আল বাকারা আয়াত ৫
اُولٰۤىِٕكَ عَلٰى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ ۙ وَاُولٰۤىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ( البقرة: ٥ )
Ulaaa'ika 'alaa hudam mir rabbihim wa ulaaa'ika humul muflihoon (al-Baq̈arah ২:৫)
English Sahih:
Those are upon [right] guidance from their Lord, and it is those who are the successful. (Al-Baqarah [2] : 5)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তারাই তাদের প্রতিপালকের হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, আর তারাই সফলকাম। (আল বাকারা [২] : ৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
তারাই তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।
এখানে সেই ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের পরিণামের কথা বলা হয়েছে, যারা ঈমান আনার পর আল্লাহভীরু ও আমল করা সহ সঠিক আক্বীদার উপর কায়েম থাকার প্রতি যত্ন নেয়; কেবল মৌখিক ঈমান প্রকাশকে যথেষ্ট মনে করে না। আর সফলকাম হওয়ার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর রহমত ও ক্ষমা লাভ। এর সাথে যদি দুনিয়াতেও সুখ-সাছন্দ্য ও সফলতা লাভ হয়ে যায় তাহলে তো 'সুবহানাল্লাহ' (বিরাট সৌভাগ্য)। নচেৎ আখেরাতের সফলতাই হল প্রকৃত সফলতা।
এর পর মহান আল্লাহ অন্য এক দলের কথা বলছেন যারা কেবল কাফেরই নয়, বরং তাদের কুফরী ও অবাধ্যতা এমন অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর পর তাদের কোন মঙ্গল বা ইসলাম কবুল করার কোন আশাই নেই।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তারাই তাদের রব-এর নির্দেশিত হেদায়েতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। [১]
[১] যারা মুত্তাকী তারাই সফলকাম। এখানে মুত্তাকীদের গুণাগুণ বর্ণনা করার পরে হিদায়াতের জন্য তাদেরকে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তারাই তাদের রব-এর দেয়া হিদায়াত পাবে এবং তারাই সফলকাম হবে। আল্লাহ্র এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে। বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি, সাফল্য ও ব্যর্থতা আসল মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহ্র শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উত্রে যাবে, সে-ই হচ্ছে সফলকাম। আর সেখানে যে উত্রোবে না, সে ব্যর্থ।
সূরা আল-বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে কুরআনকে হিদায়াত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থরূপে ঘোষণা করে সকল সন্দেহ ও সংশয়ের উর্ধ্বে স্থান দেয়ার পর সে সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এ গ্রন্থের হিদায়াতে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন এবং যাদেরকে কুরআনের পরিভাষায় মুমিন ও মুত্তাকী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী এবং পরিচয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী পনেরটি আয়াতে সে সমস্ত লোকের বিষয় আলোচিত হয়েছে, যারা এ হিদায়াতকে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এরা দু’টি দলে বিভক্ত। একদল প্রকাশ্যে কুরআনকে অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচারণের পথ অবলম্বন করেছে। কুরআন তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর দল হচ্ছে, যারা হীন পার্থিব উদ্দেশ্যে অন্তরের ভাব ও বিশ্বাসের কথাটি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে সাহস পায়নি, বরং প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছে; মুসলিমদের নিকট বলে, আমরা মুসলিম; কুরআনের হিদায়াত মানি এবং আমরা তোমাদের সাথে আছি। অথচ তাদের অন্তরে লুক্কায়িত থাকে কুফর বা অস্বীকৃতি। আবার কাফেরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা তোমাদের দলভুক্ত, তোমাদের সাথেই রয়েছি। মুসলিমদের ধোকা দেয়ার জন্য এবং তাদের গোপন কথা জানার জন্যই তাদের সাথে মেলামেশা করি। কুরআন তাদেরকে ‘মুনাফিক' বলে আখ্যায়িত করেছে। এ পনরটি আয়াত যারা কুরআন অমান্য করে তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তন্মধ্যে ৬ ও ৭নং আয়াতে যারা প্রকাশ্যে অস্বীকার করে তাদের কথা ও স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর পরবর্তী তেরটি আয়াতই মুনাফেকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা'আলা সূরা আল-বাকারার প্রথম বিশটি আয়াতে একদিকে হিদায়াতের উৎসের সন্ধান দিয়ে বলেছেন যে, এর উৎস হচ্ছে তাঁর কিতাব এই কুরআন; অপরদিকে সৃষ্টিজগতকে এ হিদায়াত গ্রহণ করা ও না করার নিরিখে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন। যারা গ্রহণ করেছে, তাদেরকে মু’মিন-মুত্তাকী বলেছেন, আর যারা অগ্রাহ্য করেছে তাদেরকে কাফের ও মুনাফেক বলেছেন। কুরআনের এ শিক্ষা থেকে একটি মৌলিক জ্ঞাতব্য বিষয় এও প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ববাসীকে এমনভাবে দু’টি ভাগ করা যায়, যা হবে আদর্শভিত্তিক। বংশ, গোত্র, দেশ, ভাষা ও বর্ণ এবং ভৌগলিক বিভক্তি এমন কোন ভেদরেখা নয়, যার ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভক্ত করা যেতে পারে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।
4 Muhiuddin Khan
তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।
5 Zohurul Hoque
এরাই আছে তাদের প্রভুর তরফ থেকে হেদায়তের উপরে, আর এরা নিজেরাই হচ্ছে সফলকাম।
6 Mufti Taqi Usmani
এরাই এমন লোক, যারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সঠিক পথের উপর আছে এবং এরাই এমন লোক, যারা সফলতা লাভকারী।
7 Mujibur Rahman
এরাই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রাপ্ত হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং এরাই পূর্ণ সফলকাম।
8 Tafsir Fathul Mazid
৩-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:
إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
9 Fozlur Rahman
এ ধরনের লোকেরাই তাদের প্রভুর সঠিক পথে আছে এবং এরাই সফলকাম।
10 Mokhtasar Bangla
৫. উক্ত গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিরাই হিদায়েতের পথে সুপ্রতিষ্ঠিত। আর তারাই দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে তাদের কাক্সিক্ষত বিষয় তথা জান্নাত পেয়ে এবং অনাকাক্সিক্ষত বিষয় তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে সফল হবে।
11 Tafsir Ibn Kathir
অর্থাৎ ঐ সব লোক, যাদের গুণাবলী পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, যেমন অদৃশ্যের উপর ঈমান আনা, নামায কায়েম করা, আল্লাহর দেয়া বন্ধু হতে দান করা, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর ঈমান আনা, তাঁর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা, পরকালের প্রতি বিশ্বাস রেখে তথায় উপকার দেয় এরূপ কাজ করা এবং মন্দ ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকা। এসব লোকই হিদায়াত প্রাপ্ত, এদেরকেই আল্লাহর নূর ও তাঁর সূক্ষ্ম অন্তদৃষ্টি দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। আর এ সমুদয় লোকের জন্যেই ইহকালে ও পরকালে সফলতা রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হিদায়াতের তাফসীর করেছেন নূর ও দৃঢ়তা দ্বারা এবং ফালাহ’ -এর তাফসীর করেছেন প্রয়োজন মিটে যাওয়া ও পাপ এবং দুস্কার্য থেকে বেঁচে যাওয়া ইত্যাদি দ্বারা।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেছেনঃ ‘এসব লোক স্বীয় প্রভুর পক্ষ হতে নূর, দলীল, দৃঢ়তা এবং সত্যতার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে, আর এরাই তাদের পবিত্র কার্যাবলীর কারণে পুণ্য ও চিরস্থায়ী জান্নাত লাভের দাবীদার এবং এরাই শাস্তি হতে দূরে সরে থাকবে।' ইবনে জারীর (রঃ) আরও বলেন যে, দ্বিতীয় اُولٰئِكَ-এর ইঙ্গিত হয়েছে, আহলে কিতাবের দিকে, যার صِفَت তার পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। এ হিসেবে وَ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ প্রথম আয়াত হতে পৃথক হবে এবং مُبْتَدَاء হয়ে مَرْفُوْع হবে এবং তার خَبَر হবে وَاُولٰٓىٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ। কিন্তু তার ইঙ্গিত পূর্বোল্লিখিত গুণাবলীর অধিকারীদের দিকে হওয়াই বেশী পছন্দনীয় মত। তারা আহলে কিতাব হোক অথবা আরবের মুমিনই হোক।।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ আরবের মুমিনগণকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে এবং তার পরবর্তী বাক্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে আহলে কিতাবের মুমিনগণ। অতঃপর এই উভয় দলের জন্যেই শুভ সংবাদ দেয়া হচ্ছে যে, এরা হিদায়াত প্রাপ্ত ও সফলকাম। পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতগুলো সাধারণ এবং ইঙ্গিত ও সাধারণ। আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানেন।
মুজাহিদ (রঃ) আবুল আলিয়া, (রঃ), রাবী' বিন আনাস (রাঃ) এবং কাতাদাহ (রঃ) হতে এটাই বর্ণিত আছে। একবার কেউ রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে প্রশ্ন করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! পবিত্র কুরআনের কতগুলো আয়াত তো আমাদেরকে উৎসাহিত করছে এবং আমাদের মনে অনন্ত আশার সঞ্চার করছে, কিন্তু কতকগুলো আয়াত আবার আমাদের আশা ভরসাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে এবং নৈরাশ্যের সাগরে নিক্ষেপ করছে।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ ‘এসো! আমি তোমাদের জান্নাত ও জাহান্নামীদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেই।' অতঃপর তিনি الــمّ হতে مُفْلِحُوْنَ পর্যন্ত পাঠ করে বললেনঃ এরা তো জান্নাতী।' সাহাবীগণ (রাঃ) খুশী হয়ে বললেনঃ “আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের আশা আছে যে, আমরা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবো।' অতঃপর তিনি اِنَّ الَّذِيْنَ হতে عَظِيْم পর্যন্ত পড়লেন এবং বললেনঃ “এরা জাহান্নামী। তাঁরা বললেনঃ ‘আমরা এরূপ নই।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ হাঁ (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম)।