৪১-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর মূর্তিপূজক বাবাকে যেভাবে তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছিলেন সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি যেন তার উম্মাতের নিকট ইবরাহীম (عليه السلام)-এর দৃষ্টান্ত পেশ করেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী নাবী। صِدِّيْقًا শব্দটি صدق থেকে উ™ূ¢ত, অর্থ হল অত্যন্ত বা পরম সত্যবাদী। যিনি কথায় ও কাজে কোন বিপরীত করেন না। সর্বদা সত্য কথা বলেন।
ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতাকে মূর্তিপূজো করার কারণে কোন কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেননি; বরং নম্র ভাষায় বললেন, হে আমার পিতা! আপনি কেন এমন কিছুর ইবাদত করেন, যে কোন কিছু শোনে না, দেখে না বরং কোন উপকারও করতে পারে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (عليه السلام) এর কথা তুলে ধরে বলেন: (إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِه۪ مَا تَعْبُدُوْنَ) “সে যখন তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা কিসের ইবাদত কর?’’ (সূরা শুয়ারা ২৬:৭০)
তিনি আরো বললেন, হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। অতএব আপনি আমার অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করব। অতঃপর তিনি বললেন: হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করবেন না। শয়তান দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য; তাই তার আনুগত্য করে কেউ মুক্তি পাবে না।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اَلَمْ اَعْھَدْ اِلَیْکُمْ یٰبَنِیْٓ اٰدَمَ اَنْ لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَﺆ اِنَّھ۫ لَکُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ)
“আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি হে বানী আদম! তোমরা শয়তানের ইবাদত কর না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৬০)
এরপর ইবরাহীম (عليه السلام) আবার তাঁর পিতাকে বললেন: হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, আপনি যদি এ শির্ক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তাহলে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে, ফলে আপনি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবেন। অতএব আপনি সতর্ক হোন।
ইবরাহীম (عليه السلام)-এর এ দাওয়াতে পিতা উত্তর দিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার মা‘বূদ হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ। যদি তুমি তোমার এরূপ কাজ থেকে নিবৃত্ত না হও তাহলে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমাকে শেষ করে দেব। অতএব তুমি আমার সম্মুখ হতে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও। পৃথিবীতে এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে যেখানে ছেলে বাবাকে কল্যাণ ও মুক্তির দিকে আহ্বান করছে সেখানে নিজের সন্তানকে বাবা হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে। ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতার এ ধরণের কথা শুনেও রাগান্বিত হননি এবং আল্লাহ তা‘আলার গযব কামনা করেননি, বরং তিনি আরো নম্রভাবে বললেন: আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।
এ সালাম বলতে মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমদের দেখে যে সালাম দেয় তা উদ্দেশ্য নয়, বরং কারো সাথে বা অজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে কথা-কাটাকাটি হলে সুন্দর করে বিদায় জানানো। যেমন সূরা ফুরকানের ৬৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
(سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّيْ)
‘আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব’ ইবরাহীম (عليه السلام) এর এ ক্ষমা প্রার্থনা ঐ সময় ছিল যখন মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। অতঃপর যখন তিনি জানতে পারলেন তখন সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাওবার ১১৪ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
আমি আমার পালনকর্তার নিকট আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি দয়াবান। আর আমি পরিত্যাগ করছি আপনাদেরকে এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত আপনারা যার ইবাদত করে থাকেন তাদেরকেও। আমি আমার পালনকর্তাকে আহ্বান করব। আমি আমার পালনকর্তাকে আহ্বান করে বঞ্চিত হব না।
অর্থাৎ যখন ইবরাহীম (عليه السلام) পিতা, স্বজন ও স্বদেশ ছেড়ে চলে এলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব (عليه السلام)-কে দান করলেন। যাতে তাদের আদর-স্নেহে পিতাকে ছেড়ে আসার শোক ভুলে থাকতে পারেন।
সুতরাং একজন আল্লাহ তা‘আলার পথে আহ্বানকারী কাফির-মুশরিকদের আহ্বান করবেন শালীন ভাষায় ও নম্র-ভদ্র আচরণে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত অন্য কোন বাতিল মা‘বূদের ইবাদত করা যাবে না।
২. দীনের তাবলীগ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে। অধৈর্য হলে চলবে না।
৩. মানুষকে নম্রভাষায় দাওয়াত দিতে হবে। যেমন ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতাকে দিয়েছেন।
৪. মানুষ দাওয়াত গ্রহণ না করলে তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। বরং তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে হবে তাকে হিদায়াত দান করার জন্য।
৫. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।