৯১-৯৩ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তাআলা ঐ শরীয়ত সম্মত ওযরসমূহের বর্ণনা দিচ্ছেন যে ওরগুলো কোন মানুষের মাঝে থাকলে সে যদি জিহাদে অংশগ্রহণ না করে তবে শরীয়তের দৃষ্টিতে তার কোন অপরাধ হবে না। ঐ ওযরগুলোর মধ্যে এক প্রকারতো হচ্ছে এই যে, তা সব সময়ই থাকবে, কোন অবস্থাতেই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। যেমন জন্মগতভাবে দুর্বল হওয়া, খোড়া হওয়া, অন্ধ হওয়া, বিকলাঙ্গ হওয়া, সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন হওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয় প্রকারের ওযর হচ্ছে ঐ সব ওযর যেগুলো কখনো থাকে আবার কখনো থাকে না। ওগুলো হচ্ছে আকস্মিক কারণ। যেমন কেউ রুগ্ন হয়ে পড়লো বা অভাবগ্রস্ত হলো অথবা সফরের ও জিহাদের সরঞ্জাম জোগাড় করতে পারছে না ইত্যাদি। সুতরাং এসব ওযর বিশিষ্ট লোকেরা জিহাদে অংশগ্রহণ না করলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের কোন অপরাধ হবে না। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা থাকতে হবে। তাদেরকে হতে হবে মুসলিমদের ও আল্লাহর দ্বীনের শুভাকাঙ্ক্ষী। তাদের কর্তব্য হবে অন্যদেরকে জিহাদের প্রতি উৎসাহিত করা। বাড়ীতে বসে বসে যতটুকু সম্ভব মুজাহিদদের খিদমত করতে হবে। এরূপ সৎ প্রকৃতির লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
ঈসা (আঃ)-এর সাহায্যকারী হাওয়ারীগণ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলঃ “আল্লাহর শুভাকাঙ্ক্ষী কারা বলুন তো?” তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “যারা আল্লাহর হককে মানুষের হকের উপর প্রাধান্য দেয় এবং যখন একটি দ্বীনের কাজ এবং একটি দুনিয়ার কাজ সামনে এসে যায় তখন যারা দ্বীনের কাজের গুরুত্বের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখে । তারপর দ্বীনের কাজ শেষ করে দুনিয়ার কাজ আনজাম দেয়।”
একবার দুর্ভিক্ষের সময় জনগণ ইসতিকার সালাত পড়ার জন্যে মাঠের দিকে বের হয়। তাদের সাথে বিলাল ইবনে সা'দ (রাঃ) ছিলেন। তিনি দাড়িয়ে আল্লাহ তাআলার হামদ ও সানার পর জনগণকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে উপস্থিত ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনারা কি এটা স্বীকার করেন যে, আপনারা সবাই আল্লাহ তা'আলার পাপী বান্দা?” সবাই সমস্বরে বলে উঠলেনঃ “হ্যাঁ।” অতঃপর তিনি প্রার্থনার জন্যে হাত উঠিয়ে বলতে লাগলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আপনার কালামে পাকে বলেছেনঃ “সৎ লোকদের প্রতি কোন প্রকারের অভিযোগ নেই।” আমরা আমাদের দুষ্কর্যের স্বীকারোক্তি করছি। সুতরাং আপনি আমাদের। ক্ষমা করুন! আমাদের উপর আপনার করুণা বর্ষণ করুন! আমাদের উপর দয়াপরবশ হয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করুন! তিনি হাত উঠালেন এবং জনগণও তাঁর সাথে হাত উঠালো। আল্লাহর করুণা উথলিয়ে উঠলো এবং মুষলধারে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো।
যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর লেখক ছিলাম। সূরায়ে বারাআত যখন অবতীর্ণ হচ্ছিল তখন আমি ঐ সূরাটিও লিখছিলাম। আমি আমার কলমটি আমার কানের উপর রাখতাম। জিহাদের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কি অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে সে জন্যে তিনি অপেক্ষমান ছিলেন। এমন সময় একজন অন্ধ এসে বলতে লাগলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তো একজন অন্ধ লোক। সুতরাং আমি জিহাদের নির্দেশ কিরূপে পালন করতে পারি?” তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
এরপর ঐ লোকদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যারা জিহাদে অংশগ্রহণের জন্যে সদা উদ্বিগ্ন, কিন্তু স্বভাবগত কারণে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণা অনুযায়ী মুজাহিদগণ জমা হতে শুরু করেন। একটি দল আগমন করলেন যাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল ইবনে মাকরান মুযানীও (রাঃ) ছিলেন। তারা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের সওয়ারী নেই। সুতরাং আপনি আমাদের সওয়ারীর ব্যবস্থা করে দিন, যাতে আমরাও জিহাদের সওয়াব লাভ করতে পারি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আমার কাছে তো একটিও সওয়ারী নেই যাতে আমি তোমাদেরকে আরোহণ করতে পারি।” সুতরাং তারা নিরাশ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান। তাঁদের এর চেয়ে বড় দুঃখ আর ছিল না যে, তারা জিহাদের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হয়ে গেলেন এবং নারীদের মত তাদেরকে ঐ সময়টা বাড়ীতেই কাটাতে হবে। তাদের না আছে নিজেদের কোন জিনিস, না কারো কাছ থেকে কোন বাহন পাচ্ছেন। তাই মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করে তাদেরকে সান্তনা দান করেন। এ আয়াতটি মুযাইনা গোত্রের শাখা বানু। মাকরানের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। মুহাম্মাদ ইবনে কা'ব (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা সাতজন ছিলেন। তাঁরা ছিলেন বানু আমির গোত্রের লোক। তাঁরা হচ্ছেন-(১) বানু ওয়াকিফ গোত্রের সালিম ইবনে আউফ, (২) বানু মাযিল গোত্রের হারামী ইবনে আমর, (৩) বানু মুআল্লা গোত্রের আব্দুর রহমান ইবনে কা'ব, (৪) বানু সালমা গোত্রের ফাযলুল্লাহ, (৫) আমর ইবনে উকবা, (৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর মুযানী, (৭) বানু হারিসা গোত্রের আলিয়্যাহ ইবনে যায়েদ। কোন কোন রিওয়ায়াতে কতকগুলো নামের হেরফেরও রয়েছে। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী এই বুযুর্গদের ব্যাপারেই রাসূলগণের মাথার মুকুট মুহাম্মাদ (সঃ) বলেছেনঃ “হে আমার মুজাহিদ সাহাবীবর্গ! তোমরা মদীনায় যেসব লোককে পিছনে ছেড়ে এসেছে তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা তোমাদের খরচ করার মধ্যে, তোমাদের মাঠে-ময়দানে চলাফেরার মধ্যে, তোমাদের জিহাদ করার মধ্যে শরীক রয়েছে। এতে তোমাদের যে সওয়াব হবে তাতে তারাও শরীক থাকবে।” অতঃপর তিনি এই আয়াতটিই পাঠ করেন। অন্য এক রিওয়ায়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ কথা শুনে সাহাবীগণ বলেনঃ “তারা বাড়ীতে বসে থেকেও সওয়াবে আমাদের শরীক হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, কেননা তাদের ওযর রয়েছে। ওযরের কারণেই তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।” অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “রোগ তাদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছে।” অতঃপর প্রকৃতপক্ষে যাদের কোন ওযর নেই, আল্লাহ তাআলা তাদের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলছেনঃ অভিযোগ তো শুধু ঐ লোকদের উপরই যারা ধন-সম্পদের মালিক ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে গমন না করার অনুমতি চাচ্ছে। তারা অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের মত বাড়ীতেই অবস্থান করতে ইচ্ছুক। তারা মাটি কামড়ে বসে থাকে। তাদের দুষ্কার্যের কারণে আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরসমূহের উপর মোহর মেরে দেন। সুতরাং তারা এখন নিজেদের ভাল মন্দ কিছুই জানতে পারছে না।