২৮-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁকে ভয় করে চলার ফযীলত বর্ণনা করছেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও যহহাক (রহঃ) বলেন : আয়াতে উল্লিখিত ফযীলত ঐ সকল আহলে কিতাবদের জন্য যারা তাদের নাবী মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল, তাওরাত ও ইঞ্জিল অনুপাতে আমল করত, অতঃপর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পর তাঁর প্রতি ঈমান আনল ও তাঁর অনুসরণ করল। ইবনু জারীর (রহঃ) এ মত সমর্থন করেছেন।
হাদীসে এসেছে তিন শ্রেণির মানুষকে দ্বিগুণ প্রতিদান প্রদান করা হবে, তার মধ্যে একশ্রেণি হল ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর প্রতি ঈমান এনেছে এবং নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান এনেছে। (সহীহ বুখারী হা. ৮২, সহীহ মুসলিম হা. ২৪১)
তবে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ মত পোষণ করেছেন যে, অত্র আয়াতে উল্লিখিত ফযীলত এ উম্মতের মু’মিন মুত্তাকীদের জন্য। আহলে কিতাবদের মু’মিনদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সূরা কাসাসের ৫২-৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা আছে। সাঈদ বিন যুবাইর (রহঃ) বলেন : যখন আহলে কিতাবগণ এ গর্ব করতে লাগল যে, তাদেরকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে তখন এ উম্মতের জন্য অত্র আয়াত নাযিল করলেন। (ইবনু কাসীর)
আল্লামা শানকিতী (রহঃ) বলেন : যারা অত্র আয়াতকে আহলে কিতাবদের ফযীলত হিসাবে উল্লেখ করে তারা ভুল করে। (আযওয়াউল বায়ান)
সুতরাং উম্মাতে মুহাম্মাদির কোন মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করলে এবং সঠিক ঈমান ও আমল করলে আহলে কিতাবের চেয়ে বেশি নেকী দেবেন। হাদীসে আহলে কিতাবের চেয়ে উম্মতে মুহাম্মাদির অনেক বেশি ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অন্যতম একটি হাদীস হল সহীহ বুখারীর এই হাদীস-
>مَثَلُكُمْ وَمَثَلُ أَهْلِ الْكِتَابَيْنِ كَمَثَلِ رَجُلٍ اسْتَأْجَرَ أُجَرَاءَ فَقَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ غُدْوَةَ إِلَي نِصْفِ النَّهَارِ عَلَي قِيرَاطٍ فَعَمِلَتْ الْيَهُودُ ثُمَّ قَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ نِصْفِ النَّهَارِ إِلَي صَلَاةِ الْعَصْرِ عَلَي قِيرَاطٍ فَعَمِلَتْ النَّصَارَي ثُمَّ قَالَ مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ الْعَصْرِ إِلَي أَنْ تَغِيبَ الشَّمْسُ عَلَي قِيرَاطَيْنِ فَأَنْتُمْ هُمْ فَغَضِبَتْ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَي فَقَالُوا مَا لَنَا أَكْثَرَ عَمَلًا وَأَقَلَّ عَطَاءً قَالَ هَلْ نَقَصْتُكُمْ مِنْ حَقِّكُمْ قَالُوا لَا قَالَ فَذَلِكَ فَضْلِي أُوتِيهِ مَنْ أَشَاءُ-
তোমরা ও উভয় আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান)-এর উদাহরণ হল এমন এক ব্যক্তির মতো, যে কয়েকজন মজদুরকে কাজে নিয়োগ করে বলল, সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত এক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ কে করবে? তখন ইয়াহুদী কাজ করে দিল। তারপর সে ব্যক্তি বলল, কে আছ যে দুপুর হতে আসর পর্যন্ত এক কিরাতের বিনিময়ে কাজ করে দেবে? তখন খ্রিষ্টান কাজ করে দিল। তারপর সে ব্যক্তি বলল, কে আছ যে আসর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুই কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করবে? আর তোমরাই হলে (মুসলমান) তারা (যারা অল্প পরিশ্রমে অধিক পারিশ্রমিক লাভ করলে) তাতে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রাগান্বিত হল। তারা বলল, এটা কেমন কথা, আমরা কাজ করলাম বেশি, অথচ পারিশ্রমিক পেলাম কম? তখন সে ব্যক্তি (নিয়োগকর্তা) বলল, আমি তোমাদের প্রাপ্য কম দিয়েছি? তারা বলল, না। তখন সে বলল, সেটা তো আমার অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা দান করি। (বুখারী ২২৬৮ নম্বর হাদীস)
(وَيَجْعَلْ لَّكُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِه۪)
‘তিনি তোমাদেরকে আলো দেবেন’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে জ্ঞান, হিদায়াত ও সুষ্পষ্ট বর্ণনা দেবেন যার দ্বারা অজ্ঞতার অন্ধকারে চলতে পারবে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূর হল কুরআন। আবার বলা হয় এমন আলো যার দ্বারা আখিরাতে পুলসিরাতে হাঁটবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
(لِّئَلَّا يَعْلَم) এখানের لا (লা) অক্ষরটি অতিরিক্ত, মূল ইবারতটি হল
ليعلم اهل الكتاب انهم لا يقدرون علي ان ينالوا شيءا من فضل الله
কিতাবীগণ যেন জানতে পারে, আল্লাহ তা‘আলার সামান্যতম অনুগ্রহের ওপরও তাদের কোন অধিকার নেই। সকল অনুগ্রহ আল্লাহ তা‘আলার হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। সুতরাং তোমাদের ওপর উম্মাতে মুহাম্মাদীকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এতে হিংসা-বিদ্বেষের কোন কারণ নেই। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের পূর্বে যারা বসবাস করেছে তাদের তুলনায় দুনিয়াতে তোমাদের অবস্থান হল তেমন আছরের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত যতটুকু সময়। তাওরাত ধারীদেরকে তাওরাত প্রদান করা হয়েছে তারা তাওরাত অনুযায়ী অর্ধদিন আমল করেছে, তারপর আমল করতে অপারগ হয়ে গেছে। ফলে তাদের আমলের বিনিময়ে এক কিরাত পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছে। তারপর ইঞ্জিল ধারীদেরকে ইঞ্জিল প্রদান করা হয়েছে, তারা ইঞ্জিল অনুপাতে আছর পর্যন্ত আমল করেছে, তারপর অপারগ হয়ে গেছে। ফলে তাদের পারিশ্রমিক এক কিরাত প্রদান করা হয়েছে। তারপর তোমাদেরকে কুরআন প্রদান করা হয়েছে, তোমরা কুরআন অনুপাতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমল করেছ। ফলে তোমাদেরকে দু কিরাত পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছে। তাওরাতধারীরা বলল : হে আমাদের প্রভু! তারা কম সময় আমল করেছে, কিন্তু প্রতিদান পেয়েছে বেশি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তোমাদের ওপর কি জুলুম করা হয়েছে। তারা বলল : না, আল্লাহ তা‘আলা বললেন : এটা হল আমার অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা আমি তা দিয়ে থাকি। (সহীহ বুখারী হা. ৭৪৬৭)
উম্মাতে মুহাম্মাদীর মু’মিন ব্যক্তিরা কম সময় আমল করবে কিন্তু তাদের প্রতিদান পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের এ নেয়ামতের প্রশংসাসহ বেশি বেশি সৎআমল করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা ও নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর সঠিক ঈমান এনে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জন করত তাঁকে যথাযথ ভয় করে চললে দ্বিগুণ প্রতিদান, সঠিক পথে চলতে পারলে আলোকবির্তকা ও অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
২. সকল নেয়ামত ও অনুগ্রহের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৩. উম্মাতে মুহাম্মাদীর অন্যতম একটি ফযীলত হল তারা সকল উম্মতের চেয়ে বেশি মর্যাদাবান, তারা কম সময় আমল করেও বেশি সময় আমলকারীদের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিদান পাবে।