৫৫-৬০ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা মুশরিকদের অজ্ঞতার খবর দিচ্ছেন যে, তারা বিনা দলীল প্রমাণে প্রতিমাগুলোর পূজা করছে যারা তাদের উপকার বা অপকার কিছুই করতে পারে না। শুধু পূর্বপুরুষদের দেখাদেখি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে তাদের প্রেম-প্রীতি তারা নিজেদের অন্তরে জমিয়ে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরোধিতা করছে। তারা শয়তানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছে এবং আল্লাহর সেনাবাহিনীর বিরোধী হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের জেনে রাখা উচিত যে, পরিণামে আল্লাহর সেনাবাহিনীই জয়যুক্ত হবে। তারা এই আশায় পড়ে রয়েছে যে, এই মিথ্যা ও বাজে মা’বৃদরা তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তারা অযথা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মুমিনদের পরিণামই ভাল হবে। দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সাহায্য করবেন। এই কাফিরদেরকে তো শয়তান শুধু আল্লাহর বিরোধিতার উপর। উত্তেজিত করছে। সে তাদের অন্তরে সত্য আল্লাহর শত্রুতা সৃষ্টি করে দিচ্ছে এবং শিরকের মহব্বত পয়দা করছে। তাই তারা আল্লাহর নির্দেশাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছে।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলছেনঃ আমি তো তোমাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। যারা আল্লাহর আনুগত্যকারী তাদেরকে তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দেবে এবং যারা তাঁর অবাধ্য তাদেরকে তার কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে। জনগণের মধ্যে তুমি সাধারণভাবে ঘোষণা করে দেবে- আমি তোমাদের কাছে আমার এই প্রচারকার্যের জন্যে কোন প্রতিদান চাই না। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া আমার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। আমি শুধু এটাই চাই যে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সঠিক পথে আসতে চায় তার সামনে সঠিক রাস্তা প্রকাশ করে দেবো।
মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (সঃ)-কে সম্বোধন করে আরো বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি প্রতিটি কাজে ঐ আল্লাহর উপর নির্ভর করবে যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই। যিনি আদি ও অন্ত, প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুরই পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। যিনি চিরজীবিত ও চির বিরাজমান। যিনি প্রত্যেক জিনিসেরই মালিক ও প্রতিপালক। তাঁকেই তুমি তোমার প্রকৃত আশ্রয়স্থল মনে করবে। তার সত্তা এমনই যে, তারই উপর ভরসা করা উচিত এবং ভীতি-বিহ্বলতার সময় তাঁরই দিকে ঝুঁকে পড়া কর্তব্য। সাহায্যকারী ও আশ্রয়দাতা হিসেবে তিনিই যথেষ্ট। মানুষের উচিত তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা। তিনি তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ
یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَ اِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهٗ وَ اللّٰهُ یَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ
অর্থাৎ “হে রাসূল (সঃ)! তোমার নিকট তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তুমি (জনগণের নিকট) পৌছিয়ে দাও। যদি তুমি এটা না কর তবে তুমি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আল্লাহ তোমাকে লোকদের (অনিষ্ট) থেকে রক্ষা করবেন।” (৫:৬৭)
শহর ইবনে হাওশিব (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, একদা কোন এক গলিতে নবী (সঃ)-এর সাথে হযরত সালমান (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সিজদা করতে উদ্যত হন। তখন নবী (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে সালমান (রাঃ)! তুমি আমাকে সিজদা করো না, বরং সিজদা করো সেই সত্তাকে যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি মুরসাল)
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ ‘তুমি আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) মহান আল্লাহর এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। তিনি বলতেনঃ
سُبْحٰنَكَ اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি।” মহান আল্লাহর এই উক্তির ভাবার্থ হচ্ছে ? ইবাদত শুধু আল্লাহরই করবে এবং শুধু তাঁর সত্তার উপরই ভরসা করবে। যেমন তিনি বলেনঃ
رَبُّ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِیْلًا
অর্থাৎ “পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিপালক তিনিই, তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। সুতরাং তাকেই কর্মবিধায়ক বানিয়ে নাও।” (৭৩:৯) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ
فَاعْبُدْهُ وَ تَوَكَّلْ عَلَیْهِ
অর্থাৎ “সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো এবং তাঁরই উপর নির্ভর করো।” (১১:১২৩) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
قُلْ هُوَ الرَّحْمٰنُ اٰمَنَّا بِهٖ وَ عَلَیْهِ تَوَكَّلْنَا
অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- তিনিই রহমান (পরম দয়ালু), আমরা তার উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁরই উপর ভরসা করেছি।” (৬৭:২৯)
মহান আল্লাহর উক্তিঃ তিনি তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। অর্থাৎ বান্দাদের সমস্ত কার্যকলাপ তার সামনে প্রকাশমান। অণু পরিমাণ কাজও তার কাছে গোপন নয়।
তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি। তিনিই সব কিছুর আহার্যদাতা। তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমান যমীনের ন্যায় বিরাট মাখলুককে মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। কার্যাবলীর তদবীর ও ফলাফল তারই পক্ষ হতে এবং তাঁরই হুকুম ও তদবীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাঁর ফায়সালা সত্য, সঠিক ও উত্তমই হয়। তাঁর সত্তা ও গুণাবলী সম্বন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখো।
এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, আল্লাহর সত্তা সম্বন্ধে পূর্ণ অবগতি একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এরই ছিল যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সাধারণভাবে সমস্ত আদম সন্তানের নেতা ছিলেন। একটি কথাও তিনি নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে বলেননি। বরং তিনি যা কিছু বলতেন আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট হয়েই বলতেন। তিনি আল্লাহ তা'আলার যে গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলোর সবই সত্য। তিনি যা কিছু সংবাদ দিয়েছেন তার সবই সঠিক। প্রকৃত ও সত্য ইমাম তিনিই। সমস্ত বিবাদের মীমাংসা তাঁরই নির্দেশক্রমে করা যেতে পারে। যে তার কথা বলে সে সত্যবাদী। আর যে তাঁর বিপরীত কথা বলে সে মিথ্যাবাদী এবং তার কথা প্রত্যাখ্যাত হবে। সে যে কেউই হোক না কেন। আল্লাহর ফরমান অবশ্যই পালনীয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ
فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِیْ شَیْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللّٰهِ وَ الرَّسُوْلِ
অর্থাৎ “কোন বিষয়ে যদি তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর দিকে ফিরিয়ে দাও।” (৪:৫৯) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ
وَ مَا اخْتَلَفْتُمْ فِیْهِ مِنْ شَیْءٍ فَحُكْمُهٗۤ اِلَى اللّٰهِ
অর্থাৎ “যে ব্যাপারেই তোমরা মতানৈক্য কর, ওর ফায়সালা আল্লাহর নিকট রয়েছে।” (৪২:১০) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ
وَ تَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّ عَدْلًا
অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের কথা যা খবরের ব্যাপারে সত্য ও ফায়সালা হিসেবে ন্যায়, পূর্ণ হয়ে গেছে।” (৬:১১৫) এটাও বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে।
মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে সিজদা করতো। তাদেরকে যখন ‘রহমানকে সিজদা করার কথা বলা হতো তখন তারা বলতো: আমরা রহমানকে চিনি না। আল্লাহর নাম যে রহমান’ এটা তারা অস্বীকার করতো। যেমন হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) লেখককে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম' লিখতে বলেন তখন মুশরিকরা বলে ওঠেঃ “আমরা রহমানকে চিনি না এবং রহীমকেও না। বরং আমাদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখুন।” তাদের এই কথার উত্তরে আল্লাহ তা'আলা নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ
قُلِ ادْعُوا اللّٰهَ اَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَ اَیًّا مَّا تَدْعُوْا فَلَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى
অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- তোমরা আল্লাহকে ডাকো অথবা রহমানকে ডাকো, যে নামেই ইচ্ছা তাকে ডাকো, তাঁর বহু উত্তম নাম রয়েছে।” (১৭:১১০) অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ এবং তিনিই রহমান।
কাফিররা বলতো: তুমি কাউকেও সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করবো? মোটকথা, এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুমিনরা আল্লাহর ইবাদত করে যিনি রহমান এবং রাহীম। তাঁরা তাঁকেই ইবাদতের যোগ্য মনে করে এবং তার উদ্দেশ্যেই সিজদা করে।
আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, সূরায়ে ফুরকানের এই আয়াতটির পাঠক ও শ্রোতার উপর সিজদা ওয়াজিব হওয়া শরীয়তের বিধান। যেমন ওর স্থলে ওর ব্যাখ্যা বিদ্যমান। এসব ব্যাপারে মহামহিমান্বিত আল্লাহই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।