২৭-৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যকে অনুসরণ করত এবং যাদেরকে অনুসরণ করত তারা পরস্পর তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং একে অপরকে দোষারোপ করবে- সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
(قَالُوْآ إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُوْنَنَا عَنِ الْيَمِيْنِ)
এ বাক্যে الْيَمِيْنِ শব্দের একাধিক অর্থ হতে পারে। এক অর্থ শক্তি ও বল। অর্থাৎ তোমরা বেশ প্রবলভাবে আমাদের নিকট আসতে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে। দ্বিতীয় অর্থ হল- শপথ। তাই কেউ কেউ বলেছেন- তোমরা আমাদের নিকট শপথ করে বলতে, আমাদের ধর্মই সঠিক। অন্য আরো একটি অর্থ হল ডান, এখানে বাম দিকের কথাটিও উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ তোমরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ডান-বাম চতুর্দিক থেকে আসতে। যেমন শয়তান বলেছিল-
(ثُمَّ لَاٰتِيَنَّهُمْ مِّنْۭ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَآئِلِهِمْ ط وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شٰكِرِيْنَ)
‘‘অতঃপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ , ডান ও বাম দিক হতে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৭)
এভাবে দুর্বল লোকেরা নিজেদের ওজর আপত্তি পেশ করলে সবল লোকেরা বলবে- আরে! আমাদের দোষ দিচ্ছো কেন? তোমাদের ওপর আমাদের তো কোন ক্ষমতাই ছিল না, তোমরাই সীমালংঘন করেছিলে, তোমরা ঈমান আননি, আর এখন আমাদের দোষ দিচ্ছো? তারা হাশরের ময়দানে এবং জাহান্নামে যাওয়ার পরে এরূপ কথা কাটাকাটি করবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذْ يَتَحَا۬جُّوْنَ فِي النَّارِ فَيَقُوْلُ الضُّعَفٰ۬ؤُا لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْآ إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُّغْنُوْنَ عَنَّا نَصِيْبًا مِّنَ النَّارِ - قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا كُلٌّ فِيْهَآ إِنَّ اللّٰهَ قَدْ حَكَمَ بَيْنَ الْعِبَادِ)
“যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবে তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে : আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম, এখন কি তোমরা আমাদের হতে জাহান্নামের আগুনের কোন অংশ নিবারণ করতে পারবে? দাম্ভিকেরা বলবে : আমরা সবাই তো জাহান্নামে আছি; নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের ফায়সালা করে ফেলেছেন।” (সূরা মু’মিন ৪০ : ৪৭-৪৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(قَالَ الَّذِيْنَ حَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ رَبَّنَا هٰ۬ؤُلَا۬ءِ الَّذِيْنَ أَغْوَيْنَا ج أَغْوَيْنٰهُمْ كَمَا غَوَيْنَا ج تَبَرَّأْنَآ إِلَيْكَ ز مَا كَانُوْآ إِيَّانَا يَعْبُدُوْنَ)
“যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক এদেরকেই আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম; এদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম যেমন আমরাও বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার সমীপে আমরা দায়িত্ব হতে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি। এরা আমাদের ‘ইবাদত করত না।’’ (সূরা ক্বাসাস ২৮ : ৬৩) এ ছাড়াও সূরা সাবার ৩১-৩২, সূরা আহযাবের ৬৭-৬৮ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।
(فَأَغْوَيْنٰكُمْ إِنَّا كُنَّا غَاوِيْنَ)
অর্থাৎ তারা পূর্বে যে কথা অস্বীকার করে বলেছিল, তোমাদের ওপর আমাদের এমন কী জোর ছিল যে, তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। পরবর্তীতে তা-ই স্বীকার করবে এই বলে যে- হ্যাঁ, সত্যই আমরা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। কিন্তু এ স্বীকারোক্তি এ সতর্কবাণীর সাথে হবে যে, এর জন্য আমাদেরকে দায়ী বা দোষী করবে না। কারণ আমরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট ছিলাম, আমরা এর জন্য তোমাদেরকেও আমাদের মতই বানাতে চেয়েছিলাম এবং তোমরা সহজেই আমাদের পথ অবলম্বন করেছিলে। যেমন শয়তানও সেদিন বলবে : “যখন বিচার কার্য সম্পন্ন হবে তখন শয়তান বলবে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের ওপর আমার তো কোন আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ কর না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমাকে উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে আমি তা অস্বীকার করছি, নিশ্চয়ই জালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ২২) কিন্তু সেখানে তাদের এসকল ওযর-আপত্তি কোনই কাজে আসবে না। তাদের সকলকেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(وَلَنْ يَّنْفَعَكُمُ الْيَوْمَ إِذْ ظَّلَمْتُمْ أَنَّكُمْ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُوْنَ)
“আর আজ তোমাদের (এ অনুুতাপ) অবশ্যই কোন উপকারে আসবে না, যেহেতু তোমরা জুলুম করেছিলে। নিশ্চয়ই তোমরা তো সবাই শাস্তিতে শরীক।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৩৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : “আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের পূর্বে যে জিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর’। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে, এমনকি যখন সকলে তাতে একত্রিত হবে তখন তাদের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; সুতরাং এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দাও। ‘আল্লাহ বলবেন, ‘প্রত্যেকের জন্যই দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৩৮)
এ সম্পর্কে সূরা আহ্যাবের ৬৭-৬৮ নম্বর, সূরা সাবা-’র ৩১-৩৩ নম্বর আয়াতে আরো আলোচনা গত হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ সকল শাস্তির আরো কারণ বর্ণনা করে বলেন, তারা যে শুধু র্শিক করত তা নয় বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত, অহংকার করত এবং এ কথাও বলত যে, আমরা কি একজন কবির কথায় আমাদের মা‘বূদদেরকে পরিত্যাগ করব? সুতরাং তা কখনো হতে পারে না। যার ফলে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার উক্ত শাস্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের মাঠে অপরাধীরা একে অন্যকে দোষারোপ করবে কিন্তু তাতে কোনই ফায়দা হবে না।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সত্যসহ প্রেরিত আল্লাহ তা‘আলার রাসূল।
৩. গর্ব-অহংকার পরিত্যাগ করতে হবে, কেননা গর্ব-অহংকার মানুষকে সত্য হতে বিমুখ করে।