আল জুমুআহ আয়াত ৪
ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَّشَاۤءُۗ وَاللّٰهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ ( الجمعة: ٤ )
Zaalika fadlul laahi yu'teehi many-yashaaa; wallaahu zul fadil 'azeem (al-Jumuʿah ৬২:৪)
English Sahih:
That is the bounty of Allah, which He gives to whom He wills, and Allah is the possessor of great bounty. (Al-Jumu'ah [62] : 4)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
ওটা আল্লাহর অনুগ্রহ যা তিনি যাকে ইচ্ছে দান করেন; আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী। (আল জুমুআহ [৬২] : ৪)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, [১] যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল।
[১] 'এটা'র ইঙ্গিত নবী (সাঃ)-এর নবুঅতের প্রতি অথবা ইসলাম, অহী, অথবা আরব-অনারব একীভূত করার প্রতি।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তিনি এটা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।
3 Tafsir Bayaan Foundation
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।
4 Muhiuddin Khan
এটা আল্লাহর কৃপা, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ মহাকৃপাশীল।
5 Zohurul Hoque
এইটিই আল্লাহ্র অনুগ্রহ-প্রাচুর্য, -- এটি তিনি দান করেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ্ বিরাট করুণাভান্ডারের অধিকারী।
6 Mufti Taqi Usmani
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা এটা দান করেন। তিনি মহা অনুগ্রহশীল।
7 Mujibur Rahman
এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি এটা দান করেন। আল্লাহতো মহা অনুগ্রহশীল।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ ও গুরুত্ব :
الجمعة জুমু‘আহ অর্থ : একত্রিত করা, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। জুমু‘আহ বলতে জুমু‘আর সালাত উদ্দেশ্য। জুমু‘আর সালাতকে এজন্য জুমু‘আহ বলা হয় এ সালাতের জন্য মুসলিমরা দূর দূরান্ত থেকে সপ্তাহে একদিন সমবেত হয়। এ দিনে সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টি পরিপূর্ণ করা হয়েছে, কারণ যে ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে তার ৬ষ্ঠ দিন ছিল জুমু‘আর দিন। এ দিন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং জান্নাত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এ দিনই কিয়ামত সংঘঠিত হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১০৪৬)
এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যদি কোন মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার কাছে কল্যাণকর কিছু চায় আল্লাহ তা‘আলা তা দান করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৯৩৫)
الجمعة শব্দটি অত্র সুরার ৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতে সূরা জুমু‘আহ ও সূরা মুনাফিকূন পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৮৭৭)
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা বলছেন; আকাশে ও জমিনে এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। অর্থাৎ জীবজন্তু ও জড় পদার্থ যা কিছু আছে সবই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِنْ مِّنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِه۪ وَلٰكِنْ لَّا تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ ط إِنَّه۫ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا)
“এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)
الْقُدُّوْسِ অর্থ হল : সকল অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে পবিত্র, সকল পূর্ণাঙ্গ গুণে গুণান্বিত।
(هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّيْنَ) - اميين
(নিরক্ষর) বলতে যাদের কোন আসমানী কিতাব নেই এবং রিসালাতের চিহ্নও নেই। তারা আরব হোক কিম্বা অনারব হোক। (তাফসীর সা‘দী)।
হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : اميين (নিরক্ষর) বলা হয় আরবদেরকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَقُلْ لِّلَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتٰبَ وَالْأُمِّيِّيْنَ أَأَسْلَمْتُمْ ط فَإِنْ أَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْ)
“আর কিতাবধারী এবং নিরক্ষরদেরকে বল : তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তাহলে তারা হিদায়াত পাবে।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ২০)
এখানে বিশেষ করে اميين (নিরক্ষর) উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত অন্যদের জন্য ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিরক্ষরদের মাঝে প্রেরণ করে তাদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছেন সে জন্য তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعَا)
“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৫৮)
এ সম্পর্কে সূরা আনআমে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতটি ইবরাহীম (আঃ)-এর দু‘আর প্রমাণ। ইবরাহীম (আঃ) মক্কাবাসীর মাঝে রাসূল প্রেরণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করে বলেছিলেন :
(رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ط إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)
“হে আমাদের রব! সে দলে তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১২৯)
(وَّاٰخَرِيْنَ مِنْهُمْ)
অর্থাৎ যারা এখনো নিরক্ষরদের সাথে মিলিত হয়নি সে সকল মানুষের জন্যও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাসূল।
اٰخَرِيْنَ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে মুফাসসিরগণের অভিমত :
(১) ইকরিমা (রহঃ) বলেন : তারা হল তাবেয়ী,
(২) ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন : সাহাবীদের পর কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সবাই শামিল।
(৩) ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন : আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমন সময় সূরা জুমু‘আহ অবতীর্ণ হল। সাহাবীগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! اٰخَرِيْنَ তথা অন্যান্য এরা কারা? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কোন জবাব দিলেন না। এমনকি তিনবার জিজ্ঞাসা করা হল। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলছেন, আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী (রাঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালমান ফারেসীর গায়ে হাত রেখে বললেন :
لَوْ كَانَ الإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هَؤُلاَءِ
ঈমান যদি সুরাইয়া নামক তারকাতেও থাকে তাহলে এ সকল লোক নিয়ে আসবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৯৭)
এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুম ও পারস্যসহ অন্যান্য জাতির নিকট বিভিন্ন চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। মুজাহিদ (রহঃ)-সহ অনেকে বলেছেন : اٰخَرِیْنَ বা অন্যান্যদের দ্বারা উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক অনারবরা যারাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনবে। আল্লামা জাবের আল জাযায়েরী (রহঃ) বলেন : আরব ও অনারব প্রত্যেক সে সকল লোক যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় উপস্থিত হয়নি। (আয়সারুত তাফাসীর)
অতএব বুঝা গেল اٰخَرِيْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল অনারবের সকল মু’মিন মুসলিমরা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
إِنَّ فِي أَصْلَابِ أَصْلَابِ أَصْلَابِ رِجَالٍ مِنْ أَصْحَابِي، رِجَالًا وَنِسَاءً يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ
আমার সাহাবী হতে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মাতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (মাযমাউজ জাওয়ায়েদ ১০/৪০৮ সনদ ভাল)।
(ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ)
অর্থাৎ যে নবুওয়াত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদান করেছেন তা বিশেষ অনুগ্রহ, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করে থাকেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. জুমু‘আর সালাতে এ সূরা পড়া সুন্নাত।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মী ছিলেন। লিখতে-পড়তে জানতেন না।
৪. আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কেউ দেখুক আর না দেখুক যারাই ঈমান আনবে তাদের ফযীলত জানতে পারলাম।
9 Fozlur Rahman
এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকেই তা দান করেন। আল্লাহ বিরাট অনুগ্রহের মালিক।
10 Mokhtasar Bangla
৪. উপরোল্লিখিত বিষয় যা হলো রাসূলকে আরব-অনারব সবার নিকট প্রেরণ করা এটি মূলতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করেন। বস্তুতঃ আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। তাঁর এ মহা অনুগ্রহের মধ্যে রয়েছে এ উম্মতের রাসূলকে গোটা মানব জাতির নিকট প্রেরণ করা।
11 Tafsir Ibn Kathir
সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জুমআর নামাযে সূরায়ে জুমআহ ও সূরায়ে মুনাফিকূন পাঠ করতেন।
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা'আলা খবর দিচ্ছেন যে, সৃষ্ট সব কিছু বাকশক্তি সম্পন্ন হোক বা নির্বাক হোক, সদা-সর্বদা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় মগ্ন রয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
وَ اِنْ مِّنْ شَیْءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمْدِهٖ
অর্থাৎ “এমন কোন জিনিস নেই যে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করে না।” (১৭:৪৪) সমস্ত মাখলুক, আসমানেরই হোক বা যমীনেরই হোক, তাঁর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় মশগুল রয়েছে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর বাদশাহ্ এবং এ দু’টির মধ্যে তিনি পূর্ণভাবে স্বীয় ব্যবস্থাপনা ও হুকুম জারীকারী। তিনি সর্ব প্রকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি দোষ মুক্ত এবং সমস্ত উত্তম গুণাবলী ও বিশেষণের সাথে বিশেষিত। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময়। এর তাফসীর কয়েক জায়গায় গত হয়েছে।
উম্মী দ্বারা আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
وَ قُلْ لِّلَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ وَ الْاُمِّیّٖنَ ءَاَسْلَمْتُمْ فَاِنْ اَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَ اِنْ تَوَلَّوْا فَاِنَّمَا عَلَیْكَ الْبَلٰغُ وَ اللّٰهُ بَصِیْرٌۢ بِالْعِبَادِ
অর্থাৎ “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বলঃ তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছো? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য শুধু প্রচার করা। আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” (৩:২০)
এখানে আরবের উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, অনারব এর অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং কারণ শুধু এটাই যে, তাদের উপর অন্যদের তুলনায় ইহ্সান ও ইকরাম বহুগুণে বেশী রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَ اِنَّهٗ لَذِكْرٌ لَّكَ وَ لِقَوْمِكَ
অথাৎ “নিশ্চয়ই এটা তোমার জন্যে ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্যে উপদেশ।” (৪৩:৪৪) এখানেও কওমকে খাস করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, কুরআন সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে উপদেশ। অনুরূপভাবে আর এক জায়গায় রয়েছেঃ
وَ اَنْذِرْ عَشِیْرَتَكَ الْاَقْرَبِیْنَ
অর্থাৎ “তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দেরকে ভীতি প্রদর্শন কর।" (২৬:২১৪) এখানেও উদ্দেশ্য এটা কখনই নয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ভীতি প্রদর্শন শুধুমাত্র তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জন্যেই খাস, বরং তাঁর সতর্ককরণ তো সাধারণভাবে সবারই জন্যে। মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেনঃ
قُلْ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللّٰهِ اِلَیْكُمْ جَمِیْعَا
অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ!) তুমি বলঃ হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবারই নিকট আল্লাহর রাসূল (রূপে এসেছি)।” (৭:১৫৮) আর এক জায়গায় আছেঃ
لِاُنْذِرَكُمْ بِهٖ وَ مَنْۢ بَلَغَ
অর্থাৎ “এর মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে এবং তাদেরকেও, যাদের কাছে পৌঁছবে।” (৬:১৯) অনুরূপভাবে কুরআন সম্পর্কে। আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِهٖ مِنَ الْاَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهٗ
অর্থাৎ “সমস্ত দলের মধ্যে যে কেউই এটাকে অস্বীকার করবে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।” (১১:১৭) এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে যেগুলো দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সারা বিশ্ববাসীর জন্যে রাসূল। সমস্ত মাখলুকের তিনি নবী, তারা লাল হোক না কালোই হোক। সূরায়ে আনআমের তাফসীরে আমরা এটা পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছি এবং বহু আয়াত ও হাদীসও আনয়ন করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই জন্যে।
এখানে আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, ঐ নিরক্ষর অর্থাৎ আরবদের মধ্যে তিনি স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এটা এই জন্যে যে, যেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দু'আ কবূল হওয়া জানা যায়। তিনি মক্কাবাসীর জন্যে আল্লাহ্ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি যেন তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। আল্লাহ্ তা'আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর এ দু'আ কবূল করেন।
ঐ সময় সমস্ত মাখলুকের জন্যে আল্লাহর নবীর কঠিন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আহলে কিতাবের শুধুমাত্র কতক লোক হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা ইফরাত ও তাফরীত হতে বেঁচে ছিলেন। তাঁরা ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সত্য দ্বীনকে ভুলে বসেছিল এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তিনি ঐ নিরক্ষরদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনালেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করলেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিলেন। অথচ ইতিপূর্বে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে ছিল।
আরবরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের দাবীদার ছিল বটে, কিন্তু অবস্থা এই ছিল যে, তারা ঐ দ্বীনকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বদল করে ফেলেছিল। তারা ঐ দ্বীনের মধ্যে এতো বেশী পরিবর্তন আনয়ন করেছিল যে, তাওহীদ শিরকে এবং বিশ্বাস সন্দেহে পরিবর্তিত হয়েছিল। তারা নিজেরাই বহু কিছু বিদআত আবিষ্কার করে নিয়ে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছিল। অনুরূপভাবে আহলে কিতাবও তাদের কিতাবগুলো বদলিয়ে দিয়েছিল, সাথে সাথে অর্থেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা হয়রত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে আযীমুশ শান শরীয়ত এবং পরিপূর্ণ দ্বীনসহ দুনিয়াবাসীর নিকট প্রেরণ করেন, যেন তিনি এই গোলযোগ মিটিয়ে দিতে পারেন। যেন তিনি আহলে কিতাবের নিকট মহান আল্লাহর আসল আহকাম পৌঁছিয়ে দেন, তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির আহকাম জনগণকে জানিয়ে দেন, এমন আমল তাদেরকে বাতলিয়ে দেন যা তাদেরকে জানাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করাবে, তিনি সমস্ত মাখলুকের জন্যে পথ প্রদর্শক হন, শরীয়তের মূল ও শাখা সবই শিক্ষা দেন, ছোট বড় কোন কথা ও কাজ না ছাড়েন, সবারই সমস্ত শক-সন্দেহ দূর করে দেন এবং জনগণকে এমন দ্বীনের উপর আনয়ন করেন যার মধ্যে সর্বপ্রকারের মঙ্গল বিদ্যমান রয়েছে।
এসব মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মধ্যে এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও বুযুর্গী একত্রিত করেন যা না তার পূর্বে কারো মধ্যে ছিল এবং না তার পরে কারো মধ্যে থাকতে পারে। মহান আল্লাহ সদা-সর্বদা তার উপর দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করতে থাকুন!
وَ اٰخَرِیْنَ مِنْهُمْ لَمَّا یَلْحَقُوْا بِهِمْ وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ-এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পার্শ্বে বসেছিলাম এমন সময় তার উপর সূরায়ে জুমআহ অবতীর্ণ হয়। জনগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! وَاٰخَرِیْنَ مِنْهُمْ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে?” কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। তিনবার এই প্রশ্ন করা হয়। আমাদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসীও (রঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতখানা হযরত সালমান ফারসীর (রাঃ) উপর রেখে বললেনঃ “ঈমান যদি সারিয়্যা নক্ষত্রের নিকট হতো তাহলেও এই লোকগুলোর মধ্যে এক বা কয়েক ব্যক্তি এটা পেয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু আবদিল্লাহ বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এ রিওয়াইয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এটা মাদানী সূরা এবং এটাও প্রমাণিত হচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে নবী, শুধু আরববাসীদের জন্যে নয়। কেননা, তিনি এই আয়াতের তাফসীরে পারস্যবাসীদের সম্পর্কে উপরোক্তে মন্তব্য করেন। এ জন্যেই তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) পারস্য ও রোমের সম্রাটদের নিকট ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও বলেন যে, এর দ্বারা অনারবদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর অহীর সত্যতা স্বীকার করেছে।
হযরত সাহল ইবনে সা'দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ “এখন হতে নিয়ে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ (পিড়ী) পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” অতঃপর তিনি وَّ اٰخَرِیْنَ مِنْهُمْ لَمَّا یَلْحَقُوْا بِهِمْ ـ ـ ـ ـ এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
‘তিনি (আল্লাহ) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।' অর্থাৎ তিনি স্বীয় শরীয়ত ও তকদীর নির্ধারণে প্রবল পরাক্রম ও মহাবিজ্ঞানময়।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা এটা তিনি দান করেন। আল্লাহ তো বড় অনুগ্রহশীল।' অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে এরূপ আযীমুশ শান নবুওয়াত দান করা এবং এই মহান অনুগ্রহে অনুগৃহীত করা আল্লাহ তা'আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করে থাকেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল।