ত্বোয়া-হা আয়াত ৯৮
اِنَّمَآ اِلٰهُكُمُ اللّٰهُ الَّذِيْ لَآ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۗ وَسِعَ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا ( طه: ٩٨ )
Innamaaa ilaahukkumul laahul lazee laa ilaaha illaa Hoo; wasi'a kulla shai'in ilmaa (Ṭāʾ Hāʾ ২০:৯৮)
English Sahih:
Your god is only Allah, except for whom there is no deity. He has encompassed all things in knowledge." (Taha [20] : 98)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তোমাদের ইলাহ একমাত্র আল্লাহ, যিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই। যাবতীয় বিষয়ে তাঁর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত। (ত্বোয়া-হা [২০] : ৯৮)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
তোমাদের উপাস্য কেবল আল্লাহই, যিনি ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই। সর্ব বিষয় তাঁর জ্ঞানায়ত্তে।’
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তোমাদের ইলাহ তো শুধু আল্লাহই যিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, সবকিছু তাঁর জ্ঞানের পরিধিভুক্ত।
3 Tafsir Bayaan Foundation
‘তোমাদের ইলাহ তো কেবল আল্লাহই। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। সকল বিষয়েই তার জ্ঞান পরিব্যাপ্ত’।
4 Muhiuddin Khan
তোমাদের ইলাহ তো কেবল আল্লাহই, যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। সব বিষয় তাঁর জ্ঞানের পরিধিভুক্ত।
5 Zohurul Hoque
তোমাদের উপাস্য তো কেবল আল্লাহ্, তিনিই তো, তিনি ছাড়া অন্য উপাস্য নেই। তিনি সবকিছু বেষ্টন করে আছেন জ্ঞানের দ্বারা।
6 Mufti Taqi Usmani
প্রকৃতপক্ষে তোমাদের সকলের মাবুদ তো কেবল এক আল্লাহই, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তাঁর জ্ঞান সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে।
7 Mujibur Rahman
তোমাদের ইলাহতো শুধুমাত্র আল্লাহই যিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, তাঁর জ্ঞান সর্ব বিষয়ে ব্যাপ্ত।
8 Tafsir Fathul Mazid
৩৬-৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ও ফির‘আউনের কাছে দাওয়াত, জাদুকরদের সাথে মুকাবেলাসহ সংশ্লিষ্ট ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
(قَدْ أُوْتِيْتَ سُؤْلَكَ)
অর্থাৎ হে মূসা! তুমি যা চাইলে সব দেয়া হল। তোমার বুক উন্মুক্ত করা, সকল কাজ সহজ করা, মুখের জড়তা দূর করা এবং তোমাকে শক্তিশালী করা হল।
দু‘আ কবুল হওয়ার সাথে সাথে অধিক সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর বাল্যকালের অনুগ্রহের কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। আরেকটি নেয়ামত হল এটাই যে তোমার মা আশংকা করছিল ফির‘আউন তোমাকে হত্যা করে ফেলবে, তখন তোমার মায়ের কাছে স্বভাবগত ইলহাম দিয়ে জানিয়ে দেয়া হল: তুমি তাকে সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দাও
(عَدُوٌّ لِّيْ) আমার শত্র“ বলতে ফির‘আউনকে বুঝানো হয়েছে। ফির‘আউন আল্লাহ তা‘আলার শত্র“ কারণ সে কুফরী করত, কিন্তু তখন সে তো মূসা (عليه السلام)-এর শত্র“তে পরিণত হয়নি। এতদসত্ত্বেও তাকে মূসা (عليه السلام)-এর শত্র“ বলা হল শেষ পরিণতির দিকে বিবেচনা করে অর্থাৎ অবশেষে ফির‘আউনের শত্র“তে পরিণত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানে ছিল।
مَحَبَّةً অর্থ ভালবাসা, সোহাগ। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি সকলের ভালবাসা ও সোহাগ ভরে দিয়েছিলেন, যেই দেখবে আদর করতে চাইবে, ভালবাসবে।
(عَلٰي عَيْنِيْ) অর্থাৎ আমার চোখের সামনে, আমার সংরক্ষণে তুমি প্রতিপালিত হবে। আল্লাহ তা‘আলার মহাশক্তি ও সংরক্ষণের নৈপুণ্যতা কত চমৎকার; আপন গৃহে শত্র“কে লালন-পালন করলেন। যে ফির‘আউন শত্র“কে মারার জন্য অসংখ্য শিশু-সন্তানকে হত্যা করেছে, শেষ পর্যন্ত সে শত্র“কে নিজের গৃহে লালন-পালন করলো; এমনকি দুধ পান করানোর জন্য স্বয়ং মূসা (عليه السلام)-এর মাকে পারিশ্রমিক দিয়ে ধাত্রি হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। কত বোকা ফির‘আউন, আবার সে নিজেকে রব দাবী করে। আল্লাহ তা‘আলা কত মহান, ক্ষমতাবান ও মহত্ত্বের অধিকারী।
আল্লাহ তা‘আলার চোখ রয়েছে তার প্রমাণ আয়াতের এ অংশ। অনেকে বলতে পারে এখানে তো চোখ উদ্দেশ্য নয় বরং সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধায়ন। যেমন আমরা বলে থাকি-ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখ। হ্যাঁ, এখানে অর্থ সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান। কিন্তু যদি কারো চোখ না থাকে তাহলে কি সে ব্যক্তিকে সম্বোধন করে এ কথা বলা যাবে যে, ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখ? না, কেবল তাকেই বলা যাবে যার এ অঙ্গ আছে। যেমন যদি বলি ছেলেটিকে শিঙে শিঙে রেখ, বলা যাবে? না, কারণ মানুষর শিং নেই। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার চোখ আছে বলেই ওভাবে ব্যক্ত করেছেন।
মূসা (عليه السلام)-এর দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তুমি যা চেয়েছ তার সবই তোমাকে দেয়া হল। শুধু এবার কেন, আমি তোমার ওপরে আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম।
(إِذْ تَمْشِيْٓ أُخْتُكَ)
অর্থাৎ যখন মূসা (عليه السلام)-কে সিন্দুকে ভরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হল তখন দূর থেকে মূসা (عليه السلام)-এর বোন লক্ষ্য রাখছেন তা কোথায় যায়, কী হয়? এ সম্পর্কে সূরা ক্বাসাসের ১১-১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
(وَقَتَلْتَ نَفْسًا)
অর্থাৎ মিশরে কিবতী বংশের ও বানী-ইসরাঈল বংশের দুজন ব্যক্তি ঝগড়া করছিল তখন মূসা (عليه السلام) কিবতী বংশের লোকটাকে চড় মেরেছিলেন ফলে লোকটা মারা যায়। তিনি মেরে ফেলার জন্য চড় মারেননি। সূরা ক্বাসাসের ১৫ নং আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা।
(وَفَتَنَّاكَ فُتُوْنًا)
অর্থাৎ আমি তোমাকে অনেক পরীক্ষা করেছি। যেমন যে বছর জন্মেছিলে সে বছর সব ছেলে শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। কিবতীকে হত্যা করেছিলে সেখান থেকে তোমাকে মুক্তি দিয়েছি ইত্যাদি।
(فَلَبِثْتَ سِنِيْنَ)
অর্থাৎ মূসা (عليه السلام)-এর শ্বশুর নিজ কন্যার মাহরস্বরূপ যে আট অথবা দশ বছর কাজ করার জন্য বলেছিলেন সে কয় বছর মাদইয়ানে অবস্থান করেছিলেন। যেমন সূরা ক্বাসাসের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে। উক্ত বছরগুলো অবস্থান করার পর মূসা (عليه السلام) আবার মিসরে ফিরে আসলেন।
(ثُمَّ جِئْتَ عَلٰي قَدَر)
অর্থাৎ এমন সময়ে এসে উপস্থিত হলে যে সময়টি আমি তোমার সাথে কথা বলার ও তোমাকে নবুওয়াত দান করার জন্য নির্ধারণ করেছিলাম। অথবা এখানে قَدَرٍ অর্থ বয়স। অর্থাৎ বয়সের এমন এক পর্যায় যখন তুমি নবুওয়াতের জন্য উপযুক্ত ছিলে।
(اِذْهَبْ أَنْتَ وَأَخُوْكَ)
অর্থাৎ দুনিয়াবী ও দীনি নেয়ামত দান করার পর আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূন (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে তাঁর দিকে আহ্বান করার জন্য যেতে বললেন। সে সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করা থেকে যেন শৈথিল্য না করা হয় সে পরামর্শ ও নির্দেশ দিলেন। কারণ এ বিশাল দায়িত্ব পালনে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ রাখলে মনে বল থাকবে এবং সাহস হারাবে না। সেই সাথে আরো বললেন: ফির‘আউনের সাথে ভদ্রতা ও নম্রতা বজায় রেখে কথা বলবে। কারণ যে ব্যক্তি যেমন পদমর্যাদার অধিকারী তাকে তেমন সম্মান দিয়ে কথা বললে কথা বলা ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রথমেই যদি সম্মানে আঘাত হানা হয় তাহলে পরবর্তী কথা শুনবে না। যেমন আবূ সুফিয়ান মক্কার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের দিন আবূ সুফিয়ানের সম্মান হানি না করে সম্মান বজায় রেখে বললেন, যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ। অর্থাৎ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন হবে।
তাই আল্লাহ তা‘আলার পথে দায়ীদের এখানে বড় শিক্ষা হল আপনি যার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছেন তিনি ফির‘আউনের চেয়ে খারাপ নন, আর আপানি মূসা (عليه السلام)-এর চেয়ে উত্তম নন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যদি মূসা (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে নম্র-ভদ্রতার সাথে দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত।
নির্দেশ পেয়ে মূসা ও হারূন (عليه السلام) ফির‘আউনের কাছে যেতে লাগলেন, আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ একজন দেশের প্রধানের কাছে দেশের প্রচলিত বিধানের বিপরীত দাওয়াত দেয়া সহজ কথা নয়! তাছাড়া মূসা (عليه السلام) পূর্বে একটি অপরাধ করেছেন কিবতীকে হত্যা করে। সে বিষয় তো ফির‘আউনের স্মরণ আছে। সব মিলিয়ে ভয় পেলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বললেন: তোমরা ভয় কর না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনছি ও দেখছি। সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল: অবশ্যই আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল, সুতরাং আমাদের সাথে বাণী ইসরাঈলকে যেতে দাও। আর তাদেরকে কষ্ট দিও না। আমরা তো তোমার নিকট এসেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে নিদর্শন ও শান্তির বিধান নিয়ে তাদের প্রতি যারা সৎ পথের অনুসরণ করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتِيَا فِرْعَوْنَ فَقُوْلَآ إِنَّا رَسُوْلُ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ لا أَنْ أَرْسِلْ مَعَنَا بَنِيْٓ إِسْرَآئِيْلَ )
“অতএব তোমরা উভয়ে ফির‘আউনের নিকট যাও এবং বল: ‘আমরা জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল, ‘আমাদের সাথে যেতে দাও বানী ইসরাঈলকে।’’ (সূরা শু‘আরা ২৬:১৬-১৭)
(إِنَّنِيْ مَعَكُمَا)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে রয়েছেন, কিভাবে রয়েছেন তা পরের দুটি শব্দ ব্যক্ত করে দিয়েছে, অর্থাৎ তিনি শ্রবণ ও দর্শন দিয়ে সাথে রয়েছেন।
(إِنَّا قَدْ أُوْحِيَ إِلَيْنَا)
অর্থাৎ আমাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যা আরোপ করবে ও আমাদের দাওয়াত থেকে বিমুখ হবে তার ওপর শাস্তি নেমে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظّٰي ج لَا يَصْلٰهَآ إِلَّا الْأَشْقَي لا الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰي )
“অতএব, আমি তোমাদেরকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করেছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা লাইল ৯২:১৬)
তখন ফির‘আউন বলল: হে মূসা! তোমাদের প্রতিপালক কে? কারণ রবের একটি অর্র্থ হল লালন-পালন করা, ফির‘আউন মূসাকে লালন-পালন করেছে, সে অর্থে সেই হল মূসার রব। সে জন্য সে আশ্চর্য হয়ে এ কথা বলছে। তাছাড়া সে নিজেই তো বড় রব বলে দাবী করত। (সূরা নাযিআত ৭৯:২৪)
তার উত্তরে মূসা (عليه السلام) বললেন: আমার প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যে মাখলুককে যে জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ফির‘আউন বলল: তাহলে অতীতের লোক যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ইবাদত করত তাদের অবস্থা কী হবে? মূসা বললেন: এর জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট লিপিবদ্ধ আছে: তিনি ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না। অর্থাৎ তাদের ভাল-মন্দ আমল লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁর জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং তা হারিয়ে যাবে না এবং তিনি ভুলেও যাবেন না।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) আরো বর্ণনা করে দিচ্ছেন, আমি সে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দিচ্ছি যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং তাতে করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য চলাচলের পথ। তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন আর আমরা তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। যা তোমরা আহার কর। তোমাদের গবাদি পশু চরাও।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
ھُوَ الَّذِیْٓ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً لَّکُمْ مِّنْھُ شَرَابٌ وَّمِنْھُ شَجَرٌ فِیْھِ تُسِیْمُوْنَﭙیُنْۭبِتُ لَکُمْ بِھِ الزَّرْعَ وَالزَّیْتُوْنَ وَالنَّخِیْلَ وَالْاَعْنَابَ وَمِنْ کُلِّ الثَّمَرٰتِﺚ اِنَّ فِیْ ذٰلِکَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّتَفَکَّرُوْنَ
“তিনিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য সেটার দ্বারা জন্মান শস্য, যায়তুন, খেজুর বৃক্ষ, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা নাহল ১৬:১০-১১)
نُهيِ শব্দটি نهية এর বহুবচন অর্থ হল বিবেক, জ্ঞান। اولوا النهي অর্থ বিবেকবান, জ্ঞানী ব্যক্তি।
(تَارَةً أُخْرٰي)
অর্থাৎ পুনরুত্থানের জন্য আবার কবর থেকে উঠানো হবে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখাকালীন তিন মুষ্ঠি মাটি দেয়ার সময় এ আয়াত পাঠ করতে হয়। এ বর্ণনা দুর্বল, তবে তিনবার মাটি দেয়ার বর্ণনা সহীহ সূত্রে ইবনু মাযাতে বর্ণিত হয়েছে। সে জন্য দাফনের সময় দু’হাত দিয়ে কবরে তিনবার মাটি দেয়া মুস্তাহাব বলা হয়। (আহকামুল জানাইয লিল আলবানী ১৫২ পৃ: ইরওয়াউল গালীল ৩/২০০)
ফির‘আউনকে এ সমস্ত নিদর্শন দেখানোর পরেও সে মিথ্যা আরোপ করেছিল এবং অমান্য করেছিল। এমনকি সে আনুগত্য করার পরিবর্তে আরো বলল যে, তুমি কি তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে দেশ হতে বহিস্কার করার জন্য এসেছ? যেমন ফির‘আউন বলল:
(قَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ إِنَّ هٰذَا لَسٰحِرٌ عَلِيْمٌ لا يُّرِيْدُ أَنْ يُّخْرِجَكُمْ مِّنْ أَرْضِكُمْ ج فَمَاذَا تَأْمُرُوْنَ)
“ফির‘আউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল: ‘এ তো একজন সুদক্ষ জাদুকর, ‘এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কার করতে চায়, এখন তোমরা কী পরামর্শ দাও?’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১০৯-১১০)
ফির‘আউন মূসা (عليه السلام)-এর এ সকল বিষয় জাদু মনে করে তার মোকাবিলা করার জন্য বলল: আমিও তোমার মত জাদু নিয়ে আসছি।
(فَاجْعَلْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدًا)
অর্থাৎ এমন একটা সময় নির্ধারণ কর এবং একটি (مَكَانًا سُوًي) তথা সমতল খোলা জায়গা নির্ধারণ কর, যাতে সকলে উপস্থিত হতে পারে এবং দেখতে পারে। যেমন সূরা শুআরার ৩৮-৪০ নং আয়াতে বলা আছে। মূসা (عليه السلام) বললেন: তোমাদেরকে ঈদের দিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যেদিন তোমরা সাজ-গোজ করে থাক। আর সময় হল দ্বিপ্রহরের সময়। ফির‘আউন প্রতিশ্রুতির সময় নিয়ে চলে গেল এবং তার সকল চক্রান্ত তথা জাদুকরদের একত্রিত করে নিয়ে আসল। সূরা আ‘রাফের ১১১-১১২ নং আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা আছে। জাদুকররা রাজ দরবারে উপস্থিত হলে ফির‘আউন তাদেরকে আশ্বাস দিল এবং জাদুকরদের দাবী অনুপাতে পুরস্কার ও নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। মূসা (عليه السلام) শুরুতেই জাদুকরদের লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা সত্য বলবে, তোমরা তোমাদের জাদুর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যা আরোপ কর না। যদি মিথ্যারোপ কর তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।
(فَتَنَازَعُوْآ أَمْرَهُمْ)
অর্থাৎ মূসা (عليه السلام)-এর কথা শুনে জাদুকরদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হল। কেউ বলল, সে যদি সত্য নাবী হয় তাহলে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, কেউ বিপরীত মত পোষণ করল।
الْمُثْلٰي শব্দটির অর্থ উৎকৃষ্ট, অর্থাৎ তোমরা যে উৎকৃষ্ট জাদুবিদ্যা নিয়ে আছো তা তারা নস্যাৎ করে দিতে চায়, সুতরাং তোমরা দৃঢ়ভাবে কাজ কর, কোন মতভেদ করো না। কারণ তারা বিজয়ী হয়ে গেলে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।
(بَلْ أَلْقُوْا) মূসা (عليه السلام) প্রথমে তাদেরকে নিক্ষেপ করতে বললেন এজন্য যে, যাতে এটা সকলের নিকট পরিস্কার হয়ে যায় যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় জাদুকররাও মূসা (عليه السلام)-এর কাছে হেরে গেছে। তাছাড়া জাদুকররাও বুঝতে পারবে যে, মূসা (عليه السلام) যা নিয়ে এসেছে তা জাদু নয় বরং সে একজন সত্য নাবী এবং তার সাথে যা আছে তা মু‘জিযাহ।
(حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ)
জাদুকরদের লাঠি ও রশিগুলো কি সত্যি সাপ হয়েছিল না বাহ্যতঃ সাপ বানিয়ে দেখিয়েছিল। অত্র আয়াত বলছে:
(يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعٰي)
“তাদের জাদু-প্রভাবে মূসার মনে হল তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” অর্থাৎ সত্য সাপ হয়ে যায়নি। বরং জাদুকররা এক প্রকার মেসমেরিজমের মাধ্যমে দর্শকদের কল্পনাশক্তিকে ক্রিয়াশীল করে দৃষ্টি বিভ্রাট ঘটিয়ে দিয়েছিল। ফলে এগুলো দর্শকদের কাছে ছুটাছুটিরত সাপ মনে হচ্ছিল।
(فَأَوْجَسَ فِيْ نَفْسِه۪ خِيْفَةً مُّوْسٰي)
অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) তাদের জাদু দেখে স্বভাবত ভয় পেয়ে গেলেন। যা স্বাভাবিকভাবে মানুষের হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে ভয় করতে নিষেধ করলেন ও নিজের হাতের লাঠি ছাড়তে বললেন, ফলে মূসা (عليه السلام)-এর লাঠি সাপে পরিণত হল আর তা তাদের পক্ষ থেকে যাদুর প্রভাবে যা সাপ হিসেবে দেখা যাচ্ছিল তার সবকেই খেয়ে ফেলল।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَأَلْقٰي مُوْسٰي عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُوْنَ)
“অতঃপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল, সহসা তা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল।” (সূরা শু‘আরা ২৬:৪৫)
যখন তারা মূসা (عليه السلام) ও আল্লাহর এ সমস্ত নিদর্শনাবলী দেখতে পেল তখন তারা বুঝতে পারল যে, এটা জাদু নয়, বরং এটা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ প্রদত্ত মু‘জিযা। তখন তারা সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলল যে, আমরা মূসা ও হারূনের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম। তখন ফির‘আউন তাদের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বলল যে, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা ঈমান নিয়ে আসলে। সুতরাং শাস্তিস্বরূপ আমি তোমাদের বিপরীত দিক থেকে অর্থাৎ একপার্শ্বের হাত আর অন্যপার্শ্বের পা কেটে ফেলব। আর অবশ্যই তোমাদেরকে খেজুর বৃক্ষের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করব।
যেমন ফির‘আউন বলেছিল:
(ققَالَ اٰمَنْتُمْ لَھ۫ قَبْلَ اَنْ اٰذَنَ لَکُمْﺆ اِنَّھ۫ لَکَبِیْرُکُمُ الَّذِیْ عَلَّمَکُمُ السِّحْرَﺆ فَلَسَوْفَ تَعْلَمُوْنَﹽ لَاُقَطِّعَنَّ اَیْدِیَکُمْ وَاَرْجُلَکُمْ مِّنْ خِلَافٍ وَّلَاُصَلِّبَنَّکُمْ اَجْمَعِیْنَ)
“ফির‘আউন বলল: ‘আমি তাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা তাতে ঈমান আনলে? সে তোমাদের প্রধান যে তোমাদেরকে জাদু শিখিয়েছে। শীঘ্রই তোমরা এর পরিণাম জানবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত এবং তোমাদের পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করবই।’’ (সূরা শু‘আরা ২৬:৪৯)
এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১২৩-১২৪ নং আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।
তখন জাদুকররা বলল: আমাদের নিকট যে স্পষ্ট বিধান এসেছে তার ওপর ও আমাদের রবের ওপর আমরা কখনো তোমাকে প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছা মত যে শাস্তি দেয়ার দিতে থাক। আমরা আমাদের রবের প্রতি ঈমান আনলাম যাতে তিনি আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন। যেমন তাদের উক্তি:
(قَالُوْا لَا ضَيْرَ ز إِنَّآ إِلٰي رَبِّنَا مُنْقَلِبُوْنَ)
“তারা বলল: ‘কোন ক্ষতি নেই, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব।” (সূরা শু‘আরা ২৬:৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(قَالُوْآ إِنَّآ إِلٰي رَبِّنَا مُنْقلِبُوْنَ ج وَمَا تَنْقِمُ مِنَّآ إِلَّآ أَنْ اٰمَنَّا بِاٰيٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَا۬ءَتْنَا ط رَبَّنَآ أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِيْنَ )
“তারা বলল: ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব। ‘তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছো শুধু এজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি যখন সেটা আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদেরকে মৃত্যু দাও।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১২৫-১২৬)
কেননা যারা অপরাধী হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে তারা তো তথায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর তারা তথায় মরবেও না আবার বাঁচবেও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ ج لَا يُقْضٰي عَلَيْهِمْ فَيَمُوْتُوْا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِّنْ عَذَابِهَا ط كَذٰلِكَ نَجْزِيْ كُلَّ كَفُوْرٍ ج )
“আর যারা কুফরী করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে জাহান্নামের আযাবও হালকা করা হবে না। আমি এরূপই শাস্তি দিয়ে থাকি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে।” (সূরা ফাতির ৩৫:৩৬)
পক্ষান্তরে যারা সৎ কাজ করবে ও ঈমান নিয়ে আসবে আর এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে তাদের জন্য থাকবে উচ্চ মর্যাদা। আর তারা তথায় এমন জান্নাতে প্রবেশ করবে যা চিরস্থায়ী এবং যার নিচে দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنّٰتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا لا خٰلِدِيْنَ فِيْهَا لَا يَبْغُوْنَ عَنْهَا حِوَلًا )
“নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান, সেথায় তারা স্থায়ী হবে, তা হতে স্থানান্তর কামনা করবে না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮:১০৭-১০৮)
সুতরাং মানুষের অন্তরে যখন ঈমান প্রবেশ করে তখন যে কোন কিছু প্রতিহত করতে পারে, সেটা যত বড় হুমকি বা শাস্তিই হোক। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফির‘আউনের জাদুকর বাহিনী। তারা সত্য উপলদ্ধি করার পর ঈমান আনতে বিলম্ব করেনি এমনকি মর্মন্তুদ শাস্তিও তাদেরকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
ফির‘আউন এ সকল মু’জিযাহ দেখার পরেও ঈমান আনতে অস্বীকার করল, বরং তার কুফরী আরো বেড়ে গেল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَحَدُوْا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَآ أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَّعُلُوًّا ط فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِيْنَ ع)
“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল।” (সূরা নামল ২৭:১৪)
এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ওয়াহী করলেন যে, তুমি আমার বান্দাদের নিয়ে রাতে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এক শুষ্ক পথ নির্মাণ কর। এ সম্পর্কে সূরা শুআরার ৬৩-৬৭ নং আয়াতে আলোচনা আছে। دَرَكًا অর্থ পাকড়াও করা, অর্থাৎ ফির‘আউন ও তার দলবল তোমাদেরকে পাকড়াও করে ফেলবে এ আশংকা করো না এবং তোমরা সমুদ্রে ডুবে যাবে এ ভয়ও করো না।
মূসা (عليه السلام) বানী-ইসরাঈলদেরকে নিয়ে মিসর থেকে চলে যাওয়ার জন্য রাতের প্রথমাংশে রওনা দিলেন। যখন সকাল হল ফির‘আউন জানতে পেরে দলবল নিয়ে মূসা (عليه السلام) ও বানী-ইসরাঈদেরকে ধরার জন্য পেছনে রওনা করল। মূসা (عليه السلام) বানী-ইসরাঈলদের নিয়ে নীল নদের কাছে চলে এসেছেন, পেছনে ফির‘আউন ও তার দলবল চলে এসেছে। যখন বানী-ইসরাঈলরা দেখল আমরা তো পাকড়াও হয়ে গেলাম, কারণ সামনে নদী পেছনে ফির‘আউন বাহিনী।
মূসা (عليه السلام) বললেন:
(كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّيْ سَيَهْدِيْنِ )
“কখনই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।’’ (সুরা শু‘আরা ২৬:৬২)
তারপর সমুদ্রে পথ বের করে দিলেন, মূসা (عليه السلام) ও বানী-ইসরাঈলরা পার হয়ে গেল। এদিকে ফির‘আউন দলবল নিয়ে সমুদ্রে রাস্তা পেয়ে নেমে গেল, অর্ধেক রাস্তা যেতেই নিমজ্জিত হয়ে মারা গেল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
( فَلَمَّآ اٰسَفُوْنَا انْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنٰهُمْ أَجْمَعِيْنَ)
“যখন তারা আমাকে ক্রোধান্বিত করল তখন আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম এবং নিমজ্জিত করলাম তাদের সবাইকে।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৫৫)
(وَأَضَلَّ فِرْعَوْنُ قَوْمَه۫ وَمَا هَدٰي)
“আর ফির‘আউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছিল এবং সে সৎ পথ দেখায়নি।” এখানে দুটি অর্থই নেয়া যায়-
১. ফির‘আউন তার জাতিকে সঠিক পথ দেখায় নাই যা মূসা (عليه السلام) নিয়ে এসেছিলেন। বরং বিভিন্ন দোহাই দিয়ে পথভ্রষ্ট করে রেখেছে।
২. ফির‘আউন মূসা (عليه السلام)-কে ধরার জন্য সঠিক পথ দেখায়নি, বরং ভুল পথে নিয়ে গেছে। যার ফলে ডুবে মারা গেছে। কারণ সমুদ্রের মধ্যে রাস্তা হয়ে গেছে যা পূর্বে ছিল সে পথে পা বাড়ানো ভুল পথে যাওয়ার শামিল নয়?
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের প্রতি যে সকল নেয়ামত দান করেছেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন। তাদেরকে ফির‘আউনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন, সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন তীহ ময়দানে মান্না ওয়াস সালওয়াহ নাযিল করেছেন। তুর পাহাড়ের ডান পাশে কিতাব নাযিলের প্রতিশ্রুতি দান করেছেন ইত্যাদি। বানী-ইসরাঈলদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪০-৪৭ নং আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَلَا تَطْغَوْا فِيْهِ)
অর্থাৎ তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তার ব্যাপারে সীমালংঘন করো না। না খেয়ে নষ্ট করবে না, অথবা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজে ব্যবহার করবে না। যদি তা কর তাহলে তোমাদের উপরও আমার গযব পতিত হবে। অর্থাৎ তার উপর আমি ক্রোধান্বিত হয়ে যাব, আর যার উপর আমার ক্রোধ হয় সে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
(وَإِنِّيْ لَغَفَّارٌ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির জন্য ক্ষমাশীল যে চারটি কাজ করবে ১. কুফর, শিরক, বিদআত ও পাপ কাজ থেকে তাওবা করবে, ২. ঈমানের সকল রুকনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে, ২. অন্তর, শরীর ও জিহ্বা দিয়ে সৎ আমল করবে, ৪. হিদায়াতের পথে অবিচল থাকবে।
মূসা (عليه السلام)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, চল্লিশ রাতভর তার ওপর তাওরাত নাযিল করবেন। সেই প্রতিশ্রুতির সময় আসার আগেই মূসা (عليه السلام) বানী-ইসরাঈলদেরকে পেছনে ফেলে তিনি আগেই তুর পাহাড়ে চলে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বললেন: তারা আমার পেছনে আসছে অচিরেই চলে আসবে, আমি আগে আসার কারণ হল আপনার নৈকট্য হাসিল করা যাতে আপনি আমার প্রতি বেশি খুশি হন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: তুমি তো এখানে চলে এসেছ, আমি তাদেরকে বাছুর পূজা দ্বারা পরীক্ষা করেছি। সামিরী নামক এক ব্যক্তি বাছুর নিয়ে এসে পূজা করতে বললে তারা তাই করল। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১৪৮ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনে মূসা (عليه السلام) তেমন কোন গুরুত্ব দেননি, শুধু রাগান্বিত ও অনুতপ্ত অবস্থায় সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলেন। কিন্তু যখন এসে স্বচক্ষে দেখলেন তখন রাগের মাত্রা বেড়ে গেল এমনকি হাতের ফলকগুলো নিক্ষেপ করে দিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:“মূসা যখন ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করল তখন বলল: ‘আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা আমার কতই নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছ! তোমাদের প্রতিপালকের আদেশের পূর্বে তোমরা ত্বরান্বিত করলে?’ এবং সে ফলকগুলো ফেলে দিল আর স্বীয় ভ্রাতাকে চুল ধরে নিজের দিকে টেনে আনল। হারূন বলল: ‘হে আমার সহোদর! লোকেরা তো আমাকে দুর্বল মনে করেছিল এবং আমাকে প্রায় হত্যা করেই ফেলেছিল। তুমি আমার সাথে এমন কর না যাতে শত্র“রা আনন্দিত হয় এবং আমাকে জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত কর না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫০)
(أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا)
অর্থাৎ তাওরাত নাযিল করে তোমাদেরকে কি উত্তম তথা জান্নাত ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেননি? সে প্রতিশ্রুতির সময় কি দীর্ঘ হয়ে গেছে যে, তোমরা ভুলে গিয়ে বাছুর পূজা শুরু করে দিলে? নাকি আমার অনুপস্থিতি অনেক লম্বা হয়ে গেছে? নাকি তোমরা চাচ্ছ তোমাদের ওপর তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ নেমে আসুক? জাতির লোকেরা মূসা (عليه السلام)-এর কথা শুনে উত্তর দিল, আমাদের এখতিয়ারে এ কাজ করিনি। কী কারণে করেছে তা পরের অংশে বলা হয়েছে। হারূন (عليه السلام) তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। সুতরাং তোমরা কেবল এক আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে থাক আর আমার ও আমার কাজের অনুসরণ কর। কিন্তু তারা তার কথা শুনল না বরং বলল যে, আমরা মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ পূজা থেকে বিরত হব না।
তখন মূসা (عليه السلام) হারূন (عليه السلام)-কে এ ব্যাপারে তার দাড়ি ও চুল ধরে যখন জিজ্ঞেস করল তখন তিনি তার পূর্ব কথা বললেন এবং বললেন যে, তারা তা শোনেনি।
তখন মূসা (عليه السلام) আবার সামিরীকে জিজ্ঞেস করলেন। হে সামিরী! তোমার ব্যাপার কী? তখন সামিরী তার ঘটনা বৃত্তান্ত খুলে বলল: মূসা (عليه السلام) তার কথা শুনে তাকে শাস্তি দিলেন, তা হল সে কারো সাথে মিশতে পারবে না। সকলে তাকে বর্জন করবে। আর তার গোবৎসকে মূসা (عليه السلام) পুড়িয়ে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন যে, আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র মা‘বূদ, তিনি ব্যতীত আর কোন সঠিক মা‘বূদ নেই।
(أَنْ تَقُوْلَ فَرَّقْتَ بَيْنَ بَنِيْٓ إِسْرَآئِيْلَ وَلَمْ تَرْقُبْ قَوْلِيْ)
‘তুমি বলবে, ‘তুমি বানী ইসরাঈলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ ও তুমি আমার বাক্য পালনে যতত্নবান হওনি।’ সূরা আ‘রাফের ১৪২ নং আয়াতে বলা হয়েছে হারূন (عليه السلام)-এর উত্তর এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, লোকেরা আামাকে দুর্বল ভেবেছিল এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। যার অর্থ হল হারূন (عليه السلام) নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করেছিলেন এবং তাদেরকে বুঝানো ও বাছুর পূজা হতে বিরত করার ব্যাপারে কোন প্রকার ক্রটি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। কিন্তু ব্যাপারটিকে তিনি এত বাড়তে দেননি যাতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। কারণ হারূন (عليه السلام)-কে হত্যা মানেই তাঁর সমর্থন ও বিরোধীদের মধ্যে আপোসে রক্তপাত শুরু হয়ে যেত এবং বানী ইসনরাঈলরা দু’ দলে বিভক্ত হয়ে পড়ত, যারা একে অপরের রক্ত পিপাসু হত। যেহেতু মূসা (عليه السلام) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না সেহেতু তিনি এ স্পর্শকাতর পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি। আর সে কারণেই তিনি হারূন (عليه السلام)-এর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটি পরিস্কার হওয়ার পর তিনি আসল অপরাধীর দিকে ফিরলেন।
সুতরাং হারূন (عليه السلام)-এর উক্তি ‘আসলে আমি আশংকা করলাম যে, আপনি বলবেন, তুমি বানী-ইসরাইলদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথার অপেক্ষা করনি’ থেকে এ দলীল নেয়া সঠিক নয় যে, মুসলিমদের মাঝে একতা ও সংহতি বজায় রাখার স্বার্থে শিরকী কর্মকাণ্ড ও অন্যায়কে মেনে নেয়া উচিত।
(أَثَرِ الرَّسُوْلِ)
এখানে রাসূল দ্বারা উদ্দেশ্য হল জিবরীল (عليه السلام)। সামিরীর কথা “আমি দেখলাম যা তারা দেখেনি” এর অর্থ হল সামিরী জিবরীল (عليه السلام)-এর ঘোড়া পার হতে দেখল এবং তার পায়ের নিচের কিছু মাটি নিজের কাছে রেখে দিল। যার মধ্যে কিছু অলৌকিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সে মাটিকে গলিত অলংকার বা বাছুর এর ভেতর ভরে দিল যার ফলে ওর ভেতর হতে এক ধরনের আওয়াজ বের হতে শুরু হল। আর তা তাদের ভ্রষ্টতা ও ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়াল।
لَامِسَاسَ অর্থাৎ তুমি সারা জীবন এটি বলতে থাকবে যে, আমার নিকট হতে দূরে থাকো। আমাকে স্পর্শ করো না বা ছুঁয়ো না। কারণ তাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে (সামিরী ও স্পর্শকারী) উভয়েই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ত। সে কারণে যখনই সে কোন মানুষকে দেখত তখনই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠত আমাকে ছুঁয়ো না। সে মানুষের জন্য শিক্ষার এক নমুনা হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য যে যত বেশি বাহানা ছল-চাতুরি ও ধোঁকাবাজি করবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার শাস্তিও সে হিসেবে তত বেশি কঠিন ও শিক্ষণীয় হবে।
(لَنُحَرِّقَنَّه ثُمَّ لَنَنْسِفَنَّه فِي الْيَمِّ)
‘আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবই, অতঃপর তাকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।’ এখান থেকে বুঝা যায় শির্ক নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বরং তার নাম নিশানা ও অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলা উচিত, তার সম্পর্ক যত বড়ই ব্যক্তিত্বের সাথেই হোক না কেন। আর এটা তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমান নয়; যেমন বিদ‘আতী, তাজিয়া ও কবর পূজারীরা মনে করে থাকে। বরং এটি তাওহীদের উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় আত্মচেতনাবোধের দাবী। যেমন এ ঘটনায় দূত (জিবরীল) এর পদচিহ্ন এর মাহাত্ম্য খেয়াল করা হয়নি; যাতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক বরকত দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। বরং তা সত্ত্বেও তার পরোয়া করা হয়নি। কারণ তা শিরকের মাধ্যম ও অসীলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন এ গুণের প্রমাণ পেলাম।
২. কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিন-তারিখ গোপন রাখার পেছনে হিকমত রয়েছে তা জানলাম।
৩. মূসা (عليه السلام)-এর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে জানলাম।
৪. তাসবীহ পাঠ করার ফযীলত জানা গেল।
৫. আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে যে পরীক্ষায় ফেলেছিলেন তা জানলাম।
৬. যাদের মাঝে ঈমানের স্বাদ প্রবেশ করেছে তাদেরকে শত বাধা ও শাস্তি ঈমান থেকে ফেরাতে পারে না।
৭. আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার ভুল-ত্র“টি থেকে মুক্ত।
৮. জাদু বিদ্যা কখনো সফলতা লাভ করতে পারে না।
৯. জাদু বিদ্যা সম্পূর্ণ হারাম।
১০. ঈমান আনার পর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পরীক্ষা করেন।
১১. শির্ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন সকল নিশানা উৎখাত করে দিতে হবে।
১২. যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তিনি তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের পথ সহজ করে দেন।
9 Fozlur Rahman
তোমাদের (প্রকৃত) উপাস্য তো আল্লাহ, যিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত।
10 Mokhtasar Bangla
৯৮. হে মানুষ! তোমাদের সত্য মা’বূদ হলেন আল্লাহ, যিনি ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নেই। যিনি প্রতিটি জিনিসের জ্ঞান রাখেন। কোন বস্তুর জ্ঞানই তাঁর আওতার বাইরে নয়।
11 Tafsir Ibn Kathir
৯৫-৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসা (আঃ) সামেরীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে সামেরী! এটা করতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছে?" হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ লোকটি আহলে বাজিরমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কওম গরু-পূজারী ছিল। তার অন্তরেও গরুর মুহব্বত ঘর করে নেয়। সে বাহ্যিকভাবে বানী ইসরাঈলের সাথে ঈমান এনেছিল। তার নাম ছিল মূসা ইবনু যু। একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, সে কিরমানের অধিবাসী ছিল। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তার গ্রামের নাম ছিল সামেরা। সে হযরত মূসার (আঃ) প্রশ্নের উত্তরে বলেঃ “ফিগ্রাউনকে ধ্বংস করার জন্যে যখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন তখন আমি তার ঘোড়ার খুরের নীচে হতে কিছুটা মাটি উঠিয়ে নিই।”
অধিকাংশ তাফসীরকারদের মতে প্রসিদ্ধ কথা এটাই। হযরত আলী (রাঃ)। হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে যখন হযরত মূসাকে (আঃ) আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হন তখন সামেরী এটা দেখে নেয়। তাড়াতাড়ি সে তার ঘোড়ার খুরের নীচের মাটি উঠিয়ে নেয়। হযরত জিবরাঈল (আঃ) হযরত মূসাকে (আঃ) আকাশ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যান। আল্লাহ তাআলা তাওরাত লিখেন। হযরত মূসা (আঃ) কলমের লিখার শব্দ শুনতে পান। কিন্তু যখন তিনি তার কওমের বিপদের অবস্থা জানতে পারেন তখন তিনি নীচে নেমে এসে ঐ বাছুরটিকে জ্বালিয়ে দেন। (এই হাদীসের সনদ দুর্বল)
ঐ এক মুষ্টি মাটিকে সে বানী ইসরাঈলের জমাকৃত অলংকারের পোড়ার সময় তাতে নিক্ষেপ করে দেয়। ওটা তখন বাছুরের রূপ ধারণ করে। ওর ভিতর ফাকা ছিল বলে ওর মধ্য দিয়ে বাতাস যাওয়া-আসা করতো এবং এর ফলে একটা শব্দ বের হতো। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) দেখেই সে মনে মনে বলেঃ “আমি তার ঘোড়ার খুরের নীচে হতে মাটি উঠিয়ে নিবো। এই মাটি গর্তে নিক্ষেপ করলে আমি যা চাইবো ওটা তাই হয়ে যাবে।”ঐ সময়েই তার অঙ্গুলীগুলি শুকিয়ে গিয়েছিল। বানী ইসরাঈল যখন দেখলো যে, তাদের কাছে ফিরাউনীদের অলংকারাদি রয়ে গিয়েছে এবং তারা ধ্বংস হয়ে গেছে, সুতরাং এগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া আর সম্ভম্ব নয়। তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়লো। সামেরী বললোঃ “দেখো, এই কারণেই, তোমাদের উপর বিপদ আপতিত হয়েছে। কাজেই এগুলো জমা করে তাতে আগুন লাগিয়ে দাও।” তারা তাই করলো। যখন ওগুলো আগুনে গলে গেল তখন তার মনে হলো যে, ঐ মাটি ওতে নিক্ষেপ করবে এবং ওর দ্বারা গো বৎসের আকৃতি বানিয়ে নেবে। তাই হয়ে গেল। সে তখন বানী ইসরাঈলকে বললোঃ “এটাই তোমাদের ও মূসার (আঃ) মাবুদ।” আল্লাহ তাআলা তার এই জবাবই এখানে উদ্ধত করেছেনঃ “আমি ওটা নিক্ষেপ করেছিলাম এবং আমার মন আমার জন্যে শোভন করেছিল এইরূপ করা।” তখন হযরত মূসা (আঃ) তাকে বললেনঃ “দূর হও। তোমার জীবদ্দশায় তোমার জন্যে এটাই রইলো যে, তুমি বলবে, আমি অস্পৃশ্য এবং তোমার জন্যে রইলো এক নির্দিষ্ট কাল, তোমার বেলায় যার ব্যতিক্রম হবে না। আর তুমি তোমার যে মা’দের পূজায় রত ছিলে তার প্রতি লক্ষ্য কর যে, আমরা ওকে জ্বালিয়ে দিবই, অতঃপর ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।” এইরূপ করার ফলে ঐ স্বর্ণ নির্মিত বাছুরটি ঐভাবেই পুড়ে গেল। যে ভাবে রক্ত মাংসের বাছুর পুড়ে যায়। তারপর ওর ছাইকে প্রখর বাতাসের দিনে সমুদ্রে উড়িয়ে দেয়া হয়।
বর্ণিত আছে যে, সামেরী তার সাধ্যমত বানী ইসরাঈলের মহিলাদের নিকট হতে অলংকারাদি গ্রহণ করেছিল এবং ওগুলি দিয়ে বাছুর তৈরী করেছিল। ওটাকেই হযরত মূসা (আঃ) জ্বালিয়ে দিয়ে ওর ভগ্ন সমুদ্রে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেই ওর পানি পান করেছিল। তারই চেহারা হলুদে বর্ণ ধারণ করেছিল। এর মাধ্যমেই সমস্ত বাছুর পূজারীর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তারা তখন তাওবা করে এবং হযরত মূসাকে (আঃ) বলেঃ “আমাদের তাওবা ককূল হওয়ার উপায় কি?" তখন তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন একে অপরকে হত্যা করে। এর পূর্ণ বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে।
অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমাদের মাবুদ এটা নয়। ইবাদতের যোগ্য তো একমাত্র আল্লাহ। বাকী সমস্ত জগত তাঁর মুখাপেক্ষী এবং তার অধীনস্থ। সব কিছুরই তাঁর অবগতি রয়েছে। তাঁর জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টজীবকে ঘিরে রেখেছে। সমস্ত জিনিসের সংখ্যা তার জানা আছে। এক অনুপরিমাণ জিনিসও তার জ্ঞানের বাইরে নেই। প্রত্যেক পাতা ও প্রত্যেক দানার তিনি খবর রাখেন। তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে সব কিছুই বিদ্যমান রয়েছে। যমীনের সমস্ত জীবকে তিনিই আহার্য দান করে থাকেন। প্রত্যেকের জায়গা তার জানা আছে। প্রকাশ্য কিতাবে সবকিছুই লিপিবদ্ধ আছে। এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে।