৬-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! এই মিথ্যা প্রশ্নকারী মুশরিকদেরকে বলে দাও- আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমাকে অহীর মাধ্যমে বলে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের সবারই মা'বুদ এক আল্লাহ। তোমরা যে কতকগুলো মা'বূদ বানিয়ে নিয়েছো এটা সরাসরি বিভ্রান্তিকর পন্থা। তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর এবং ঠিক ঐভাবে কর যেভাবে তোমরা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে জানতে পেরেছে। আর তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী গুনাহ্ হতে তাওবা কর এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। বিশ্বাস রেখো যে, আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপনকারীরা ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ যারা যাকাত প্রদান করে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে এর ভাবার্থ হলোঃ “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই’ এই সাক্ষ্য যারা প্রদান করে না। ইকরামাও (রঃ) এ কথাই বলেন। এই উক্তিটি আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলার নিম্নের উক্তির মতইঃ
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا ـ وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا
অর্থাৎ “সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।”(৯১:৯-১০) নিমের উক্তিটিও অনুরূপঃ
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰى ـ وَ ذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰى
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায পড়ে।”(৮৭:১৪-১৫) আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের এ উক্তিটিও ঐরূপঃ
هَلْ لَّكَ اِلٰۤى اَنْ تَزَكّٰى
অর্থাৎ “তোমার পবিত্রতা অর্জন করার খেয়াল আছে কি?”(৭৯:১৮) এ আয়াতগুলোতে যাকাত অর্থাৎ পবিত্রতা দ্বারা নফকে বাজে চরিত্র হতে মুক্ত রাখা উদ্দেশ্য। আর এর সবচেয়ে বড় ও প্রথম প্রকার হচ্ছে শিরূক হতে পবিত্র হওয়া। অনুরূপভাবে উপরোক্ত আয়াতে যাকাত না দেয়া দ্বারা তাওহীদকে অমান্য করা বুঝানো হয়েছে। মালের যাকাতকে যাকাত বলার কারণ এই যে, এটা মালকে অবৈধতা হতে পবিত্র করে এবং মালের বৃদ্ধি ও বরকতের কারণ হয়। আর আল্লাহর পথে ঐ মাল হতে কিছু খরচ করার তাওফীক লাভ হয়। কিন্তু ইমাম সুদ্দী (রঃ), মুআবিয়া ইবনে কুরুরা (রঃ), কাতাদা (রঃ) এবং অন্যান্য তাফসীরকারগণ এর অর্থ করেছেন মালের যাকাত না দেয়া এবং বাহ্যতঃ এটাই বুঝা যাচ্ছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-ও এটাকেই পছন্দ করেছেন। কিন্তু এ উক্তিটির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, যাকাত ফরয হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। আর এ আয়াত অবতীর্ণ হয় মক্কায়। বড় জোর এই তাফসীরকে মেনে নিয়ে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, সাদকা ও যাকাতের আসল হুকুম তো নবুওয়াতের শুরুতেই ছিল। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ
وَ اٰتُوْا حَقَّهٗ یَوْمَ حَصَادِهٖ
অর্থাৎ “ফসল কাটার দিন তোমরা তার হক দিয়ে দাও।”(৬:১৪১) হ্যা, তবে ঐ যাকাত, যার নিসাব ও পরিমাণ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে নির্ধারিত হয় তা হয় মদীনায়। এটি এমন একটি উক্তি যে, এর দ্বারা দু’টি উক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য এসে যায়।
নামাযের ব্যাপারেও এটা দেখা যায় যে, নামায সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে নবুওয়াতের শুরুতেই ফরয হয়েছিল। কিন্তু মিরাজের রাত্রে হিজরতের দেড় বছর পূর্বে পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিতভাবে শর্ত ও আরকানসহ নির্ধারিত হয়। আর ধীরে ধীরে এর সমুদয় সম্পর্কিত বিষয় পুরো করে দেয়া হয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।” এটা কখনো শেষ হবার নয়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ مَاكِثِيْنَ فِيْهِ اَبَدًا অর্থাৎ “যাতে তারা হবে চিরস্থায়ী।”(১৮:৩) আর এক জায়গায় আছেঃ عَطَآءً غَیْرَ مَجْذُوْذٍ অর্থাৎ “তাদেরকে যে ইনআ'ম দেয়া হবে তা কখনো ভাঙ্গবার বা শেষ হবার নয়, বরং অনবরতই থাকবে।”(১১:১০৮) সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, তাদেরকে যেন এটা তাদের প্রাপ্য হিসেবে দেয়া হবে, অনুগ্রহ হিসেবে নয়। কিন্তু কতক ইমাম তাঁর এ উক্তি খণ্ডন করেছেন। কেননা, জান্নাতবাসীর উপরও নিশ্চিতরূপে আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে, এ কথা বলতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیْكُمْ اَنْ هَدٰىكُمْ لِلْاِیْمَانِ
অর্থাৎ “বরং আল্লাহ্ই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন বা তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।”(৪৯:১৭) জান্নাতবাসীদের উক্তিঃ
فَمَنَّ اللّٰهُ عَلَیْنَا وَ وَقٰىنَا عَذَابَ السَّمُوْمِ
অর্থাৎ “আল্লাহ্ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন।”(৫২:২৭) রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ কিন্তু এই যে, আল্লাহ্ আমাকে স্বীয় রহমত, অনুগ্রহ ও ইহসানের মধ্যে নিয়ে নিবেন।