৩৮-৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
জাহান্নামীরা কী কারণে জাহান্নামে যাবে, সে কারণগুলো এখানে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
رَهِيْنَةٌ অর্থ বন্ধক রাখা জিনিসকে বলা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার কৃত আমলের কারণে আটক, বন্ধক ও দায়বদ্ধ থাকবে। মানুষ যেমন একজন অন্যজনের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস বন্ধক রেখে টাকা বা খাদ্য ধার করে থাকে এবং ধার করা টাকা বা খাদ্য ফেরত দিলে বন্ধক রাখা মূল্যবান জিনিস ফেরত দেওয়া হয় ঠিক তেমনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রতিটি আত্মা কিয়ামতের দিন বন্ধক থাকবে, প্রতিটি কর্মের হিসাব দিলে তা ফেরত দেওয়া হবে। তবে যারা ডান হাতে আমলনামা পাবে তারা ব্যতীত, কারণ তাদের এমন কোন খারাপ আমল থাকবে না যার কারণে তারা দায়বদ্ধ থাকবে। এ সব জান্নাতীরা পরস্পর অপরাধীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কেন তোমরা জাহান্নামে গেলে? জাহান্নামীরা জবাবে বলবে : (১) আমরা সালাত আদায় করতাম না। (২) মিসকীনদের খাবার দিতাম না। (৩) সত্যকে খণ্ডন করার জন্য বাতিল নিয়ে সবর্দা মত্ত থাকতাম। (৪) এমনকি আখিরাতকেও অস্বীকার করতাম।
এ অবস্থা বহাল থাকতে থাকতে আমাদের মৃত্যু চলে আসল। এ কারণে আজ আমরা জাহান্নামী।
الْيَقِيْنُ শব্দের অর্থ : দৃঢ় বিশ্বাস। তবে এখানে অর্থ হল : মৃত্যু, কারণ মৃত্যুর ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰي يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ)
“তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ‘ইবাদত কর।” (সূরা হিজর ১৫ : ৯৯)
(فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ)
সেদিন কোন সুপারিশকারীর সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না। কারণ তাদের আমলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট নন। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি রয়েছে এবং সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন কেবল তারাই সুপারিশ দ্বারা উপকৃত হবে। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার আয়াতুল কুরসীতে আলোচনা করা হয়েছে।
قَسْوَرَةٍ অর্থ সিংহ, কেউ বলেছেন তীরন্দাজ। অর্থাৎ এদের সত্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা ঐ রকমই যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত জংলী গাধা সিংহ দেখে পালায়, যখন সে তাকে শিকার করতে চায়।
(أَنْ يُّؤْتٰي صُحُفًا مُّنَشَّرَةً)
অর্থাৎ ঐ সকল প্রত্যেক মুশরিক চায় যে, তার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করা হোক যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذَا جَا۬ءَتْهُمْ اٰيَةٌ قَالُوْا لَنْ نُّؤْمِنَ حَتّٰي نُؤْتٰي مِثْلَ مَآ أُوْتِيَ رُسُلُ اللّٰهِ)
“যখন তাদের নিকট কোন নিদর্শন আসে তারা তখন বলে, ‘আল্লাহর রাসূলদেরকে যা দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকেও তা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা কখনও বিশ্বাস করব না।’ (সূরা আনআম ৬ : ১২৪) মূলত তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হিংসা ও বিদ্বেষবশত এ কথা বলত। তাদের কাছে প্রত্যেক নিদর্শন আসলেও তারা আযাব প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না। কারণ তাদের কাছে সত্য বর্ণনাকারী নিদর্শনসমূহ এসেছিল কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং যদি তাদের মাঝে কোন কল্যাণ থাকত তাহলে তারা ঈমান আনত। পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ধমক দিয়ে বলছেন- কক্ষনো নয়, তারা যা কামনা করে তা আমি দেব না। কার কাছে ওয়াহী প্রেরণ করা দরকার, কে তার যোগ্য সে আমিই ভাল জানি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَللہُ اَعْلَمُ حَیْثُ یَجْعَلُ رِسٰلَتَھ۫ﺚ سَیُصِیْبُ الَّذِیْنَ اَجْرَمُوْا صَغَارٌ عِنْدَ اللہِ وَعَذَابٌ شَدِیْدٌۭ بِمَا کَانُوْا یَمْکُرُوْنَ)
“আল্লাহ তাঁর রিসালাতের ভার কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন। যারা অপরাধ করেছে, তাদের চক্রান্তের কারণে আল্লাহর নিকট হতে লাঞ্ছনা ও কঠোর শাস্তি তাদের ওপর পতিত হবেই।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১২৪) প্রকৃতপক্ষে তারা আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। যদি ঈমান রাখত তাহলে তাদের অবস্থা এমন হত না।
আল্লাহ তা‘আলা আবার সতর্ক করে বলছেন : যদিও তারা কুরআনকে এড়িয়ে চলে, মুহাম্মাদের বিরোধিতা করে তবুও সকলের জানা উচিত যে, এ কুরআন হলো সাবধানকারী বাণী। সুতরাং যে চায় সে এখান থেকে উত্তম নির্দেশাবলী গ্রহণ করে নিজের দুনিয়াবী ও আখিরাতের জীবন সাফল্যময় করুক। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে সে কেবল নিজেকেই ধ্বংস করল।
(وَمَا يَذْكُرُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّشَا۬ءَ اللّٰهُ)
অর্থাৎ এ কুরআন থেকে কেবল তারাই হিদায়াত নিতে পারবে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করবেন। অতএব বান্দার সকল কাজই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন এবং বান্দারও ইচ্ছা রয়েছে সে ইচ্ছাও আল্লাহর অধীন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না।
(هُوَ أَهْلُ التَّقْوٰي وَأَهْلُ الْمَغْفِرَةِ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র মা‘বূদ যিনি ভয় ও ইবাদত পাওয়ার অধিকার রাখেন, তিনি ছাড়া এমন কোন মা‘বূদ নেই যিনি ইবাদত পাওযার যোগ্য। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে তিনি তাদের ক্ষমা করেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
২. জাহান্নামীদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ জানতে পারলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা যাকে যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন কেবল সেই তার জন্য সুপারিশ করতে পারবে।
৪. ‘আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন’ এ গুণের প্রমাণ পেলাম।
৫. হিদায়াত পাওয়ার জন্য মনে-প্রাণে ইসলামকে ভালবাসতে হবে, অন্যথায় হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়।