নামকরণ : أحقاف
শব্দটি حقف এর বহুবচন, যার অর্থ হল : প্রচুর বালু, বালুর উঁচু ও লম্বা পাহাড়। কেউ অর্থ করেছেন পাহাড় ও গুহা। এটা আরব উপ-দ্বীপের দক্ষিণ পাশে তথা ইয়ামানের হাযরামাউতের নিকটস্থ হূদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্প্রদায় প্রথম ‘আদ এর এলাকার নাম। সূরা আল আহক্বাফ মক্কায় অবতীর্ণ। এ সূরায় আহক্বাফ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে আর তা থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাতে কয়েকটি আলোচনা স্থান পেয়েছে : (১) আকাশ জমিন সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং এর একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, সময় শেষ হলে সব শেষ হয়ে যাবে। (২) আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যদেরকে মা‘বূদ হিসেবে ডাকে তারা সবচেয়ে পথভ্রষ্ট। (৩) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন নতুন রাসূল নন, বরং তাঁর মত অনেক রাসূল অতীতে চলে গেছেন। (৪) কাফিরদের দাবী- মুহাম্মাদ যে ইসলাম নিয়ে এসেছে তা কল্যাণকর হলে আমরাই তা প্রথমে গ্রহণ করতাম। (৫) পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ এবং তাদের অবদান উল্লেখ করা হয়েছে, সবশেষে আহকাফবাসী ও তাদের ওপর আপতিত শাস্তি সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে।
১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এর অর্থ ও প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
মক্কার কাফির-মুশরিকরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতকে অস্বীকার, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবকে অবিশ্বাস, বরং এটা মানব রচিত একটি কিতাব বলে বিশ্বাস করার কথা খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত। এর বিধি-বিধান সত্য, এতে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَإِنَّه۫ لَكِتٰبٌ عَزِيْزٌ لا - لَّا يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْمبَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِه۪ ط تَنْزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ)
“এবং এটা অবশ্যই এক মহিমাময় গ্রন্থ। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না- অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসনীয় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।” (সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ্ ৪১ : ৪১-৪২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(وَاِنَّھ۫ لَتَنْزِیْلُ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَﰏﺚنَزَلَ بِھِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُﰐﺫعَلٰی قَلْبِکَ لِتَکُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِیْنَﰑﺫبِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیْنٍﰒ)
“নিশ্চয়ই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হতে অবতীর্ণ। জিব্রাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পার। (অবতীর্ণ করা হয়েছে) সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।” (সূরা আশ্ শু‘আরা- ২৬ : ১৯২-১৯৫)
(بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّي)
‘সত্যতার সাথে ও এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য’ অর্থাৎ আকাশসমূহ ও জমিন সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ তা‘আলা দুটি বিষয় সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন- (১) আল্লাহ তা‘আলা সত্যসহ আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, অনর্থক সৃষ্টি করেননি, বরং সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য, আর তা হল : মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে সৎ আমলে উত্তম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(ھُوَ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ فِیْ سِتَّةِ اَیَّامٍ وَّکَانَ عَرْشُھ۫ عَلَی الْمَا۬ئِ لِیَبْلُوَکُمْ اَیُّکُمْ اَحْسَنُ عَمَلًاﺚ وَلَئِنْ قُلْتَ اِنَّکُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ مِنْۭ بَعْدِ الْمَوْتِ لَیَقُوْلَنَّ الَّذِیْنَ کَفَرُوْٓا اِنْ ھٰذَآ اِلَّا سِحْرٌ مُّبِیْنٌ)
“আর তিনিই আকাশসমূহ ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর ‘র্আশ ছিল পানির ওপর, (সৃষ্টি করেছেন) তোমাদের মধ্যে কে সৎকর্মে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য। তুমি যদি বল : ‘মৃত্যুর পর তোমরা অবশ্যই উত্থিত হবে’, কাফিররা নিশ্চয়ই বলবে, ‘এটা তো সুস্পষ্ট জাদু।’ (সূরা হূদ ১১ : ৭)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَي الْأَرْضِ زِيْنَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا )
“পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে সৎকর্মে কে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৭)
এছাড়াও এ ব্যাপারে অনেক আয়াত প্রমাণ করে আল্লাহ তা‘আলা অনর্থক এ মহা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেননি। (২) এ আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। যখন প্রতিশ্র“ত সময় উপস্থিত হবে তখন আকাশ ও পৃথিবীর বর্তমান এ সকল নিয়মশৃংখলা ভেঙ্গে পড়বে। তা হল কিয়ামত দিবস। তখন আর আকাশ ও জমিন থাকবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمٰوٰتُ وَبَرَزُوْا لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ )
“যেদিন এ পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশসমূহও; এবং মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সম্মুখে- যিনি এক, পরাক্রমশালী।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪৮)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَيَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الرُّوْحِ ط قُلِ الرُّوْحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّيْ وَمَآ أُوْتِيْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيْلًا )
“আর তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল : ‘রূহ আমার প্রতিপালকের আদেশমাত্র এবং তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে সামান্যই।” (সূরা হিজর ১৫ : ৮৫)
(وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ)
‘কিন্তু যারা কাফির তাদেরকে এ বিষয়ে সাবধান করা সত্ত্বেও তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে’ অর্থাৎ একমাত্র কাফিররাই আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন ও দীনের প্রতি আমলের সতর্কতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঈমান না আনার কারণে যখন তাদেরকে পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদানের ব্যাপারে ভয় দেখানো হয় তখন তারা তার কোন পরওয়া করেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا تَأْتِيْهِمْ مِّنْ اٰيَةٍ مِّنْ اٰيٰتِ رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوْا عَنْهَا مُعْرِضِيْنَ)
“তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীর এমন কোন নিদর্শন তাদের নিকট উপস্থিত হয় না যা হতে তারা মুখ না ফেরায়।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৪)
তাই আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, দীনি জ্ঞানার্জন না করা ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না করা কুফরী কাজ। কেউ কেউ এদেরকে নাস্তিক এবং ধর্মনিরপেক্ষবাদী বলেছেন। আসলে এরা হলো শয়তান পূজারী। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে ইবাদত করে না। যে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে না, প্রকৃত পক্ষে সে শয়তানের ইবাদত করে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আকাশ ও জমিন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা, কে সৎ আমলে উত্তম।
২. দুনিয়া একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিন দুনিয়ার এ নিয়ম-কানুন বহাল থাকবে না।
৩. আল্লাহ তা‘আলার দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, দীনি জ্ঞানার্জন না করা ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না করা কুফরী কাজ।