৬০-৬৪ নং আয়াতের তাফসীরঃ
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জনের নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে শত্রুরা তা দেখে ভয় করে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন:
أَلَا إِنَّ الْقُوَّةَ الرَّمْي ، أَلَا إِنَّ الْقُوَّةَ الرَّمْي ، أَلَا إِنَّ الْقُوَّةَ الرَّمْي
অর্র্থাৎ জেনে রেখ! শক্তি হল নিক্ষেপণ, জেনে রেখ! শক্তি হল নিক্ষেপণ। (আবূ দাউদ হা: ২৫১৬, তিরমিযী হা: ৩০৮৩, সহীহ)
এখানে লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কথা বলেননি যে, শক্তি হল তীর নিক্ষেপ করা। কেননা তা বললে, তীর নিক্ষেপণে সীমাবদ্ধ হয়ে যেত। বরং বলেছেন: শক্তি হল নিক্ষেপণ। তার মানে হল সকল যুগের সকল ক্ষেপণাস্ত্র এতে শামিল। তৎকালীন আরবে তীর নিক্ষেপ করার বিদ্যা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারা দূর থেকে সহজেই শত্রু নিপাত করা যেত। বর্তমানে হল, ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট মিসাইল, ট্যাংক, কামান, বোমারু বিমান ইত্যাদি। শারীরিক প্রশিক্ষণ ও সমর বিদ্যা শিক্ষা করাও এতে শামিল। আল্লাহ তা‘আলা এ শক্তি অর্জনের সাথে মু’মিনদেরকে সাহস দিয়ে বলেন: তোমাদের সফলতা লাভের জন্য এটা অপরিহার্য নয় যে, তোমাদের প্রতিপক্ষের নিকট যে ধরণের এবং যে পরিমাণ উপকরণ রয়েছে তোমাদেরকেও ততটাই অর্জন করতে হবে বরং সামর্থ্য অনুযায়ী যা কিছু উপকরণ জোগাড় করতে পার তা-ই কর। আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য তোমাদের সাথে থাকবে। সুতরাং শত্রুদের অধিক পরিমাণ সৈন্য ও অস্ত্র দেখে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী সরঞ্জামাদী নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করে জিহাদে অংশ গ্রহণ করলে আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করবেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
(وَّمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ)
‘অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত কর’ অর্থাৎ সুসজ্জিত ঘোড়াও প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তৎকালীন আরবে যুদ্ধের প্রধান উপকরণ হিসেবে ঘোড়া ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বতর্মানেও তা অনস্বীকার্য। তাই সব দেশের সেনাদের সাথে কমবেশি ঘোড়া দেখা যায়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: কিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালের চুলে কল্যাণ বাঁধা থাকবে। সে কল্যাণ হল সাওয়াব ও গনীমত। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫২)
আবূ হুরারইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: নাবী (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান ও তাঁর প্রতিশ্র“তির প্রতি বিশ্বাস রেখে আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখে, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির দাঁড়িপাল্লায় ঘোড়ার খাদ্য, পানীয়, গোবর ও পেশাব ওজন করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৩, সহীহ মুসলিম হা: ৯৮৭)
(وَاٰخَرِيْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ)
‘এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, অর্থাৎ যাদের সাথে এখনো তোমাদের শত্রুতা প্রকাশ পায়নি। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জানেন এবং তারা যা গোপন করে তাও জানেন।
আবদুর রহমান বিন যায়েদ বলেন: তারা হল মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِمَّنْ حَوْلَکُمْ مِّنَ الْاَعْرَابِ مُنٰفِقُوْنَﹾ وَمِنْ اَھْلِ الْمَدِیْنَةِﹻ مَرَدُوْا عَلَی النِّفَاقِﺤ لَا تَعْلَمُھُمْﺚ نَحْنُ نَعْلَمُھُمْ)
“মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ তারা কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে জান না; আমি তাদেরকে জানি।” (তাওবাহ ৯:১০১)
(وَإِنْ جَنَحُوْا لِلسَّلْمِ)
‘তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে...’ অর্থাৎ শত্রুরা যদি যুদ্ধ না করে সন্ধি করতে সম্মত হয় তাহলে তাদের সাথে সন্ধি করে নাও। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা কর।
কোন অমুসলিম এলাকায় হামলা করার পূর্বশর্ত হল:
১. প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। যদি ইসলাম কবূল করে নেয় তাহলে ভাল।
২. ইসলাম কবূল না করলে জিযিয়া দিয়ে থাকবে আর ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হবে।
৩. যদি জিযিয়া দিতে না চায় তাহলে বিসমিল্লাহ বলে যুদ্ধ করতে হবে। (সহীহ মুসলিম হা:৪৬১৯)
তবে সন্ধির নামে যদি ধোঁকা ও প্রতারণার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা সহযোগিতা করবেন।
অতঃপর রাসূলকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি মু’মিনদের মাঝে সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করেছেন, যা তুমি সারা জাহানের বিনিময়েও করতে সক্ষম হতে না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَا۬ءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِه۪ إِخْوَانًا)
“আর তোমাদের ওপর আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে স্মরণ কর। যখন তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের অন্তরের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে।” (সূরা আলি-ইমরান ৩:১০৯)
সাহাবীদের মাঝে এমন আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল যার কারণে একজন সাহাবী অপর মুসলিম ভাইয়ের বিবাহর জন্য নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে তালাক দিতে এবং নিজের জমিতে অংশীদার বানাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। মূলতঃ এটা ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব।
(یٰٓاَیُّھَا النَّبِیُّ حَسْبُکَ اللہُ....)
‘হে নাবী! তোমার জন্য ও তোমার অনুসারী মু’মিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ অর্থাৎ হে নাবী! তোমার জন্য এবং যে সকল মু’মিনরা তোমার আনুগত্য করে তাদের সকলের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। অনেকে ভুল করে এ আয়াতের অনুবাদ করে যে, হে নাবী! তোমার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যথেষ্ট এবং যে সকল মু’মিনরা তোমার অনুসরণ করে তারাও তোমার জন্য যথেষ্ট। এটা ভুল; বরং সঠিক অর্থ হল “তোমার জন্য এবং যে সকল মু’মিনরা তোমার আনুগত্য করে তাদের সকলের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট”।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. শত্রুদের বিরুদ্ধে যথাযথ অস্ত্র, সরঞ্জামাদি ও শারীরিক যোগ্যতা প্রস্তুত রাখা মু’মিনদের জন্য ওয়াজিব।
২. কোন কাফির জাতি যুদ্ধ না করে সন্ধি করতে চাইলে তা কবূল করে নেয়া উচিত।
৩. প্রকৃত মুসলিম কখনো শত্রু থেকে মুক্ত নয়।
৪. ঈমানের মাধ্যমে মু’মিনদের মাঝে নজিরবিহীন ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় যা রক্তের ভ্রাতৃত্ববোধকে হার মানায়।
৫. সকলের সার্বিক বিষয়ের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট।