৩৫ হতে ৩৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা কর্তৃক আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ দেয়ার পর আদমকে যে মর্যাদা দান করেছেন সেই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের জন্য জান্নাতকে বসবাসের স্থান করে দিলেন এবং সকল প্রকার ভোগ-সম্ভোগ দিলেন, তবে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ)
“হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৯)
সে বৃক্ষের নাম কী বা সে বৃক্ষটি কী এ নিয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক কথা হল: তা জান্নাতের গাছগুলোর অন্যতম একটি গাছ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর উভয়ে জান্নাতে বসবাসকালে শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহ তা‘আলার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَوَسْوَسَ لَھُمَا الشَّیْطٰنُ لِیُبْدِیَ لَھُمَا مَا و۫رِیَ عَنْھُمَا مِنْ سَوْاٰتِھِمَا وَقَالَ مَا نَھٰٿکُمَا رَبُّکُمَا عَنْ ھٰذِھِ الشَّجَرَةِ اِلَّآ اَنْ تَکُوْنَا مَلَکَیْنِ اَوْ تَکُوْنَا مِنَ الْخٰلِدِیْنَ)
“অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা স্থায়ী হয়ে যাবে এজন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২০)
এমনকি শয়তান আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের কল্যাণকামী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَاسَمَهُمَآ إِنِّيْ لَكُمَا لَمِنَ النّٰصِحِيْنَ لا فَدَلّٰهُمَا بِغُرُوْرٍ )
“সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল: আমি তো তোমাদের কল্যাণকারীদের একজন। এভাবে সে তাদের উভয়কে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২১-২২)
এভাবে প্ররোচিত করে শয়তান জান্নাতের নেয়ামত থেকে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত করে বের করে দিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়কে সম্বোধন করে বললেন; “আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?”
আল্লাহ তা‘আলা এরূপ অন্যত্র বলেন:
(وَنَادٰهُمَا رَبُّهُمَآ أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَّكُمَآ إِنَّ الشَّيْطٰنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ)
“তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“?” (সূরা আ‘রাফ ৭:২২)
তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ জারি করলেন:
(وَقُلْنَا اھْبِطُوْا بَعْضُکُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّﺆ وَلَکُمْ فِی الْاَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ اِلٰی حِیْنٍ)
“এবং আমি বললাম, নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্র“। আর পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য এক নির্দিষ্টকালের বসবাস ও ভোগ-সম্পদ রয়েছে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে বললেন, আমি তোমাকে যে গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছি সে গাছের ফল খেতে কিসে তোমাকে উদ্বুুদ্ধ করল। সে বলল: হাওয়া আমাকে তা সুশোভিত করে দেখিয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি তার শাস্তিস্বরূপ গর্ভধারণ বেদনা ও প্রসব বেদনা দিয়েছি। (দুররুল মানসুর, ১/১৩২, ফাতহুর কাদীর, ১১১, আল মাত্বালিব আল আলিয়া- কিতাবুল হায়েয। হাদীসটি মাওকুফ কিন্তু তার সনদ সহীহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আদমকে হিন্দুস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং হাওয়াকে জেদ্দায়। হাওয়া (আঃ)-কে আদম (আঃ) খুঁজতে খুঁজতে মুযদালিফায় একত্রিত হন। হাওয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। এ জন্য মুযদালিফাকে মুযদালিফা বলা হয়।
অতঃপর আদম ও হাওয়া তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনুশোচনা ও তাওবাহ করল। সে তাওবার বাক্যও আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে শিখে নিলেন।
( رَبَّنَا ظَلَمْنَآ اَنْفُسَنَاﺒ فَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَکُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ)
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’(সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)
কেউ এখানে একটি জাল হাদীসের আশ্রয় নিয়ে বলেন যে, আদম (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’লেখা দেখেন এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওসীলা গ্রহণ করে দু‘আ করেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁেক ক্ষমা করে দেন। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং কুরআনের বর্ণনার পরিপন্থী। এ ছাড়া এটা আল্লাহ তা‘আলার বর্ণিত তরীকারও বিপরীত। প্রত্যেক নাবী সব সময় সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করেছেন। অন্য কোন নাবী ও অলীর ওসীলা বা মাধ্যম ধরেননি। কাজেই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল নাবীদের দু‘আ করার নিয়ম এটাই ছিল যে, তাঁরা বিনা ওসীলা ও মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সরাসরি দু‘আ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের তাওবাহ কবূল করে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়াকে পাঠিয়ে বলে দিলেন- তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তার প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং কোন দুশ্চিন্তাও নেই। অর্থাৎ পরকালে সকল প্রকার ভয় ও হতাশামুক্ত থাকবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاِمَّا یَاْتِیَنَّکُمْ مِّنِّیْ ھُدًیﺃ فَمَنِ اتَّبَعَ ھُدَایَ فَلَا یَضِلُّ وَلَا یَشْقٰی)
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।”(সূরা ত্বা-হা: ২০:১২৩)
যে ব্যক্তি আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণ করবে সে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে মুক্ত থাকবে।
১. দুশ্চিন্তা, ২. ভয়-ভীতি, ৩. পথভ্রষ্টতা, ৪. দুর্ভাগ্য। (তাফসীরে সা‘দী পৃঃ ২৭)
আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর বিষয়কে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা‘আলা সকল আদম সন্তানকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন:
(يٰبَنِيْٓ اٰدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطٰنُ كَمَآ أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْاٰتِهِمَا ط إِنَّه۫ يَرٰكُمْ هُوَ وَقَبِيْلُه۫ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ط إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيٰطِيْنَ أَوْلِيَآءَ لِلَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ )
“হে বানী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে- যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে (আদম-হাওয়া) সে জান্নাত হতে বহিষ্কার করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। যারা ঈমান আনে না, শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:২৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের মর্যাদার কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে নেয়ামতের পরিবর্তে শাস্তি দেন।
৩. কোন বস্তুর নাম বা ধরণ কুরআনে উল্লেখ না হলে এবং হাদীসেও এর বিবরণ না আসলে তা নিয়ে অহেতুক আলোচনা করা শরীয়তসম্মত নয়।
৪. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্র“, তার কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
৫. কোন অপরাধ হয়ে গেলে তার ওপর অটল না থেকে বরং তা বর্জন করে অনুশোচিত হয়ে তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৬. যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হিদায়াতের অনুসরণ করে চলবে সে দুশ্চিন্তা, ভয়-ভীতি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে।