৫০-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিচ্ছেন, তুমি বলে দাও যে, আমি দাবী করি না যে, আমার কাছে আকাশমণ্ডলী ও জমিনের ধন-ভাণ্ডার রয়েছে। ফলে আমি যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় করব। আমি এও দাবী করিনা যে, আমি অদৃশ্যের খবর জানি এবং আমি একজন ফেরেশতা। বরং আল্লাহ তা‘আলার কাছেই রয়েছে গায়েবের সকল জ্ঞান।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَعِنْدَه۫ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَآ إِلَّا هُوَ)
“ গায়েবের সকল চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না।” (সূরা আনআম ৬:৫৯)
আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মত একজন মানুষ, তিনি নূরের তৈরি ফেরেশতা নন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّمَآ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحٰٓي إِلَيَّ أَنَّمَآ إلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ)
“বল: ‘আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মা‘বূদ এক ও অদ্বিতীয়।”(সূরা কাহ্ফ ১৮:১১০)
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন রাসূল তার কাছে যা ওয়াহী করা হয় তিনি তারই অনুসরণ করেন।
(الْاَعْمٰی وَالْبَصِیْرُ)
‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান’অর্থাৎ কাফির আর মু’মিন কি সমান। (আইসারুত তাফাসীর ১/৬১০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: যে ব্যক্তি সত্যের অনুসারী ও তার দিকে হিদায়াত প্রাপ্ত এবং যে ব্যক্তি সত্য থেকে পথভ্রষ্ট তারা কি সমান? কখনো সমান নয়। (ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৩)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সতর্ক করতে বললেন তাদেরকে যারা তাদের রবের সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে এবং তাদেরকে জানিয়ে দিতে যে, তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই।
(وَلَا تَطْرُدِ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ...)
“যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিবে না।”এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দুর্বল ও গরীব মুসলিমদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নিষেধ করছেন, যারা সকাল-বিকাল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় ব্যস্ত। বরং তাদের সাথে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدٰوةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَه۫ وَلَا تَعْدُ عَيْنٰكَ عَنْهُمْ ج تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا ج وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَه۫ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُه۫ فُرُطًا)
“তুমি নিজকে ধৈর্য সহকারে রাখবে তাদেরই সাথে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা সৌন্দর্য কামনা করে তাদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। তুমি তার আনুগত্য কর না-যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।”(সূরা কাহ্ফ ১৮:২৮) অনুরূপভাবে তাদের প্রতি সালাম, রহমতের সুসংবাদ দিতে বলেছেন।
পূর্ববর্তী নাবীদের প্রতিও এ বিধান ছিল যে, তারা মুসলিমদের যারা তাদের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে তাড়িয়ে দিবে না, অবজ্ঞা করবে না।
যেমন নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَنَا بِطَارِدِ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)
“মু’মিনদেরকে তাড়িয়ে দেয়া আমার কাজ নয়।”(সূরা হূদ ১১:২৯)
একই সূরার ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيٰقَوْمِ مَنْ يَّنْصُرُنِيْ مِنَ اللّٰهِ إِنْ طَرَدْتُّهُمْ ط أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ)
‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি যদি তাদেরকে তাড়িয়ে দেই, তবে আল্লাহর পাকড়াও হতে আমাকে কে রক্ষা করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’
(وَكَذٰلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ)
‘আমি এভাবে তাদের একদলকে অন্যদল দ্বারা পরীক্ষা করেছি’অর্থাৎ রাসূলগণের অধিকাংশ অনুসারী হল গরীব ও দুর্বল শ্রেণির মানুষ। যখন হিরাকল (রোমের বাদশা) আবূ সুফিয়ানকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল সমাজের বিত্তশালী ও মর্যাদাশীল লোকেরা তাঁর অনুসারী, না দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণি? তিনি বলেছেন, দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণি।
হিরাকল বলল: এরাই রাসূলগণের অনুসারী হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৭)
এখানে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত হল: আল্লাহ তা‘আলা কতক মানুষ দ্বারা কতক মানুষকে পরীক্ষা করবেন। যারা বিত্তশালী ও মর্যাদার অধিকারী তারা বলে: যদি ইসলামে কল্যাণ থাকত তাহলে আমাদের আগে এ দুর্বলেরা ইসলাম গ্রহণ করতে পারত না। আমরাই অধিক হকদার কল্যাণ গ্রহণ করার। তাদের এ মিথ্যা দাবীর প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَيْسَ اللّٰهُ بِأَعْلَمَ بِالشّٰكِرِيْنَ)
“আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকেদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন?” (সূরা আন্‘আম ৬:৫৩)
তাদের কথা আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র তুলে ধরে বলেন:
(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَّا سَبَقُوْنَآ إِلَيْهِ)
“কাফিররা ঈমানদারদের সম্পর্কে বলে যে, যদি এটা (কিতাবকে মেনে নেওয়া সত্যিই) কোনো ভাল কাজ হতো তাহলে তারা এ বিষয়ে আমাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারত না।”(সূরা আহকাফ ৪৬:১১)
جهالة অজ্ঞতাবশত যদি কেউ খারাপ কাজ করে অতঃপর তাওবাহ করে। এ সম্পর্কে সূরা নিসার ১৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূরের তৈরি ও ফেরেশতা নন এবং গায়েবও জানতেন না, শুধু আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুকু তথ্য দিতেন ততটুকুই জানতেন।
২. দরিদ্র মু’মিনদের অবজ্ঞা করা নিষেধ সম্পদের কারণে নয় বরং ঈমানের কারণে তাদেরকে মূল্যায়ন করা উচিত।
৪. আল্লাহ তা‘আলা কতক মানুষ দ্বারা কতক মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন।
৫. গরীব লোকেরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাবী-রাসূলগণের অনুসারী হয়।