যুখরুফ আয়াত ১৪
وَاِنَّآ اِلٰى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ ( الزخرف: ١٤ )
Wa innaaa ilaa Rabbinaa lamunqaliboon (az-Zukhruf ৪৩:১৪)
English Sahih:
And indeed we, to our Lord, will [surely] return." (Az-Zukhruf [43] : 14)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যেতে হবে। (যুখরুফ [৪৩] : ১৪)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।’ [১]
[১] নবী করীম (সাঃ) যখন বাহনে আরোহণ করতেন, তখন তিনবার 'আল্লাহু আকবার' বলতেন এবং سُبْحَانَ الَّذِي থেকে لَمُنْقَلِبُوْنَ পর্যন্ত আয়াতের অংশটুকু পড়তেন। এ ছাড়াও কল্যাণ ও নিরাপত্তা চেয়ে দু'আ করতেন। দু'আগুলো দু'আর বইগুলোতে দ্রষ্টব্য। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হাজ্জ)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
‘আর নিশ্চয় আমারা আমাদের রবের কাছেই প্রত্যাবর্তনকারী।’
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর নিশ্চয় আমরা আমাদের রবের কাছেই প্রত্যাবর্তনকারী।
4 Muhiuddin Khan
আমরা অবশ্যই আমাদের পালনকর্তার দিকে ফিরে যাব।
5 Zohurul Hoque
''আর অবশ্য আমরা আমাদের প্রভুর দিকেই তো ফিরে যাব।’’
6 Mufti Taqi Usmani
নিশ্চয়ই আমাদেরকে আমাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।
7 Mujibur Rahman
আমরা আমাদের রবের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।
8 Tafsir Fathul Mazid
৯-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ তথা সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ এ স্বীকারোক্তি মক্কার কুরাইশরাও দিত সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ সম্পর্কে যদি মক্কার কাফিরদেরকে জিজ্ঞাসা করা হত তাহলে তারা এ কথাই বলত যে, সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক আল্লাহ, যিনি জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন ইত্যাদি। শুধু তাই নয় বরং বিপদে পড়লে তারা একমাত্র আল্লাহকে ডাকত, কারণ তারা জানত এ বিপদ থেকে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। তারপরেও তারা মুসলিম হতে পারেনি, কারণ তারা তাওহীদে উলূহিয়্যাতে সরাসরি বিশ্বাস করত না এবং মানত না। কোন কিছুর প্রয়োজন পড়লে দেব-দেবীর কাছে যেত, তাদের নামে মানত করত, তাদের নামে কুরবানী করত।
তাই একজন ব্যক্তি আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও সবকিছুর মালিক ইত্যাদি অর্থাৎ তাওহীদে রুবুবিয়্যাতে ঈমান আনলেই মু’মিন হবে না যতক্ষণ না সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য সম্পাদন করে। এ সম্পর্কে আরো আলোচনা সূরা লুক্বমান-এর ২৫ নম্বর আয়াতে করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তিনি পৃথিবীকে মানুষের জন্য করেছেন শয্যাস্বরূপ, তা এমন শয্যা বা বিছানা যা স্থির ও স্থিতিশীল। তোমরা এর ওপর চলাফেরা করো, দণ্ডায়মান হও। নিদ্রা যাও এবং যেখানে ইচ্ছা যাতায়াত করো। তিনি এটাকে পর্বতমালা দ্বারা সুদৃঢ় করে দিয়েছেন, যাতে তা নড়াচড়া না করে এবং এতে চলার পথ তৈরী করে দিয়েছেন যাতে মানুষ সঠিক পথ লাভ করতে পারে। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাহ্ল-এর ১৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনিই আকাশ হতে পরিমিত বৃষ্টি বর্ষণ করেন যা দ্বারা মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। তার থেকে কমও নয় আবার বেশিও নয়। আর এ পানির দ্বারা তিনিই মৃত জমিনকে সঞ্জীবিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَّالسَّمَا۬ٓءَ بِنَا۬ٓءً ص وَّأَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ٓءً فَأَخْرَجَ بِه۪ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ ج فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন এবং যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তার দ্বারা তোমাদের জন্য জীবিকাস্বরূপ ফল উৎপাদন করেন, অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না।” (সূরা বাকারাহ ২ : ২২)
এ সম্পর্কেও সূরা আল হিজ্র, সূরা আন নাহ্ল সহ অন্যান্য জায়গাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত জীবকে জোড়া জোড়া তথা নর ও নারী করে সৃষ্টি করেছেন। যাবতীয় উদ্ভিদ, শস্য, ফল-মূল এবং জীব-জন্তু সবকিছুরই বিপরীত লিঙ্গ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(سُبْحٰنَ الَّذِیْ خَلَقَ الْاَزْوَاجَ کُلَّھَا مِمَّا تُنْۭبِتُ الْاَرْضُ وَمِنْ اَنْفُسِھِمْ وَمِمَّا لَا یَعْلَمُوْنَ)
“পবিত্র তিনি, যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে।” (সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সওয়ারের জন্য নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা আন্ নাহ্ল এ আলোচনা করা হয়েছে।
لِتَسْتَوُوْا -এর অর্থ, لتستقروا অথবা لتستعلوا স্থির হয়ে বসতে পার অথবা সওয়ার হতে পার।
ظُهُوْرِه۪ এখানে একবচনের যমীর (সর্বনাম) ব্যবহার করা হয়েছে ‘জিন্স’ (শ্রেণি)-এর দিকে লক্ষ্য করে। অর্থাৎ যাতে তোমরা নৌযান অথবা চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের কথা স্মরণ করবে যে, তোমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তা অনুগত করে দিয়েছেন।
مقرنين অর্থ- مطيعين অর্থাৎ- বশীভূত করে দেয়া, অনুগত করে দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সওয়ারে আরোহণের জন্য যে, দু‘আ পাঠ করতে হয় তা শিক্ষা দিয়েছেন। সেটা হলো,
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ- وَإِنَّا إِلَي رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ)
পবিত্র ও মহান তিনি যিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব। সওয়ারীতে আরোহণ করার ব্যাপারে আরো সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়।
‘আলী ইবনু রাবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি ‘আলী (রাঃ)-কে দেখলাম তিনি তার সওয়ারীর নিকট আসলেন, যখন সওয়ারীর ওপর পা রাখলেন তখন বললেন : بسم الله যখন সেটার ওপর বসলেন তখন বললেন : الحمد لله এবং এ দু‘আটি পাঠ করলেন :
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ..)
অতঃপর তিনবার الحمد لله তিনবার الله اكبر এবং বললেন :
سبحانك لا اله الا انت قد ظلمت نفسي فاغفرلي
আপনি পবিত্র, আপনি ব্যতীত কোন সঠিক মা‘বূদ নেই। আমি আমার নিজের ওপর জুলুম করেছি সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এটা মূলত সওয়ারীতে আরোহণ করার পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতেই সকল মুসলিমকে আরোহণ করা উচিত।
অতঃপর তিনি হাসলেন। আমি তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুরূপ করতে দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : বান্দা যখন বলে- হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা কর তখন আল্লাহ তা‘আলা আনন্দিত হন এবং বলেন : আমার বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। (আবূ দাঊদ হা. ২৬০২, তিরমিযী হা. ৩৪৪৬, সহীহ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁর বাহনে আরোহণ করতেন তখন তিনবার তাকবীর বলতেন, অতঃপর বলতেন :
(سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَه۫ مُقْرِنِيْنَ....)
তারপর বলতেন :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِي سَفَرِي هَذَا مِنَ البِرِّ وَالتَّقْوَي، وَمِنَ العَمَلِ مَا تَرْضَي، اللّٰهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا المَسِيرَ، وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَ الأَرْضِ، اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ، وَالخَلِيفَةُ فِي الأَهْلِ، اللَّهُمَّ اصْحَبْنَا فِي سَفَرِنَا، وَاخْلُفْنَا فِي أَهْلِنَا
হে আল্লাহ! আমি আমার এ সফরে কল্যাণ ও তাক্বওয়া কামনা করছি এবং এমন আমল কামনা করছি যা আপনি পছন্দ করেন।
হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাদের জন্য সফর সহজ করে দাও, দূরকে নিকটবর্তী করে দাও। হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমি সফরে সাথী, পরিবারের প্রতিনিধি। হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাদের সফরে তুমি সাথী হও এবং আমাদের পরিবারের প্রতিনিধি হও। (সহীহ মুসলিম, তিরমিযী হা. ২৪৪৭, আবূ দাঊদ হা. ২৫৯৯)
সফর থেকে ফিরে এসে বলতেন :
آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ
আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী ও আমাদের প্রভুর প্রশংসাকারী। (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৬৮, সহীহ মুসলিম হা. ১৩৪২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : প্রত্যেক জন্তুর গজের ওপর শয়তান থাকে, যখন তার ওপর আরোহণ করবে তখন বিসমিল্লাহ বলবে যেমন তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে; তারপর সে জন্তু ব্যবহার কর। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই বহন করে নিয়ে চলে। (সিলসিলা সহীহাহ হা. ২২৭১)
সুতরাং একজন বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষের কর্তব্য হল সত্যিকার দাতা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ব্যবহার করার সময় অমনযোগী ও উদাসীন না হওয়া। বরং নেয়ামতের কৃজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি জন্তুর অধিকারের দিকে খেয়াল রাখা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নয়। এ কথা মক্কার কুরাইশরাও স্বীকার করত।
২. আল্লাহ তা‘আলা সকল বস্তুকে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন।
৩. মানুষকে মৃত্যুর পর অবশ্যই পুনরায় জীবিত করা হবে। যেমনভাবে জীবিত করা হয় মৃত জমিনকে।
৪. সওয়ারীতে আরোহণ করার পদ্ধতি ও দু‘আ জানতে পারলাম।
৫. কোন ব্যক্তি যে-কোন প্রকার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের জন্য সম্পাদন করলে মু’মিন থাকবে না, যদিও আল্লাহ তা‘আলাকে রিযিকদাতা, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে।
9 Fozlur Rahman
“আর আমরা আমাদের প্রভুর কাছেই ফিরে যাব।”
10 Mokhtasar Bangla
১৪. আমরা নিজেদের মৃত্যুর পর এককভাবে আমাদের প্রতিপালকের নিকট হিসাব ও প্রতিদানের উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তিত হবো।
11 Tafsir Ibn Kathir
৯-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি যদি এই মুশরিকদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তবে অবশ্যই তারা উত্তরে বলবে যে, পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহই এগুলো সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তারা তাঁর একত্বকে স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও তার সাথে ইবাদতে অন্যদেরকেও শরীক করছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে শয্যা এবং ওতে করেছি তোমাদের চলার পথ যাতে তোমরা সঠিক পথে চলতে পার। অর্থাৎ যমীনকে আমি স্থির ও মযবুত বানিয়েছি, যাতে তোমরা এর উপর উঠা-বসা ও চলা-ফেরা করতে পার এবং শুতে ও জাগতে পার। অথচ স্বয়ং এ যমীন পানির উপর রয়েছে, কিন্তু মযবূত পর্বতমালা এতে স্থাপন করে দিয়ে একে হেলা-দোলা ও নড়াচড়া করা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে। এতে রাস্তা বানিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তোমরা এক শহর হতে অন্য শহরে এবং এক দেশ হতে অন্য দেশে গমনাগমন করতে পার। তিনি আকাশ হতে এমন পরিমিত পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করেন যে, তা জমির জন্যে যথেষ্ট হয়। এর ফলে ভূমি শস্য-শ্যামল হয়ে ওঠে। এই পানি মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু পানও করে থাকে। এই বৃষ্টির দ্বারা মৃত ও শুষ্ক জমিকে সজীব করে তোলা হয়। শুষ্কতা সিক্ততায় পরিবর্তিত হয়। জঙ্গল ও মাঠ-ময়দান সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে এবং গাছপালা ফুলে ফলে পূর্ণ হয়ে যায়। বিভিন্ন প্রকারের সুন্দর ও সুস্বাদু ফল-মূল উৎপন্ন হয়। এটাকেই আল্লাহ তা'আলা মৃতকে পুনর্জীবিত করার দলীল হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ ‘এই ভাবেই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে।'
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তিনি যুগলসমূহের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন। তিনি শস্য, ফলমূল, শাক-সবজী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের জিনিস সৃষ্টি করেছেন। মানুষের উপকারের জন্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন নানা প্রকারের জীবজন্তু। সামুদ্রিক সফরের জন্যে তিনি নৌযানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং স্থল ভাগের সফরের জন্যে তিনি সরবরাহ করেছেন চতুষ্পদ জন্তু। এগুলোর মধ্যে মানুষ কতকগুলোর গোত ভক্ষণ করে থাকে এবং কতকগুলো তাদেরকে দুধ দিয়ে থাকে। আর কতকগুলো তাদের সওয়ারীর কাজে ব্যবহৃত হয়। তারা ঐগুলোর উপর তাদের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং নিজেরাও সওয়ার হয়। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের উচিত যে, সওয়ার হওয়ার পর আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে বলবেঃ পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আর আমরা (মৃত্যুর পর) আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবো। এই আগমন ও প্রস্থান এবং এই সংক্ষিপ্ত সফরের মাধ্যমে আখিরাতের সফরকে স্মরণ কর।” যেমন দুনিয়ার পাথেয়ের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা'আলা আখিরাতের পাথেয়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ
وَ تَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَیْرَ الزَّادِ التَّقْوٰى
অর্থাৎ “তোমরা পাথেয় গ্রহণ কর, তবে আখিরাতের পাথেয়ই হলো উত্তম পাথেয়।”(২:১৯৭) অনুরূপভাবে পার্থিব পোশাকের বর্ণনা দেয়ার পর পারলৌকিক পোশাকের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ “তাকওয়ার পোশাকই হলো উত্তম পোশাক।”
সওয়ারীর উপর সওয়ার হওয়ার সময় দু'আ পাঠের হাদীসসমূহঃ
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)-এর হাদীসঃ
হযরত আলী ইবনে রাবীআহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে তাঁর সওয়ারীর উপর সওয়ার হওয়ার সময় পা-দানীতে পা রাখা অবস্থাতেই بِسْمِ اللّٰهِ পড়তে শুনেছেন। যখন ঠিকভাবে সওয়ার হয়ে যান তখন পাঠ করেনঃ
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ سُبْحَانَ الَّذِىْ سَخَّرَ لَنَا هٰذَا وَمَا كُنَّا لَهٗ مُقْرِنَِيْنَ ـ وَاِنَّا اِلٰى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ
অর্থাৎ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এটাকে আমাদের বশীভূত করেছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না একে বশীভূত করতে। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবো।” অতঃপর তিনি তিনবার اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ এবং তিন বার اَللّٰهُ اَكْبَرُ বলেন। তারপর পাঠ করেনঃ
سُبْحَانَكَ لَا اِلٰهَ اِلَّا اَنْتَ قَدْ ظَلَمْتُ نَفْسِىْ فَاغْفِرْ لِىْ
অর্থাৎ “আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আপনি ছাড়া কোন মা'বুদ নেই, আমি আমার উপর যুলুম করেছি, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন। তারপর তিনি হেসে উঠেন। হযরত আলী ইবনে রাবীআহ (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি হাসলেন কেন?” তিনি উত্তরে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এই প্রশ্নই করেছিলাম। তিনি জবাবে বলেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা যখন স্বীয় বান্দার মুখে رَبِّ اغْفِرْلِىْ (হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন!) শুনতে পান তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং বলেনঃ “আমার বান্দা জানে যে, আমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ মাফ করতে পারে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু দাঊদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে তাঁর সওয়ারীর পিছনে বসিয়ে নেন। ঠিকঠাকভাবে বসে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) اَللّٰهُ اَكْبَرُ তিনবার اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ তিনবার এবং سُبْحَانَ اللهِ তিনবার পাঠ করেন। অতঃপর একবার পড়েন। তারপর সওয়ারীর উপর চিত হয়ে শয়নের মত হন এবং এরপর হেসে ওঠেন। অতঃপর তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন জানোয়ারের উপর সওয়ার হয়ে আমি যেমন করলাম এরূপ করে, তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ তার প্রতি মনোযোগী হয়ে এই ভাবে হেসে ওঠেন যেভাবে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখনই স্বীয় সওয়ারীর উপর আরোহণ করতেন তখনই তিনি তিনবার তাকবীর পাঠ করে কুরআন কারীমের سُبْحَانَ الَّذِىْ হতে لَمُنْقَلِبُوْنَ পর্যন্ত আয়াত দু’টি পাঠ করতেন। অতঃপর বলতেনঃ
اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَسْأَلُكَ فِىْ سَفَرِىْ هٰذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوٰى، وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضٰى ـ اَللّٰهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا السَّفَرَ وَاطْوِ لَنَا الْبَعِيْدَ ـ اَللّٰهُمَّ اَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيْفَةُ فِى الْاَهْلِ ـ اَللّٰهُمَّ اَصْحِبْنَا فِى سَفَرِنَا وَاخْلُفْنَا فِى اَهْلِنَا
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আমার এই সফরে আপনার নিকট কল্যাণ ও তাকওয়া প্রার্থনা করছি এবং ঐ আমল কামনা করছি যাতে আপনি সন্তুষ্ট। হে আল্লাহ! আমাদের উপর সফরকে হালকা করে দিন এবং আমাদের জন্যে দূরত্বকে জড়িয়ে নিন। হে আল্লাহ! আপনিই সফরে সাথী এবং পরিবার পরিজনের রক্ষক। হে আল্লাহ! আপনি সফরে আমাদের সাথী হয়ে যান এবং বাড়ীতে আমাদের পরিবার পরিজনের রক্ষক হয়ে যান। আর যখন তিনি সফর হতে বাড়ী অভিমুখে ফিরতেন তখন বলতেনঃ
اٰيِبُوْنَ تَائِبُوْنَ اِنْ شَاءَ اللّٰهُ عَابِدُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ
অর্থাৎ “প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী ইনশাআল্লাহ প্রতিপালকের ইবাদতকারী, প্রশংসাকারী।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু লাস খুযায়ী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে সাদকার একটি উট দান করেন যেন আমরা ওর উপর সওয়ার হয়ে হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) ! আমরা তো এটা দেখতে পারি না যে, আপনি আমাদেরকে এর উপর সওয়ার করিয়ে দিবেন! তিনি তখন বললেনঃ “জেনে রেখো যে, প্রত্যেক উটে উপর শয়তান থাকে। তোমরা যখন এর উপর সওয়ার হবে তখন আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দিচ্ছি তাই করবে। প্রথমে আল্লাহর নাম স্মরণ করবে, তারপর একে নিজের খাদেম বানাবে। মনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলাই সওয়ার করিয়ে থাকেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবূ লাস (রাঃ)-এর নাম মুহাম্মাদ ইবনে আসওয়াদ ইবনে খালফ (রাঃ) মুসনাদের অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক উটের পিঠের উপর শয়তান থাকে। সুতরাং যখন তোমরা ওর উপর সওয়ার হবে তখন আল্লাহর নাম নাও, অতঃপর প্রয়োজন সংক্ষেপ করো না বা প্রয়োজন পূরণে ত্রুটি করো না।"