি। তিনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময় বলেনঃ 'আপনাদের এই অনুগ্রহের প্রতিদান ও হক আদায় করা আমার উচিত। শুনে রাখুন! আমি আপনাদেরকে এমন একটা হাদীস শুনাবো যা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছি। আমরা বলিঃ “আল্লাহ আপনার উপর দয়া করুন! আমাদেরকে তা অবশ্যই বলুন'। তিনি বললেনঃ
‘শুনুন! আমরা দশজন লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। হযরত মুআয বিন জাবালও (রাঃ) ছিলেন। আমরা বলিঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) আমাদের চেয়েও কি বড় পুণ্যের অধিকারী আর কেউ হবে? আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার অনুসরণ করেছি। তিনি বললেনঃ “তোমরা কেন করবে না? আল্লাহর রাসূল (সঃ) তো স্বয়ং তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছেন। আকাশ হতে আল্লাহর ওয়াহী তোমাদের সামনেই মুহুর্মুহু অবতীর্ণ হচ্ছে। ঈমান তো ঐ সব লোকের যারা তোমাদের পরে আসবে, তারা দুই জিলদের মধ্যে কিতাব পাবে এবং তার উপরেই ঈমান এনে আমল করবে। তারাই তোমাদের দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী।” এ হাদীসটি তাদের প্রার্থনা কবুল হওয়ার দলীল যাতে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমি এ বিষয়টি বুখারী শরীফের শারাতে খুব স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছি। কেননা পরবর্তীদের প্রশংসা এর উপরে ভিত্তি করেই হচ্ছে এবং এই হিসেবেই তাদেরকে বড় পুণ্যের অধিকারী বলা হয়েছে। নতুবা সাধারণভাবে তো সাহাবীগণই (রাঃ) প্রত্যেক দিক দিয়েই উত্তম। আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। অন্য একটি হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা সাহাবীগণকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমাদের মতে ঈমান আনার ব্যাপারে সর্বোত্তম কে?' তারা বলেনঃ “ফেরেশতাগণ।' তিনি বলেন, তারা কেন ঈমান আনবে না? তারা তো প্রভুর নিকটেই আছে। সাহাবীগণ (রাঃ) বলেন, তারপর নবীগণ (আঃ)।' তিনি বলেন, 'তারা ঈমান আনবে না কেন? তাদের উপর তো ওয়াহী অবতীর্ণ হয়ে থাকে। তারা বলেন, ‘তাহলে আমরা।' তিনি বলেন, তোমরা ঈমান কবুল কেন করবে না? আমি তোমাদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছি। জেনে রেখো, আমার মতে সর্বোত্তম ঈমানদার তারাই হবে যারা তোমাদের পরে আসবে। সহীফাসমূহের মধ্যে তারা লিখিত পুস্তক পাবে এবং তার উপরেই তারা ঈমান আনবে।' এর সনদে মুগীরা বিন কায়েস রয়েছে। আবূ হাতিম রাযী তাকে মুনকারুল হাদীস' বলে থাকেন। কিন্তু তারই মত একটি হাদীস দুর্বল সনদে মুসনাদ-ই-আবূ ইয়ালা', তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই এবং মুসতাদরাক-ই-হাকিমের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। এবং হাকীম (রঃ) তাকে সহীহ বলেছেন। হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) হতেও তারই মত মারফু' রূপে বর্ণিত আছে। আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন।
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে হযরত বুদাইলা বিনতে আসলাম (রাঃ) বলেনঃ বানু হারিসার মসজিদে আমরা যোহর বা আসরের নামাযে ছিলাম এবং আমাদের মুখ বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ছিল। দুই রাকাত পড়েছি এমন সময়ে কোন একজন এসে সংবাদ দিল যে, নবী (সঃ) বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করেছেন। শোনা মাত্রই আমরা ঘুরে গেলাম। স্ত্রী লোকেরা পুরুষদের জায়গায় চলে আসলো এবং পুরুষেরা স্ত্রীলোকদের জায়গায় চলে গেল এবং বাকী দুই রাকআত আমরা বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে মুখ করে আদায় করলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট এ সংবাদ পৌছলে তিনি বললেনঃ ‘এসব লোক তারাই যারা অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস করে থাকে। এই ইসনাদে এই হাদীসটি গরীব।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ তারা ফরয নামায আদায় করে, রুকূ' সিজদাহ্, তিলাওয়াত, নম্রতা এবং মনোযোগ প্রতিষ্ঠিত করে।' কাতাদাহ্ (রঃ) বলেন যে, নামায প্রতিষ্ঠিত করার অর্থ হচ্ছে নামাযের সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা, ভালভাবে অযু করা এবং রুকূ' ও সিজদাহ্ যথাযথভাবে আদায় করা। মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, সময়ের হিফাযত করা, পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করা “রুকূ ও সিজদাহ্ ধীরস্থিরভাবে আদায় করা, ভালভাবে কুরআন পাঠ করা, আত্তাহিয়্যাতু এবং দুরূদ পাঠ করার নাম হচ্ছে ইকামাতে সালাত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ-এর অর্থ হচ্ছে যাকাত আদায় করা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে মানুষের তার সন্তান সন্ততিকে পানাহার করাননা। এটা যাকাতের হকুমের পূর্বেকার আয়াত।
হযরত যহাক (রাঃ) বলেন যে, সূরা-ই- বারাআতের মধ্যে যাকাতের যে সাতটি আয়াত আছে তা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে এই নির্দেশ ছিল যে,বান্দা যেন নিজ সাধ্য অনুসারে কমবেশী কিছু দান করতে থাকে। কাতাদাহ্ (রঃ) বলেনঃ ‘এই মাল তোমাদের নিকট আল্লাহর আমানত, অতি সত্বরই এটা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে। সুতরাং ইহলৌকিক জীবনে তা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি সাধারণ। যাকাত, সন্তান সন্ততির জন্যে খরচ এবং যেসব লোককে দেয়া প্রয়োজন এ সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্যে মহান প্রভু একটা সাধারণ বিশেষণ বর্ণনা করেছেন এবং সাধারণভাবে প্রশংসা করেছেন, কাজেই সব খরচই এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
আমি বলি যে, কুরআন কারীমের মধ্যে অধিকাংশ জায়গায় নামায ও মাল খরচ করার বর্ণনা মিলিতভাবে এসেছে। এজন্যে নামায হচ্ছে আল্লাহর হক এবং তাঁর ইবাদত-যা তাঁর একত্ববাদ, প্রশংসা, শ্রেষ্ঠত্ব, তার দিকে প্রত্যাবর্তন, তাঁর উপর ভরসা এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করার নাম। আর খরচ করা হচ্ছে সৃষ্ট জীবের প্রতি অনুগ্রহ করা-যার দ্বারা তাদের উপকার হয়। এর সবচেয়ে বেশী হকদার হচ্ছে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন এবং দাসদাসী। অতঃপর দূরের লোক এবং অপরিচিত ব্যক্তিরা তার হকদার। সুতরাং অবশ্যকরণীয় সমস্ত ব্যয় ও ফরয যাকাত এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। (১) আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রেরিতত্বের সাক্ষ্য প্রদান। (২) নামায প্রতিষ্ঠিত করণ। (৩) যাকাত প্রদান। (৪) রমযান শরীফের রোযা পালন এবং (৫) বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ কার্য সম্পাদন। এ সম্পর্কে আরও বহু হাদীস রয়েছে।
আরবী ভাষায় সালাতের অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা। আরব কবিদের কবিতা এর সাক্ষ্য দেয়। সালাতের প্রয়োগ হয়েছে নামাযের উপর যা রুকু সিজদাহ এবং অন্যান্য নির্দিষ্ট কতকগুলি কার্যের নাম এবং যা নির্দিষ্ট সময়ে কতকগুলি নির্দিষ্ট শর্ত , সিফাত ও পদ্ধতির মাধ্যমে পালিত হয়। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ “সালাত নামাযকে বলার কারণ এই যে, নামাযী ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নিকট স্বীয় কার্যের পুণ্য প্রার্থনা করে এবং তার নিকট তার প্রয়োজন যাজ্ঞা করে। কেউ কেউ বলেছেনঃ “যে দুটি শিরা পৃষ্ঠদেশ থেকে মেরুদণ্ডের অস্থির দু দিকে এসে থাকে তাকে আরবী ভাষায় صُلْوَيْن বলা হয়। নামাযের এটা নড়ে থাকে বলে একে صَلٰوة বলা হয়েছে। কিন্তু এ কথাটি সঠিক নয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এটা صَلْىٌ হতে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে সংলগ্ন ও সংযুক্ত থাকা। যেমন কুরআন মাজীদে আছে لَايَصْلٰهَا اِلَّاالْاَشْقَى অর্থাৎ দুর্ভাগা ব্যক্তি ছাড়া কেউই দোযখে চিরকাল থাকবে না।' (৯২:১৫)
কোন কোন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছেন যে, যখন কাঠকে সোজা করার জন্যে আগুনের উপর রাখা হয় তখন আরববাসীরা تَصْلِيَة বলে থাকে। নামাযের মাধ্যমে আত্মার বক্রতাকে সোজা করা হয় বলে একে صَلٰوة বলে। যেমন কুরআন মাজীদে আছে اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِؕ অর্থাৎ ‘নিশ্চয় নামায নির্লজ্জতা ও অসৎ কাজ হতে বিরত রাখে।' (২৯:৪৫)। কিন্তু এর অর্থ প্রার্থনা হওয়াই সর্বাপেক্ষা সঠিক ও প্রসিদ্ধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। যাকাত শব্দের আলোচনা ইনশাআল্লাহ পরে আসবে।