আম্বিয়া আয়াত ৮২
وَمِنَ الشَّيٰطِيْنِ مَنْ يَّغُوْصُوْنَ لَهٗ وَيَعْمَلُوْنَ عَمَلًا دُوْنَ ذٰلِكَۚ وَكُنَّا لَهُمْ حٰفِظِيْنَ ۙ ( الأنبياء: ٨٢ )
Wa minash Shayaateeni mai yaghoosoona lahoo wa ya'maloona 'amalan doona zaalika wa kunna lahum baafizeen (al-ʾAnbiyāʾ ২১:৮২)
English Sahih:
And of the devils [i.e., jinn] were those who dived for him and did work other than that. And We were of them a guardian. (Al-Anbya [21] : 82)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
শয়ত্বানদের কতক তার জন্য ডুবুরির কাজ করত, এছাড়া অন্য কাজও করত, আমিই তাদেরকে রক্ষা করতাম। (আম্বিয়া [২১] : ৮২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
শয়তানদের মধ্যে কতক তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত, এটা ছাড়া অন্য কাজও করত; [১] আর আমি তাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম।[২]
[১] জীনরাও সুলাইমান (আঃ)-এর অনুগত ছিল; তারা তাঁর আদেশে সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা তুলে আনত। অনুরূপভাবে অন্যান্য নির্মাণ কাজ প্রভৃতিও তাঁর ইচ্ছামত করত।
[২] অর্থাৎ, জীনদের মধ্যে যে অবাধ্যতা ও ফাসাদী স্বভাব ছিল, তা থেকে আমি সুলাইমানকে রক্ষা করেছি। ফলে তার সম্মুখে তাদের অবাধ্য হওয়ার উপায় ছিল না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর শয়তানদের মধ্যে কিছু সংখ্যক তার জন্য ডুবুরির কাজ করত, এ ছাড়া অন কাজও করত [১]; আর আমরা তাদের রক্ষাকারী ছিলাম।
[১] অর্থাৎ আমরা সুলাইমানের জন্যে শয়তানের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যককে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, যারা তার জন্যে সমুদ্রে ডুব দিয়ে মনিমুক্তা সংগ্রহ করে আনত, এছাড়া অন্য কাজও করত; যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তারা সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্যে বেদী, সুউচ্চ প্রাসাদ, মুর্তি ও চৌবাচ্চার ন্যায় পাথরের বড় বড় পেয়ালা তৈরী করত।” [সূরা সাবাঃ ১৩] সুলাইমান তাদেরকে অধিক পরিশ্রমের কাজেও নিয়োজিত করতেন এবং অভিনব শিল্পকাজও করাতেন। অন্য আয়াতে এসেছে, “আর (অধীন করে দিলাম) প্রত্যেক প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী শয়তান (জিন) দেরকেও, এবং শৃংখলে আবদ্ধ আরো অনেককে।” [সূরা ছোয়াদ; ৩৭-৩৮]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর শয়তানদের মধ্যে কতক তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত, এছাড়া অন্যান্য কাজও করত। আর আমিই তাদের জন্য হিফাযতকারী ছিলাম।
4 Muhiuddin Khan
এবং অধীন করেছি শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্যে ডুবুরীর কাজ করত এবং এ ছাড়া অন্য আরও অনেক কাজ করত। আমি তাদেরকে নিয়ন্ত্রন করে রাখতাম।
5 Zohurul Hoque
আর শয়তানদের কতক তাঁর জন্য ডুব দিত আর তা ছাড়া আরো কাজ করত, আর আমরা ছিলাম তাদের তত্ত্বাবধায়ক।
6 Mufti Taqi Usmani
এবং কতক দুষ্ট জিনকেও আমি তার বশীভূত করে দিয়েছিলাম, যারা তার জন্য ডুবুরির কাজ করত এবং তাছাড়া অন্য কাজও করত। আর আমিই তাদের সকলের দেখাশোনা করছিলাম।
7 Mujibur Rahman
এবং শাইতানদের মধ্যে কতক তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত, এটা ছাড়া অন্য কাজও করত; আমি তাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম।
8 Tafsir Fathul Mazid
৭৮-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ ও তাঁর ছেলে সুলাইমান (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে এসেছেন। বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী পিতা ও পুত্র তথা দাঊদ (عليه السلام) ও সুলাইমান (عليه السلام)। আল্লাহ তা‘আলা উভয়কেই নবুওয়াত ও মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করার প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। বর্তমান ফিলিস্তীনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। দাঊদ (عليه السلام) হলেন আল্লাহ তা‘আলার সে বান্দা যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম (عليه السلام) স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হতে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়। (তিরমিযী, মিশকাত হা: ১১৮, হাসান সহীহ) তবে বিভিন্ন ঘটনার আলোকে জানা যায় দাঊদ (عليه السلام) থেকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর বিচার ফায়সালার হেকমত বেশি ছিল। যেমন
মেষপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার:
ঘটনাক্রমে তারা উভয়ে একটি শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে ফায়সালা করলেন। এ ফায়সালা ওয়াহীভিত্তিক ছিল। তবে সুলাইমান (عليه السلام)-এর কাছে এ ফায়সালার যে ওয়াহী নাযিল করা হয়ে ছিল তা দাঊদ (عليه السلام)-এর ওপর অবতীর্ণ ওয়াহীকে রহিত করে দিয়েছিল। কেউ বলেছেন, তা ওয়াহীভিত্তিক ছিল না বরং ইজতিহাদভিত্তিক ছিল। দাঊদ (عليه السلام) ইজতিহাদে সঠিক করতে পারেননি, তবে তাকে তিরস্কার করা হয়নি, সুলাইমান (عليه السلام) ইজতিহাদে সঠিক করেছিলেন এজন্য তার প্রশংসা করা হয়েছে।
ইমাম বাগাভী ইবনু আব্বাস, কাতাদাহ ও যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা দু’জন লোক দাঊদ (عليه السلام)-এর নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল মেষপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্যক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক মেষপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার মেষপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে প্রবেশ করে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। দাঊদ (عليه السلام) একজন নাবী হওয়ার সাথে সাথে একজন বাদশাহও ছিলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন, ক্ষেতের মালিক মেষগুলো নিয়ে যাবে যাতে তার ক্ষতিপূরণ হয়। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও মেষের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে তিনি এ ফায়সালা দিয়েছেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ (عليه السلام)-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলাইমান (عليه السلام)্ এর সাথে দেখা হয়। তিনি মোকাদ্দামার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। সুলাইমান (عليه السلام) এ ফায়সালার সাথে একমত হলেন না। তিনি পিতার কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হত। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, মেষের পাল ক্ষেতের মালিককে কিছু দিনের জন্য দিয়ে দেয়া হোক, সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হবে এবং ক্ষেত মেষের মালিকের হাতে তুলে দেয়া হোক। সে ক্ষেতের পরিচর্যা করে ঠিক করুক। যখন ক্ষেত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে তখন ক্ষেতের মালিক মেষগুলো ফেরত দিবে আর মেষের মালিক ক্ষেত দিয়ে দিবে। প্রথম ফায়সালা থেকে দ্বিতীয়টি উত্তম, এতে কারো ক্ষতি হবে না, বরং প্রত্যেকেই স্ব-স্ব জিনিস ফিরে পাবে।
দাঊদ (عليه السلام) উপযুক্ত বিচার না করতে পারায় তাঁকে তিরস্কার করা হয়নি বরং প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’ এখান থেকেই বলা হয় মুজতাহিদ ভুল করলেও পাকড়াও করা হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
(إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ)
যখন বিচারক বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করে, যদি ইজতিহাদ সঠিক হয় তাহলে দুটি নেকী পাবে, আর যদি ভুল করে তাহলে একটি নেকী পাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৭৩৬২, সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৬)
আর তাদের বিচারকার্য আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে হচ্ছিল অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিচারকার্য প্রত্যক্ষ করছিলেন। আর আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমানকে এ বিষয়ের ফায়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং উভয়কেই প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। যেমন হাদীসে এসেছে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দুজন মহিলা ছিল যাদের সাথে তাদের দু’জন পুত্র ছিল। একজনের শিশুকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তখন মহিলা দু’জনেই একে অপরকে বলে: বাঘে তোমার শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে এবং যেটা আছে সেটা আমার সন্তান। অবশেষে তারা দাঊদ (عليه السلام)-এর নিকট মুকাদ্দামা পেশ করে। তখন তিনি ফায়সালা দেন যে, শিশুটি বড় স্ত্রী লোকটির প্রাপ্য। অতঃপর তারা দু’জন বেরিয়ে আসে এবং সুলাইমান (عليه السلام)-এর কাছে ঘটনাটি খুলে বলে। সুলাইমান (عليه السلام) তাদেরকে বললেন: ছুরি নিয়ে এসো, এই শিশুকে কেটে দু’টুকরা করব। তখন ছোট স্ত্রী লোকটি বলল: আল্লাহ তা‘আলা আপনার ওপর রহম করুন। এটি তার সন্তান, একে কাটবেন না। অতঃপর তিনি এটিকে ছোট মহিলার জন্য ফায়সালা করে দেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪২৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৩৪৪)
سَخَّرْ অর্থ নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেয়া। অর্থাৎ দাঊদ (عليه السلام)-এর সাথে পাহাড়-পর্বত ও পক্ষীকুল আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করত, যখন তাসবীহ পাঠ করতে বলত তখনই করত। দাঊদ (عليه السلام) একজন ইবাদতগুজার বান্দা ছিলেন। তিনি বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করতেন এবং একদিন অন্তর সিয়াম পালন করতেন। তাঁর কন্ঠস্বর অত্যন্ত মধুর ছিল; ফলে পাখি, পাহাড়-পর্বত এমনকি সাগরের মাছ তাঁর সুর শুনতে চলে আসতো এবং আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করত।
(وَكُنَّا فٰعِلِيْنَ) অর্থাৎ দাঊদ (عليه السلام)-কে নবুওয়াত দেয়া, বিচার-ফায়সালা বুঝিয়ে দেয়া, পাখি ও পাহাড়কে তার অনুগত করে দেয়া এবং অন্যান্য মু‘জিযাহ আমিই দান করেছিলাম, সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
(صَنْعَةَ لَبُوْسٍ) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (عليه السلام)-এর জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলেন, ফলে তিনি তা দিয়ে যুদ্ধের বর্ম তৈরি করতে পারতেন। পৃথিবীর বুকে তিনিই সর্বপ্রথম এ কাজ করেন, তারপর থেকে এ শিক্ষা শুরু হয়। দাঊদ (عليه السلام) সম্পর্কে সূরা সাবার ১০-১১ নং আয়াত ও সূরা স্ব-দ-এর ১৭-১৯ নং আয়াতে আরো আলোচনা রয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি দাঊদ (عليه السلام)-এর জন্য যেমন পাহাড়, পাখি ইত্যাদি অনুগত করে দিয়েছিলেন, তেমনি বাতাসকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিষদবর্গসহ সিংহাসনে বসতেন এবং যেখানে ইচ্ছা করতেন এক মাসের পথ কয়েক ঘন্টায় পৌঁছে যেতেন। বাতাস তাঁর সিংহাসন উড়িয়ে নিয়ে যেত।
(الْأَرْضِ الَّتِيْ بَارَكْنَا)
কল্যাণের দেশ বলতে সিরিয়াকে বুঝানো হয়েছে।
জিন-শয়তানরাও সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত ছিল, তারা তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা তুলে আনত। অনুরূপভাবে অন্যান্য নির্মাণ কাজ করত, যেমন বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেছিল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَعْمَلُوْنَ لَه۫ مَا يَشَا۬ءُ مِنْ مَّحَارِيْبَ وَتَمَاثِيْلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُوْرٍ رّٰسِيٰتٍ ط اِعْمَلُوْآ اٰلَ دَاو۫دَ شُكْرًا ط وَقَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ)
“তারা (জিনেরা) সুলাইমানের জন্য সেসব বস্তু নির্মাণ করত যা তিনি ইচ্ছা করতেন, যেমন বড় বড় অট্টালিকা, মূর্তি, চৌবাচ্চার ন্যায় বড় পাত্র এবং চুল্লির ওপর দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বড় ডেগসমূহ। হে দাঊদের ক্বাওম! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পই কৃতজ্ঞ।” (সূরা সাবা ৩৪:১৩)
(وَكُنَّا لَهُمْ حٰفِظِيْنَ)
অর্থাৎ জিনদের মধ্যে যে অবাধ্যতা ও ফাসাদী স্বভাব ছিল, তা থেকে আল্লাহ সুলাইমান (عليه السلام)-কে রক্ষা করেছিলেন। ফলে তাঁর সম্মুখে তাদের অবাধ্য হওয়ার উপায় ছিল না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দাঊদ ও সুলাইমান (عليه السلام)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের বিবরণ জানলাম।
২. বিচারক কোন বিষয়ে ফায়সালা করতে গিয়ে সঠিকতায় পৌঁছার জন্য ইজতিহাদ করার পরেও ভুল করলে একটি নেকী পাবেন।
৩. জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে ছেলে বাপের চেয়েও বড় হতে পারে।
৪. দাঊদ (عليه السلام) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে বর্ম তৈরি করেন।
9 Fozlur Rahman
(তার অধীন করেছিলাম) কতিপয় শয়তানকে (দুষ্ট জ্বিনকে) যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এ ছাড়া অন্য কাজও করত; আর আমি তাদেরকে প্রহরায় রাখতাম।
10 Mokhtasar Bangla
৮২. আমি এমন কিছু জিনকে তাঁর অধীন করেছি যারা সাগরে ডুব দিয়ে মুক্তা ইত্যাদি বের করে আনে। এ ছাড়াও তারা অন্যান্য কর্ম করে যেমন: ঘর তৈরি করা। বস্তুতঃ আমি তাদের সংখ্যা ও কর্মসমূহ সংরক্ষণকারী। এগুলোর কোন কিছুই আমার হাত ছাড়া হয় না।
11 Tafsir Ibn Kathir
৭৮-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ওটা ছিল আঙ্গুরের ক্ষেত্র বা বাগান। ঐ সময় আঙ্গুর গাছের গুচ্ছ বের হয়েছিল। نَفَشَتْ শব্দের অর্থ হলো রাত্রিকালে পশুর চারণ ভূমিতে চরতে থাকা। দিবাভাগে চরাকে আরবী ভাষায় هَمل বলা হয়। হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ঐ বাগানটিকে বকরীগুলি নষ্ট করে দেয়। হযরত দাউদ (আঃ) ফায়সালা দেন যে, বাগানের ক্ষতি পুরণ স্বরূপ বকরীগুলি বাগানের মালিক পেয়ে যাবে। হযরত সুলাইমান (আঃ) এই ফায়সালা শুনে আরয করেনঃ “ হে আল্লাহর নবী (আঃ)! এটা ছাড়া অন্য একটা ফায়সালা করা যেতে পারে তো?” হযরত দাউদ (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “ওটা কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “প্রথমতঃ বকরীগুলি বাগানের মালিকের হাতে সমর্পণ করা হোক। সে ওগুলি দ্বারা ফায়েদা উঠাতে থাকবে। আর বাগান বকরীর মালিককে দেয়া হোক। সে আঙ্গুরের চারার খিদমত করতে থাকবে। অতঃপর যখন আঙ্গুরের গাছ গুলি ঠিক ঠাক হয়ে যাবে এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে তখন বাগানের মালিককে বাগান ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বাগানের মালিকও বকরীগুলি বকরীর মালিককে ফিরিয়ে দেবে।” এই আয়াতের ভাবার্থ এটাইঃ ‘আমি এই ঝগড়ার সঠিক ফায়সালা সুলাইমানকে (আঃ) বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।”
হযরত ইবনু আব্বাস (রা) বলেন যে, হযরত দাউদ (আঃ) যখন বকরীগুলি বাগানের মালিককে দিয়ে দেয়ার ফায়সালা করেন তখন বকরীর মালিকরা বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে কুকুর ছিল। হযরত সুলাইমান (আঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের ফায়সালা কি হলো?” তারা তাদের ফায়সালার খবর দিলে তিনি বললেনঃ “আমি সেখানে হাযির থাকলে এই ফায়সালা দেয়া হতো না, বরং অন্য ফায়সালা হতো। তার এ কথা হযরত দাউদের (আঃ) কানে পৌঁছলে তিনি হযরত সুলাইমানকে (আঃ) ডেকে পাঠান এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি কি ফায়সালা করতে?” তখন তিনি তাঁর উপরিউক্ত ফায়সালার কথা শুনিয়ে দেন।
হযরত মাসরূক (রাঃ) বলেন যে, ঐ বকরীগুলি আঙ্গুর গাছের গুচ্ছ ও পাতা সব খেয়ে ফেলেছিল। তখন হযরত সুলাইমান (আঃ) হযরত দাউদের (আঃ) বিপরীত ফায়সালা দেন যে, ঐ লোকদের বকরীগুলি বাগানের মালিকদের দিয়ে দেয়া হোক এবং ছাগলওয়ালাদেরকে বাগান সমর্পন করা হোক। যত দিন পর্যন্ত বাগান পূর্ব অবস্থায় ফিরে না আসবে ততদিন পর্যন্ত বকরী, বাচ্চা, দুধ এবং অন্যান্য সমস্ত উপকার বাগানের মালিকরা ভোগ করবে। অতঃপর প্রত্যেককে নিজনিজ জিনিস ফিরিয়ে দেয়া হবে।
কাযী শুরাইহ্ এর (রাঃ) কাছেও এইরূপ একটি বিচার আসলে তিনি এই ফায়সালা করেন যে, দিনের বেলায় বকরী কোন ক্ষতি করলে ওর কোন ক্ষতিপূরণ করতে হবে না। আর যদি রাত্রি বেলায় ক্ষতি করে তবে বকরীওয়ালাদেরকে যামিন হতে হবে। অতঃপর তিনি এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।
হযরত সা'দ ইবনু মাহীসাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত বারা ইবনু আযিবের (রাঃ) উন্থী একটি বাগানে প্রবেশ করে এবং বড়ই ক্ষতি করে ফেলে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফায়সালা করেন যে, দিনের বেলায় বাগানওয়ালাদের দায়িত্ব হলো বাগানের হিফাযত করা। আর যদি পশু রাত্রিকালে বাগানের ক্ষতি করে তবে পুশুর মালিকদেরকেই ওর যামিন হতে। হবে (অর্থাৎ ক্ষতি পূরণ করতে হবে)। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রাঃ) ইমাম আবু দাউদ (রাঃ) এবং ইমাম ইবনু মাজাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন) এই হাদীসে ইল্লাত সমূহ বের করা হয়েছে। আমরা কিতাবুল আহকামে আল্লাহর ফলে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছি।
বর্ণিত আছে যে, হযরত আইয়াম ইবনু মুআবিয়াকে কাযী পদে নিয়োগ করার জন্যে যখন তাঁর কাছে আবেদন জানানো হয় তখন তিনি হযরত হাসান্দ্রে (রাঃ) কাছে এসে কেঁদে ফেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আবু সাঈদ (রাঃ)! আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার কাছে এই রিওয়াইয়াত পৌঁছেছে যে, কাযী যদি ইজতিহাদ করার পরেও ভুল করে তবে সে জাহান্নামী হবে। আর যে কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ে সেও জাহান্নামী। কিন্তু যে ইজতিহাদ করার পর সঠিকতায় পৌঁছে যায় সে জান্নাতে যাবে।" তার এ কথা শুনে হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেনঃ “শুনুন, আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত সুলাইমানের (আঃ) ফায়সালার কথা বর্ণনা করেছেন। আর এটা প্রকাশমান যে, নবীরা (আঃ) ন্যায় বিচারক হয়ে থাকেন এবং তাঁদের কথা দ্বারা এই লোকদের কথা খণ্ডন করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা হযরত সুলাইমানের (আঃ) প্রশংসা করেছেন বটে, কিন্তু হযরত দাউদকে (আঃ) তিনি নিন্দা করেননি। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তাআলা বিচারকদের নিকট তিনটি কথার অঙ্গীকার নিয়েছেন। প্রথম অঙ্গীকার এই যে, তাঁরা যেন পার্থিব লোভের বশবর্তী হয়ে শরীয়তের আহকাম পরিবর্তন না করেন। দ্বিতীয় অঙ্গীকার এই যে, তারা যেন অন্তরের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির পিছনে না পড়েন বা প্রবৃত্তির অনুসরণ না করেন। তৃতীয় অঙ্গীকার এই যে, তারা যেন আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় না করেন। তারপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلْنٰكَ خَلِیْفَةً فِی الْاَرْضِ فَاحْكُمْ بَیْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَ لَا تَتَّبِـعِ الْهَوٰى فَیُضِلَّكَ عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ অর্থাৎ “হে দাউদ (আঃ)! আমি তোমাকে যমীনের খলীফা বা প্রতিনিধি বানিয়েছি, সুতরাং তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা কর এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, অন্যথায় ওটা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত করে ফেলবে।” (৩৮:২৬) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَ اخْشَوْنِ অর্থাৎ “মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় কর।” (৫:৪৪) অন্য একস্থানে মহান আল্লাহ বলেনঃ وَ لَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا অর্থাৎ “তোমরা সামান্য বা নগণ্য মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াতসমূহ। বিক্রি করো না।” (৫:৪৪) আমি বলি যে, নবীরা যে নিস্পাপ এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাদেরকে যে সাহায্য করা হয়ে থাকে এ বিষয়ে পূর্বযুগীয় ও পরযুগীয় গুরুজনদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। তাদের ছাড়া অন্যদের ব্যাপারে কথা এই যে, হযরত আম্র ইনবুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “বিচারক যখন ইজতিহাদ ও চেষ্টা করার পর সঠিকতায় পৌঁছে যায় তখন সে দুটো প্রতিদান লাভ করে। আর ইজতিহাদের পর যদি তার ভূল হয়ে যায় তবে তার জন্যে রয়েছে একটি প্রতিদান।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রাঃ) স্বীয় সহীহ্ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন) এহাদীসটি পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে, পুর্ণভাবে চেষ্টা চালানোর পরেও যদি বিচারক ভুল করে দেয় তবে সে জাহান্নামী হবে বলে যে ধারণা ও সন্দেহ হযরত আইয়াস (রাঃ) করেছেন তা ঠিক নয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সুনানের একটি হাদীসে রয়েছে যে, বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকারের বিচারক জান্নাতী ও দু'প্রকারের বিচারক জাহান্নামী। যে সত্য ও ন্যায় জানে এবং তদনুযায়ী ফায়সালা করে সে জান্নাতী। যে না জেনে ফায়সালা করে সে জাহান্নামী এবং যে সত্য জেনে শুনে ওর বিপরীত ফায়সালা করে সেও জাহান্নামী।
কুরআন কারীমে বর্ণিত এই ঘটনার কাছাকাছিই আর একটি ঘটনা মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “দু'টি মহিলা ছিল, যাদের সাথে তাদের দুটি পুত্র সন্তান ছিল, (তারা ছিল দুগ্ধ পোষ্য শিশু)। একজনের শিশুকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। এখন মহিলা দুটির প্রত্যেকেই একে অপরকে বলেঃ “বাঘে তোমার শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে এবং যেটা আছে আমারই।” অবশেষে তারা হযরত দাউদের (আঃ) নিকট এই মুকাদ্দামা পেশ করে। তখন তিনি ফায়সালা দেন যে, শিশুটি বড় স্ত্রী লোকটির প্রাপ্য। অতঃপর তারা দুজন বেরিয়ে আসে। পথে হযরত সুলাইমান (আঃ) ছিলেন। তিনি তাদেরকে ডাকলেন এবং (লোকদেরকে) বললেন “ছুরী নিয়ে এসো। আমি এই শিশুটিকে কেটে দুটুকরা করে দেবো এবং অর্ধেক করে দু’জনকে প্রদান করবো।” এতে বড় স্ত্রী লোকটি চুপ থাকলো। কিন্তু ছোট স্ত্রী লোকটি বললোঃ “আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন! শিশুটিকে কাটবেন ন। এটা বড় স্ত্রী লোকটিরই। সুতরাং তাকেই দিয়ে দিন।" হযরত সুলাইমান (আঃ) প্রকৃত ব্যাপার বুঝে নেন এবং শিশুটিকে ঐ ছোট স্ত্রী লোকটিকে দিয়ে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নাসায়ী (রাঃ) এর উপর একটি অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন যে, বিচারক যদি নিজের ফায়সালা অন্তরে গোপন রেখে প্রকৃত রহস্য জানবার উদ্দেশ্যে ওর বিপরীত কিছু বলেন তবে তা জায়েয হবে)
এ ধরনেরই একটি ঘটনা হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, বানী ইসরাঈলের যুগে একটি সুন্দরী নারী ছিল, যার প্রেমে চারজন নেতৃস্থানীয় লোক আসক্ত হয়ে পড়ে এবং তার সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা করে। কিন্তু ঐ নারী তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। তখন তারা তার প্রতি চরম দুঃখিত ও রাগান্বিত হয় এবং চারজন একমত হয়ে হযরত দাউদের (আঃ) বিচারালয়ে উপস্থিত হয় ও সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সে তার কুকুরের দ্বারা নিজের কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। চার জনের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে হযরত দাউদ (আঃ) মহিলাটিকে রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার নিদের্শ দেন। ঐ দিনই সন্ধ্যায় হযরত সুলাইমান (আঃ) নিজের সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে বসেন। তিনি বিচারক হন এবং চার জন ছেলে ঐ লোকগুলির মত তার কাছে ঐ মুকাদ্দামা পেশ করে এবং একটি স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে ঐ কথাই বলে। হযরত সুলাইমান (আঃ) ঐ চারজনকে পৃথক পৃথক করে দেয়ার নিদের্শ দেন। তার পর একজনকে তিনি তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “ঐ কুকুরটির রং কেমন ছিল?” সে উত্তরে বলেঃ “কালো”। এরপর দ্বিতীয় জনকে পৃথক ভাবে ডেকে ঐ প্রশ্নই করেন। সে জবাব দেয়ঃ “সাদা।” তিনি তৎক্ষণাৎ ফায়সালা দেন যে, স্ত্রী লোকটির উপর এটা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয় এবং এই চারজনকে হত্যা করে দেওয়া হোক।” হযরত দাউদের (আঃ) নিকটও এই ঘটনাটি পেশ করা হলো। তিনি তখনই ঐ চারজন নেতৃ স্থানীয় লোককে ডেকে পাঠান এবং ঐ রূপেই পৃথক পৃথক ভাবে তাদেরকে কুকুরটির রং সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়। তারা এক একজন এক এক কথা বলে এবং গড় বড় করে দেয়। হযরত দাউদের (আঃ) কাছে তারা মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয়ে যায়। সুতরাং তিনি তাদেরকে হত্যা করে দেয়ার নিদের্শ দেন। (এটা হাফিয আবুল কাসিম ইবনু আসাকির (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি বিহঙ্গকুলের জন্যে নিয়ম করে দিয়েছিলাম যে, তারা যেন হযরত দাউদের (আঃ) সাথে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। হযরত দাউদকে (আঃ) এমন মিষ্ট কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছিল যে, যখন তিনি মিষ্টি সুরে ও আন্তরিকতার সাথে যরূর পাঠ করতেন। তখন পক্ষীকূল উড়ন বাদ দিয়ে থেমে যেতো এবং তার সুরে সুরে মিলিয়ে আল্লাহর তাসবীহ পাঠে লেগে পড়তো। অনুরূপভাবে পাহাড় পর্বতও তাসবীহ পাঠ করতো।
বর্ণিত আছে যে, একদা রাত্রে হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) কুরআন কারীম পাঠ করছিলেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখান দিয়ে গমন করছিলেন। তার মিষ্টি সূরে কুরআন পাঠ শুনে তিনি দাড়িয়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনতে থাকেন। তারপর তিনি বলেনঃ “একে তো আ'লে দাউদের (আঃ) মত মিষ্টি সুর দান করা হয়েছে। হযরত আবু মূসা (রাঃ) এটা জানতে পেরে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি যদি জানতাম যে, আপনি আমার কুরআন পাঠ শুনতে ছিলেন। তবে আমি আরো উত্তম রূপে পাঠ করতাম।”
হযরত আবু উছমান নাহদী (রাঃ) বলেনঃ “ আমি কোন উত্তম বাজনার মধ্যে ঐ মজা পাই নাই যা হযরত আবূ মূসার (রাঃ) কণ্ঠস্বরে পেতাম।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার উত্তম কণ্ঠ স্বরকে হযরত দাউদের (আঃ) উত্তম ও মিষ্ট কণ্ঠস্বরের একটি অংশ বলেছেন। তাহলে স্বয়ং হযরত দাউদের কণ্ঠস্বর কত মধুর ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
আল্লাহ তাআলা তাঁর আর একটি অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেনঃ “আমি দাউদকে (আঃ) তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে ওটা তোমাদেরকে তোমাদের যুদ্ধে রক্ষা করে। তার যুগের পূর্বে হল্কা বিহীন বর্ম নির্মিত হতো। হলকা বিশিষ্ট বর্ম তিনিই তৈরী করেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ وَ اَلَنَّا لَهُ الْحَدِیْدَ ـ اَنِ اعْمَلْ سٰبِغٰتٍ وَّ قَدِّرْ فِی السَّرْدِ “তার জন্যে আমি লৌহকে নমনীয় করেছিলাম। (হে দাউদ (আঃ)! উদ্দেশ্য এই যে, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী করতে এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পার।" (৩৪:১০-১১) এই বর্ম যুদ্ধের মাঠে কাজে লাগতো। সুতরাং এটা ছিল এমনই নিয়ামত যার কারণে মানুষের উচিত মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাই তিনি বলেনঃ তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না?"
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি সুলাইমানের (আঃ) বশীভূত করেছিলাম উদ্দাম বায়ুকে, ওটা তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই দেশের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি। অর্থাৎ ঐ বায়ু তাকে সিরিয়ায় পৌঁছিয়ে দিতো। মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত হযরত সুলাইমান (আঃ) তার লোক-লশকর, সাজ-সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রসহ তার সিংহাসনে বসে যেতেন। অতঃপর বায়ু তাঁকে তাঁর গন্তব্য স্থানে ক্ষণিকের মধ্যে পৌছিয়ে দিতো। সিংহাসনের উপর হতে পাখী পালক দ্বারা তাকে ছায়া করতো। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ فَسَخَّرْنَا لَهُ الرِّیْحَ تَجْرِیْ بِاَمْرِهٖ رُخَآءً حَیْثُ اَصَابَ অর্থাৎ “আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে সে যেখানেই ইচ্ছা করতো সেথায় মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো।" (৩৮:৩৬) মহান আল্লাহ বলেনঃ غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَّ رَوَاحُهَا شَهْرٌ অর্থাৎ “(আমি সুলাইমানের (আঃ) অধীন করেছিলাম বায়ুকে) যা প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করতো।” (৩৪:১২)
হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাঃ) বলেন যে, ছয় লক্ষ চেয়ার রাখাহতো। তার পাশে বসতো মু'মিন মানুষ এবং তাদের পিছনে বসতো মু'মিন জ্বিন। তারপর তাঁর নির্দেশক্রমে পক্ষীকুল সবারই উপর ছায়া করতো। অতঃপর তার আদেশ অনুযায়ী বায়ু তাঁকে নিয়ে চলতে শুরু করতো। (এটা ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন) তার উপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদিল্লাহ ইবনু উমাইর (রাঃ) বলেন যে, হযরত সুলাইমান (আঃ) বাতাসকে হুকুম করতেন তখন ওটা স্থূপাকারে জমা হয়ে যেতো, যেন ওটা পাহাড়। তারপর তিনি তাঁর ফরাশ আনার নিদের্শ দিতেন। তখন উচু জায়গায় রেখে দেয়া হতো। অতঃপর তিনি তাঁর ডানা ওয়ালা ঘোড়া আনার হুকুম করতেন।
এরপর তিনি ঐ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে স্বীয় ফরাশে উঠে বসতেন। অতঃপর তাঁর নির্দেশক্রমে বায়ূ তাকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে যেতো। ঐ সময় তিনি মাথা নীচু করে থাকতেন। ডানে বামে মোটেই তাকাতেন না। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হতো বিনয় ও আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কেননা, নিজের নীচতার জ্ঞান তাঁর ছিল। অতঃপর বায়ুকে তিনি যেখানে নামাবার হুকুম করতেন সেখানেই নামিয়ে দিতো।
অনুরূপভাবে অবাধ্য শয়তানদেরকেও আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তার জন্যে ডুবুরী কাজ করতো। তারা সমুদ্রে ডুব দিয়ে ওর তলদেশ হতে মণি মুক্তা বের করে আনতো। আরো বহু কাজ তারা করতো।
যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ وَالشَّیٰطِیْنَ كُلَّ بَنَّآءٍ وَّ غَوَّاصٍ অর্থাৎ “এবং শয়তানদেরকে (আমি তার বাধ্য করেছিলাম), যারা সবাই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী।” (৩৮:৩৭) এরা ছাড়া অন্যান্য শয়তানরাও তার অনুগত ছিল, যাদেরকে শিকলে আবদ্ধ রাখা হতো।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম। কোন শয়তানই তার কোন ক্ষতি করতে পারতো না। বরং সবাই ছিল তার অনুগত ও অধীনস্থ। কেউই তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারতো না। তাদের উপর তাঁরই শাসন চলতো। যাকে ইচ্ছা তিনি বন্দী করতেন এবং যাকে ইচ্ছা ছেড়ে দিতেন। তাদের কথাই বলেনঃ ‘অন্যান্য জ্বিন ছিল যারা শৃংখলে আবদ্ধ থাকতো।'