১০-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যারা আল্লাহর শরীক স্থাপন করে এবং তাঁর রাসল (সঃ)-কে অবিশ্বাস করে তারা কি ভূ-পৃষ্ঠে ভ্রমণ করেনি? করলে তারা জানতে পারতো এবং স্বচক্ষে দেখে নিতো যে, তাদের পূর্বে যারা তাদের মত ছিল তাদের পরিণাম হয়েছিল খুবই মারাত্মক। তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে শুধু মুসলমান ও মুমিনরাই পরিত্রাণ পেয়েছিল। কাফিরদের জন্যে এরূপই শাস্তি এসে থাকে।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ ‘এটা এই জন্যে যে, আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক এবং কাফিরদের কোন অভিভাবক নেই। এ জন্যেই উহুদের যুদ্ধের দিন মুশরিকদের সরদার আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব যখন গর্বভরে নবী (সঃ) ও তাঁর দু’জন খলীফা (রাঃ) সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলো, কিন্তু কোন উত্তর পায়নি তখন বলেছিলোঃ “এরা সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে।” তখন হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) জবাব দিলেনঃ “হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বললে। যাদের বেঁচে থাকা তোমার দেহে কাঁটার মত বিধছে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা তোমার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছেন।” আবু সুফিয়ান (রাঃ) তখন বললোঃ “জেনে রেখো যে, এটা বদরের প্রতিশোধের দিন। আর যুদ্ধ তো বালতির মত (কখনো এই হাতে এবং কখনো ঐ হাতে)। তোমরা তোমাদের নিহতদের মধ্যে কতকগুলোকে নাক, কান ইত্যাদি কর্তিত অবস্থায় পাবে। আমি এরূপ করার হুকুম জারী করিনি, তবে এতে আমি অসন্তুষ্ট নই।” অতঃপর সে গর্ববোধক কবিতা পাঠ করতে শুরু করে। সে বলেঃ اُعْلُ هُبَلْ اُعْلُ هُبَلْ অর্থাৎ “আমাদের হুবুল' দেবতা সমুন্নত হোক।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) বলেনঃ “তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন?” তারা তখন বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি বলবো?” তিনি জবাবে বললেনঃ “তোমরা বল, اَللهُ اَعُلٰى وَاَجَلُّ অর্থাৎ “আল্লাহ অতি উচ্চ ও মহাসম্মানিত।” আবু সুফিয়ান (রাঃ) আবার বললঃ لَنَا الْعُزّٰى وَلَا عُزّٰى لَكُمْ এই অর্থাৎ “আমাদের উযযা (দেবতা) রয়েছে এবং তোমাদের উ নেই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ফরমান অনুযায়ী সাহাবীগণ (রাঃ)-এর জবাবে বলেনঃ
اَللهُ مَوْلَانَا وَلَا مَوْلَاكُمْ
অর্থাৎ “আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তোমাদের কোন অভিভাবক
নেই।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ খবর দিচ্ছেন যে, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা কিয়ামতের দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। পক্ষান্তরে যারা কুফরী করে ও ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু পানাহার ও পেট পূরণ করা। তারা জন্তু-জানোয়ারের মত উদরপূর্তি করে। অর্থাৎ জন্তু-জানোয়ার যেমন মুখের সামনে যা পায় তা-ই খায়, অনুরূপভাবে এ লোকগুলোও হারাম হালালের কোন ধার ধারে না। পেট পূর্ণ হলেই হলো। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু এটাই। তাদের নিবাস হলো জাহান্নাম। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, মু'মিন খায় একটি পাকস্থলীতে এবং কাফির খায় সাতটি পাকস্থলীতে। তাই তাদের কুফরীর প্রতিফল হিসেবে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম।
এরপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ মক্কার কাফিরদেরকে ধমকের সূরে বলছেন যে, তারা তাঁর নবী (সঃ)-কে তাঁর যে জনপদ হতে বিতাড়িত করেছে তা অপেক্ষা অতি শক্তিশালী কত জনপদ ছিল, ওগুলোর অধিবাসীদেরকে আল্লাহ তাআলা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কেননা, এদের মত তারাও তাঁর নবীদেরকে (আঃ) অবিশ্বাস করেছিল এবং তাঁর আদেশ নিষেধের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। সুতরাং এরা যে আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সঃ)-কে অবিশ্বাস করছে এবং তাঁকে বিভিন্ন প্রকারের কষ্ট দিচ্ছে, এদের পরিণাম কি হতে পারে? এই নবী (সঃ) তো সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী! এটা স্বীকার করে নেয়া যেতে পারে যে, এই বিশ্বশান্তির দূত (সঃ)-এর কল্যাণময় অস্তিত্বের কারণে পার্থিব শাস্তি হয় তো এদের উপর আসবে না, কি পারলৌকিক ভীষণ শাস্তি হতে এরা কোনক্রমেই রক্ষা পেতে পারে না।
যখন মক্কাবাসী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি হতে বিতাড়িত করে এবং তিনি গুহায় এসে আত্মগোপন করেন, ঐ সময় তিনি মক্কার দিকে মুখ করে বলেনঃ “হে মক্কা! তুমি সমস্ত শহর হতে আল্লাহ তা'আলার নিকট অত্যধিক প্রিয় এবং অনুরূপভাবে আমার নিকটও তুমি সমস্ত শহর হতে অত্যন্ত প্রিয়। যদি মুশরিকরা আমাকে তোমার মধ্য হতে বের করে না দিতো তবে আমি কখনো তোমার মধ্য হতে বের হতাম না। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সুতরাং যারা সীমালংঘনকারী, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সীমালংঘনকারী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর সীমালংঘন করে, অথবা নিজের হন্তা ছাড়া অন্যকে হত্যা করে কিংবা অজ্ঞতা যুগের গোঁড়ামির উপর থেকে হত্যাকার্য চালিয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উপর وَكَاَيِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ -এই আয়াত অবতীর্ণ করেন।