হিজর আয়াত ৯৯
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ ࣖࣖ ( الحجر: ٩٩ )
Wa'bud Rabbaka hattaa yaatiyakal yaqeen (al-Ḥijr ১৫:৯৯)
English Sahih:
And worship your Lord until there comes to you the certainty [i.e., death]. (Al-Hijr [15] : 99)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর তোমার রব্বের ‘ইবাদাত করতে থাক তোমার সুনিশ্চিত ক্ষণের (অর্থাৎ মৃত্যুর) আগমন পর্যন্ত। (হিজর [১৫] : ৯৯)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর। [১]
[১] মুশরিকরা নবী (সাঃ)-কে যাদুকর, পাগল, গণক ইত্যাদি বলত। আর মানুষ হওয়ার কারণে তিনি এ সব কথায় দুঃখ পেতেন। মহান আল্লাহ সান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি প্রশংসা কর, নামায পড় এবং নিজ আল্লাহর এবাদত কর। যাতে তোমার অন্তর শান্তি লাভ করবে এবং আল্লাহর সাহায্য আসবে। সিজদাকারী বলতে নামাযী ও ইয়াকীন বলতে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর আপনার মৃত্যু আসা পর্যন্ত আপনি আপনার রবের ইবাদাত করুন [১]।
[১] এখানে কুরআন ব্যবহার করেছে (الْيَقِيْنُ) শব্দটি। সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম শব্দটির তাফসীর করেছেনঃ মৃত্যু [বুখারীঃ ৪৭০৬] কুরআন ও হাদীসে ইয়াকীন’ শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহার হওয়ার বহু প্রমাণ আছে। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ
“তারা বলবে, আমরা মুসল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করতাম না, এবং আমরা বিভ্রান্ত আলোচনাকারীদের সাথে বিভ্রান্তিমূলক আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিন অস্বীকার করতাম, শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে মৃত্যু এসে যায় " [সূরা আল-মুদ্দাসসিরঃ ৪৩-৪৭] অনুরূপভাবে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে মায’উন এর মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে বলেছেনঃ “কিন্তু সে! তার তো (الْيَقِيْنُ) তথা মৃত্যু এসেছে, আর আমি তার জন্য যাবতীয় কল্যাণের আশা রাখি। [বুখারীঃ ১২৪৩]
সুতরাং বুঝা গেল যে, এখানে (الْيَقِيْنُ) শব্দের অর্থ মৃত্যুই। আর এ অর্থই সমস্ত মুফাসসেরীনদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে যেতে হবে। যদি কাউকে ইবাদত থেকে রেহাই দেয়া হতো তবে নবী-রাসূলগণ তা থেকে রেহাই পেতেন কিন্তু তারাও তা থেকে রেহাই পাননি। তারা আমৃত্যু আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং যদি কেউ এ কথা বলে যে, মারেফত এসে গেলে আর ইবাদতের দরকার নেই সে কাফের। কারণ সে কুরআন, হাদীস এবং ইজমায়ে উম্মাতের বিপরীত কথা ও কাজ করেছে। এটা মূলতঃ মুলহিদদের কাজ। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর ইয়াকীন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত কর।
4 Muhiuddin Khan
এবং পালনকর্তার এবাদত করুন, যে পর্যন্ত আপনার কাছে নিশ্চিত কথা না আসে।
5 Zohurul Hoque
আর তোমার প্রভুর উপাসনা কর যে পর্যন্ত না তোমার কাছে আসে যা সুনিশ্চিত।
6 Mufti Taqi Usmani
এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাক যাবত না যার আগমন সুনিশ্চিত তোমার কাছে তা এসে যায়।
7 Mujibur Rahman
আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত কর।
8 Tafsir Fathul Mazid
৯৪-৯৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি যেন তাঁর প্রতি যে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে তা প্রচার করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَآ أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ)
“হে রাসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর।” (সূরা মায়িদা ৫:৬৭)
সুতরাং তাবলীগ করতে হবে আল্লাহ তা‘আলা যা নাযিল করেছেন তার। আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন কুরআন ও সুন্নাহ।
আর তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরো নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তিনি কাফির-মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করে চলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(فَتَوَلَّ عَنْهُمْ فَمَآ أَنْتَ بِمَلُوْمٍ)
“অতএব, তুমি তাদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নাও, এতে তুমি তিরস্কৃত হবে না।” (সূরা যারিয়াত ৫১:৫৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اِتَّبِعْ مَآ أُوْحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ ج لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ ج وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ)
“তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা ওয়াহী করা হয় তুমি তারই অনুসরণ কর, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার ইলাহ নেই এবং মুশরিকদের হতে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (সূরা আনয়াম ৬:১০৬)
(إِنَّا كَفَيْنٰكَ الْمُسْتَهْزِئيْنَ)
অর্থাৎ যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, ব্যঙ্গ ও উপহাস করে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। অর্থাৎ তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া এবং পাকড়াও করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَيْسَ اللّٰهُ بِكَافٍ عَبْدَه)
“আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?” (সূরা যুমার ৩৯:৩৬)
আর এখানে উপহাসকারী বলতে যাদেরকে বুঝানো হয়েছে তারা হল ওলীদ বিন মুগিরা, আস বিন ওয়েল, হারেস বিন কায়েস আস-সাহমী, আসউয়াদ বিন আব্দ ইয়াগুছ এবং আসউয়াদ বিন ম্ত্ত্বুালিব। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) তবে উপহাসকারীদের মাঝেই কেবল সীমাবদ্ধ নয় কিয়ামত পর্যন্ত যত ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ও উপহাসকারী আসবে সবাই এতে শামিল।
(وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ)- আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি জানেন মানুষের খারাপ কথা-বার্তায় তাঁর রাসূলের মন সংকীর্ণ হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَدْ نَعْلَمُ إِنَّه۫ لَيَحْزُنُكَ الَّذِيْ يَقُوْلُوْنَ)
“আমি অবশ্য জানি যে, তারা যা বলে তা তোমাকে নিশ্চিতই কষ্ট দেয়; (সূরা আন‘আম ৬:৩৩)
এরূপ সূরা আন‘আমের ৩৩ নং, সূরা হুদের ১২ নং এবং সূরা কাহফের ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
তাই তিনি তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন: তিনি যেন তাঁর রবের ইবাদত করেন, তিনিই তাদের এ ব্যপারে অবগত আছেন। তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে।
(وَاعْبُدْ رَبَّكَ) এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে দুনিয়ার সকল মু’মিন মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন ইয়াকীন আসা পর্যন্ত ইবাদত করে। এখানে “يقين” দ্বারা উদ্দেশ্য হল মৃত্যু।
দলীল: উম্মু ‘আলার হাদীস, সেখানে বর্ণিত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমান বিন মাযউন সম্পর্কে বলেছেন:
أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ اليَقِينُ، وَاللّٰهِ إِنِّي لَأَرْجُو لَهُ الخَيْرَ، وَاللّٰهِ مَا أَدْرِي، وَأَنَا رَسُولُ اللّٰهِ، مَا يُفْعَلُ بِه
তার ইয়াকীন চলে এসেছে অর্থাৎ মৃত্যু চলে এসেছে। আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার জন্য কল্যাণ আশা করছি। আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি আল্লাহ তা‘আলার রাসূল হওয়া সত্ত্বেও জানিনা তার সাথে কী ব্যবহার করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩, ৭০১৮)
কিন্তু কোন কোন ভ্রান্ত সম্প্রদায় এর দ্বারা উদ্দেশ্য গ্রহণ করেন যে, যখন “ইয়াক্বীন” চলে আসবে তখন আর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার প্রয়োজন নেই। যার ফলে অনেকে এই “ইয়াক্বীন” বা “খাঁটি বিশ্বাস” অর্থ গ্রহণ করে ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছে। তাদের এই উদ্দেশ্যটি ভুল। বরং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি হাদীসে বলেন, “তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় কর যদি তাতে সক্ষম না হও তাহলে বসে। আর যদি তাতেও সক্ষম না হও তাহলে ইশারা দিয়ে সালাত আদায় কর”। (সহীহ বুখারী হা: ১২৪৩)
সুতরাং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত করে যেতে হবে, যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদত করেছেন। যারা এর ব্যতিক্রম বলে তারা সঠিক পথে নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. তাবলীগ করতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর।
২. যারা রাসূল ও মু’মিনদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করবে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট, তিনি তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
৩. মু’মিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলা একাই যথেষ্ট।
৪. মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
9 Fozlur Rahman
আর তোমার প্রভুর ইবাদত করতে থাক, যতক্ষণ না তোমার কাছে নিশ্চিত বস্তু (মৃত্যু) উপস্থিত হয়।
10 Mokhtasar Bangla
৯৯. আর আপনি সর্বদা নিজ প্রতিপালকের ইবাদাত করুন এবং মৃত্যু আসা পর্যন্ত যতক্ষণ আপনি বেঁচে থাকেন তার উপর অটল থাকুন।
11 Tafsir Ibn Kathir
৯৪-৯৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূলকে (সঃ) নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে রাসূল (সঃ)! তুমি জনগণের কাছে আমার বাণী স্পষ্টভাবে পৌছিয়ে দাও। এ ব্যাপারে কোনই ভয় করবে না। মুশরিকদের কাছে তুমি একত্ববাদ খোলাখুলি ভাবে প্রচার করো। নামাযে কুরআন কারীম উচ্চ স্বরে পাঠ করো।
এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সঃ) গোপনীয় ভাবে প্রচার কার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি এবং তার সাহাবীগণ প্রকাশ্য ভাবে তাবলীগের কাজ চালিয়ে যেতে শুরু করেন।
আল্লাহ পাক বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! এ কাজে মুশরিকদের ঠাট্টা বিদ্রুপকে। তুমি উপেক্ষা করো। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্যে আমিই যথেষ্ট। প্রচার কার্যে তুমি মোটেই অবহেলা প্রদর্শন করো না। এরা তো চায় যে, তুমি তাবলীগের কাজে অমনোযোগী হয়ে যাও। সুতরাং তোমার কর্তব্য হচ্ছে দ্বিধাসংকোচহীন ভাবে পুরোমাত্রায় প্রচারকার্য চালিয়ে যাওয়া এবং তাদেরকে মোটেই ভয় না করা। আমি আল্লাহ স্বয়ং তোমার রক্ষক ও সাহায্যকারী। আমিই তোমাকে তাদের ক্ষতি ও দুষ্টামি থেকে রক্ষা করবো। যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে রাসূল (সঃ)! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তুমি পৌছিয়ে দাও, আর তা যদি তুমি না কর তাহলে তুমি তাঁর রিসালাতকে পৌছিয়ে দিলে না। আর আল্লাহ তোমাকে মানুষ (এর অনিষ্ট) থেকে রক্ষা করবেন।”
হযরত আনাস (রাঃ) اِنَّا كَفَیْنٰكَ الْمُسْتَهْزِءِیْنَ ـ الَّذِیْنَ یَجْعَلُوْنَ مَعَ اللّٰهِ আয়াত সম্পর্কে বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) পথ দিয়ে গমন করছিলেন। এমতাবস্থায় মুশরিকরা তাঁকে জ্বালাতন করে। তখন তার রক্ষক হিসেবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন এবং তাদেরকে চওকা মারেন। ফলে তাদের দেহ এমন ক্ষত বিক্ষত হয় যে, যেন তাতে বর্শা দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। তাতেই তারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়। তারা ছিল মুশরিকদের বড় বড় নেতা। তারা ছিল বেশ বয়স্ক লোক এবং তাদেরকে খুবই সম্ভ্রান্ত মনে করা হতো। আসওয়াদ ইবনু আবদিল মুত্তালিব আবু যামআ ছিল বানু আসাদ গোত্রভূক্ত। সে ছিল রাসূলুল্লাহর (সঃ) চরমতম শত্রু। সে তাঁকে খুবই দুঃখ-কষ্ট দিতো এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো। তিনি অসহ্য হয়ে তার জন্যে বদদুআ’ও করেছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি তাকে অন্ধ ও সন্তানহীন করে দিন।” আসওয়াদ ছিল বানু যাহরার অন্তর্ভূক্ত। বানু মাখযুম গোত্রভূক্ত ছিল ওয়ালীদ। আস ইবনু ওয়ায়েল ছিল বানু সাহমের অন্তর্ভূক্ত। হারিস ছিল খুযাআ গোত্রভূক্ত। এই লোকগুলি সদা সর্বদা রাসূলুল্লাহর (সঃ) ক্ষতি করতেই থাকতো। তারা জনগণকেও তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতো। যতদূর কষ্ট দেয়ার শক্তি তাদের ছিল তাতে তারা মোটেই ত্রুটি করতো না। তাদের উৎপীড়ন যখন চরম পর্যায়ে পৌছে গেল এবং কথায় কথায় রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বিদ্রুপ করতে থাকলো তখন আল্লাহ তাআলা فَاصْدَعْ হতে يَعْلَمُوْنَ পর্যন্ত আয়াত নাযিল করলেন। (এটা হাফিয আবু বকর আল বায্যার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করছিলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান। এমন সময় আসওয়াদ ইবনু আবদে ইয়াছ তার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) তার পেটের দিকে ইশার করেন। এর ফলে তার পেটের অসুখ হয়ে যায় এবং তাতেই তার মৃত্যু ঘটে। ইতিমধ্যে ওয়ালীদ ইবনু মুগীরা গমন করে। খোযা’ গোত্ৰীয় একটি লোকের তীরের ফলকের সামান্য আঘাতে তার পায়ের গোড়ালী কিছুটা আহত হয়েছিল। এরপর সুদীর্ঘ দু' বছর কেটে গিয়েছিল। হযরত জিবরাঈল (আঃ) ঐ দিকেই ইশারা করেন। এর ফলে ঐ ক্ষতস্থানটুকু ফুলে যায় ও পেকে ওঠে এবং তাতেই সে মৃত্যু বরণ করে। এরপর গমন করে আস ইবনু ওয়ায়েল। হযরত জিবরাঈল (আঃ) তার পায়ের পাতার দিকে ইশারা করেন। কিছু দিন আগে তায়েফ গমনের উদ্দেশ্য সে তার গাধার উপর আরোহণ করে। পথে সে গাধার পিঠ থেকে পড়ে যায় এবং তার পায়ের পাতায় কাটা ঢুকে যায়। তাতেই তার জীবন লীলা শেষ হয়। হযরত জিবরাঈল (আঃ) হারিছের মাথার দিকে ইশারা করেন। এর ফলে তার মাথা দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। তাতেই তার মৃত্যু হয়। এই সব কষ্টদাতাদের নেতা ছিল ওয়ালীদ ইবনু মুগীরা। সেই তাদেরকে একত্রিত করেছিল। তারা ছিল সংখ্যায় পাঁচ জন বা সাতজন। তারাই ছিল প্রধান এবং তাদের ইঙ্গিতেই ইতর লোকেরা ইতরামি করতো। এই লোকগুলি এই সব বাজে ও জঘন্য ব্যবহারের সাথে সাথে একাজও করতো যে, তারা আল্লাহ তাআলার সাথে অন্যদেরকে শরীক করতো। তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি এখনই ভোগ করতে হবে। আরো যারা রাসূলের (সঃ) বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরীক করবে তাদেরও অবস্থা অনুরূপই হবে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ) আমি তো জানি যে, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। কিন্তু তুমি তাদের কথার প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করো না। আমি তোমার সাহায্যকারী। তুমি তোমার প্রতিপালকের যিকর, পবিত্রতা ঘোষণা এবং গুণকীর্তনে লেগে থাকো। মন ভরে তাঁর ইবাদত কর, নামাযের খেয়াল রেখো এবং সিজদাকারীদের সঙ্গ লাভ কর।”
হযরত নাঈম ইবনু আম্মার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলতে শুনেছেনঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হে আদম সন্তান! তুমি দিনের প্রথমভাগে চার রাকআত নামায হতে অপারগ হয়ো না, তা হলে আমি তোমার জন্যে ওর শেষ ভাগ যথেষ্ট করবো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এজন্যেই রাসূলুল্লাহর (সঃ) অভ্যাস ছিল এই যে, যখন তিনি কোন ব্যাপারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন তখন নামায শুরু করে দিতেন।
এই শেষ আয়াতে يَقِيْن শব্দ দ্বারা মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এর দলীল হচ্ছে সূরায়ে مُدَثِّر এর ঐ আয়াতগুলি যেগুলিতে বর্ণিত হয়েছে যে, জাহান্নামীরা নিজেদের অপরাধ বর্ণনা করতে গিয়ে বলবেঃ لَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِیْنَ ـ وَ كُنَّا نَخُوْضُ مَعَ الْخَآىٕضِیْنَ ـ وَ كُنَّا نُكَذِّبُ بِیَوْمِ الدِّیْنِ ـ حَتّٰۤى اَتٰىنَا الْیَقِیْنُ অর্থাৎ “তারা বলবেঃ আমরা নামাযীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করতাম না। আর আমরা আলোচনাকারীদের সাথে। আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করতাম, আমাদের নিকট মৃত্যুর আগমন পর্যন্ত।” (৭৪:৪৩-৪৭) এখানেও مَوْت এর স্থলে يَقِيْن শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি সহীহ, হাদীসেও রয়েছে যে, হযরত উসমান ইবনু মাঊনের (রাঃ) মৃত্যুর পর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর নিকট গমন করেন তখন উম্মুল আ’লা (রাঃ) নাম্নী আনসারের একটি মহিলা বলেনঃ “হে আবুস সায়েব (রাঃ) । আপনার উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক, নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে সম্মান দান করেছেন।” তাঁর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি করে জানলে যে, আল্লাহ তাকে সম্মান দান করেছেন?” উত্তরে মহিলাটি বলেনঃ “আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উৎসর্গিত হোক! তার উপর আল্লাহ তাআলা দয়া না করলে আর কার উপর করবেন?” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জেনে রেখো যে, তার মৃত্যু হয়ে গেছে এবং আমি তার মঙ্গলেরই আশা রাখি।” এই হাদীসেও مَوْت এর স্থলে يَقِيْن শব্দ রয়েছে।
এই আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নামায ইত্যাদি ইবাদত তার উপর ফরয। তার অবস্থা যেমন থাকবে সেই অনুযায়ী সে নামায আদায় করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দাঁড়িয়ে নামায পড়তে সক্ষম না হলে বসে পড়বে এবং বসে পড়তে না পারলে শুয়ে শুয়েই পড়বে।”
এর দ্বারা বদমাযহাবীরা নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে একটি কথা বানিয়ে নিয়েছে। তা এই যে, তাদের মতে মানুষ যে পর্যন্ত পূর্ণতার পর্যায়ে না পৌছে সেই পর্যন্ত তার উপর ইবাদত ফরয থাকে। কিন্তু যখনই সে মারেফাতে মনযিলগুলো অতিক্রম করে ফেলে তখন তার উপর থেকে ইবাদতের কষ্ট লোপ পেয়ে যায়। এটা সরাসরি বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতামূলক কথা। এই লোকগুলি কি এটুকুও বুঝে না যে, নবীগণ, বিশেষ করে নবীকূল শিরমণি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীবর্গ মারেফাতের সমস্ত মনযিল অতিক্রম করেছিলেন এবং তারা খোদায়ী বিদ্যা এবং পরিচিতির ক্ষেত্রে সারা দুনিয়া অপেক্ষা পূর্ণতম ছিলেন। মহান আল্লাহর গুণাবলী এবং তাঁর পবিত্র সত্তা সম্পর্কে তাঁরাই সবচেয়ে বেশী জ্ঞান রাখতেন। এতত্সত্ত্বেও তারা সকলের চেয়ে বেশী ইবাদত করতেন এবং দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাতেই লেগে রয়েছিলেন। তাঁরা মহান প্রতিপালকের আনুগত্যের কাজে সমস্ত দুনিয়া হতে বেশী নিমগ্ন ছিলেন। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলো যে, এখানে يَقِيْن দ্বারা مَوْت উদ্দেশ্য। সমস্ত মুফাসির, সাহাবী, তাবিঈ প্রভৃতির এটাই মাযহাব। অতএব, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমরা তারই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে, তিনি আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। আমরা তার কাছে ভাল কাজে সাহায্য চাচ্ছি। তার পবিত্র সত্তার উপরই আমাদের ভরসা। আমরা সেই মালিক ও হাকিমের কাছে এই প্রার্থনা জানাই যে, তিনি যেন আমাদেরকে পূর্ণ ইসলাম ও ঈমান এবং পুণ্য কাজের উপর আমাদের মৃত্যু ঘটান। তিনি বড় দাতা এবং পরম দয়ালু।