আল ইমরান আয়াত ১৩৬
اُولٰۤىِٕكَ جَزَاۤؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَجَنّٰتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَا ۗ وَنِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِيْنَۗ ( آل عمران: ١٣٦ )
Ulaaa'ika jazaaa'uhum maghfiratum mir Rabbihim wa Jannaatun tajree min tahtihal anhaaru khaalideena feeha; wa ni'ma ajrul 'aamileen (ʾĀl ʿImrān ৩:১৩৬)
English Sahih:
Those – their reward is forgiveness from their Lord and gardens beneath which rivers flow [in Paradise], wherein they will abide eternally; and excellent is the reward of the [righteous] workers. (Ali 'Imran [3] : 136)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এরাই তারা যাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে ক্ষমা এবং এমন এক জান্নাত যার নিম্নে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তারা তার স্থায়ী অধিবাসী এবং সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতই না উত্তম! (আল ইমরান [৩] : ১৩৬)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
ঐ সকল লোকের প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা এবং জান্নাত; যার নিচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এবং (সৎ)কর্মশীলদের পুরস্কার কতই না উত্তম।
(১৩৬) ঐ সকল লোকের প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা এবং জান্নাত; যার নিচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এবং (সৎ)কর্মশীলদের পুরস্কার কতই না উত্তম।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তারাই, যাদের পুরস্কার হলো তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতইনা উত্তম!
3 Tafsir Bayaan Foundation
এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!
4 Muhiuddin Khan
তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা কাজ করে তাদের জন্য কতইনা চমৎকার প্রতিদান।
5 Zohurul Hoque
এরা? -- এদের পুরস্কার হচ্ছে এদের প্রভুর কাছ থেকে পরিত্রাণ ও স্বর্গোদ্যানসমূহ যাদের নিচে দিয়ে বয়ে চলে ঝরনারাজি, সেখানে তারা থাকবে স্থায়ীভাবে, আর কর্মীবৃন্দের পুরস্কার কী চমৎকার!
6 Mufti Taqi Usmani
এরাই সেই লোক, যাদের পুরস্কার হচ্ছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত এবং সেই উদ্যানসমূহ, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যাতে তারা স্থায়ী জীবন লাভ করবে। তা কতই না উৎকৃষ্ট প্রতিদান, যা কর্ম সম্পাদনকারীগণ লাভ করবে।
7 Mujibur Rahman
তাদের পুরস্কার হবে তাদের রবের নিকট হতে মার্জনা এবং এমন উদ্যানসমূহ যেগুলির তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনীসমূহ প্রবাহিত থাকবে, তন্মধ্যে তারা সদা অবস্থান করবে, এবং কর্মীদের জন্য কি সুন্দর প্রতিদান!
8 Tafsir Fathul Mazid
১৩০-১৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতগুলোতে মু’মিনদেরকে কয়েকটি আদেশ ও নিষেধ করছেন এবং তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।
১. মু’মিনদেরকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া নিষেধ করেছেন। পূর্বে সূরা বাকারার ২৭৮-২৮০ নং আয়াতে সুদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে, এর অর্থ এমন নয় যে, চক্রবৃদ্ধি ছাড়া সুদ খাওয়া যাবে, বরং সকল প্রকার সুদ হারাম। আয়াতে চক্রবৃদ্ধি সুদ উল্লেখের কারণ হল তৎকালীন আরবের অধিকাংশ সুদী লেনদেন ছিল চক্রবৃদ্ধি হারে। তাই এভাবে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুদ দাতা, গ্রহীতা, লেখক ও সাক্ষ্যদানকারীদের ওপর লা‘নত করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৯) সুতরাং সকল প্রকার সুদ বর্জনীয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা বলেন ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন, কেননা তাদের একচ্ছত্র আনুগত্য করলে আল্লাহ তা‘আলা রহম করবেন। অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলার রহমতের পরিবর্তে আমাদের আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ أَطِيْعُوا اللّٰهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلَا تُبْطِلُوْآ أَعْمَالَكُمْ)
“ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য স্বীকার কর। আর নিজেদের আমল নষ্ট কর না।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩৩)
৩. তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হবার জন্য প্রেরণা দিচ্ছেন। যে জান্নাতের প্রশস্ততা আকাশ-জমিন সমপরিমাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(سَابِقُوْآ إِلٰي مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَآءِ وَالْأَرْضِ)
“তোমরা অগ্রগামী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের আশায় যা প্রশস্ততায় আকাশ ও পৃথিবীর মত।” (সূরা হাদীদ ৫৭:২১)
৪. মু’মিনদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করে। এরূপ ব্যয় করার ফযীলত অনেক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! কোন্ সদাক্বাহ প্রতিদানের দিক দিয়ে সবচেয়ে উত্তম? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তুমি দান করবে এমতাবস্থায় যে তুমি সুস্থ ও সম্পদের প্রতি তোমরা লালসা রয়েছে। সেই সাথে তুমি দরিদ্র হবার আশংকা কর এবং ধনী হবার আশা কর। (সহীহ বুখারী হা: ১৪১৯) এ সম্পর্কে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে।
৫. (وَالْكٰظِمِيْنَ الْغَيْظَ)
অর্থাৎ যারা ক্রোধ দমন করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ঐ ব্যক্তি বীরপুরুষ নয় যে অন্যকে মল্ল যুদ্ধে পরাস্ত করে বরং প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যক্তি বীরপুরুষ যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে। (সহীহ বুখারী হা: ৬১১৪) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তির ক্রোধ প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিন সকল মাখলুকের সামনে ডেকে এনে এ ইখতিয়ার দেবেন সে যেন পছন্দমত হুর চয়ন করে নিতে পারে। (আবূ দাঊদ হা: ৪৭৭৭, তিরমিযী হা: ২০২১, সনদটি হাসান)
৬. (وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِ)
যারা মানুষকে ক্ষমা করে দেয়, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তিন বিষয়ে আমি শপথ গ্রহণ করেছি: ১. সদাকা প্রদানে মাল হ্রাস পায় না। ২. মানুষকে ক্ষমা করার দ্বারা সম্মান বেড়ে যায়, ৩. আল্লাহ তা‘আলা বিনয় প্রকাশকারীর মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২৭৫৮, তিরমিযী হা: ২১২৯)
৭. (وَالَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً)
‘এবং যখন কেউ অশ্লীল কার্য করে’, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যখন কোন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার সামনে হাযির হয়ে বলে, হে প্রভু! আমার দ্বারা পাপ কাজ সাধিত হয়েছে, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা যদিও পাপ কাজ করেছে কিন্তু তার বিশ্বাস রয়েছে যে, তার প্রভু তাকে পাপের কারণে ধরতেও পারেন আবার ক্ষমাও করতে পারেন। আমি আমার ঐ বান্দার পাপ ক্ষমা করে দিলাম। সে আবার পাপ করে ও তাওবাহ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এবারও ক্ষমা করে দিলাম, সে তৃতীয়বার পাপ করে ও তাওবাহ করে। আল্লাহ তা‘আলা তৃতীয়বারও ক্ষমা করে দেন। সে চতুর্থবার পাপ করে ও তাওবাহ করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করতঃ বলেন, আমার বান্দার এখন যা ইচ্ছা আমল করুক। (সহীহ মুসলিম হা: ২৭৫৮, সহীহ বুখারী হা: ৭৫০৭)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, শয়তান বলে, হে প্রভু! তোমার ইজ্জতের শপথ যতদিন তোমার বান্দাদের দেহে প্রাণ থাকবে ততদিন তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতেই থাকব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার ইজ্জত ও মহত্বের শপথ, যতক্ষণ বান্দা আমার কাছে ক্ষমা চাইবে ততক্ষণ আমি তাকে ক্ষমা করবো। (আহমাদ হা: ১১২৪৪, হাসান)
৮. (وَلَمْ يُصِرُّوْا عَلٰي مَا فَعَلُوْا وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ)
‘তার ওপর জেনে-শুনে অটল থাকে না।’ মু’মিনদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা অপরাধ কাজ জানার পর সে অপরাধে অটল থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা অপরাধ ক্ষমা করবেন, শর্ত হল জেনেশুনে বারবার করতে পারবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমরা মানুষের ওপর দয়া কর, তোমাদেরকে দয়া করা হবে। মানুষকে ক্ষমা করে দাও, তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। যারা কথা বানিয়ে বলে তাদের জন্য দুর্ভোগ এবং দুর্ভোগ তাদের যারা জেনেশুনে পাপ কাজকে আঁকড়ে ধরে থাকে। (আদাবুল মুফরাদ হা: ৩৮০, সহীহ)
সুতরাং ধ্বংসাত্মক সুদী লেনদেন করা থেকে বিরত থাকতে হবে, আর আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমার দিকে ধাবিত হওয়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ ক্ষমা করতে পারবে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করা ওয়াজিব।
২. যারা দ্রুত ক্রোধ দমন করতে পারে তাদের অনেক ফযীলত রয়েছে।
৩. অপরাধ ঘটে গেলে দ্রুত তাওবাহ করা ওয়াজিব।
৪. মানুষকে ক্ষমা করা অনেক মহৎ কর্ম।
৫. ক্ষমা প্রার্থনা করা ও বারবার পাপ কাজ না করার অনেক ফযীলত রয়েছে।
9 Fozlur Rahman
তাদের প্রতিদান হল তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা আর এমনসব জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে। সৎকর্মশীলদের এই প্রতিদান কত উত্তম!
10 Mokhtasar Bangla
১৩৬. যারা এ প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদাপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী তাদের প্রতিদান হলো আল্লাহ তা‘আলা তাদের গুনাহগুলো গোপন রাখবেন এবং তা ক্ষমা করে দিবেন। আর তাদের জন্য রয়েছে পরকালে এমন জান্নাত যার অট্টালিকাগুলোর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে অনেকগুলো নদী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। আল্লাহর আনুগত্যকারীদের জন্য এটি হলো এক উত্তম প্রতিদান।
11 Tafsir Ibn Kathir
১৩০-১৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় মুমিন বান্দাদের সুদ আদান প্রদান হতে এবং ভক্ষণ হতে নিষেধ করেছেন। অজ্ঞতা যুগের লোকেরা সুদের উপর ঋণ প্রদান করতো। ঋণ পরিশোধের একটি সময় নির্ধারিত হতো। ঐ সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সময় বাড়িয়ে দিয়ে সুদের উপর সুদ বৃদ্ধি করা। হতো। এভাবে চক্রাকারে সুদ বৃদ্ধি পেতে পেতে মূলধন কয়েক গুণ হয়ে যেতো। মহান আল্লাহ স্বীয় ঈমানদার বান্দাদেরকে এরূপ অন্যায়ভাবে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করতে চরমভাবে নিষেধ করেছেন এবং তাদেরকে মুত্তাকী হওয়ার নির্দেশ প্রদান করতঃ ওর উপর মুক্তিদানের অঙ্গীকার করছেন। অতঃপর তাদেরকে আল্লাহ তদীয় রাসূলের আনুগত্য স্বীকারের নির্দেশ দান করতঃ ওর উপর করুণা প্রদর্শনের ওয়াদা দিচ্ছেন। এরপর ইহজগত ও পরজগতের মঙ্গল লাভের জন্য তাদের সৎকার্যের দিকে ধাবিত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং জান্নাতের প্রশংসা করছেন। এর প্রস্থ বর্ণনা করতঃ দৈর্ঘ্যের অনুমানের ভার শ্রোতাদের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন। যেমন তিনি জান্নাতী বিছানার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ بَطَآىٕنُهَا مِنْ اِسْتَبْرَقٍ অর্থাৎ ‘ওর ভেতর হবে নরম রেশমের। (৫৫:৫৪) ভাবার্থ এই যে, ভেতরই যখন এরূপ তখন বাহির কিরূপ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অনুরূপভাবে এখানেও বলা হচ্ছে যে, জান্নাতের প্রস্থই যখন সপ্ত আকাশ ও সপ্ত যমীনের সমান, তখন দৈর্ঘ্য কত বড় হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কেউ কেউ বলেন যে, জান্নাতের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান। কেননা, জান্নাত গম্বুজের মত আরশের নীচে রয়েছে এবং যে জিনিস গম্বুজ সদৃশ তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান। একটি বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ তোমরা আল্লাহ তা'আলার নিকট জান্নাত যা করলে ফিরদাউস যা করো। এটাই সবচেয়ে উঁচু ও সর্বোত্তম জান্নাত। এ জান্নাতের মধ্য দিয়েই সমস্ত নদী প্রবাহিত হয় এবং ওর ছাদই হচ্ছে পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর আরশ।' মুসনাদ-ই আহমাদে রয়েছে যে, হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে একটি প্রতিবদিমূলক পত্র লিখে পাঠায়। পত্রে লিখা ছিল- আপনি আমাকে এমন জান্নাতের দিকে আহবান করছেন যার প্রস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সমান। তাহলে বলুন, জাহান্নাম কোথায় গেল? রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ ‘সুবহান্নাল্লাহ! যখন দিন আসে তখন রাত কোথায় যায়? যে দূতটি হিরাক্লিয়াসের পত্র নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়েছিলো তার সাথে হিমস নামক স্থানে হযরত আবূ ইয়ালার সাক্ষাৎ হয়েছিল। হযরত আবু ইয়ালা বলেন যে, ঐ সময় উক্ত দূতটি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সে বলেঃ যখন আমি পত্রটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে প্রদান করি তখন তিনি উক্ত পত্রটি তাঁর বাম দিকের একজন সাহাবীকে প্রদান করেন। আমি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করিঃ ‘তার নাম কি?' জনগণ বলেনঃ ‘ইনি হচ্ছেন হযরত মুআবিয়া (রাঃ)। হযরত উমারকেও (রাঃ) এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনিও বলেছিলেন ও রাতের সময় দিন কোথায় যায়?' এ উত্তর শুনে ইয়াহূদী লজ্জিত হয়ে বলেঃ ‘এটা তাওরাত হতেই গ্রহণ করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এ উত্তর বর্ণিত আছে। একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যখন প্রত্যেক জিনিসের উপর রাত এসে যায় তখন দিন কোথায় যায়?' তখন সে বলেঃ “যেখানে আল্লাহ চান। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এ রকমই জাহান্নামও সেখানেই যায়। যেখানে আল্লাহ চান। (বাযযারা) এ বাক্যটির দু’টি অর্থ হতে পারে। একতো এই যে, রাত্রে যদিও আমরা দিনকে দেখতে পাই না, তথাপি দিন কোন জায়গায় থাকা অসম্ভব নয়। অনুরূপভাবে যদিও জান্নাতের বিস্তার এত বেশী তথাপি জাহান্নামের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যেতে পারে না। যেখানে আল্লাহ তা'আলা চেয়েছেন সেখানে ওটাও রয়েছে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, যখন দিন একদিকে চড়ে যায় তখন রাত অন্য দিকে থাকে। দ্রুপ জান্নাত সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে এবং জাহান্নাম সর্বনিম্ন স্থানে রয়েছে। কাজেই এ দুয়ের অবস্থানের কোন অসুবিধে নেই।
অতঃপর আল্লাহ পাক জান্নাতবাসীদের বিশেষণ বর্ণনা করেছেন যে, তারা সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে এবং স্বচ্ছলতায় ও অভাবে, মোটকথা সর্বাবস্থাতেই আল্লাহ তা'আলার পথে ব্যয় করে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً অর্থাৎ যারা দিনে-রাতে প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের সম্পদ খরচ করে থাকে।' (২:২৭৪) কোন কিছু তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্য হতে বিরত রাখতে পারে না। তারা তাঁর নির্দেশক্রমে তার সৃষ্টজীবের উপর অনুগ্রহ করে থাকে। كظم শব্দের অর্থ গোপন করাও হয়ে থাকে। অর্থাৎ এমন কি তারা তাদের ক্রোধ প্রকাশ পর্যন্তও করে না। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “হে আদম সন্তান! তুমি যদি ক্রোধের সময় আমাকে স্মরণ কর অর্থাৎ আমার নির্দেশ মান্য করতঃ ক্রোধ সংবরণ করে নাও তবে আমিও আমার ক্রোধের সময় তোমাকে স্মরণ করবো অর্থাৎ তোমার ধ্বংসের সময় তোমাকে ধ্বংস হতে রক্ষা করবো'। (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম) অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তার উপর হতে শাস্তি সরিয়ে নেন। আর যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বাকে (শরীয়ত বিরোধী কথা হতে) সংযত রাখে, আল্লাহ তা'আলা তার গোপনতা রক্ষা করেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার নিকট ওযর পেশ করে, আল্লাহ তাআলা তার ওযর গ্রহণ করে থাকেন। (মুসনাদ-ই-আবি ইয়ালা) এ হাদীসটি গারীব এবং এর সনদের ব্যাপারেও সমালোচনা রয়েছে। অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তি বীর পুরুষ নয় যে কাউকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত করে,বরং প্রকৃতপক্ষ ঐ ব্যক্তি বীর পুরুষ যে ক্রোধের সময় ক্রোধ দমন করতে পারে।' (মুসনাদ-ই-আহমাদ) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যার নিকট তার উত্তরাধিকারীর মাল নিজের মাল অপেক্ষা বেশী প্রিয় হয়? জনগণ বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি তো দেখেছি যে, তোমরাই তোমাদের নিজস্ব মাল অপেক্ষা তোমাদের উত্তরাধিকারীদের মালকেই বেশী পছন্দ করছো! কেননা, প্রকৃতপক্ষে তোমাদের নিজস্ব মালতো ওটাই যা তোমরা, তোমাদের জীবদ্দশায় আল্লাহ তা'আলার পথে ব্যয় করে থাক এবং যা তোমরা ছেড়ে যাও তা তো তোমাদের মাল নয়, বরং তোমাদের উত্তরাধিকারীদের মাল। তাহলে তোমাদের আল্লাহ পাকের পথে খরচ কম করা এবং জমা বেশী রাখা ওরই প্রমাণ যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের মাল অপেক্ষা উত্তরাধিকারীদের মালকেই বেশী ভালবাস। অতঃপর তিনি বলেনঃ “তোমারা কোন্ লোককে বীর পুরুষ মনে কর?' জনগণ বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ ব্যক্তিকে (আমরা বীর পুরুষ মনে করি) যাকে কেউ মল্লযুদ্ধে নীচে ফেলতে পারে না। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ না, বরং প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী বীর পুরুষ ঐ ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় নিজকে সামলিয়ে নিতে পারে। তারপরে তিনি বলেনঃ ‘তোমরা নিঃসন্তান কাকে বল?' জনগণ বলেনঃ যাদের কোন সন্তান-সন্ততি নেই।' তিনি বলেনঃ না, বরং নিঃসন্তান ঐ ব্যক্তি যার সামনে তার কোন সন্তান মারা যায়নি। (সহীহ মুসলিম) একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ দরিদ্র কে তোমরা জান কি? সাহাবীগণ বলেনঃ যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বলেনঃ না, বরং ঐ ব্যক্তি দরিদ্র যে নিজের জীবদ্দশায় স্বীয় মাল আল্লাহর পথে ব্যয় করে না'। (মুসনাদ-ইআহমাদ) হযরত হারেসা ইবনে কুদ্দামা সা'দী (রাঃ) নবী (সঃ)-এর খিমতে হাযির হয়ে আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে কোন উপকারী কথা বলুন। তা যেন সংক্ষিপ্ত হয়, তাহলে আমি মনেও রাখতে পারবো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ “রাগ করো না।' তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ উত্তরই দেন। কয়েকবার একই প্রশ্ন ও উত্তর হয়। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে কিছু উপদেশ দিন।' তিনি বলেনঃ রাগ করো না।' তিনি বলেনঃ আমি চিন্তা করে বুঝলাম যে, ক্রোধই হচ্ছে সমস্ত খারাপ ও অন্যায়ের মূল'। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আবু যর (রাঃ) একবার ক্রোধান্বিত হয়ে বসে পড়েন এবং তার পরে শুয়ে যান। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে শুনেছি, তিনি বলেছেন যার ক্রোধ হয় সে দাঁড়িয়ে থাকলে যেন বসে পড়ে তাতেও যদি ক্রোধ প্রশমিত না হয় তবে যেন শুয়ে পড়ে। (মুসনাদ-ইআহমাদ) মুসনাদ-ই-আহমাদের আর একটি হাদীসে রয়েছে যে, হযরত উরওয়া ইবনে মুহাম্মাদ (রঃ) একবার ক্রোধান্বিত হন। তিনি অযু করতে বসে পড়েন এবং বলেনঃ আমি আমার শিক্ষকগণ হতে এ হাদীসটি শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ক্রোধ শয়তানের পক্ষ হতে হয়ে থাকে এবং শয়তান অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে, আর আগুনকে নির্বাপণকারী হচ্ছে পানি। সুতরাং তোমাদের ক্রোধ হলে অযু করতে বসে পড়।' রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এটাও ইরশাদ আছে যে, “যে ব্যক্তি কোন দরিদ্রকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণ ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম হতে মুক্ত করে থাকেন। হে জনমণ্ডলী! জেনে রেখো যে, জান্নাতের কাজ খুব কঠিন এবং জাহান্নামের কাজ সহজ। সৎ ঐ ব্যক্তি যে গণ্ডগোল হতে বেঁচে যায়। কোন চুমুককে পান করে নেয়া অল্লাহ তাআলার ততো পছন্দনীয় নয় যতো পছন্দনীয় ক্রোধের চুমুককে পান করে নেয়া। এরূপ ব্যক্তির অন্তরে ঈমান দৃঢ়ভাবে বসে যায়।' (মুসনাদ-ই-আহমাদ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা দমন করে রাখে আল্লাহ তা'আলা তার অন্তরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দ্বারা পূর্ণ করে দেন। যে ব্যক্তি আঁকজমক পূর্ণ পোষাক পরিধানে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও বিনয় প্রকাশার্থে তা পরিত্যাগ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তাকে সম্মানের হুল্লা (লুঙ্গী ও চাদর) পরিধান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কারও রহস্য গোপন রাখবে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তাকে বাদশাহী মুকুট পরাবেন।' (সুনানে আবি দাউদ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা দমন করে, তাকে আল্লাহ তা'আলা সমস্ত মাখলুকের সামনে ডেকে অধিকার প্রদান করবেন যে, সে কোন হুরকে ইচ্ছে মত পছন্দ করতে পারে।
(মুসনাদ-ই-আহমাদ) এ বিষয়ের আরও বহু হাদীস রয়েছে। সুতরাং আয়াতের ভাবার্থ হলো এই যে, তাদের ক্রোধ বাইরে প্রকাশ পায় না এবং তাদের পক্ষ হতে লোকের প্রতি কোন অন্যায় হয় না। বরং তারা উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখে। আর তারা আল্লাহকে ভয় করতঃ পুণ্যের আশায় সমস্ত কাজ আল্লাহ তা'আলার উপর সমর্পণ করে। তারা মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়। আত্যাচারীদের অত্যাচারের প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করে না। একেই বলে অনুগ্রহ এবং এরূপ অনুগ্রহশীল বান্দাকেই আল্লাহ তা'আলা ভালবাসেন। হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘তিনটি কথার উপর আমি শপথ গ্রহণ করছিঃ (১) সাদকা দ্বারা মাল হ্রাস পায় না, (২) মানুষের অপরাধ ক্ষমা করার মাধ্যমে মানুষের সম্মান বেড়ে যায় এবং (৩) আল্লাহ তা'আলা বিনয় প্রকাশকারীর মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। মুসতাদরিক-ই-হাকীমে হাদীস রয়েছে, যে ব্যক্তি চায় যে, তার ভিত্তি উঁচু হোক এবং মর্যাদা বেড়ে যাক তার জন্যে উচিত হবে যে, সে যেন অত্যাচারীদেরকে ক্ষমা করে দেয়, যারা দেয় না তাদেরকে প্রদান করে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন যুক্ত করে। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন এক আহবানকারী ডাক দিয়ে বলবেনঃ “হে জনগণকে ক্ষমাকারীগণ! তোমাদের প্রভুর নিকট এসো এবং স্বীয় প্রতিদান গ্রহণ কর। ক্ষমাকারী প্রত্যেক মুসলমানের জান্নাতে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তারা পাপ কার্য করার পর তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করে এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। মুসনাদ-ইআহমাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন কোন ব্যক্তি কোন পাপ কার্য করে, অতঃপর আল্লাহ পাকের সামনে হাযির হয়ে বলেঃ হে আমার প্রভু! আমার দ্বারা পাপকার্য সাধিত হয়েছে, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমার বান্দা যদিও পাপকার্য করেছে, কিন্তু তার বিশ্বাস রয়েছে যে, তার প্রভু তাকে পাপের কারণে ধরতেও পারেন, আবার ক্ষমা করতেনও পারেন, আমি আমার ঐ বান্দার পাপ ক্ষমা করে দিলাম। সে আবার পাপ করে ও তাওবা করে, আল্লাহ তাআলা এবারেও ক্ষমা করেন। বার পাপ করে ও তাওবা করে, আল্লাহ পাক তৃতীয়বারও ক্ষমা করেন। সে চতুর্থবার পাপ করে ও তাওবা করে তখন আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করতঃ বলেনঃ “আমার বান্দা এখন যা ইচ্ছে আমল করুক'। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমেও রয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “আমরা একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আরয করিঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যখন আমরা আপনাকে দর্শন করি তখন আমাদের অন্তরে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় এবং আমরা মুত্তাকী হয়ে যাই। কিন্তু যখন আপনার নিকট হতে চলে যাই তখন ঐ অবস্থা আর থাকে না, ছেলে মেয়েদের ফাঁদে পড়ে যাই এবং পারিবারিক কাজ কর্মে লেগে পড়ি।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ ‘জেনে রেখো, আমার নিকট অবস্থান কালে তোমাদের মনের অবস্থা যেমন থাকে, যদি সর্বদা এরূপ থাকতো তবে ফেরেশতাগণ তোমাদের করমর্দন করতেন এবং তোমাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য তোমাদের বাড়ীতেই আগমন করতেন। মনে রেখো, তোমরা যদি পাপ কর্ম না কর তবে আল্লাহ পাক তোমাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেবেন এবং অন্য এক সম্প্রদায়কে এখানে বসিয়ে দেবেন যারা পাপকার্য করবে, অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন।' আমরা বলিঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জান্নাতের ভিত্তি কিসের তৈরী তা আমাদেরকে বলুন।' তিনি বলেনঃ ‘একটি সোনার ইট ও একটি চাদির ইট এবং ওর গারা (দেয়াল ইত্যাদি বাঁধবার জন্যে চুন, বালি ও মাটি পানিতে মিশিয়ে যে কাদা তৈরী করা হয়) খাটি মৃগনাভির। ওর পাথর মনি মুক্তার এবং মাটি হচ্ছে যাফরানের। জান্নাতের নিয়ামতরাজি কখনও শেষ হবে না। তথায় হবে চিরস্থায়ী জীবন। তথাকার অধিবাসীদের কাপড় কখনও পুরাতন হবে না। তাদের যৌবন ক্ষয় হবে না।' তিন ব্যক্তির প্রার্থনা অগ্রাহ্য হয় নাঃ (১) ন্যায় বিচারক বাদশাহ, (২) রোযাদার ব্যক্তি এবং (৩) অত্যাচারিত ব্যক্তি। তাদের প্রার্থনা মেঘে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং ওর জন্যে আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং মহান আল্লাহ ঘোষণা করেনঃ ‘আমার মর্যাদার শপথ! কিছু সময় পরে হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবো'। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন পাপকার্য করার পর অযু করতঃ দুই রাকাআত নামায আদায় করে এবং পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে, মহাসম্মানিত আল্লাহ তার পাপ মার্জনা করে দেন। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) সহীহ মুসলিমে রয়েছে, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে অযু করতঃ اَشْهَدُ اَنْ لَّا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ لَاشَرِيْكَ لَهٗ وَاشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهٗ وَرَسُوْلُهٗ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল' পাঠ করে, তার জন্যে জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হয়, সে যেটা দিয়ে ইচ্ছে ভেতরে প্রবেশ করবে। আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান (রাঃ) সুন্নাত অনুযায়ী অযু করেন অতঃপর বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার মত অযু করে, অতঃপর খাটি অন্তরে দু'রাকা'আত নামায আদায় করে, আল্লাহ তা'আলা তার পাপ মার্জনা করে দেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এটাই সেই কল্যাণময় আয়াত যা অবতীর্ণ হওয়ার সময় ইবলীস কাঁদতে আরম্ভ করেছিল। (মুসনাদ-ই-আবদুর রাযযাক) মুসনাদ-ই-আবূ ইয়া’লার মধ্যে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ খুব বেশী করে পাঠ কর এবং সদা-সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক। ইবলীস পাপের মাধ্যমে মানুষকে ধ্বংস করতে চায় এবং তার নিজের ধ্বংস রয়েছে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু পাঠে ও ক্ষমা প্রার্থনায়। এ অবস্থা দেখে ইবলীস মানুষকে প্রবৃত্তির উপাসনায় নিক্ষেপ করেছে। সুতরাং মানুষ নিজেকে সঠিক পথের পথিক বলে মনে করে, অথচ সে ধ্বংসের পথে রয়েছে। কিন্তু এ হাদীসটির দু’জন বর্ণনাকারী দুর্বল। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ইবলীস বলেছিল, হে আমার প্রভু! আপনার মার্যাদার শপথ! আমি আদম সন্তানকে তাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পথভ্রষ্ট করতে থাকবো।' তখন আল্লাহ তা'আলা বলেছিলেনঃ “আমার মাহাত্ম্য ও মর্যাদার শপথ! যে পর্যন্ত তারা আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে সে পর্যন্ত তাদেরকে ক্ষমা করতেই থাকবো।' মুসনাদ-ই-বায্যারে রয়েছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি পাপকার্য করেছি।' তিনি বলেনঃ তাওবা কর।' সে বলেঃ আমি তাওবা করেছি, পরে আবার পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছি।' তিনি বলেনঃ পুনরায় তাওবা কর।' সে বলেঃ ‘আমার দ্বারা পুনরায় পাপকার্য সাধিত হয়েছে।' তিনি বলেনঃ ‘পুনরায় তাওবা কর।' সে বলেঃ আমি আবার পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছি।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাক, শেষ পর্যন্ত শয়তান পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। এর পর বলা হচ্ছে- ‘পাপ মার্জনা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, একজন বন্দী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করতঃ বলেঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হচ্ছি, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দিকে প্রত্যাবর্তিত হচ্ছি না।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ ‘সে প্রকৃত অধিকারীকেই অধিকার প্রদান করেছে।' হঠকারিতা না করার ভাবার্থ এই যে, তাওবা না করেই সে পাপকার্যকে আঁকড়ে ধরে থাকে না। কয়েকবার পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়লে কয়েকবার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। মুসনাদ-ই-আবু ইয়া'লার মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘ঐ ব্যক্তি হঠকারী নয় যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাকে যদিও তার দ্বারা দিনে সত্তরবারও পাপকার্য সাধিত হয়। এরপরে আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা জানে।' অর্থাৎ তারা জানে যে, আল্লাহ তা'আলা তাওবা কবূলকারী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে اَلَمْ یَعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ هُوَ یَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهٖ অর্থাৎ তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করে থাকেন?' (৯:১০৪) অন্য স্থানে রয়েছে- 'যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ করে। কিংবা নিজের জীবনের উপর অত্যাচার করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল দয়ালু পাবে।' মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর বর্ণনা করেনঃ হে জনমণ্ডলী! তোমরা অন্যদের উপর দয়া প্রদর্শন কর, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। হে লোকসকল! তোমরা অন্যদের অপরাধ ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন। যারা কথা বানিয়ে বলে তাদের দুর্ভাগ্য এবং যারা পাপকার্যকে আঁকড়ে ধরে থাকে তাদেরও দুর্ভাগ্য। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “তাদের ঐ সব সত্ত্বার্যের পুরস্কার হবে তাদের প্রভুর পক্ষ হতে মার্জনা, এমন উদ্যানসমূহ যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনীসমূহ প্রবাহিত থাকবে, তন্মধ্যে তারা সদা অবস্থান করবে; এবং কর্মীদের জন্যে কি সুন্দর প্রতিদান।'