আল-আনফাল আয়াত ৪০
وَاِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمُوْٓا اَنَّ اللّٰهَ مَوْلٰىكُمْ ۗنِعْمَ الْمَوْلٰى وَنِعْمَ النَّصِيْرُ ۔ ( الأنفال: ٤٠ )
Wa in tawallaw fa'lamooo annal laaha mawlaakum; ni'mal mawlaa wa ni'man naseer (al-ʾAnfāl ৮:৪০)
English Sahih:
But if they turn away – then know that Allah is your protector. Excellent is the protector, and excellent is the helper. (Al-Anfal [8] : 40)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রেখ যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক, কতই না উত্তম অভিভাবক! কতই না উত্তম সাহায্যকারী! (আল-আনফাল [৮] : ৪০)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আর যদি তারা মুখ ফেরায়[১] তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক[২] এবং তিনি কত উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী। [৩]
[১] অর্থাৎ, ইসলাম গ্রহণ না করে এবং কুফরীর ও তোমাদের বিরোধিতার উপর অবিচল থাকে।
[২] তোমাদের শত্রুদের উপর তোমাদের সাহায্যকারী এবং তোমাদের রক্ষক ও হিফাযতকারী।
[৩] সুতরাং সফলকাম সেই হবে, যার অভিভাবক আল্লাহ এবং বিজয় সেই লাভ করবে, যার সাহায্যকারী আল্লাহ।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর যদি তারা মুখ ফিরায় তবে জেনে রাখ, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক, তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক এবং কতই না উত্তম সাহায্যকারী!
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর যদি তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, তাহলে জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক। তিনি কতইনা উত্তম অভিভাবক এবং কতইনা উত্তম সাহায্যকারী।
4 Muhiuddin Khan
আর তারা যদি না মানে, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের সমর্থক; এবং কতই না চমৎকার সাহায্যকারী।
5 Zohurul Hoque
কিন্তু যদি তারা ফিরে যায় তবে জেনে রেখো যে আল্লাহ্ নিঃসন্দেহ তোমাদের অভিভাবক, -- কতো উত্তম অভিভাবক ও উত্তম সাহায্যকারী!
6 Mufti Taqi Usmani
তারা যদি মুখ ফিরিয়ে রাখে, তবে জেনে রেখ, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক কত উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।
7 Mujibur Rahman
আর যদি তোমাকে না’ই মানে এবং দীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রেখ যে, আল্লাহই তোমাদের (মুসলিমদের) অভিভাবক। তিনি কতইনা উত্তম অভিভাবক ও সাহায্যকারী!
8 Tafsir Fathul Mazid
৩৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীরঃ
৩৬ নং আয়াতের শানে নুযূল:
বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় বরণ এবং আবূ সুফিয়ান ও তার কাফেলা মক্কায় প্রত্যার্বতন করার পর আবদুল্লাহ বিন আবূ রাবিআহ, ইকরিমা বিন আবূ জাহল, সাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং কুরাইশদের আরো কয়েকজন লোক যাদের পিতা-পুত্র ও ভাই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল তারা আবূ সুফিয়ানকে এবং ঐ লোকেদেরকে বলল যাদের কাফেলাতে সম্পদ ছিল, হে কুরাইশদের দল! মুহাম্মাদ তোমাদেরকে নীচে ফেলে দিয়েছে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকেদের হত্যা করেছে। তার সাথে পুনরায় যুদ্ধ করার জন্য তোমাদের এই কাফেলার সমস্ত মাল দিয়ে দাও, যেন আমরা এর মাধ্যমে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারি। তখন তারা তাই করল। তাদের ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এরূপ ইবনু আব্বাস (রাঃ) উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর তাবারী. ১৩/৫৩২, ইবনে হিশাম সীরাহ নবুবিয়াহ ২ /২৭৪,মুরসাল সহীহ)
(الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ)
‘কুজনকে সুজন হতে’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সৌভাগ্যশীলদেরকে দুর্ভাগ্যবানদের থেকে আলাদা করার জন্য। সুদ্দী (রহঃ) বলেন: মু’মিনদেরকে কাফিরদের হতে আলাদা করার জন্য।
তবে সম্ভবনা রয়েছে এ আলাদা আখিরাতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيْعًا ثُمَّ نَقُوْلُ لِلَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَا۬ٓؤُكُمْ ج فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ)
“এবং সেদিন আমি তাদের সকলকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, ‘তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা স্ব স্ব স্থানে অবস্থান কর’; আমি তাদেরকে পরস্পর হতে পৃথক করে দেব।” (সূরা ইউনূস ১০:২৮)
আবার সম্ভবনা রয়েছে এ আলাদা দুনিয়াতেও হতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا كَانَ اللّٰهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلٰي مَآ أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتّٰي يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ)
“আল্লাহ এরূপ নন যে, তিনি অপবিত্র হতে পবিত্রকে পৃথক না করা পর্যন্ত মু’মিনরা যে অবস্থায় আছে সে অবস্থার উপরেই ছেড়ে দিবেন?” (সূরা আলি-ইমরান ৩:১৭৯)
فَيَرْكُمَهُ অর্থাৎ সবাইকে একত্রিত করবেন। সকল পাপাচারী লোকেদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামে একত্রিত করবেন।
(إِنْ يَّنْتَهُوْا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ)
‘যদি তারা বিরত হয় তবে যা অতীত হয়েছে তা ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ অর্থাৎ এখানে ইসলাম গ্রহণ করার ফযীলত বর্ণনা করা হচ্ছে। কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করলে তার পূর্বের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি ভালভাবে ইসলাম মেনে নেয় জাহিলী যুগের (ইসলাম গ্রহণের পূর্বের) আমালের জন্য তাকে পাকড়াও করা হবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯২১)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ইসলাম তার পূর্বের সকল অপরাধ মোচন করে দেয়। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৩৬)
পক্ষান্তরে যদি কুফরীর ওপর অটল থাকে তাহলে পূর্ববর্তীদেরকে তাদের অপরাধের জন্য যেমন পাকড়াও করা হয়েছিল তাদের মত তাদেরকেও পাকড়াও করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ইসলাম আগমনের পরেও যে ব্যক্তি কুফরীর ওপর বহাল থাকবে তাকে আগে ও পরের সকল গুনাহর জন্য পাকড়াও করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯২১)
(وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّٰي لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ)
‘এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফেতনা (শির্ক) দূরীভূত হয়’ এখানে ফেতনা অর্থ হল- শির্ক অর্থাৎ যতদিন পৃথিবীর বুকে শির্ক থাকবে এবং সকলে আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের পতাকা তলে না আসবে ততদিন পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।
ইমাম বুখারী এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু উমার (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। ইবনু উমার (রাঃ)-এর নিকট জনৈক ব্যক্তি আগমন করল এবং বলল: হে আবূ আবদুর রহমান! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে কী বলেছেন তা শুনেননি?
(وَإِنْ طَا۬ئِفَتٰنِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا ج فَإِنْۭ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَي الْأُخْرٰي فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتّٰي تَفِيْ۬ءَ إِلٰٓي أَمْرِ اللّٰهِ)
“যদি ঈমানদারদের দু’দল একে অপরের সাথে লড়াই করে তাহলে তাদের মধ্যে আপোষ করে দাও। এরপর যদি একদল অপর দলের সাথে বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা লড়াই কর; যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে।” (সূরা হুজুরাত ৪৯:৯)।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যখন এরূপ উল্লেখ করেছেন তাহলে কিসে আপনাকে সংগ্রাম করতে বাধা দিল? তিনি বললেন: হে ভ্রাতুষ্পুত্র! কোন মু’মিনকে ইচ্ছাপূবর্ক হত্যা করা অপেক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার ভর্ৎসনা সহ্য করা আমার পক্ষে অধিক সহজ। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(وَمَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَا۬ؤُه۫ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللّٰهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَه۫ وَأَعَدَّ لَه۫ عَذَابًا عَظِيْمًا)
“আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু’মিনকে হত্যা করলে, তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ এবং অভিসম্পাত এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (সূরা নিসা ৪:৯৩)।
ইবনু উমার (রাঃ) বললেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগে আমাদের অবস্থা এরূপই ছিল। ইসলামে লোকেদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। দীনের ব্যাপারে লোকেরা পরীক্ষার মধ্যে পড়েছিল। হয় তাদেরকে হত্যা করা হত অথবা বন্দী করে রাখা হত এমনকি যখন ইসলামের অনুসারী অনেক হয়ে গেল তখন আর ফেতনা বাকি থাকল না।
মোটকথা, ঐ আপত্তিকারী লোকটির মতের সাথে যখন ইবনু উমার (রাঃ) এর মতের মিল হল না তখন সে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলল: আলী (রাঃ), উসমান (রাঃ) সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? ইবনু উমার (রাঃ) বললেন: আলী ও উসমান (রাঃ) এদের ব্যাপারে আমার আবার কী কথা? উসমান (রাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে কিন্তু তোমরা এ ক্ষমা করে দেয়াকে অপছন্দ কর। আর আলী তো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জামাতা ও চাচাতো ভাই। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫০)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে তাবেয়ী নাফি (রহঃ) বলেন: আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ)-এর ঘটনার সময় দু’জন লোক ইবনু ওমার (রাঃ)-এর কাছে এসে বললেন: কী ব্যাপার, মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর আপনার মত নাবী (সাঃ)-এর সাহাবী বসে আছেন; বের হচ্ছেন না, আপনাকে কিসে বাধা দিচ্ছে? তিনি বললেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য মুসলিম ভাই এর রক্ত হারাম করে দিয়েছেন। এটাই আমাকে বাধা দিচ্ছে। তারা বললেন: কী বলেন! আল্লাহ তা‘আলা কি বলেননি:
(وَقٰتِلُوْھُمْ حَتّٰی لَا تَکُوْنَ فِتْنَةٌ وَّیَکُوْنَ الدِّیْنُ لِلہِ)
“আর ফেত্না-ফাসাদ দূরীভূত হয়ে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর।” তিনি বললেন: আমরা যুদ্ধ করেছি, ফিতনা নির্মূল হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্যই দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর তোমরা চাও যুদ্ধ করবে যেন ফিতনা সৃষ্টি হয় এবং দীন অন্যের জন্য হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫১৩)
সাঈদ বিন যুবাইর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদের কাছে ইবনু উমার (রাঃ) বের হয়ে আসলেন। একজন লোক বলল: ফেতনার সময় যুদ্ধের ব্যাপারে আপনার মতামত কী? ইবনু উমার বললেন: তুমি জান ফেতনা কী? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। তখন তাদের মধ্যে ফেতনা ছিল (অর্থাৎ শির্ক ছিল) আমাদের মত রাজার বিরুদ্ধে রাজত্ব হাসিলের জন্য যুদ্ধ করতেন না। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫১)
(وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ كُلُّه۫ لِلّٰهِ)
‘আল্লাহর দীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন:
يَخْلُصُ التَّوْحِيْدَ لِلّٰهِ
অর্থাৎ সকলেই আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের অনুসারী হয়ে যাবে।
মুহাম্মাদ বিন ইসহাক বলেন: একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ প্রতিষ্ঠা হবে, কোন শির্ক থাকবে না এবং অন্যান্য সকল মা‘বূদ থেকে মুক্ত থাকবে। (ইবনু কাসীর, ৪র্থ খ. পৃঃ ৬১)
فَإِنِ انْتَهَوْا ‘যদি তারা বিরত হয়’ অর্থাৎ তাদের সাথে যুদ্ধ করার পর যদি তারা কুফরী থেকে ফিরে আসে তাহলে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, কারণ এখন তারা তোমাদের দীনি ভাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِيْنَ حَيْثُ وَجَدْتُّمُوْهُمْ وَخُذُوْهُمْ وَاحْصُرُوْهُمْ وَاقْعُدُوْا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ ج فَإِنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتَوُا الزَّكٰوةَ فَخَلُّوْا سَبِيْلَهُمْ ط إِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ)
“অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা কর, তাদেরকে বন্দী কর, অবরোধ কর এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাক । কিন্তু যদি তারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও; নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরা তাওবাহ ৯:৫)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সকল অপরাধ ক্ষমা হয়ে যায়।
২. শির্ক থাকা অবধি শরীয়তসম্মতভাবে জিহাদ চলতে থাকবে।
৩. কাফির-মুশরিকরা ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলিমদের দীনি ভাই বলে গণ্য হবে।
৪. কাফিরদের সম্পদ ব্যয় করার উদ্দেশ্য জানতে পারলাম।
৫. ভাল মন্দ পার্থক্য করার পর জান্নাত অথবা জাহান্নামে দেয়া হবে।
9 Fozlur Rahman
আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় (অন্যায় ছেড়ে দিতে রাজি না হয়) তাহলে জেনে রেখো, আল্লাহ তোমাদের (মুমিনদের) অভিভাবক; (তিনি) কত উত্তম অভিভাবক ও কত উত্তম সাহায্যকারী!
10 Mokhtasar Bangla
৪০. আর যদি তারা তাদেরকে যে শিরক পরিহার করা ও আল্লাহর পথে বাধা না দেয়ার আদেশ অমান্য করে তাহলে হে মু’মিনরা! তোমার এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন। তিনি তাঁর বন্ধুদের জন্য কতোই না উত্তম অভিভাবক। আর তাঁর দীনের সাহায্যকারীদের জন্য কতোই না উত্তম সাহায্যকারী। কারণ, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করবে সে সত্যিই সফলকাম আর যে ব্যক্তি তাঁকে সাহায্য করবে সে সত্যিই সাহায্যপ্রাপ্ত।
11 Tafsir Ibn Kathir
৩৮-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলছেন, তুমি কাফিরদেরকে বলে দাও- তোমরা যদি কুফরী ও বিরুদ্ধাচরণ হতে বিরত থেকে ইসলাম গ্রহণ করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা কর তবে কুফরীর যুগে যেসব গুনাহ তোমরা করেছো সবই আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি ইসলামে ভাল কাজ করলো তাকে অজ্ঞতা যুগের কার্যাবলী সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে আসার পরেও খারাপ কাজ করতে থাকলো তাকে দু' যুগেরই আমল সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।” সহীহ হাদীসে আরো রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ইসলাম পূর্ববর্তী পাপরাশির জন্যে তাওবা স্বরূপ এবং এই তাওবা পূর্বের সমস্ত গুনাহ মিটিয়ে দেয়। কিন্তু হে নবী (সঃ)! তারা যদি তাদের পূর্বের অবস্থার উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং কুফরী ও বিরোধিতা পরিত্যাগ না করে তবে পূর্ববর্তী লোকদের পরিণাম কি হয়েছিল তা কি তারা জানে না? জেনে রেখো যে, শাস্তিই হবে এর চিকিৎসা। سُنَّتُ الْاَوَّلِيْنَ দ্বারা মুজাহিদ (রঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) “বদরের দিন” উদ্দেশ্য নিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে- তোমরা কাফিরদের সাথে খুব বেশী যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না ফিত্না দূর হয় এবং দ্বীন আল্লাহর জন্যেই হয়ে যায়।
হযরত নাফে' (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ হে আবদুর রহমান (রাঃ)! আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় .....।' এরূপ দুটি জামাআতের উল্লেখ যখন কুরআন কারীমে রয়েছে তখন আপনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ। করছেন না কেন? উত্তরে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! কোন মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করা অপেক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার ভৎসনা সহ্য করা আমার পক্ষে অধিক সহজ। যেহেতু আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ وَ مَنْ یَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا ـ ـ ـ অর্থাৎ “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করবে .....।” (৪:৯৩) হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে আমাদের অবস্থা এরূপই ছিল । ইসলামে লোকদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। দ্বীনের ব্যাপারে লোকেরা পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তাদেরকে হত্যা করে দেয়া হতো অথবা বন্দী করা হতো। এভাবে তারা কঠিন বিপদের মধ্যে পতিত হয়েছিল। অতঃপর যখন ইসলামের উন্নতি লাভ হলো তখন ফিত্ন আর বাকী থাকলো না।” মোটকথা, ঐ আপত্তিকারী লোকটির মতের সাথে যখন হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর মতের মিল খেলো না তখন সে কথার মোড় ফিরিয়ে দিয়ে বললোঃ “হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত উসমান (রাঃ) সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?”
উত্তরে তিনি বললেনঃ “হযরত উসমান (রাঃ) সম্পর্কে বলতে গেলে তো এটাই বলতে হয় যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, অথচ তোমরা তাঁকে ক্ষমা করে দেয়াকে অপছন্দ করছে। আর হযরত আলী (রাঃ) তো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চাচাতো ভাই ও জামাতা।" অতঃপর তিনি হাত দ্বারা ইশারা করে বললেনঃ “আর ঐ দেখো, ওখানে রয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কন্যা (হযরত ফাতিমা রাঃ)।”
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃ) বলেন, হযরত ইবনে উমার (রাঃ) আমাদের কাছে আগমন করেন এবং বলেনঃ “ফিত্নার যুদ্ধের ব্যাপারে তোমাদের অভিমত কি? আর ফিত্না কাকে বলে? নবী (সঃ) যেই সময় মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতেন সেই সময় ফিত্না আত্মপ্রকাশ করেছিল। আর তোমাদের যুদ্ধ তো শুধু আধিপত্য ও ক্ষমতা লাভের জন্যেই চলছে।” হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃ)-এর ফিত্নার ব্যাপারে দু’টি লোক তার কাছে আসে এবং বলে- “লোকেরা যেসব আমল করছে তা আপনার অজানা নয়। আপনি হযরত উমারের ছেলে এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবী। সুতরাং এ ব্যাপারে বের হতে আপনাকে কিসে বাধা দিচ্ছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমাকে এটাই বাধা দিচ্ছে যে, আল্লাহ তা'আলা এক মুসলমানের রক্ত তার অপর মুসলমান ভাই-এর উপর হারাম করেছেন।” তখন জনগণ জিজ্ঞেস করেঃ “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিত্রার অবসান হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে হয়ে যায়” -একথা কি আল্লাহ তা'আলা বলেননি? উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমরা তো ফিত্নাকে মিটিয়ে দেয়ার জন্যে বহু যুদ্ধ করেছি, শেষ পর্যন্ত ফিত্না দূর হয়ে গেছে। আর তোমরা মুসলমানদের দু’টি দল এ কারণে যুদ্ধ করতে চাচ্ছ যে, যেন ফিত্না সৃষ্টি হয়ে যায় এবং দ্বীন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে হয়ে যায়।”
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি لَااِلٰهَ اِلَّا اللهُ বলেছে, আমি তো তাকে কখনো হত্যা করবো না।” তখন সা’দ ইবনে মালিকও (রাঃ) ঐ কথাই বলেন। তখন একটি লোক وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّٰى لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ ـ ـ ـ আয়াতটি পাঠ করলেন। তখন তারা দু’জন বললেনঃ “ফিতনা অবসানের জন্যে আমরা যুদ্ধ করেছি এবং ফিত্নার অবসান ঘটেছে, আর দ্বীন একমাত্র আল্লাহর জন্যে হয়ে গেছে।”
وَیَكُوْنَ الدِّیْنُ كُلُّهٗ لِلّٰهِ দ্বারা খাটি বা নির্ভেজাল তাওহীদ বুঝানো হয়েছে, যার মধ্যে শিরকের কোনই মিশ্রণ থাকবে না এবং আল্লাহর ক্ষমতায় কাউকে শরীক বানানো হবে না। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে দ্বীনে ইসলামের বিদ্যমানতায় কুফরী অবশিষ্ট থাকবে না। এর সত্যতা এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা لَااِلٰهَ اِلَّا اللهُ বলে। যদি তারা তা বলে তবে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা এসে যাবে, তবে কোন কারণে কিসাস গ্রহণ হিসেবে তাকে হত্যা করা যেতে পারে এবং তার হিসাব আল্লাহর দায়িত্বে রয়েছে। হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, একটি লোক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, যে লোকটি স্বীয় বীরত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেছে বা গোত্র ও বংশের স্বার্থ রক্ষার্থে জিহাদ করেছে অথবা খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেছে, এগুলোর মধ্যে আল্লাহর পথে জিহাদ কোন্টি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমা সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে সেই শুধু আল্লাহর পথে জিহাদকারী রূপে পরিগণিত।”
فَاِنِ انْتَهَوْا অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তারা ভিতরে কুফরী রেখেই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হতে বিরত থাকে তবে তোমরাও হাত উঠিয়ে নাও। কেননা, তোমরা তাদের অন্তরের কথা অবগত নও। তাদের অন্তরের কথা একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই জানেন। তিনি তাদেরকে সব সময় দেখতে রয়েছেন। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ “যদি তারা তাওবা করে, নামায প্রতিষ্ঠিত করে এবং যাকাত দেয় তবে তোমরা তাদের পথ ছেড়ে দাও (অর্থাৎ তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনই প্রয়োজন নেই)।” আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ “ফিত্নার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর যেন দ্বীন আল্লাহর জন্যে হয়ে যায়, অতঃপর তারা যদি বিরত থাকে তবে (যুদ্ধের আর প্রয়োজন নেই) বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের অনুমতি শুধু অত্যাচারীদের ব্যাপারে রয়েছে।” সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, হযরত উসামা (রাঃ) একটি লোককে তলোয়ার মারতে উদ্যত হলে লোকটি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পাঠ করে। তবুও হযরত উসামা (রাঃ) তাকে তরবারী দ্বারা হত্যা করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এ সংবাদ পৌছলে তিনি হযরত উসামা (রাঃ)-কে বলেনঃ “সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করেছে এর পরও তুমি তাকে হত্যা করেছো কেন? কিয়ামতের দিন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ব্যাপারে তুমি কি করবে?” উত্তরে হযরত উসামা (রাঃ) আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সে শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্যে এ কথা বলেছিল।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি কি তার অন্তর ফেডে দেখেছিলে?” অতঃপর ‘কিয়ামতের দিন তুমি কি করবে’ -এ কথা তিনি তাকে বার বার বলতে থাকেন। হযরত উসামা (রাঃ) তখন বলেনঃ “আমি আকাঙ্খা করতে লাগলাম যে, আমি যদি সে দিনের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ না করে থাকতাম (তবে ইসলামের ধারণায় তাকে হত্যা করতাম না)!”
আল্লাহ পাক বলেন, তারা যদি তোমাকে না-ই মানে ও দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রেখো যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু, তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক ও কতই না উত্তম সাহায্যকারী! অর্থাৎ যদি তাদের স্বভাবের কোন পরিবর্তন না ঘটে এবং তারা তোমাদের বিরোধিতায় লেগেই থাকে তবে জেনে রেখো যে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহই তোমাদের সাহায্যকারী।
আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান উরওয়া (রাঃ)-কে একটি পত্র লিখেন এবং তাতে তিনি তাঁকে কতগুলো কথা জিজ্ঞেস করেন। তখন হযরত উরওয়া (রাঃ) তাকে উত্তরে লিখেনঃ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হাক। প্রথমে আমি এক আল্লাহর প্রশংসা করছি। অতঃপর, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ঘটনাবলী আপনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আমি আপনাকে জানাচ্ছি যে, ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে নবুওয়াত দান করেছিলেন। তিনি কতই না ভাল নবী ও কতই না ভাল নেতা ছিলেন! আল্লাহ তাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন, জান্নাতে তাঁর চেহারা দর্শনের আমাদেরকে তাওফীক দান করুন, আমাদেরকে তারই দ্বীন ও মিল্লাতের উপর জীবিত রাখুন, তারই দ্বীনের উপর মৃত্যু দান করুন এবং তারই সাথে আমাদের পুনরুত্থান ঘটিয়ে দিন। তিনি যখন জনগণকে হিদায়াত ও ইসলামের আলোকের দিকে আহ্বান করেন তখন তারা তার সেই তাবলীগের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়নি। তারা তার উপর অবতারিত অহীও শুনতো। যখন তিনি তাদের মূর্তিগুলোর সমালোচনা শুরু করলেন তখন তায়েফ থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনকারী ধনী কুরায়েশদের অধিকাংশ লোক তাঁর তাবলীগের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলো এবং তার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলো। যে কেউই মুসলমান হতো তাকেই তারা বিভ্রান্ত করতে থাকতো। সুতরাং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট সাধারণ লোকদেরও আর আকর্ষণ থাকলো না। তথাপি কতক লোক তাদের মতের উপর দৃঢ় থাকলো এবং তাদের ধারণা ও চিন্তাধারা ইসলামের দিক থেকে বিক্ষিপ্ত হলো না। তখন কুরায়েশ নেতৃবর্গ পরস্পর পরামর্শ করলো যে, ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর কঠোরতা অবলম্বন করা হাক। এই ফিত্রা ছিল একটা ভীষণ ভূ-কম্পন। যারা এই ফিত্যায় জড়িয়ে পড়ার ছিল তারা তাতে জড়িয়ে পড়লো এবং যাদেরকে আল্লাহ তা থেকে নিরাপদে রাখলেন তারা নিরাপদে থাকলো । মুসলমানদের উপর কুরায়েশদের অত্যাচার যখন চরমে উঠলো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার পরামর্শ দিলেন। আবিসিনিয়ার বাদশাহ্ ছিলেন একজন সৎ লোক যার নাম ছিল নাজ্জাশী। তিনি অত্যাচারী বাদশাহ ছিলেন না। চতুর্দিকেই তাঁর প্রশংসা করা হচ্ছিল। আবিসিনিয়া ছিল কুরায়েশদের ব্যবসা কেন্দ্র এবং ব্যবসায়ী কুরায়েশদের সেখানে ঘড়বাড়ীও ছিল। সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করে তারা প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেছিল এবং তাদের ব্যবসা ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে কুরায়েশদের অত্যাচারে জর্জরিত সাধারণ মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন। কেননা, মক্কায় তাদের প্রাণের ভয় ছিল। আবিসিনিয়ায় তাঁরা চিরকাল অবস্থান করেননি, বরং শুধু কয়েক বছর তারা সেখানে বসবাস করেছিলেন। সেখানেও মুসলমানরা ইসলাম ছড়িয়ে দেন। সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকেরাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। কুরায়েশরা যখন দেখলো যে, মুসলমানদের উপর অত্যাচার করার ফলে তারা আবিসিনিয়ায় চলে যাচ্ছে এবং তথাকার নেতৃবর্গকে নিজেদের লোক বানিয়ে নিচ্ছে তখন তারা মুসলমানদের উপর নরম ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত মনে করলো। সুতরাং তারা নবী (সঃ) ও সাহাবীদের সাথে নরম ব্যবহার করতে শুরু করলো। কাজেই মুসলমানদের প্রথম পরীক্ষা ছিল এটাই যা তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিল।
যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলো এবং যে ফিৎনার ভূ-কম্পন মুসলমান সাহাবীদেরকে মাতৃভূমি ছেড়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিল, সেই ফিত্রা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার সংবাদ আবিসিনিয়ার মুহাজির মুসলমানদেরকে পুনরায় মক্কায় ফিরে আসতে উত্তেজিত করলো। সুতরাং কম বেশী তারা যতজন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন সবাই মক্কায় ফিরে আসলেন।
এদিকে মদীনার আনসারগণ মুসলমান হতে থাকেন এবং মদীনাতেও ইসলামের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। মদীনার লোকদের মক্কায় যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এতে মক্কাবাসী আরো চটে যায় এবং পুনরায় মুসলমানদের উপর কঠোরতা অবলম্বনের পরামর্শ গ্রহণ করে। সুতরাং মুসলমানদের উপর সাধারণভাবে অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। মুসলমানরা ভীষণ অত্যাচারের শিকারে পরিণত হন। এটা ছিল মুসলমানদের দ্বিতীয় ফিত্ন ও পরীক্ষা। প্রথম ফিত্না তো ওটাই যে, মুসলমানদেরকে আবিসিনিয়ায় পালাতে হয়। আর দ্বিতীয় ফিত্না হচ্ছে- সেখান থেকে মুসলমানদের ফিরে আসার পর যখন মক্কাবাসী দেখলো যে, মদীনার লোক মক্কার সাথে যোগাযোগ করছে এবং মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। একবার মদীনা থেকে সত্তরজন লোক মক্কা আসলেন, যারা ছিলেন গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় লোক। তারা সবাই মুসলমান হয়ে যান। তাঁরা হজ্ব পৰ্ব পালন করেন, ‘আকাবা’ নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং অঙ্গীকার করে বলেনঃ “আমরা আপনার হয়ে থাকবো এবং আপনি আমাদের হয়ে থাকবেন। যদি আপনার সাহাবীরা আমাদের শহরে গমন করেন বা আপনি আমাদের ওখানে তাশরীফ আনয়ন করেন তবে আমরা আপনার ও আপনার সাহাবীবর্গের এমনভাবে পণ্ঠপোষকতা করবো যেমনভাবে নিজেদের লোকদের করে থাকি।” কুরায়েশরা এই অঙ্গীকারের কথা শুনতে পেয়ে মুসলমানদের উপর আরো বেশী কঠোরতা শুরু করে দিলো। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল দ্বিতীয় ফিত্না, যা নবী (সঃ)-কে এবং তাঁর সহচরদেরকে মক্কা থেকে বের করে দিলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “তোমরা সদা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিত্নার অবসান হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে হয়ে যায়।” হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এই চিঠিটি তিনি আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানকে লিখেছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন।