৬৩-৬৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা নিজের ব্যাপক ক্ষমতা ও বিরাট শক্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি শুষ্ক, অনাবাদ ও মৃত যমীনের উপর বাতাসের মাধ্যমে মেঘমালা সৃষ্টি করে বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন। ফলে যমীন সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে। দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এখানে تَعْقِيْب ـ ف (পিছনে পিছনে আসা) এর জন্যে এসেছে। প্রত্যেক জিনিসের তাকীব ওরই অনুপাতে হয়ে থাকে। শুক্র রক্তপিণ্ড হওয়া, রক্ত মাংসপিণ্ড হওয়া যেখানে বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেখানেও ف এসেছে। অথচ এই দুই অবস্থার মধ্যে চল্লিশ দিনের ব্যবধান থাকে। আবার এটাও উল্লিখিত আছে যে, হিজাজের কতক মাটি এমনও আছে যার উপর বৃষ্টিপাত হওয়া মাত্রই ওটা রক্তিম ও সবুজ শ্যমল আকার ধারণ করে। সুতরাং এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। এক একটি দানা তাঁর গোচরে রয়েছে। যমীনের প্রান্তে এবং ভিতরে যা কিছু আছে সবই তাঁর জানা আছে। বীজের উপর পানি পতিত হয়, তখন তা হতে অংকুর বের হয়। যেমন হযরত লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেনঃ “হে বৎস! কোন কিছু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নীচে, আল্লাহ তাও হাজির করবেন; আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, খবর রাখেন সব বিষয়ের।”
আর এক জায়গায় বলেনঃ “(নিবৃত্ত করেছে এই জন্যে যে,) তারা যেন সিজুদা না করে আল্লাহ্কে যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর লুক্কায়িত বস্তুকে প্রকাশ করেন। আর একটি আয়াতে আছেঃ “প্রত্যেকটি পাতা যা ঝরে পড়ে, প্রত্যেকটি দানা যা যমীনের অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে এবং প্রত্যেক সিক্ত ও শুষ্ক জিনিসের খবর আল্লাহ জানেন, সবই প্রকাশ্য কিতাবের মধ্যে রয়েছে। অন্য একটি আয়াতে আছেঃ “আসমান ও যমীনের কোন অনুপরিমাণ জিনিসও আল্লাহর কাছে গোপন নেই এবং কোন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জিনিস এমন নেই যা প্রকাশ্য কিতাবে বিদ্যমান নেই।”
উমাইয়া ইবনু আবুস সালাত অথব্য যায়েদ ইবনু আমর ইবনু নুফায়েলের কাসীদায় রয়েছেঃ
وَقُوْلَا لَهٗ مَنْ يُّنْبِتُ الْحبَّ فِى الثَّرٰى ـ فَيُصْبِحُ منْهُ الْبَقْلُ يَهْتَزُّ رَّابِيًا
وَيُخْرُجُ مِنْهُ حَبَّهُ فِىْ رُؤُوْسِهٖ ـ فَفِيْ ذٰلِكَ اٰيَاتٌ لِّمَنْ كَانَ وَاعِيًا
অর্থাৎ “(হে আমার নবীদ্বয়!) তোমরা তাকে (ফিরাউনকে) বললাঃ মাটির মধ্য হতে দানা বের করেন কে? যার ফলে গাছ হয়ে গিয়ে আন্দোলিত হতে থাকে? এবং ওর মাথায় শিষ বের করেন কে? জ্ঞানীর জন্যে তো এতে মহাশক্তিশালী আল্লাহর মহাশক্তির নিদর্শনাবলী রয়েছে।”
সমস্ত বিশ্বজগতের একচ্ছত্র অধিপতি তিনিই। তিনি সবকিছু হতে বেপরোয়া ও অভাবমুক্ত। সবাই তার সামনে ফকীর, সবাই তার মুখাপেক্ষী। সমস্ত মানুষ আল্লাহর গোলাম।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমুদয়কে? সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ,বাগ-বাগীচা, ক্ষেত খামার তোমাদেরই উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন। যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিস তিনি তোমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযান সমূহকে তিনি তোমাদের কাজে লাগিয়ে রেখেছেন। এই নৌযান গুলি তোমাদেরকে এদিক হতে ওদিকে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে তোমাদের মাল ও আসবাবপত্র এক স্থান হতে অন্য স্থানে পৌঁছে যায়। পানি ফেড়ে, তরঙ্গ কেটে আল্লাহর নির্দেশক্রমে বাতাসের সাথে নৌকাগুলি তোমাদের উপকারার্থে চলতে রয়েছে। এখানকার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি ওখান থেকে এখানে এবং ওখানকার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি এখান হতে ওখানে সদা পৌঁছাতে রয়েছে।
তিনিই আকাশকে স্থির রেখেছেন। ওটা যমীনের উপর পড়ে যাচ্ছে না। তিনি ইচ্ছা করলে এখনই আসমান যমীনের উপর পড়ে যাবে এবং যমীনের অধিবাসী সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। মানুষ পাপে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করছেন। এটা তার পরম করুণার পরিচায়ক, যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ وَ اِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ لِّلنَّاسِ عَلٰى ظُلْمِهِمْ وَ اِنَّ رَبَّكَ لَشَدِیْدُ الْعِقَابِ অর্থাৎ “নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক লোকদের যুলুম সত্ত্বেও তাদের প্রতি ক্ষমাশীল এবং নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক কঠিন শাস্তিদাতাও বটে। (১৩:৬)
তিনিই তো তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন এবং তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পুনরায় তিনি তোমাদেরকে জীবন দান করবেন। যেমন তিনি বলেনঃ كَیْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللّٰهِ وَ كُنْتُمْ اَمْوَاتًا فَاَحْیَاكُمْ ثُمَّ یُمِیْتُكُمْ ثُمَّ یُحْیِیْكُمْ ثُمَّ اِلَیْهِ تُرْجَعُوْنَ অর্থাৎ “তোমরা কিরূপে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদেরকে জীবন্ত করেছেন, আবার তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করবেন, পরিণামে তার দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।” (২:২৮) আর এক জায়গায় বলেনঃ قُلِ اللّٰهُ یُحْیِیْكُمْ ثُمَّ یُمِیْتُكُمْ ثُمَّ یَجْمَعُكُمْ اِلٰى یَوْمِ الْقِیٰمَةِ لَا رَیْبَ فِیْهِ অর্থাৎ “বলঃ আল্লাহ তোমাদেরকে জীবিত রাখেন, অতঃপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনিই তোমাদেরকে একত্রিত করবেন, যে দিন সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই।" (৪৫:২৬) অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ “তারা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি দুইবার আমাদের মৃত্যু ঘটিয়েছেন এবং দুইবার জীবন্ত করেছেন।" কালামের ভাবার্থ হলোঃ এইরূপ আল্লাহর সাথে তোমরা অন্যদেরকে শরীক করছো কেন? সৃষ্টিকর্তা তো একমাত্র তিনিই। আহার্য দাতাও তিনি ছাড়া অন্য কেউ নয়। সমস্ত আধিপত্য তাঁরই। তোমরা তো কিছুই ছিল না। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। মৃত্যুর পরে পুনরায় তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করবেন, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন। মানুষ অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ বটে!