আল ইনশিক্বাক্ব আয়াত ১৫
بَلٰىۛ اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِهٖ بَصِيْرًاۗ ( الإنشقاق: ١٥ )
Balaaa inna Rabbahoo kaana bihee baseeraa (al-ʾInšiq̈āq̈ ৮৪:১৫)
English Sahih:
But yes! Indeed, his Lord was ever, of him, Seeing. (Al-Inshiqaq [84] : 15)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
অবশ্যই ফিরে যাবে, তার প্রতিপালক তার প্রতি দৃষ্টি রাখছেন। (আল ইনশিক্বাক্ব [৮৪] : ১৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
অবশ্যই (সে প্রত্যাবর্তিত হবে)।[১] নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার উপর সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন। [২]
[১] একটা অর্থ এটাও হতে পারে যে, এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, সে ফিরে আসবে না এবং পুনর্বার জীবিত হবে না? অথবা 'অবশ্যই', 'কেন নয়', সে অবশ্যই আল্লাহর নিকট ফিরে আসবে।
[২] অর্থাৎ, তার আমল আল্লাহর নিকট কোন রকমের গুপ্ত ছিল না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
হ্যাঁ, [১] নিশ্চয় তার রব তার উপর সম্যক দৃষ্টি দানকারী।
[১] অর্থাৎ সে যা মনে করেছে তা ঠিক নয়। সে অবশ্যই তার রবের কাছে ফিরে যাবে। অবশ্যই সে পুনরুথিত হবে। [ফাতহুল কাদীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
হ্যাঁ, নিশ্চয় তার রব তার প্রতি সম্যক দৃষ্টি দানকারী।
4 Muhiuddin Khan
কেন যাবে না, তার পালনকর্তা তো তাকে দেখতেন।
5 Zohurul Hoque
না, নিঃসন্দেহ তার প্রভু বরাবর তার প্রতি দৃষ্টিদাতা।
6 Mufti Taqi Usmani
কেন নয়? নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার উপর দৃষ্টি রাখছিলেন।
7 Mujibur Rahman
হ্যাঁ,(অবশ্যই প্রত্যাবর্তিত হবে) নিশ্চয়ই তার রাব্ব তার উপর সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ ও গুরুত্ব:
انشقاق শব্দের অর্থ ফেটে যাওয়া, বিদীর্ণ হওয়া। সূরার প্রথম আয়াতে বর্ণিত انشقاق শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যদি কেউ স্বচক্ষে কিয়ামতের দৃশ্য দেখে নিজেকে খুশি করতে চায় সে যেন সূরা তাকভীর, ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পাঠ করে। (তিরমিযী হা. ৩৩৩৩, সহীহাহ হা. ১০৮১)
আবূ রাফে (রাঃ) বলেন : আমি আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)-এর সাথে ইশার সালাত আদায় করেছি। তিনি
(إِذَا السَّمَا۬ءُ انْشَقَّتْ)
পড়লেন এবং সিজদা দিলেন। আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন : আমি আবুল কাশেম (সাঃ)-এর পেছনে (এ সূরা পাঠ শেষে) সিজদা করেছি। অতএব আমি তাঁর সাথে সাক্ষাত করা পর্যন্ত সিজদা করেই যাব। (সহীহ বুখারী হা. ৭৬৬)
অন্য বর্ণনাতে তিনি বলেন : আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে
(إِذَا السَّمَا۬ءُ انْشَقَّتْ) ও (اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ)
এ দুটি সূরা পাঠান্তে সিজদা করেছি। (সহীহ মুসলিম, সিজদাতুত তিলাওয়াহ অধ্যায়)
কিয়ামতের দিন অবশ্যই মানুষকে কৃতকর্মের ফলাফল প্রদান করা হবে, সুখ আর দুঃখ এ দুটি মিলে মানুষের জীবন এবং কাফির ও মু’মিনদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে সূরায় আলোচনা করা হয়েছে।
১-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিন আকাশ ও জমিনের যে অবর্ণনীয় অবস্থা হবে এবং ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত মু’মিনরা যে আনন্দ পাবে আর পেছন দিক থেকে বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্ত কাফিররা যে দুঃখ কষ্টে থাকবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
انْشَقَّتْ অর্থাৎ আকাশ কিয়ামতের দিন চূর্ণ-বিচূর্ণ ও বিদীর্ণ হয়ে যাবে। এর দ্বারা আকাশ যে মজবুত তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا)
“আর নির্মাণ করেছি তোমাদের ওপর সাতটি মজবুত আসমান।” (সূরা নাবা ৭৮ : ১২)
(وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাকে ফেটে যাওয়ার যে আদেশ করবেন তা শুনবে এবং মেনে নেবে। এ আয়াত বলছে আকাশ-জমিন সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার হুকুম মেনে চলে। এও প্রমাণ করছে যে, আকাশ আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়নি বরং এসবের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন, তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা।
وَحُقَّتْ অর্থাৎ তার দায়িত্ব হলো রবের ডাকে সাড়া দেয়া, তাই সে তার দায়িত্ব পালন করত ফেটে যাবে।
مُدَّتْ অর্থ : بسطت বা সম্প্রসারিত হয়ে যাবে। অথবা উদ্দেশ্য হলো জমিনের ওপরে পাহাড়সহ যা আছে সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে সমান হয়ে যাবে। কোন উঁচু-নীচু থাকবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمٰوٰتُ وَبَرَزُوْا لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ )
“যেদিন এ পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশসমূহও; এবং মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সম্মুখেÑযিনি এক, পরাক্রমশালী।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪৮)
(وَأَلْقَتْ مَا فِيْهَا)
অর্থাৎ জমিনের ভেতরে যে মুর্দা দাফনকৃত থাকবে সমস্ত মুর্দাকেই সে বের করে দেবে। আর যে সব গুপ্ত ধন তাতে মজুদ রয়েছে তা বের করে দিয়ে একেবারে খালি করে দেবে। একথাই আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا)
“এবং যখন পৃথিবী তার বোঝা বের করে দেবে”। (সূরা যিলযাল ৯৯: ২)
كَدْحًا অর্থ : কঠোর সাধনা বা পরিশ্রম, সে পরিশ্রম ভালও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে। অর্থাৎ যখন উল্লিখিত বস্তুসমূহ প্রকাশ পাবে তখন মানুষ তার কৃত ভাল-মন্দ সকল আমল দেখতে পাবে। জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : জিবরীল (আঃ) বললেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি যত দিন ইচ্ছা বেঁচে থাক, তবে তোমাকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে। তুমি যত ইচ্ছা ভালবাসা গড়ে তোলো তবে তোমাকে অবশ্যই সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে। তুমি যা ইচ্ছা আমল কর, তবে একদিন তোমাকে সে আমলের হিসাব দিতেই হবে। (আবূ দাঊদ আত তায়ালিসি পৃ. ২৪২) সুতরাং যদি সকল ভালবাসা ও মায়া ছিন্ন করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতেই হয় আর আমলের হিসাব দিতেই হয় তাহলে আমাদের উচিত হবে ভাল আমল করা।
অর্থাৎ যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে এরা হল ডানপন্থী। এদের কথা সূরা ওয়াকিয়ার ২৭ নম্বরসহ কয়েক আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। এরা দুনিয়াতেও ছিল ডানপন্থী, তাদের সকল প্রকার কার্যকলাপ, আচার-আচরণ ও অবস্থা ডানপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
(حِسَابًا يَّسِيْرًا)
বা সহজ হিসাব হলো মু’মিনের আমলনামা শুধু তার সামনে পেশ করা হবে। তার ভুল-ভ্রুটিও সামনে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের রহমত ও অনুগ্রহে তাদের মার্জনা করে দেবেন। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যার হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বললাম : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলা কি এ কথা বলেননি (فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَّسِيْرًا) ‘তার হিসাব-নিকাশ অতি সহজ ভাবে নেয়া হবে।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : এটা হিসাব না। এটা কেবলমাত্র পেশ করা হবে। যার কিয়ামত দিবসে হিসাব নেয়া হবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৩৯)
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কোন এক সালাতে বলতে শুনেছি
اللّٰهُمَّ حَاسِبْنِي حِسَابًا يَسِيرًا
হে আল্লাহ তা‘আলা আমার হিসাব সহজ করে নিয়ো। সালাত শেষে আমি বললাম : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) সহজ হিসাব কী? তিনি বললেন :
(أَنْ يَنْظُرَ فِي كِتَابِهِ فَيَتَجَاوَزَ عَنْهُ)
শুধু আমলনামার প্রতি দৃষ্টি দেয়া হবে। অতঃপর তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। কিন্তু হে আয়িশাহ! সেদিন যার হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। (আহমাদ ৬/৪৮, সহীহ মুসলিমের শর্তানুপাতে।)
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাকে কাছে ডেকে নেবেন, এমনকি তাকে ডানে রাখবেন ও ঢেকে নেবেন। অতঃপর বলবেন : তুমি যে অমুক গুনাহ করেছো তা জান, তুমি যে অমুক গুনাহ করেছো তা জান? বান্দা বলবে : হ্যাঁ, হে আমার রব জানি। এভাবে স্বীকার করতে করতে যখন দেখবে তার জন্য ধ্বংস অবধারিত তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন :
سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِي الدُّنْيَا، وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ اليَوْمَ، فَيُعْطَي كِتَابَ حَسَنَاتِهِ
দুনিয়াতে এগুলো আমি তোমার ওপর গোপন রেখেছিলাম। আজ আমি তোমার এগুলো ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকুল সাক্ষ্য দিয়ে বলবে ‘এরাই এদের প্রতিপালকের বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করেছিল।’ সাবধান! আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত জালিমদের ওপর, (সহীহ বুখারী হা ২৪৪১)
(وَّيَنْقَلِبُ إِلٰٓي أَهْلِه۪)
অর্থাৎ জান্নাতী ব্যক্তির জন্য জান্নাতে তার যে সকল পরিবার-পরিজন আছে তাদের কাছে আনন্দচিত্তে ফিরে যাবে। পরিবার বলতে, জান্নাতী হুর, গিলমান যা জান্নাতীগণ লাভ করবে। ইবনু যায়েদ বলেন: আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারদেরকে দুনিয়ার ভীতি ও কষ্টের বিনিময়ে আখিরাতে জান্নাত দেবেন আর কাফিরদেরকে দুনিয়ার আনন্দ-ফুর্তির বিনিময়ে আখিরাতে জাহান্নাম দেবেন। একথা বলে তিনি সূরা তুরের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতদ্বয় পাঠ করতেন। (তাফসীর কুরতুবী)
আর যারা কাফির তাদেরকে আমলনামা তাদের
(وَرَا۬ءَ ظَهْرِه۪)
অর্থাৎ বাম হাতে পেছন দিক থেকে দেয়া হবে। এরা ছিল দুনিয়াতে বামপন্থী, তাদের সকল কার্যকলাপ ছিল বাম। তারা আখিরাতে শত চেষ্টা করেও ডানহাতে আমলনামা নিতে পারবে না।
ثُبُوْرًا অর্থ : ধ্বংস, ক্ষতি। অর্থাৎ বামপন্থী চিৎকার করে বলবে, আমি মরে গেলাম, আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذَآ أُلْقُوْا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُّقَرَّنِيْنَ دَعَوْا هُنَالِكَ ثُبُوْرًا لَا تَدْعُوا الْيَوْمَ ثُبُوْرًا وَّاحِدًا وَّادْعُوْا ثُبُوْرًا كَثِيْرًا)
“এবং যখন তাদেরকে শৃংখলিত অবস্থায় কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা তথায় ধ্বংস কামনা করবে। (তাদেরকে বলা হবে) ‘আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কর না; বহুবার ধ্বংস হবার কামনা করতে থাক।’ (সূরা ফুরকান ২৫: ১৩-১৪)
অর্থাৎ বাম হাতে আমলনামা পাওয়া বামপন্থীদের পরিণতি হল একটাই, তা হল জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(خُذُوْهُ فَغُلُّوْهُ ثُمَّ الْجَحِيْمَ صَلُّوْهُ ثُمَّ فِيْ سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُوْنَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوْهُ)
“(ফেরেশতাকে বলা হবে) তাকে ধর। অতঃপর তার গলায় বেড়ী পরিয়ে দাও। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। পুনরায় তাকে বেঁধে ফেলো এমন শেকল দ্বারা যা সত্তর হাত লম্বা।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯: ৩০-৩২)
(إِنَّه كَانَ فِيْٓ أَهْلِه۪ مَسْرُوْرًا)
অর্থাৎ দুনিয়ায় নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে মগ্ন এবং আপন পরিবারের মাঝে বড় আনন্দিত ছিল। আখিরাতের কোন তোয়াক্কা করত না, দীন-ধর্মের কোন পরওয়া করত না। দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও-দাও ফুর্তি কর এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।
(إِنَّه ظَنَّ أَنْ لَّنْ يَّحُوْرَ)
অর্থাৎ সে বিশ্বাস করত, কখনও সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যাবে না এবং পুনরুত্থিত হবে না। এটাই ছিল দুনিয়াতে অন্যায়ে মত্ত ও আনন্দিত হওয়ার কারণ। নাবী (সাঃ) দু‘আ করে বলতেন :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْحَوْرِ بَعْدَ الْكَوْر
হে আল্লাহ তা‘আলা! আমি ঈমান ও আনুগত্যের পর যেন কুফরী ও অবাধ্যতায় ফিরে না যাই এ ব্যাপারে আশ্রয় চাচ্ছি। (সহীহ মুসলিম হা. ১৩৪৩)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সকল কাজ কর্ম প্রত্যক্ষ করেন। সুতরাং তাঁর অগোচরে কোন কাজ করার সুযোগ নেই। সুতরাং সর্বদাই আমাদের সতর্ক থাকা উচিত আমাদের দ্বারা যেন কোন অন্যায় কাজ না হয়। কারণ সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার কাছে দৃশ্যমান।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আকাশ, জমিন ও নক্ষত্র সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
২. মানুষ অবশ্যই তার কৃত আমলের প্রতিদান পাবে।
৩. যারা ডান হাতে আমলনামা পাবে তাদের হিসাব হবে হালকা ও তারা জান্নাতে সপরিবারে আনন্দে থাকবে।
৪. সহজ হিসাবের অর্থ জানলাম।
৫. যারা পেছন দিক থেকে বাম হাতে আমলনামা পাবে তাদের দুর্দশার শেষ হবে না। তাদের একমাত্র ঠিকানা জাহান্নাম।
9 Fozlur Rahman
অবশ্যই; (তাকে ফিরে আসতেই হত;) নিশ্চয়ই তার প্রভু তার ওপর দৃষ্টি রাখতেন।
10 Mokhtasar Bangla
১৫. অবশ্যই, আল্লাহ তাকে প্রথমবারের মতো আবারো দুনিয়ার জীবনে ফিরত আনবেন। নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার ব্যাপারে সম্যক অবগত। তাঁর নিকট এর কোন কিছুই গোপন নয় এবং তিনি অচিরেই তাকে এ কাজের বদলা দিবেন।
11 Tafsir Ibn Kathir
ইমাম মালিক (রঃ)-এর মুআত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি জনগণকে নামায পড়ান এবং ঐ নামাযে তিনি اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ এ সূরাটি পাঠ করেন। অতঃপর তিনি (সিজদার আয়াতে নামাযের মধ্যেই) সিজদা করেন। নামায শেষে তিনি জনগণকে সংবাদ দেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এভাবে নামাযের মধ্যে সিজদা করেছেন। (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈতেও বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু রাফে (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবু হুরাইরার (রাঃ) সাথে এশার নামায পড়েছি। তিনি নামাযে اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ সূরাটি পাঠ করেন এবং (সিজদার আয়াতে) সিজদা করেন। আমি তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ আমি আবুল কাসেমের (সঃ) পিছনে (নামায পড়েছি এবং তার সিজদার সাথে) সিজদা করেছি। আমি তার সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন বেঁচে আছি ততদিন পর্যন্ত) এই স্থলে সিজদা করতেই থাকবো। (ইমাম বুখারী (রঃ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের আরো সনদ রয়েছে) সহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ এবং اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ এই সূরাদ্বয়ে সিজদা করেছি।
১-১৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ কিয়ামতের দিন আকাশ ফেটে যাবে, ওটা স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ পালনের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে থাকবে এবং ফেটে যাওয়ার আদেশ পাওয়া মাত্র ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তার করণীয়ই হলো আল্লাহর আদেশ পালন। কেননা, এটা ঐ আল্লাহর আদেশ যা কেউ ঠেকাতে পারে না, যিনি সবারই উপর বিজয়ী সবকিছুই যার সামনে অসহায় ও নাচার ।
জমীনকে যখন সম্প্রসারিত করে দেয়া হবে। অর্থাৎ জমীনকে প্রসারিত করা হবে, বিছিয়ে দেয়া হবে এবং প্রশস্ত করা হবে। হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী পাক (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা জমীনকে চামড়ার মত টেনে নিবেন। তাতে সব মানুষ শুধু দুটি পা রাখার মত জায়গা পাবে। সর্বপ্রথম আমাকে ডাকা হবে। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহ তা'আলার ডান দিকে থাকবেন। আল্লাহর কসম! হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর পূর্বে আল্লাহ তাআলাকে কখনো দেখেননি। আমি তখন বলবো: হে আমার প্রতিপালক! ইনি হযরত জিবরাঈল (আঃ), আমাকে খবর দিয়েছেন যে, আপনি তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। (এটা কি সত্য) তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ উত্তরে বলবেনঃ হ্যা, সত্য বলেছে।” অতঃপর আমি শাফাআতের অনুমতিপ্রাপ্ত হবো এবং বলবো: “হে আমার প্রতিপালক! আপনার বান্দারা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে আপনার ইবাদত করেছে।!” ঐ সময় তিনি মাকামে মাহমুদে থাকবেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে অর্থাৎ জমীন তার অভ্যন্তরভাগ থেকে সকল মৃতকে উঠিয়ে ফেলবে এবং এভাবে ও গর্ভ শূন্য হয়ে যাবে। সেও প্রতিপালকের ফরমানের অপেক্ষায় থাকবে তার জন্যে এটাই করণীয়ও বটে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট পৌছানো পর্যন্ত যে কঠোর সাধনা করে থাকো পরে তোমরা তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি অগ্রসর হতে থাকবে, আমল করতে থাকবে, অবশেষে একদিন তার সাথে মিলিত হবে এবং তার সম্মুখে দাঁড়াবে। তখন তোমরা নিজেদের প্রচেষ্টা ও কার্যাবলী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে।
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ) আপনি যতদিন ইচ্ছা জীবন যাপন করুন, অবশেষে একদিন আপনার মৃত্যু অনিবার্য। যা কিছুর প্রতি মনের আকর্ষণ সৃষ্টি করার করুন, একদিন তা থেকে বিচ্ছেদ অবধারিত। যা ইচ্ছা আমল করুন, একদিন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে।” مُلَاقِيْه শব্দের ه সর্বনাম দ্বারা রব হবে বা প্রতিপালককে বুঝানো হয়েছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। তখন অর্থ হবেঃ তোমার সাথে তোমার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ হবেই। তিনি তোমাকে তোমার সকল আমলের পারিশ্রমিক দিবেন। তোমার সকল প্রচেষ্টার প্রতিফল তোমাকে প্রদান করবেন। এ উভয় কথাই পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে আদম সন্তান! তোমরা চেষ্টা কর বটে কিন্তু নিজেদের চেষ্টায় তোমরা দুর্বল। সকল চেষ্টা পুণ্যাভিমুখী যেন হতে পারে এ চেষ্টা করো। প্রকৃতপক্ষে পূণ্যকাজ করাবার এবং পাপকাজ হতে বিরত রাখার শক্তি একমাত্র আল্লাহর। তাঁর সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যাকে তার আমলনামা দক্ষিণ হস্তে দেয়া হবে তার হিসাব নিকাশ সহজেই নেয়া হবে। অর্থাৎ তার ছোট খাট পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর খুটিনাটিভাবে যার আমলের হিসাব গ্রহণ করা হবে তার ধ্বংস অনিবার্য। সে শাস্তি হতে পরিত্রাণ পাবে না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “(কিয়ামতের দিন) যার হিসাব যাচাই করা হবে, আযাব তার জন্য অবধারিত।” হযরত আয়েশা (রাঃ) একথা শুনে বলেনঃ আল্লাহ তা'আলা কি একথা বলেন নাই? “অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে প্রদান করা হবে তার হিসাব হবে সহজতর।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, সেটা তো হিসাবের নামে দৃশ্যতঃ পেশ করা মাত্র (যথার্থ হিসাব নয়)। কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তির হিসাব যাচাই করা হবে, আযাব তার জন্যে অবধারিত।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ইমাম বুখারী (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ, ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি বিওয়াইয়াতে আছে যে, এটা বর্ণনা করার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় অক্ষুণী স্বীয় হস্তের উপর রেখে যেভাবে কেউ কোন জিনিস তন্ন তন্ন করে বুজে ঠিক সেইভাবে অঙ্গুলি নাড়াচাড়া করে বলেনঃ “অর্থাৎ যাকে তন্ন তন্ন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সে আযাব থেকে বাঁচতে পারবে না।” হযরত আয়েশা (ব্রাঃ) বলেন যে, যার কাছ থেকে যথারীতি হিসাব নেয়া হবে সে আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। তাকে শাস্তি ভোগ থেকে রেহাই দেয়া হবে না। حِسَابًا يَّسِيْرًا দ্বারা শুধু পেশকরণ বুঝানো হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে তার কোন এক নামাযে বলতে শুনি? اَللّٰهُمَّ حَاسِبْنِىْ حِسَابًا يَّسِيْرًا অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার হিসাব আপনি সহজভাবে গ্রহণ করুন।” তিনি এ নামায হতে ফারেগ হলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ সহজ হিসাব কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “শুধু আমলনামার প্রতি দৃষ্টি দেয়ানো হবে অর্থাৎ ভাসাভাসা ন্যর দেয়ানো হবে। তারপর বলা হবেঃ যাও, আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু হে আয়েশা (রাঃ)! আল্লাহ তা'আলা যার কাছ থেকে হিসাব নিবেন সে ধ্বংস হয়ে যাবে। মোটকথা, যার ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে সে তা পেশ হওয়ার পরপরই ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপর দলীয় লোকদের কাছে উৎফুল্লভাবে ফিরে আসবে।
হযরত সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ "তোমরা আমল করতে রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কারো জানা নেই। শীঘ্রই এমন সময় আসবে যখন তোমরা নিজেদের আমলসমূহ চিনতে পারবে। কোন কোন লোক উৎফুল্লভাবে দলীয় লোকদের সাথে মিলিত হবে। আর কোন কোন লোক বিমর্ষভাবে, মলিন মুখে এবং উদাসীন চেহারায় ফিরে আসবে। যারা পিঠের কাছে বাম হাতে আমলনামা পাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ততা ও ধ্বংসের কথা ভেবে চীৎকার করবে, মৃত্যু কামনা করবে এবং জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। পৃথিবীতে তারা খুব হাসিখুশী বা নিশ্চিন্ত আরাম আয়েশে দিন কাটিয়েছে। পরকালের জন্যে সামান্যতম ভয়ও তাদের ছিল না। আজ তাদেরকে সর্বপ্রকারের দুঃখ যাতনা, বিমর্ষতা, মলিনতা এবং উদাসীনতা সবদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তারা মনে করেছিল যে মৃত্যুর পর আর পুনরুত্থান হবে না এবং আর কোন জীবন নেই। তারা আল্লাহ তাআলার কাছে যাওয়ার কথা মোটেই বিশ্বাস করেনি।
তাই, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ নিশ্চয়ই তারা ফিরে যাবে। আল্লাহ অবশ্য তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। প্রথমবার তিনি যেভাবে সৃষ্টি করেছেন দ্বিতীয় বারও সেভাবেই সৃষ্টি করবেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে পাপ ও পূণ্য কর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন। তিনি তাদের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন। তারা যা কিছু করছে সে সম্পর্কে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল।