৮১-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা'আলা মুনাফিকদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছেন যারা তাবুকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে গমন করেনি এবং বাড়ীতে বসে থাকায় আনন্দিত হয়েছিল। আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করা তাদের কাছে ছিল অপছন্দনীয়।
তারা পরস্পর বলাবলি করছিলঃ “এই কঠিন গরমের সময় কোথায় যাবে?” তাবুকের যুদ্ধে বের হওয়ার সময়টা এমনই ছিল যে, একদিকে গরম ছিল অত্যন্ত কঠিন, অপরদিকে ফলগুলো সব পেকে গিয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের সম্পর্কে বলেন, তোমরা তোমাদের দুষ্কর্মের মাধ্যমে যে দিকে যাচ্ছ, তার মধ্যে এর চেয়ে বহুগুণ গরমের প্রখরতা রয়েছে। তা হচ্ছে জাহান্নামের আগুন। দুনিয়ার আগুনতো ঐ আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।
মুসনাদে আহমাদে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের এই আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ মাত্র। অধিকন্তু এই আগুনকে সমুদ্রের পানি দ্বারা দু’বার নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। এরূপ করা না হলে তোমরা এ আগুন দ্বারা কোনই উপকার লাভ করতে পারতে না।”
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা এক হাজার বছর (জাহান্নামের) আগুনকে উত্তপ্ত করেন, তখন তা লাল বর্ণ ধারণ করে। তারপর আবার এক হাজার বছর উত্তপ্ত করেন, তখন তা সাদা হয়ে যায়। এরপর পুনরায় এক হাজার বছর তাপ দেন তখন তা কালো বর্ণ ধারণ করে। আর ওটা রাতের আঁধারের মত ভীষণ কালো হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ “আমি জানি না যে, ইয়াহইয়া (রঃ) ছাড়া অন্য কেউ এটাকে মার’ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন।”)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) وَ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ (২:২৪) এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “(জাহান্নামের) আগুনকে এক হাজার বছর উত্তপ্ত করা হয়, তখন তা সাদা হয়ে যায়। তারপর আরো এক হাজার বছর তাপ দেয়া হয়, তখন তা লাল বর্ণ ধারণ করে। তারপর আরো এক হাজার বছর উত্তপ্ত করা হয়, তখন তা রাতের আঁধারের মত কালো হয়ে যায়। ওর শিখায় কোন ঔজ্জ্বল্য অবশিষ্ট নেই।” (এ হাদীসটি আবু বকর ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
একটি হাদীসে এসেছে যে, জাহান্নামের আগুনের একটি স্ফুলিঙ্গ যদি পূর্ব দিকে থাকে তবে ওর উষ্ণতা পশ্চিম দিক পর্যন্ত পৌছে যাবে। (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) তাম্মাম ইবনে নাজীহ্ (রঃ)-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন) আবু ইয়ালার (রঃ) একটি দুর্বল রিওয়ায়াতে রয়েছে যে, যদি এই মসজিদে এক লক্ষ বা এর চেয়েও বেশী লোক থাকে এবং কোন জাহান্নামী এখানে এসে শ্বাস গ্রহণ করে তবে ওর উষ্ণতায় মসজিদ ও মসজিদে অবস্থিত সমস্ত লোক পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে। অন্য একটি হাদীসে আছে যে, জাহান্নামে যে লোকটির শাস্তি সবচেয়ে হাল্কা হবে তা হবে এই যে, তার পায়ে আগুনের জুতা পরানো হবে, যার ফলে তার মাথার খুলি টগবগ করে ফুটতে থাকবে। সে তখন মনে করবে যে, তাকেই সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি দেয়া হচ্ছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে ওটাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা হাল্কা শাস্তি। কুরআন কারীমে ঘোষিত হচ্ছে- “নিশ্চয়ই ওটা (জাহান্নামের অগ্নি) হচ্ছে জ্বলন্ত হলকা যা চর্ম পর্যন্ত খসিয়ে ফেলবে।” আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ “তাদের মাথার উপর ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দেয়া হবে, যার ফলে তাদের পেটের সমস্ত জিনিস এবং চামড়া ঝলসে যাবে। তারপর লোহার হাতুড়ী দ্বারা তাদের মস্তক পিষ্ট করা হবে। তারা যখন সেখান থেকে বের হতে চাইবে তখন তাদেরকে সেখানেই ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বলা হবে- দাহনকারী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর।” অন্য স্থানে আল্লাহ পাক বলেনঃ “যারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছে আমি তাদেরকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করবো, যখন তাদের (গায়ের) চামড়া ঝলসে যাবে তখন আমি ওর পরিবর্তে অন্য চামড়া আনয়ন করবো, যেন তারা পূর্ণভাবে শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করে। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “(হে নবী!) তুমি বলে দাও- জাহান্নামের আগুন (এর চেয়ে) অধিকতর গরম, কি ভাল হতো যদি তারা বুঝতে পারতো!” অর্থাৎ যদি তারা এটা অনুধাবন করতো যে, জাহান্নামের আগুনের প্রখরতা অত্যন্ত বেশী, তবে অবশ্যই গ্রীষ্মের মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও খুশী মনে তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে যুদ্ধে গমন করতো এবং নিজেদের জান ও মাল আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করতো না।
আরবের একজন কবি বলেনঃ
عُمْرُكَ بِالْحَمِيَّةِ اَفْنَيْتَهٗ ـ خَوْفًا مِّنَ الْبَارِدِ وَالْحَارِّ
وَكَانَ اَوْلٰى لَكَ اَنْ تَتَّقِىْ ـ مِنَ الْمَعَاصِىْ حَذَرَ النَّارِ
অর্থাৎ “তুমি তোমার জীবনকে ঠাণ্ডা ও গরম হতে বাঁচানোর চেষ্টায় কাটিয়ে দিয়েছো, অথচ তোমার উচিত ছিল যে, তুমি আল্লাহর নাফরমানী থেকে বিরত থাকবে, তাহলে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পেতে।”
এখন আল্লাহ তা'আলা এই মুনাফিকদের সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করছেন যে, অল্পদিন তারা এই নশ্বর জগতে হাসি-তামাশা ও আমোদ আহলাদ করে জীবনটা কাটিয়ে দিক, অতঃপর ভবিষ্যতের চিরস্থায়ী জীবনে তাদেরকে শুধু কাঁদতেই হবে যা কখনো শেষ হবে না।
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “হে লোক সকল! তোমরা ক্রন্দন কর। যদি তোমাদের ক্রন্দন না আসে তবে ক্রন্দনের ভান কর। কেননা, জাহান্নামবাসীরা কাঁদতে থাকবে, এমন কি কেঁদে তাদের গণ্ডদেশে নদীর মত গর্ত হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত অশ্রু শুকিয়ে যাবে। অতঃপর তাদের চক্ষুগুলো রক্ত বর্ষণ করতে শুরু করবে। তাদের চক্ষু দিয়ে এতো বেশী অশ্রু ও রক্ত বর্ষিত হবে যে, কেউ যদি ওর উপর দিয়ে নৌকা চালানোর ইচ্ছে করে তবে চালাতে পারবে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল ইয়ালা আল মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশের পর কাঁদতে থাকবে। এতো বেশী কাঁদবে যে, অশ্রু শেষ হবার পর পুঁজ বের হতে থাকবে। ঐ সময় জাহান্নামের দারোগা তাদেরকে ডাক দিয়ে বলবেঃ “ওরে হতভাগ্যের দল! করুণার জায়গাতে তো তোমরা কখনো ক্রন্দন করনি। এখন এখানে কান্নাকাটি করা বৃথা।” তখন তারা উচ্চৈঃস্বরে চীকার করে জান্নাতবাসীদের নিকট ফরিয়াদ করবেঃ “হে জান্নাতবাসিগণ! হে পিতা, মাতা ও পুত্রদের দল! আমরা কবর থেকে পিপাসার্ত অবস্থায় উঠেছিলাম। তারপর হাশরের ময়দানেও পিপাসার্ত রয়েছিলাম এবং আজ পর্যন্ত এখানেও পিপাসার্ত অবস্থায় রয়েছি। সুতরাং আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। কিছু পানি আমাদের দিকে বহিয়ে দাও এবং যে আহার্য আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে দান করেছেন তার থেকে আমাদেরকে কিছু দান কর।” চল্লিশ বছর পর্যন্ত তারা এভাবে (কুকুরের মত) চীষ্কার করতে থাকবে। চল্লিশ বছর পর তাদেরকে উত্তর দেয়া হবেঃ “তোমাদেরকে এ অবস্থাতেই অবস্থান করতে হবে।” শেষ পর্যন্ত তারা সমস্ত কল্যাণ থেকে নিরাশ হয়ে যাবে।