কাহফ আয়াত ৯৯
۞ وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَىِٕذٍ يَّمُوْجُ فِيْ بَعْضٍ وَّنُفِخَ فِى الصُّوْرِ فَجَمَعْنٰهُمْ جَمْعًا ۙ ( الكهف: ٩٩ )
Wa taraknaa ba'dahum Yawma'iziny yamooju fee ba'dinw wa nufikha fis Soori fajama'naahum jam'aa (al-Kahf ১৮:৯৯)
English Sahih:
And We will leave them that day surging over each other, and [then] the Horn will be blown, and We will assemble them in [one] assembly. (Al-Kahf [18] : 99)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আমি তাদেরকে সেদিন এমন অবস্থায় ছেড়ে দেব যে, তারা একদল আরেক দলের উপর তরঙ্গমালার মত পড়বে। আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। অতঃপর আমরা সব মানুষকে একসঙ্গে একত্রিত করব। (কাহফ [১৮] : ৯৯)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
সেই দিন আমি তাদেরকে এক দল অপর দলের উপর তরঙ্গায়িত অবস্থায় ছেড়ে দেব। আর শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে; অতঃপর আমি তাদের সবাইকেই একত্রিত করব।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর সেদিন আমারা তাদেরকে ছেড়ে দেব এ অবস্থায় যে, একদল আরেক দলের উপর তরঙ্গের ন্যায় আছড়ে পড়বে [১]। আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে , অতঃপর আমরা তাদের সবাইকে [২] পুরোপুরি একত্রিত করব।
[১] بعضهم এর সর্বনাম দ্বারা বাহ্যতঃ ইয়াজুজ-মাজুজকেই বোঝানো হয়েছে। তাদের একদল অপরদলের মধ্যে ঢুকে পড়বে- বাহ্যতঃ এই অবস্থা তখন হবে, যখন তাদের পথ খুলে যাবে এবং তারা পাহাড়ের উচ্চতা থেকে দ্রুতবেগে নীচে অবতরণ করবে। [ফাতহুল কাদীর] [উসাইমীন, তাফসীরুল কুরআনিল কারাম]। তাফসীরবিদগণ অন্যান্য সম্ভাবনাও লিখেছেন। যেমন তারা মানুষের সাথে মিশে যমীনের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করবে। [ইবন কাসীর] কারও কারও মতে, এখানে কিয়ামতের সময়ের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। ইবন কাসীর কারও কারও মতে, যেদিন বাঁধ নির্মান শেষ হয়েছে সেদিন ইয়াজুজ মাজুজ বাঁধের ভিতরে পরস্পর পরস্পরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। [ফাতহুল কাদীর]
[২] فَجَمَعْنَاهُم এর সর্বনাম দ্বারা সাধারণ জিন ও মানবজাতিকে বোঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার মাধ্যমে হাশরের মাঠে সমগ্র জিন ও মানুষকে একত্রিত করা হবে। [ফাতহুল কাদীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর সেদিন আমি তাদেরকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেব যে, তারা একদল আরেক দলের উপর তরঙ্গমালার মত আছড়ে পড়বে এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকে একত্র করব।
4 Muhiuddin Khan
আমি সেদিন তাদেরকে দলে দলে তরঙ্গের আকারে ছেড়ে দেব এবং শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করে আনব।
5 Zohurul Hoque
আর সেই সময়ে আমরা তাদের এক দলকে অন্য দলের সাথে যুদ্ধাভিযানে ছেড়ে দেব, আর শিঙায় ফুৎকার দেয়া হবে, তখন আমরা তাদের জমায়েৎ করব এক সমাবেশে।
6 Mufti Taqi Usmani
সে দিন আমি তাদের অবস্থা এমন করে দেব যে, তারা তরঙ্গের মত একে অন্যের উপর আছড়ে পড়বে এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকে একত্র করব।
7 Mujibur Rahman
সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দিব একের পর এক তরঙ্গের আকারে এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে; অতঃপর আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করব।
8 Tafsir Fathul Mazid
৮৩-৯৯ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা বাদশা ‘যুল-কারনাইন’ এর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যার সম্পর্কে ইয়াহূদীদের কথামত মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেছিল। সে দ্বিতীয় জিজ্ঞেসার উত্তর এটি। যুল-কারনাইন এর শাব্দিক অর্থ হল দু’ শিংবিশিষ্ট। তাঁর নাম করণের কারণ হল তাঁর মাথায় প্রকৃতপক্ষে দুটি শিং ছিল। কিংবা তিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে সূর্যের শিং বা কিরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন: তাঁর মাথায় শিঙের মত চুলের দুটি ঝুটি ছিল। তার প্রকৃত নাম নিয়েও মতামত পাওয়া যায়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: তার নাম হল আব্দুল্লাহ বিন যহহাক বিন মা‘আদ, আবার বলা হয়-আবদুল্লাহ বিন কিনান বিন আজাদ ইত্যাদি। তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশা, সৎ মু’মিন ব্যক্তি ছিলেন। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/১০২-১০৬)
সংক্ষিপ্ত ঘটনা:
‘যুল-কারনাইন’ একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশা ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পৃথিবীতে রাজত্ব ও কর্তৃত্ব দান করেছিলেন এবং তাঁকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন যে, তুমি যেখানে খুশি সেখানে ভ্রমণ করতে পারবে। তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করেছিলেন। এসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল প্রকার সাজ-সরঞ্জাম দান করা হয়েছিল। একদা একটি পথ ধরে চলতে লাগলেন, চলতে চলতে এক পর্যায়ে সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌছে গেলেন। অর্থাৎ পশ্চিম প্রান্তে, যার পরে কোন জনবসতি ছিল না। সেখানে তিনি দেখলেন যে, সূর্য কর্দমাক্ত গরম পানিতে অস্ত যাচ্ছে এবং তিনি সেখানে একটি সম্প্রদায়ের সাথে সাক্ষাত লাভ করলেন। আর তারা ছিল কুফরী আকীদা পোষণকারী সম্প্রদায়। তখন আল্লাহ তা‘আলা যুল-কারনাইনকে বললেন: হে যুল-কারনাইন! তুমি চাইলে তাদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা তাদেরকে সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।
তখন যুল-কারনাইন তাদেরকে বললেন, যে কেউ সীমালঙ্ঘন করবে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন এবং তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হয়েও কঠিন শাস্তি ভোগ করবে। আর যে ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে তাদের জন্য থাকবে কল্যাণ ও শান্তি। আর তাদের প্রতি নম্র ব্যবহার করা হবে।
অতঃপর তিনি অন্য একটি পথ ধরে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে এক পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন সূর্যোদয় স্থলে অর্থাৎ পূর্বপ্রান্তে। সেখানে গিয়ে একটি সম্প্রদায়ের সাথে সাক্ষাত লাভ করলেন যাদের জন্য সূর্যের তাপ থেকে আত্মরক্ষা করার মত কোন অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়নি। আর এ ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
অতঃপর অন্য একটি পথ ধরে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে এক পর্যায়ে দু’ পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছে গেলেন এবং সেখানে একটি সম্প্রদায়ের সাথে সাক্ষাত হল যারা তার কথা কিছুই বুঝতে পারছিল না, তারা তাঁকে ইয়া’জূজ ও মা’জূজ এর কষ্ট দেয়ার কথা জানাল এবং তারা যে জমিনে ফিতনা-ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে সে কথাও জানাল আর তাকে কর দিতে চাইল এ শর্তে যে, সে ইয়া’জূজ ও মা’জূজ এবং ঐ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি প্রাচীর তৈরী করে দেবে যাতে ইয়া’জূজ ও মা’জূজ তাদেরকে আর কষ্ট দিতে না পারে ও জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। তাদের এ দাবী শুনে যুল-কারনাইন তাদের থেকে কর নিতে রাজি হননি বরং এ প্রাচীর নির্মাণ করার জন্য তাদের সাহায্য কামনা করলেন এবং তাদেরকে বললেন, তারা যেন লৌহপিণ্ডসমূহ নিয়ে আসে। লৌহপিণ্ডসমূহ দু’ পর্বতের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে রাখার পর যখন তা দু’ পর্বতের সমান হল তখন তাদেরকে বললেন, হাঁপর গরম করার জন্য। অবশেষে যখন তা আগুনে উত্তপ্ত হয়ে গলে গেল তখন তাদেরকে তামা নিয়ে আসার জন্য বললেন এবং যুল-কারনাইন ঐ গলিত তামা ঐ লোহার প্রাচীরের ওপর ঢেলে দিলেন। এরপর ইয়া’জূজ ও মা’জূজ আর এ প্রাচীর ছেদ করতে পারেনি। এ ইয়া’জূজ ও মা’জূজ এখনো ঐ প্রাচীরে বন্দী অবস্থায় রয়েছে। তারা প্রাচীর ভাঙ্গতে পারেনি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা যখন বাস্তবায়িত হয়ে যাবে তখন তারা এ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে এবং পৃথিবীতে এসে পূর্বের মতই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।
(قُلْ سَأَتْلُوْا عَلَيْكُمْ مِّنْهُ ذِكْرًا)
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় যে, কুরআন ذكره সংক্ষিপ্ত শব্দ ছেড়ে مِّنْهُ ذِكْرًا বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটি শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কুরআন যুল-কারনাইন এর আদ্যোপান্ত কাহিনী বর্ণনা করবে না বরং তার আলোচনার একাংশ উল্লেখ করবে।
سبب এর প্রকৃত অর্থ মাধ্যম, উপকরণ, যার দ্বারা লক্ষ্য অর্জন করা যায়। এখানে অর্থ হল আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এমন কিছু মাধ্যম ও উপকরণ দান করেছেন যার দ্বারা তিনি দেশসমূহ জয় করেছেন। শত্র“দের অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেন এবং অত্যাচারী বাদশাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন।
(أَتْبَعَ سَبَبًا) অর্থাৎ তাঁকে যে সকল উপকরণ দান করা হয়েছিল তা তিনি কাজে লাগান।
عين অর্থ ঝরনা বা সমুদ্র, حمئة অর্থ কর্দম বা কাদা। অর্থাৎ যুল-কারনাইন দেশের পর দেশ জয় করে যখন পশ্চিম প্রান্তে শেষ জনপদে পৌঁছে গেলেন। সেখানে কাদাময় পানির ঝরণা বা সমুদ্র ছিল যেটা নিচে থেকে কালো মনে হচ্ছিল। তার মনে হল যেন সূর্য ঐ পানিতে অস্ত যাচ্ছে। সমুদ্র-তীর থেকে দূরে সূর্যাস্ত স্থলে পানি ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না। সেখানে যারা সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করবে তাদের মনে হবে যে সূর্য সমুদ্রেই অস্ত যাচ্ছে অথচ সূর্য মহাকাশে স্বস্থানেই অবস্থান করে।
(قُلْنَا يَذَا الْقَرْنَيْنِ)
‘আমি বললাম, ‘হে যুল-কারনাইন!’ আল্লাহ তা‘আলার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি নাবী ছিলেন।
(بَيْنَ السَّدَّيْنِ)
যে বস্তু কোন কিছুর জন্য বাধা হয়ে যায় তাকে سد বলা হয়। তা প্রাচীর হোক কিংবা পাহাড় হোক, কৃত্রিম হোক আর প্রাকৃতিক হোক। এখানে السَّدَّيْنِ বলতে দু’ পাহাড় বুঝানো হয়েছে। এগুলো ইয়া’জূজ মা’জূজের পথে বাধা ছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যবর্তী গিরিপথ দিয়ে এসে তারা আক্রমন চালাত। যুলকারনাইন এ গিরিপথটি বন্ধ করে দেন।
زبر শব্দটি زبرة এর বহুবচন। এর অর্থ পাত। এখানে লৌহখণ্ড বুঝানো হয়েছে। গিরিপথ বন্ধ করার জন্য নির্মিতব্য প্রাচীর ইট-পাথরের পরিবর্তে লোহার পাত ব্যবহার করেছেন।
قطرا শব্দের অর্থ ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরানো তামা, আলকাতরার প্রলেপ দেয়া। ق এর হরকত পরিবর্তনের কারণে অর্থেরও পরিবর্তন হয়। এখানে গলিত তামা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ লোহার পাতকে খুব গরম করে এর ওপর গলিত তামা ঢেলে দেয়ায় সে পাহাড়ী রাস্তার মাঝের প্রাচীর এত মজুবত হয়েছিল যে, ইয়া’জূজ-মা’জূজের পক্ষে তা ভেঙ্গে আসা অসম্ভব হয়ে গেল।
ইয়া’জূজ ও মা’জূজের বিবরণ:
ইয়া’জূজ ও মা’জূজ মূলত মানুষ। তারা আদম ও হাওয়ারই সন্তান। সাহাবী আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইয়া’জূজ ও মা’জূজ হচ্ছে আদম (عليه السلام)-এর সন্তান। তাদেরকে যদি সাধারণ মানব সমাজে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে তারা ওদের স্বাভাবিক জীবন যাপন বিনষ্ট করে দেবে। তাদের কেউ মরবে না যতক্ষণ না তার সন্তান-সন্ততি এক হাজার বা তার বেশিতে পৌঁছে। (মিনহাতুল মা‘বূদ ফী তারবীবি মুসনাদিত তায়ালিসী ২/২১৯.)
তাদের গঠন প্রকৃতি: তাদের গঠন বর্ণনা দিয়ে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, তাদেরকে দেখতে মোঘল তুর্কীদের মতো মনে হবে। তাদের চোখ হবে ছোট। নাক হবে ছোট ও চ্যাপটা। চুল হবে লাল-সাদা মিশ্রিত হলুদ বর্ণের। তাদের চেহারা যেন চামড়া মোড়ানো ঢালের ন্যায় তথা চওড়া ও ঝুলে পড়া গণ্ডদেশবিশিষ্ট। (নিহায়া/আল ফিতান ওয়াল মালাহিম ১/১৫৩.)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) ইবনু হারমালাহ থেকে তিনি তাঁর খালা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর খালা বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর খুৎবায় বলেন, তোমরা বলছ যে, কোন শত্র“ নেই, অথচ তোমরা ইয়া’জূজ ও মা’জূজ আসা পর্যন্ত শত্র“র মোকাবেলা করেই যাবে। যাদের চেহারা হবে প্রশস্ত। চোখ হবে ছোট, চুল হবে লাল-সাদা মিশ্রিত হলুদ বর্ণের। তারা প্রত্যেক উঁচু জায়গা থেকে দ্রুত নিচে পদার্পন করবে। তাদের চেহারা যেন চামড়া মোড়ানো ঢালের ন্যায় তথা চওড়া ও ঝুলে পড়া গণ্ডদেশবিশিষ্ট। (আহমাদ হা: ২২৩৩১.)
ইয়াজূজ ও মা’জূজের আবির্ভাবের প্রমাণসমূহ:
শেষ যুগে ইয়া’জূজ ও মা’জূজের আবির্ভাব কিয়ামতের বড় বড় আলামতগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। তাদের আবির্ভাবের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহয় প্রমাণ রয়েছে। যেমন উক্ত আয়াতগুলোতে রয়েছে।
ইয়া’জূজ ও মা’জূজ সংক্রান্ত হাদীসের সংখ্যা অনেক, যা মুতাওয়াতির পর্যায়ে চলে যাবে।
সাহাবী আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যে রাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইসরা তথা মিরাজ হয় সে রাতে তিনি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত করেন। তাঁরা সবাই তখন পরস্পর কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। তাঁরা উক্ত আলোচনার জন্য ঈসা (عليه السلام) কে আবেদন করলে তিনি দাজ্জালের হত্যার ব্যাপারে আলোচনা করার পর বলেন: এরপর মানুষ তাদের নিজ নিজ শহরে চলে যাবে। তখন হঠাৎ তাদের সম্মুখীন হবে ইয়া’জূজ ও মা’জূজ। তারা প্রত্যেক উঁচু জায়গা থেকে নিচের দিকে দ্রুত অবতরণ করবে। তারা কোন পানির পাশ দিয়ে যেতে না যেতেই তা পান করে নিঃশেষ করে ফেলবে এবং কোন বস্তুর পাশ দিয়ে যেতে না যেতেই তা ধ্বংস করে দেবে। তখন মানুষেরা আমার নিকট আশ্রয় নিলে আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করব। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মেরে ফেলবেন। তখন পুরো পৃথিবী তাদের দুর্গন্ধে গন্ধময় হয়ে যাবে। পুনরায় তারা আবারো আমার নিকট আশ্রয় নেবে। তখন আমি তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করলে আকাশ ভারী বৃষ্টি বর্ষণ করবে। অতঃপর বৃষ্টির পানি তাদের শরীরগুলোকে স্থল ভাগ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করবে। (আহমাদ ৪/১৮৯-১৯০, হাকিম ৪/৪৮৮-৪৮৯)
ইয়া’জূজ মা’জূজের প্রাচীর:
যুল-কারনাইন বাদশা উক্ত প্রাচীর নির্মাণ করেন। যাতে ইয়া’জূজ-মা’জূজ ও তাদের প্রতিবেশির মাঝে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় যারা যুল-কারনাইনের কাছে সাহায্য কামনা করছিল। যেমন আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
তবে উক্ত প্রাচীরের সঠিক স্থান এখনো কেউ নির্ণয় করতে পারেনি। কতক রাজা-বাদশা ও ঐতিহাসিকগণ সে স্থানের পরিচয় দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল আব্বাসীয় খলীফা ওয়াসিক (মৃত্যু ২৩২ হি:) কতক আমীরদেরকে সৈন্যদলসহ সে প্রাচীর দেখার জন্য প্রেরণ করেছেন যাতে তার কাছে সে প্রাচীরের বর্ণনা দিতে পারে। তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পৌঁছল এমনকি সে প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তারা দেখতে পেলো, সে প্রাচীরটি লোহা ও পিতল দিয়ে নির্মিত। তারা আরো উল্লেখ করলেন যে, সেখানে একটি বিরাট দরজা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাতে বড় বড় কয়েকটি তালা রয়েছে। তারা আরো দেখতে পেলেন, একটি দুর্গে দুধ ও মধুর অবশিষ্টাংশ রয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী বাদশার পক্ষ থেকে একজন পাহারাদার নিযুক্ত রয়েছে, যিনি সুউচ্চ ও সুঠাম দেহের অধিকারী যা পার্শ্ববর্তী পাহাড়ও তার সমান হবে না। তারপর তারা দেশে ফিরে আসলেন, তাদের ভ্রমণ ৬০ দিনের অধিক ছিল এবং তারা আরো অনেক ভয়ংকর ও আশ্চর্যজনক জিনিস দেখলেন।
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ ঘটনা তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তবে তার কোন সনদ উল্লেখ করেননি। আল্লাহ তা‘আলাই তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ভাল জানেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর ৫/১৯৩.)
অনেকে মনে করেন ইয়া’জূজ ও মা’জূজের আর্বিভাব হয়ে গেছে। মূলত তাদের আর্বিভাব এখনো হয়নি। কিয়ামতের আলামতস্বরূপ যে ইয়া’জূজ ও মা’জূজ আগমন করবে তারা শেষ যুগে আসবে। কারণ সহীহ হাদীস প্রমাণ করে তাদের আগমন ঈসা (عليه السلام)-এর অবতরণের পর হবে। তিনিই তাদের প্রতি বদদু‘আ করবেন, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করবেন। তারপর তাদেরকে সাগরে নিক্ষেপ করবেন এবং মানুষ ও জমিনকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের প্রামাণিক স্বীকৃতি পেলাম। কারণ তিনি কুরাইশদের তৃতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর দিলেন আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর দ্বারা জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।
২. প্রকৃত বিষয় জানার জন্য জ্ঞানীরা উপকরণ গ্রহণ করতে পারেন।
৩. শাসকদের উচিত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র আল্লাহ তা‘আলার বিধানানুযায়ী পরিচালনা করা।
৪. যে সকল বাদশা সারা পৃথিবী শাসন করেছেন তাদের মধ্যে যুল-কারনাইন অন্যতম।
৫. শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়া শরীয়তসম্মত।
৬. ইয়া’জূজ ও মা’জূজের অস্তিত্ব রয়েছে, এখনো তারা প্রাচীরের মধ্যে আবব্ধ।
৭. ইয়া’জূজ ও মা’জূজের আর্বিভাব কিয়ামতের আলামত, তারা প্রাচীর থেকে বের হয়ে দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে।
9 Fozlur Rahman
সেদিন আমি তাদেরকে (ইয়াজূজ ও মাজূজকে) এমন অবস্থায় ছেড়ে দেব যে, একদল আরেকদলের ওপর তরঙ্গের মত আছড়ে পড়বে। তারপর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে এবং আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করব।
10 Mokhtasar Bangla
৯৯. আমি শেষ যুগে কিছু সৃষ্টিকে অন্যের সাথে মিশ্রিত ও আলোড়িত হওয়ার সুযোগ দিবো। আর যখন সিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে তখন আমি সকল সৃষ্টিকে হিসাব ও প্রতিদানের জন্য একত্রিত করবো।
11 Tafsir Ibn Kathir
৯৭-৯৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআ’লী খবর দিতে গিয়ে বলছেন, ইয়াজুজ ও মাজুজের ক্ষমতা নেই যে, তারা ঐ প্রাচীরের উপর উঠে তা অতিক্রম করতে পারে এবং এই শক্তিও নেই যে, তাতে ছিদ্র করে ওর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। উপরে চড়া তা ভেঙ্গে দেয়া তুলনায় সহজ বলে مَااسْطَاعُوْا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষেত্রে مَااسْتَطَاعُوْا শব্দ আনয়ন করা হয়েছে। মোট কথা, তারা ঐ প্রাচীরের উপর উঠতেও পারে না এবং ওতে ছিদ্র করতেও সক্ষম নয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রত্যহ প্রাচীরটিকে খনন। করতে থাকে এবং এই পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তারা যেন সূর্যের আলো দেখেই ফেলবে। তারপর দিন অতিবাহিত হয়ে যায় এবং তাদের নেতা তাদেরকে হুকুম করেঃ “আজকের মত এখানেই শেষ কর, আগামীকাল এসে আবার ভাঙ্গা যাবে। কিন্তু পরের দিন এসে তারা ওটাকে পূর্বাপেক্ষা বেশী শক্ত পায়। কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সময় যখন তাদের বের হওয়া আল্লাহ চাবেন, তখন তারা ওটা খনন করতে করতে চোকলা বা বাকলের মত করে ফেলবে। ঐ সময় তাদের নেতা তাদেরকে বলবেঃ “এখন ছেড়ে দাও, আগামীকাল ইনশা আল্লাহ আমরা এটা ভেঙ্গে ফেলবো।" সুতরাং ইশাআল্লাহ বলার বরকতে পরের দিন যখন তারা আসবে, তখন ওটাকে যে অবস্থায় ছেড়ে গিয়েছিল ঐ অবস্থাতেই পাবে। ফলে, তৎক্ষণাৎ তারা ঐ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে ও বাইরে বেরিয়ে পড়বে। বেরিয়ে এসেই তারা সমস্ত পানি অবলেহন করবে। জনগণ ব্রিত হয়ে দূর্গে আশ্রয় নেবে। তারা তাদের তীরগুলি আকাশের দিকে ছুড়বে। তীরগুলি রক্ত মাখানো অবস্থায় তাদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। তারা তখন বলবেঃ আকাশবাসীদের উপরও আমরা বিজয় লাভ করেছি। অতঃপর তাদের ঘাড়ে গুটি বের হবে এবং সবাই আল্লাহর হুকুমে ঐ প্লেগেই ধ্বংস হয়ে যাবে। যার হাতে মুহাম্মদের (সঃ) প্রাণ রয়েছে তার শপথ! তাদের দেহ ও রক্ত হবে জন্তুরখাদ্য, যার ফলে তারা খুব মোটা তাজা হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। সুনানে ইবনু মাজাহতেও এ রিওয়াইয়াতটি রয়েছে। ইমাম তিরমিযীও (রঃ) এটা আনয়ন করেছেন এবং বলেছেন যে, এ রিওয়াইয়াতটি গারীব। এর সনদ খুব মজবুত)
কা’ব আহ্বার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ইয়াজুজ-মাজুজ দৈনিক প্রাচীরটিকে চাটতে থাকে এবং ওটাকে একেবারে ছালের মত করে দেয়। তারপর তারা পরস্পর বলাবলি করেঃ “আজ চলো, আগামীকাল এটা ভেঙ্গে দেবো।" কিন্তু পরের দিন এসে দেখতে পায় যে, ওটা পূর্বে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে অর্থাৎ আসল অবস্থাতেই ফিরে গেছে। অবশেষে তাদের উপর আল্লাহর ইলহাম হবে এবং তারা যাওয়ার সময় ইনশা-আল্লাহ বলে ফেলবে। সুতরাং তারা ওটাকে গত দিন যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিল ঐ অবস্থাতেই পাবে। কাজেই তারা ওটা ভেঙ্গে ফেলবে। (খুব সম্ভব এই কা'ব (রাঃ) থেকেই হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এটা শুনে থাকবেন এবং তা বর্ণনা করে থাকবেন। তারপর কোন বর্ণনাকারী ধারণা বশতঃ এটাকে রাসূলুল্লাহর (সঃ) উক্তি মনে করে মারফুরূপে বর্ণনা করে দিয়েছেন। এ সব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী) আমরা যে এটা বর্ণনা করলাম এর পৃষ্ঠপোষকতা ঐ হাদীস দ্বারাও হয় যা মুসনাদে আহমাদে রয়েছে। হাদীসটি হলোঃ নবীর (সঃ) স্ত্রী হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, একদা নবী (সঃ) ঘুম হতে জাগ্রত। হন। তাঁর চেহারা মুবারক রক্তিম বর্ণ ধারণ করছিল এবং তিনি বলতে ছিলেনঃ “লাইলাহা ইল্লাল্লাহ! আরবের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার সময় নিকটবর্তী হয়েছে। আজ ইয়াজুজ ও মাজুজের প্রাচীরে এই পরিমাণ ছিদ্র হয়ে গেছে।” অতঃপর তিনি স্বীয় অঙ্গুলীগুলি দ্বারা বৃত্ত করে তা দেখিয়ে দিলেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) ! আমাদের মত ভাল লোকগুলি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কি ধ্বংস করে দেয়া হবে?" উত্তরে তিনি বলেনঃ “হাঁ যখন খারাপ ও কলুষিত লোকদের সংখ্যা বেশী হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম উভয় গ্রন্থেই এটা বর্ণিত হয়েছে। তবে সহীহ বুখারীতে বর্ণনাকারীদের তালিকায় হযরত উম্মে হাবীবার (রাঃ) উল্লেখ নেই। শুধু সহীহ মুসলিমে রয়েছে। এর সনদে এ ধরনের আরো অনেক কথা রয়েছে যা খুবই কম পাওয়া গেছে। যেমন যুহরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন উরওয়া (রাঃ) হতে। অথচ এ দুজন মনীষী হলেন তাবেয়ী। আবার চারজন মহিলা একে অপর হতে বর্ণনা করেছেন এবং তারা চারজনই সাহাবিয়্যাহ (রাঃ)। তাঁদের মধ্যে দুজন আবার নবীর (সঃ) স্ত্রীর কন্যা এবং বাকী দু’জন তার স্ত্রী! মুসনাদে বায্যারেও এই রিওয়াইয়াতটি হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে)
ঐ প্রাচীরের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করে ফুলকারনাইন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এবং মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেনঃ “এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ যে, তিনি দুষ্টদের দুষ্টামী হতে সৃষ্টজীবকে নিরাপত্তা দান করলেন। তবে যখন তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়ে যাবে তখন তিনি ওকে চুর্ণবিচর্ণ করে ফেলবেন। তখন এর দৃঢ়তা কোনই কাজে আসবে না। উষ্টীর ঔজ যখন ওর পিঠের সাথে সমানভাবে মিলে থাকে, উঁচু হয়ে থাকে না তখন আরববাসী ওকে ناقة دكاء বলে থাকে। অন্য আয়াতে রয়েছে যে, যখন হযরত মূসার (আঃ) সামনে আল্লাহ তাআলা পাহাড়ের উপর ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করেন তখন ঐ পাহাড় যমীনের সমান হয়ে যায়। সেখানেও جعله دكا শব্দ রয়েছে। সুতরাং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ঐ প্রাচীরটিও চূর্ণ বিচূর্ণ। হয়ে যাবে এবং ইয়াজুজ ও মাজুজের বের হবার পথ বেরিয়ে পড়বে। আল্লাহ তাআ'লার ওয়াদা অটল ও সত্য। কিয়ামতের আগমনও সত্য। ঐ প্রাচীর ভাঙ্গা মাত্রই ইয়াজুজ-মাজুজ বেরিয়ে পড়বে এবং জনগণের মধ্যে ঢুকে পড়বে। আপন পরের কোন পার্থক্য থাকবে না। এই ঘটনা দাজ্জালের আগমনের পর কিয়ামত সংঘটনের পূর্বে ঘটবে। এর পূর্ণ বর্ণনা حَتّٰۤى اِذَا فُتِحَتْ یَاْجُوْجُ وَ مَاْجُوْجُ وَ هُمْ مِّنْ كُلِّ حَدَبٍ یَّنْسِلُوْنَ (২১:৯৬)
এই আয়াতের তাফসীরে আসবে ইনশা আল্লাহ। এরপরে শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং সবাই একত্রিত হয়ে যাবে। একথাও বলা হয়েছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ কিয়ামতের দিন মানব ও দানব সবাই মিশ্রিত হয়ে যাবে।
তাফসীরে ইবনু জারীরে বানু খুযায়া গোত্রের একজন শায়েখের বর্ণনা রয়েছে যে, দানব ও মানব যখন পরস্পর মিলিত হয়ে যাবে, তখন ইবলীস বলবেঃ “আমি যাচ্ছি এবং ব্যাপার কি তা জেনে আসছি।” অতঃপর সে পূর্ব দিকে পালাবে। কিন্তু সেখানে ফেরেশতাদের দল দেখে সে থমকে দাড়াবে এবং ফিরে গিয়ে পশ্চিম দিকে যাবে। সেখানেও ঐ একই অবস্থা দেখে ডানে-বামে পালাবে। কিন্তু চতুর্দিকেই ফেরেশতাদের পরিবেষ্টন দেখে নিরাশ হয়ে গিয়ে চীৎকার শুরু করে দেবে। অকস্মাৎ একটা ছোট রাস্তা তার দৃষ্টি গোচর হবে। তখন সে তার সমস্ত সন্তানদেরকে নিয়ে ঐ পথ ধরে চলতে থাকবে। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখবে যে, দুযখের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। জাহান্নামের একজন দারোগা তাকে বলবেঃ “ওরে কষ্টদায়ক কলুষিত শয়তান! আল্লাহ তাআলা কি তোর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন না? তুই কি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলি ?” সে উত্তরে বলবেঃ “আজ শাসন-গর্জন করছো কেন? আজ পরিত্রাণের পথ বাতলিয়ে দাও। আমি আল্লাহ তাআলার ইবাদতের জন্যে প্রস্তুত রয়েছি। যদি আল্লাহর হুকুম হয় তবে আমি এমন ইবাদত করবো যা ভূ-পৃষ্ঠে কেউ কখনো করে নাই।” তরি এ কথা শুনে দারোগা বলবেনঃ “আল্লাহ তাআলা তোর জন্যে একটা নির্দেশনামা নির্ধারণ করছেন।”সে তখন খুশী হয়ে বলবেঃ “ আমি তার হুকুম পালনের জন্যে সর্বপ্রকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।” তখন হুকুম দেয়া হবেঃ “ঐ নির্দেশনামা এটাই যে, তোরা সবাই জাহান্নামে চলে যা।” এই কলুষিত শয়তান তখন হতভম্ব হয়ে পড়বে। সেখানে ফেরেশতা নিজের পালক দ্বারা তাকে ও তার সন্তানদেরকে ছেচড়াতে ছেচড়াতে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। জাহান্নাম তাদেরকে নিয়ে এমনভাবে তর্জন গর্জন করতে থাকবে যে, সমস্ত নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতা, সমস্ত রাসূল হাঁটুর ভরে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর সামনে পড়ে যাবেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “ইয়াজুজ-মাজুজ হযরত আদমের (আঃ) বংশধর। যদি তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয় তবে তারা মানুষের জীবিকার উপর ফাসাদ সৃষ্টি করবে। তাদের এক একজন নিজের পিছনে হাজার জন ছেড়ে মারা যায়, বরং এর চেয়েও বেশী। এদের ছাড়া আরো তিনটি দল রয়েছে। তারা হলোঃ তাভীল, তায়েস ও মানসক।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা গারীব এমন কি অস্বীকার্য ও দুর্বল)
আউস ইবনু আবি আউস (রাঃ) হতে মার’ রূপে বর্ণিত আছে যে, ইয়াজুজ ও মাজুজের স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে রয়েছে। এক একজন নিজের পিছনে হাজার বা তারও বেশী রেখে মারা যায়। (এ হাদীসটি সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে)
মহান আল্লাহ বলেনঃ শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। হাদীসে আছে যে, ওটা একটা যুগ যাতে শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। ফুকারদাতা হবেন হযরত ইসরাফীল (আঃ)। যেমন এটা প্রমাণিত। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কি করে আমি শান্তিতে ও আরামে বসে থাকতে পারি? অথচ শিংগার অধিকারী ফেরেশতা শিংগা মুখে লাগিয়ে, কপাল কুঁকিয়ে এবং কান খাড়া করে বসে রয়েছেন যে, কখন আল্লাহর নির্দেশ হবে এবং তিনি শিংগায় ফুৎকার দিবেন।” জনগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “তাহলে আমরা কি বলবো?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “তোমরা বলোঃ حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ عَلَى اللهِ تَوَكَّلْنَا অর্থাৎ “আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতইনা উত্তম কার্য নির্বাহক! আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করেছি।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করবো। অর্থাৎ তিনি সকলকেই হিসাবের জন্যে জমা করবেন। সবারই হাশর তাঁর সামনে হবে। যেমন সূরায়ে ওয়াকেআ’য় রয়েছেঃ قُلْ اِنَّ الْاَوَّلِیْنَ وَ الْاٰخِرِیْنَ ـ لَمَجْمُوْعُوْنَ اِلٰى مِیْقَاتِ یَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)!) তুমি বলে দাওঃ পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণ, সকলকে সমবেত করা হবে, এক স্থীরিকৃত দিবসে নির্দিষ্ট সময়ে।” (৫৬:৪৯) আর এক জায়গায় আছেঃ وَحَشَرْنٰهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ اَحَدًا অর্থাৎ “আমি সকলকেই একত্রিত করবো এবং তাদের একজনকেও অবশিষ্ট ছেড়ে দেবো না।" (১৮:৪৭)