আল-যুমার আয়াত ৩১
ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ عِنْدَ رَبِّكُمْ تَخْتَصِمُوْنَ ࣖ ۔ ( الزمر: ٣١ )
Summa innakum Yawmal Qiyaamati 'inda Rabbikum takhtasimoon (az-Zumar ৩৯:৩১)
English Sahih:
Then indeed you, on the Day of Resurrection, before your Lord, will dispute. (Az-Zumar [39] : 31)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
অতঃপর ক্বিয়ামত দিবসে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সম্মুখে বাদানুবাদ করবে। (আল-যুমার [৩৯] : ৩১)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
অতঃপর কিয়ামতের দিনে তোমরা পরস্পর তোমাদের প্রতিপালকের সম্মুখে বাক-বিতন্ডা করবে। [১]
[১] অর্থাৎ, হে নবী! তুমি ও তোমার বিরোধী সকলেই মৃত্যুবরণ করে আখেরাতে আমার নিকট উপস্থিত হবে। পৃথিবীতে তোমাদের মাঝে তাওহীদ ও শিরকের ফায়সালা সম্ভব হয়নি এবং তুমি এই বিষয়ে ঝগড়া করতেই থেকেছ। কিন্তু আমি এখানে তার ফায়সালা করব এবং মুখলিস ও একত্ববাদে বিশ্বাসীদেরকে জান্নাতে এবং মুশরিক (অংশীবাদী), অস্বীকারকারী এবং মিথ্যাজ্ঞানকারীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব। উক্ত দুটি আয়াত দ্বারা নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ হয়। যেমন সূরা আলে ইমরানের ৩;১৪৪ নং আয়াতেও সে কথা প্রমাণ হয়। এই সব আয়াতসমূহ থেকে দলীল নিয়ে আবু বাকর সিদ্দীক (রাঃ) লোকেদের মাঝে নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ করেছিলেন। অতএব নবী (সাঃ) সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখা যে, তিনি পৃথিবীতে যেমন জীবন পেয়েছিলেন, বারযাখী জীবন (কবরে)ও অনুরূপ জীবিত আছেন, কুরআনের স্পষ্ট দলীলের পরিপন্থী। তিনিও অন্যান্য মানুষের মত মৃত্যুবরণ করেছেন, ফলে তাঁকেও দাফন করা হয়েছে এবং কবরে তিনি অবশ্যই বারযাখী জীবন পেয়েছেন। তবে তা কেমন তার জ্ঞান আমাদের নেই। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহ যে কবরে তাঁকে পৃথিবীর মত জীবন দেওয়া হয়নি। (সাঃ)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
তারপর কিয়ামতের দিন নিশ্চয় তোমরা তোমাদের রবের সামনে পরস্পর বাক-বিতণ্ডা করবে [১]।
[১] এ আয়াত নাযিল হলে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে আমরা যে ঝগড়া করছি সেটা কি আবার আখেরাতেও হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তখন যুবাইর বললেন, বিষয়টি তাহলে ভয়াবহ। [তিরমিয়ী; ৩২৩৬] ইবন উমর বলেন, আমরা এ আয়াত নাযিল হয়েছে জানতাম কিন্তু কেন নাযিল হলো বুঝতে পারিনি। আমরা বলতাম, কার সাথে আমরা ঝগড়া করব? আমাদের মধ্যে এবং আহলে কিতাবদের মধ্যে তো কোন ঝগড়া নেই। অবশেষে যখন মুসলিমদের মাঝে ফেতনা শুরু হলো তখনই বুঝতে পারলাম যে, এটাই আমাদের রবের পক্ষ থেকে যে ঝগড়ার ওয়াদা করা হয়েছিল তা। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
3 Tafsir Bayaan Foundation
তারপর কিয়ামতের দিন নিশ্চয় তোমরা তোমাদের রবের সামনে ঝগড়া করবে।
4 Muhiuddin Khan
অতঃপর কেয়ামতের দিন তোমরা সবাই তোমাদের পালনকর্তার সামনে কথা কাটাকাটি করবে।
5 Zohurul Hoque
তারপর কিয়ামতের দিনে নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভুর সামনে তোমরা একেঅন্যে বাকবিতন্ডা করবে।
6 Mufti Taqi Usmani
অবশেষে তোমরা সকলে কিয়ামতের দিন তোমাদের প্রতিপালকের সামনে বাদানুবাদ করবে।
7 Mujibur Rahman
অতঃপর কিয়ামাত দিবসে তোমরা পরস্পর তোমাদের রবের সামনে বাকবিতন্ডা করবে।
8 Tafsir Fathul Mazid
২৪-৩১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(اَفَمَنْ یَّتَّقِیْ بِوَجْھِھ۪ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ..... لَوْ کَانُوْا یَعْلَمُوْنَﭩ)
এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের মাঠে কাফির-মুশরিকদের কেমন অবস্থা হবে, তারা কেমন শাস্তি প্রাপ্ত হবে সে কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যারা দুনিয়াতে মন্দ কাজ করত পরকালে তারা তাদের চেহারা দ্বারা জাহান্নামের আগুন ঠেকাতে চাইবে। কিন্তু তা করতে সক্ষম হবে না, তখন তাকে ভর্ৎসনা করা হবে এবং বলা হবে- তুমি তোমার অপকর্মের প্রতিদানস্বরূপ এ কাঠিন শাস্তি ভোগ কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ يُسْحَبُوْنَ فِي النَّارِ عَلٰي وُجُوْهِهِمْ ط ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ)
“যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; (বলা হবে) জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর।” (সূরা কামার ৫৪ : ৪৮)
অতএব যারা দুনিয়াতে মন্দ আমল করবে, যারা শয়তানের অনুসরণ করবে তাদের অবস্থা মৃত্যুর পর খবুই কঠিন হবে। তাই আমাদের উচিত শয়তানের আনুগত্য বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করা। তাহলেই পরকালে নাজাত পাওয়ার আশা করতে পারি।
(وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ...)
দৃষ্টান্ত বর্ণনা এক প্রকার ভাষা অলঙ্কার। প্রত্যেক ভাষায় দৃষ্টান্তের ব্যবহার দেখা যায়। আল্লাহ তা‘আলাও কুরআনে অসংখ্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। এগুলোকে আমসালুল কুরআন বলা হয়। দৃষ্টান্তের মাধ্যমে কোন অবোধগম্য বিষয়কে সহজে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে বুঝানোর জন্য এ কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে যাতে সকল কথা তাদের মনে গেঁথে যায় এবং তারা নসীহত গ্রহণ করে।
(غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ)
‘এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই’ অর্থাৎ কুরআন শুদ্ধ আরবী ভাষায় নাযিল করা হয়েছে যা সকল প্রকার বক্রতা ও জটিলতা থেকে মুক্ত। যাতে মানুষ তাতে বর্ণিত শাস্তিসমূহকে ভয় করে এবং তাতে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি অর্জন করার নিমিত্তে আমল করে।
দৃষ্টান্তের উপকারিতা উল্লেখ করার পর একটি দৃষ্টান্তের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা হল-
(رَّجُلًا فِيْهِ شُرَكَا۬ءُ...)
এটি বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ও একত্ববাদে বিশ্বাসীর একটি দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ একজন দাস যার কয়েকজন মনিব আছে যাদের মন-মানসিকতা আলাদা আলাদা, সুতরাং তারা আপোষে তাকে নিয়ে ঝগড়া করে। আর একজন দাস যার মাত্র একজন মনিব, তার মালিকানায় অন্য কেউ শরীক নেই। উক্ত দাস দু’টি কি সমান হতে পারে? না, কক্ষণই না। অনুরূপ ঐ মুশরিক ব্যক্তি যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য উপাস্যের ইবাদত করে এবং ঐ মু’মিন ব্যক্তি যে একমাত্র এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে, তার সাথে কাউকে শরীক করে না, এদের উভয়ে সমান হতে পারে না।
(إِنَّكَ مَيِّتٌ وَّإِنَّهُمْ مَّيِّتُوْنَ..... تَخْتَصِمُوْنَ)
অর্থাৎ হে নাবী! তুমি ও তোমার বিরোধী সকলেই মৃত্যুবরণ করে আখিরাতে আমার নিকট উপস্থিত হবে। পৃথিবীতে তোমাদের মাঝে তাওহীদ ও শির্কের ফায়সালা সম্ভব হয়নি এবং তুমি এ বিষয়ে ঝগড়া করতেই থেকেছ। কিন্তু আমি এখানে তার ফায়সালা করব এবং মিথ্যাবাদীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব।
উক্ত দু’টি আয়াত দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ হয়। যেমন সূরা আলি-ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াতেও সে কথা প্রমাণ হয়। অতএব নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “হায়াতুন নাবী” বলে বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহ বিরোধী আক্বিদাহ। বরং তিনিও অন্যান্য মানুষের মত মৃত্যুবরণ করেছেন, ফলে তাঁকেও দাফন করা হয়েছে এবং কবরে তিনি অবশ্যই বারযাখী জীবন পেয়েছেন। তাঁর কবর এখনো মদীনাতে রয়েছে। তবে নাবীদের মৃত্যু ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য হলো, নাবীরা মারা গেলে তাদের দেহ অক্ষত থাকে, নষ্ট হয় না। আর আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম দিলে আল্লাহ তা‘আলা সে সালাম তাঁর নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
হাশরের আদালতে মাজলূম ব্যক্তি যেভাবে কিসাস আদায় করবে :
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এখানে إِنَّكُمْ শব্দের মধ্যে মু’মিন, কাফির, জালিম-মাজলূম সবাই শামিল। তারা সবাই নিজ নিজ মোকদ্দমা আল্লাহ তা‘আলার আদালতে দায়ের করবে এবং আল্লাহ তা‘আলা জালিমকে মাজলূমের হক ফেরৎ দিতে জালিমকে বাধ্য করবেন। সহীহ বুখারীতে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কারো যিম্মায় কারো কোন হক থাকলে তার উচিত দুনিয়াতেই তা আদায় করা অথবা ক্ষমা নিয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া। কেননা পরকালে টাকা-পয়সা থাকবে না যে, তা দিয়ে হক আদায় করা যাবে। সেখানে জালিম ব্যক্তির কিছু সৎ কর্ম থাকলে তা জুলুমের পরিমাণে তার কাছ থেকে নিয়ে মাজলুম ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হবে। তার কাছে কোন সৎকর্ম না থাকলে মাজলুম ব্যক্তির গুনাহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা. ২৪৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ৯৩৩২)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : একদিন সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করলেন তোমরা কি জান নিঃস্ব কে? তারা বললেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা তো নিঃস্ব মনে করি তাকে যার কোন অর্থকড়ি নেই এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই। তিনি বললেন : আমার উম্মাতের মধ্যে সত্যিকার নিঃস্ব সে ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন অনেক সালাত, সিয়াম, হাজ্জ ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হবে কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছিল, কারো অর্থকড়ি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছিল। কাউকে হত্যা করেছিল এবং কাউকে প্রহার করে দুঃখ দিয়েছিল। এসব মাজলূম সবাই আল্লাহ তা‘আলার সামনে তাদের প্রতি জুলূমের বিচার দাবী করবে। ফলে তার সৎ কর্মসমূহ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। যদি তার সৎ কর্ম নিঃশেষ হয়ে যায় এবং হকদারের হক অবশিষ্ট থাকে তবে হকদারের গুনাহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহ্ন্নাামে নিক্ষেপ করা হবে। অতএব এ ব্যক্তির সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হয়ে যাবে। সেই প্রকৃত নিঃস্ব। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৮১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. শয়তানের অনুসরণ করে কোনদিন সফলতার আশা করা যায় না।
২. কাফিররা পরকালে চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে।
৩. মানুষের বোধগম্যের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।
৪. মুশরিকরা কক্ষনো তাওহীদপন্থী মু’মিনের সমান হতে পারে না।
৫. নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতেকাল করেছেন, তিনি ‘হায়াতুন নাবী’ নন, বরং তিনি কবরের জীবনে রয়েছেন।
9 Fozlur Rahman
তারপর কেয়ামতের দিন নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রভুর সামনে বিতর্ক করবে।
10 Mokhtasar Bangla
৩১. হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট কিয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। ফলে হকপন্থী আর বাতিলপন্থীর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে পড়বে।
11 Tafsir Ibn Kathir
২৭-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
দৃষ্টান্ত দ্বারা কথা সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়। এ জন্যেই আল্লাহ তা'আলা নানা প্রকারের দৃষ্টান্তও পেশ করে থাকেন যেন মানুষ ভালভাবে বুঝতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلًا مِّنْ اَنْفُسِكُمْ ـ ـ ـ অর্থাৎ “আল্লাহ তা'আলা তোমাদের জন্য এই দৃষ্টান্তগুলো বর্ণনা করেছেন যেগুলো তোমরা নিজেদেরই মধ্যে ভালভাবে জানতে বুঝতে পার (শেষ পর্যন্ত)।” আর এক জায়গায় বলেনঃ
وَ تِلْكَ الْاَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَ مَا یَعْقِلُهَاۤ اِلَّا الْعٰلِمُوْنَ
অর্থাৎ “ঐ দৃষ্টান্তগুলো আমি তোমাদের জন্যে বর্ণনা করে থাকি, শুধু জ্ঞানীরাই ওগুলো বুঝে থাকে।” (২৯:৪৩)।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আরবী ভাষায় এই কুরআন বক্রতামুক্ত। অর্থাৎ এই কুরআন স্পষ্ট আরবী ভাষায় রয়েছে। এতে নেই কোন বক্রতা এবং নেই কোন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। এতে রয়েছে খোলাখুলি দলীল ও উজ্জ্বল প্রমাণাদি। যাতে মানুষ এগুলো পড়ে ও বুঝে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। তারা যেন এর শাস্তি সম্বলিত আয়াতগুলো পড়ে দুষ্কর্মগুলো পরিত্যাগ করতে পারে এবং এর সাওয়াবের আয়াতগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে সৎ আমলের প্রতি আগ্রহী হয়।
এরপর মহান আল্লাহ একত্ববাদী ও অংশীবাদীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেন যে, একজন গোলামের প্রভু অনেক এবং তারাও আবার পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন। আর অন্য একজন গোলামের শুধুমাত্র একজন প্রভু ঐ প্রভু ছাড়া তার উপর অন্য কারো আধিপত্য নেই। এ দু’জন কি কখনো সমান হতে পারে? কখনো নয়। অনুরূপভাবে একত্ববাদী, যে শুধু এক ও অংশীবিহীন আল্লাহরই ইবাদত করে এবং মুশরিক, যে তার বহু মা'বুদ বানিয়ে রেখেছে, এ দু’জনও কখনো সমান হতে পারে না। এ দুজনের মধ্যে আসমান যমীনের পার্থক্য রয়েছে। এই প্রকাশ্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর প্রশংসা করা উচিত যে, তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে এমনভাবে বুঝিয়েছেন যে, সত্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। শিরকের অসারতা এবং তাওহীদের বাস্তবতা সুন্দরভাবে মানুষের মন মগজে ভরে দেয়া হয়েছে। এখন মহান আল্লাহর সাথে একমাত্র ঐ ব্যক্তি শরীক স্থাপন করতে পারে যে একেবারে অজ্ঞান, যার মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি মোটেই নেই।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলার اِنَّكَ مَيِّتٌ وَّاِنَّهُمْ مَّيِّتُوْنَ (নিশ্চয়ই তুমি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল) এই উক্তি এবং
وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ اَفَاۡئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰۤى اَعْقَابِكُمْ وَ مَنْ یَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَیْهِ فَلَنْ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیْئًا وَ سَیَجْزِی اللّٰهُ الشّٰكِرِیْن
(মুহাম্মদ সঃ একজন রাসূল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন) (৩:১৪৪)-এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর মৃত্যুর প্রমাণ হিসেবে পাঠ করেন এবং জনগণকে বুঝিয়ে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইন্তেকাল করেছেন। তার একথা শুনে সবারই বিশ্বাস হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইন্তেকাল করেছেন। আয়াতের ভাবার্থ এই যে, সবাই এই দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণকারী এবং আখিরাতে সবাই আল্লাহ তাআলার নিকট একত্রিত হবে। সেখানে আল্লাহ তা'আলা অংশীবাদী ও একত্ববাদীদের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ফায়সালা করবেন এবং সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে। তাঁর চেয়ে উত্তম ফায়সালাকারী ও বড় জ্ঞানী আর কে আছে? ঈমানদার, একত্ববাদী এবং সুন্নাতের পাবন্দ ব্যক্তি সেদিন মুক্তি পাবে এবং মুশরিক, কাফির ও মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী কঠিন শাস্তির শিকার হবে। অনুরূপভাবে দুনিয়ার যে দুই ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া ও বিরোধ ছিল, তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে এবং মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন।
হযরত ইবনে যুবায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন ثُمَّ اِنَّكُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ عِنْدَ رَبِّكُمْ تَخْتَصِمُوْنَ-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন হযরত যুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামতের দিন (দুনিয়ার) ঝগড়ার পুনরাবৃত্তি হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যা, নিশ্চয়ই।” তখন হযরত যুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ “তাহলে তো এটা খুবই কঠিন ব্যাপার হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেন)
মুসনাদে আহমাদের হাদীসে এও রয়েছে যে, যখন ثُمَّ لَتُسْئَلُنَّ یَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِیْمِ (এরপর অবশ্যই সেই দিন তোমাদেরকে নিয়ামত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে) (১০২:৮) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন হযরত যুবায়ের (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন নিয়ামত সম্বন্ধে আমরা জিজ্ঞাসিত হবো? আমরা তো খেজুর ও পানি খেয়েই জীবন যাপন করছি!” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এখন বেশী নিয়ামত নেই বটে, কিন্তু সত্বরই তোমরা অধিক নিয়ামত লাভ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহও (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন) মুসনাদের এই হাদীসেই এটাও রয়েছে যে,
اِنَّكَ مَيِّتٌ وَّاِنَّهُمْ مَّيِّتُوْنَ ـ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ عِنْدَ رَبِّكُمْ تَخْتَصِمُوْنَ
এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হলে হযরত যুবায়ের ইবনে মুতঈম (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! দুনিয়ায় আমাদের মধ্যে যে ঝগড়া-বিবাদ রয়েছে, কিয়ামতের দিন ওটারই কি পুনরাবৃত্তি করা হবে? সাথে সাথে ওর গুনাহ সম্বন্ধেও কি প্রশ্ন করা হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, অবশ্যই পুনরাবৃত্তি হবে এবং হকদারকে পূর্ণ হক দেয়া হবে।” একথা শুনে হযরত যুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ “তাহলে তো কঠিন ব্যাপার হবে।” (ইমাম তিরমিযীও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
হযরত উকবা ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম দু’জন প্রতিবেশীর পারস্পরিক ঝগড়া পেশ করা হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! কিয়ামতের দিন সমস্ত ঝগড়ারই ফায়সালা করা হবে, এমনকি দু’টি বকরী, যারা দুনিয়ায় লড়াই করেছিল এবং শিং বিশিষ্ট বকরীটি শিং বিহীন বকরীকে শিং দ্বারা গুঁতো দিয়েছিল, তারও প্রতিশোধ আদায় করে দেয়া হবে।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা দুটি বকরীকে পরস্পর লড়াই করতে দেখে বলেনঃ “হে আবু যার (রাঃ)! বকরী দুটি কি নিয়ে লড়াই করছে তা তুমি জান কি?” হযরত আবু যার (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “জ্বী, না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা কিন্তু জানেন এবং কিয়ামতের দিন তিনি তাদের উভয়ের মধ্যে ইনসাফের সাথে ফায়সালা করবেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন অত্যাচারী ও আত্মসাকারী বাদশাহকে আনয়ন করা হবে এবং তার প্রজারা তার সাথে ঝগড়া করে জয়লাভ করবে। তখন তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবেঃ যাও, তাকে জাহান্নামের একটি স্তম্ভ বানিয়ে নাও।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের আগলাব ইবনে তামীম নামক একজন বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি দুর্বল ছিল)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ঐদিন প্রত্যেক সত্যবাদী মিথ্যাবাদীর সাথে, প্রত্যেক অত্যাচারিত ব্যক্তি অত্যাচারীর সাথে, প্রত্যেক সুপথপ্রাপ্ত ব্যক্তি পথভ্রষ্ট ব্যক্তির সাথে এবং প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি সবল ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করবে।
ইবনে মুনদাহ (রঃ) কিতাবুর রূহ এর মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে রিওয়াইয়াত করেছেন যে, জনগণ কিয়ামতের দিন ঝগড়া করবে, এমন কি আত্মা ও দেহের মধ্যেও ঝগড়া বাঁধবে। আত্মা দেহের উপর দোষারোপ করে বলবেঃ “এসব দুষ্কার্য তো তুমিই করেছিলে।” তখন দেহ আত্মাকে বলবেঃ “সমস্ত চাহিদা ও দুষ্টামি তো তোমারই ছিল।” তখন একজন ফেরেশতা তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন। তিনি বলবেনঃ “তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন দুটি লোকের মত যাদের একজন চক্ষু বিশিষ্ট, কিন্তু খোড়া ও বিকলাঙ্গ। চলাফেরা করতে পারে না। দ্বিতীয়জন অন্ধ, কিন্তু তার পা ভাল, খোড়া নয়। সে চলাফেরা করতে পারে। তারা দু'জন একটি বাগানে রয়েছে। খোড়া অন্ধকে বললোঃ “ভাই, এই বাগানটি তো ফলে ভরপুর রয়েছে। কিন্তু আমার তো পা নেই যে, ফল পাড়বো?" তখন অন্ধ বললোঃ “এসো, আমার তো পা রয়েছে, আমি তোমাকে আমার পিঠের উপর চড়িয়ে নিচ্ছি।” অতঃপর তারা দুজন এভাবে পৌঁছলো এবং ইচ্ছা ও চাহিদা মত ফল পাড়লো। আচ্ছা বলতো, এ দু'জনের মধ্যে অপরাধী কে?” দেহ ও আত্মা উভয়ে জবাব দিলোঃ “দু'জনই সমান অপরাধী।” ফেরেশতারা তখন বলবেনঃ “তাহলে তো তোমরা নিজেরাই তোমাদের ফায়সালা করে দিলে। অর্থাৎ দেহ যেন সওয়ারী এবং আত্মা যেন সওয়ার বা আরোহী।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আমরা বিস্ময়বোধ করছিলাম যে, আমাদের ও আহলে কিতাবের মধ্যে তো কোন ঝগড়া নেই। তাহলে কিয়ামতের দিন কার সাথে আমরা ঝগড়া করবো? এরপর যখন মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ফিনা শুরু হয়ে গেল তখন আমরা বুঝলাম যে, এটাই হলো পরস্পরের ঝগড়া যা কিয়ামতের দিন পেশ করা হবে।”
হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আহলে কিবলার ঝগড়া বুঝানো হয়েছে। আর ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা মুসলমান ও কাফিরের ঝগড়া উদ্দেশ্য। এসব ব্যাপারে সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।