নামকরণ :
الْمُنٰفِقُوْنَ শব্দটি المنافق শব্দের বহুবচন। অর্থ হল : যারা দ্বিমুখীতা অবলম্বন করে, যারা মুখে বলে ঈমানের কথা কিন্তু অন্তরে কুফরী, কপটতা। সূরার প্রথম আয়াতের মুনাফিকুন শব্দ থেকে উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতের প্রথম রাকআতে সূরা জুমু‘আহ পড়তেন আর এর দ্বারা মু’মিনদের উৎসাহিত করতেন। আর দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকুন পড়তেন, আর এর দ্বারা মুনাফিকদের তিরস্কার করতেন। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ ২/১৯১, সনদ হাসান)। সূরায় মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথীদের মুনাফিকী কর্মকাণ্ড ও মুসলিমদের সাথে তাদের আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তারা নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে আর আল্লাহর রাসূল ও মু’মিনদেরকে অসম্মানিত মনে করে থাকে। তাদের এসব ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে। সবশেষে মু’মিনদেরকে সম্পদ ও সন্তান সম্পর্কে সতর্ক করছেন যেন কিছুতেই তারা আল্লাহ তা‘আলা থেকে বিমুখ না হয়।
শানে নুযূল :
জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন : একদা আমি কোন এক যুদ্ধে ছিলাম। অন্য বর্ণনাতে বলা হয়েছে তাবুক যুদ্ধে (সহীহ বুখারী হা. ৩৫১৮) শুনতে পেলাম আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলছে; যদি আমরা মদীনাতে ফিরে যাই তাহলে সম্মানিতরা অসম্মানিতদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেব। সাহাবী জায়েদ বলেন : এ কথাটা আমি আমার চাচা অথবা উমার (রাঃ)-এর কাছে বললাম। তিনি এটা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উল্লেখ করলেন। জায়েদ (রাঃ) বলছেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন, আমি গেলাম এবং এ ঘটনা বললাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীদের নিকট ডেকে লোক পাঠালেন। তারা এসে শপথ করে বলল : আমরা এরূপ কথা বলিনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করলেন আর তাদের কথা বিশ্বাস করে নিলেন। ফলে আমাকে এমন চিন্তা আক্রান্ত করল যা ইতোপূর্বে কখনো করেনি। আমি (মনের দুঃখে) ঘরে বসে গেলাম। আমার চাচা আমাকে বললেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছেন এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে তোমার মন খারাপ? এ প্রসঙ্গে এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। পরে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে লোক প্রেরণ করলেন এবং এ সূরাটি পাঠ করে শুনালেন আর বললেন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য বলে উল্লেখ করেছেন হে জায়েদ। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০০, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭২)
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র সূরাতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যার অধিকাংশগুলো সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর মানুষ প্রতিনিয়ত ইসলামে দিক্ষিত হতে লাগল। এমনকি যখন আওস ও খাজরায গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করল তখন এক শ্রেণির লোক বাহ্যিক ঈমানের কথা প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরী গোপন রাখল যাতে সমাজে তাদের সম্মান, রক্ত ও সম্পদ হেফাযতে থেকে যায়। এরাই হল মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা এদের গুণাবলী উল্লেখ করে দিয়েছেন যাতে মু’মিনরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারে।
(إِذَا جَا۬ءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ)
‘যখন মুনাফিকরা তোমার নিকট আসে’ এখানে মুনাফিক বলতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সহচর মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। এরা নিজেদের কপটতা গোপন রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে এসে বলে, আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আপনি আল্লাহর রাসূল।
(وَاللّٰهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُه۫)
‘আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল’ এ বাক্যটি পূর্বের বাক্য থেকে আলাদা একটি বাক্য, যা পূর্বের বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করেছে এবং যার প্রকাশ মুনাফিকরা মুনাফিক হিসাবে করত। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : মুনাফিকদের এটা শুধু মুখের কথা, অন্তরে এর বিশ্বাস নেই। তবে আমি জানি যে, তুমি সত্যিই আমার রাসূল।
(إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ)
অর্থাৎ মুনাফিকরা কথায় ও দাবীতে মিথ্যেবাদী।
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً)
‘তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের মিথ্যা শপথসমূহকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে। কারণ যারা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানেনা তারা তাদেরকে মুসলিম মনে করবে। ফলে তাদেরকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে না। এভাবে তারা বেঁচে যাবে। তাদের এরূপ কার্যকলাপে মুসলিমদের অনেক ক্ষতি হয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদেরকে নিজেদের মত মুসলিম মনে করে তাদের কথা ও কাজের অনুসরণ করে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنَّهُمْ سَا۬ءَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْن)
“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে। তারা যা করছে তা কতই না মন্দ।”
মুনাফিকদের এসব কার্যকলাপের কারণ হল তারা তাদের কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে কুফরীর ওপর বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।
(ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا)
‘এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে’ এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা কাফির। তারা মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করেছে তারপর অন্তর দ্বারা অস্বীকার করেছে। তাই দুনিয়াতে তাদের ওপর কাফিরদের বিধান কার্যকর না হলেও আখিরাতে কাফিরদের কাতারে থাকবে।
(وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ)
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন : তুমি তাদের দৈহিক কাঠামো, সৌন্দর্য ও সজীবতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। আর তাদের ভাষার যে বিশুদ্ধতা ও তারা যে বাকপটু তাতে তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনবে। কিন্তু তারা হিদায়াত থেকে বিমুখ। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُّسَنَّدَةٌ)
অর্থাৎ দেওয়ালে ঠেকানো কাঠ দেখতে ভাল কিন্তু কোন উপকারে আসে না, এ সকল মুনাফিকরাও প্রাচীরে ঠেকানো কাঠের মত, এরা হিদায়াতের কথা শোনার মত নয়।
(يَحْسَبُوْنَ كُلَّ صَيْحَةٍ)
অর্থাৎ এ সকল মুনাফিকদের অন্তরে সন্দেহ, দুর্বলতা, ভীরুতা ও ভয় থাকার কারণে যে কোন ভীতিকর অবস্থা বা হট্টগোল শুনলেই তারা মনে করে হয়তো কোন বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ج فَإِذَا جَا۬ءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُوْنَ إِلَيْكَ تَدُوْرُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِيْ يُغْشٰي عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ج فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَي الْخَيْرِ ط أُولٰ۬ئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوْا فَأَحْبَطَ اللّٰهُ أَعْمَالَهُمْ ط وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرًا)
“তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর যখন সেই ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরূপ করা আল্লাহ্র জন্য খুবই সহজ।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ১৯)
মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মুনাফিকরা মুসলিমদের জন্য কাফিরদের চেয়ে ভয়ংকর। সুতরাং নিজেরা মুনাফিকী চরিত্র থেকে বেঁচে থাকব এবং মুসলিম সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক করব।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও মুসলিমদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
২. মুনাফিকরা ফেতনা-ফাসাদ ও অরাজকতা সৃষ্টি করে বেড়ায়।
৩. মুনাফিকরা নিজেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বেশি বেশি শপথ করবে।
৪. মুনাফিকরা ঈমানদারদের সামনে খুব চমকপ্রদভাবে নিজেদের কথা উত্থাপন করে থাকে যাতে তারা তাদের অন্তরের খবর বুঝতে না পারে।
৫. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের চরম শত্রু।