হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার পথে ব্যয়কারীদের সম্বন্ধে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় (সহীহ বুখারী)। মনীষীগণও এই আয়াতের তাফসীরে একথাই বলেছেন। হযরত আবু ইমরান (রঃ) বর্ণনা করেন যে, মুহাজিরগণের একব্যক্তি কনস্টান্টিনোপলের যুদ্ধে কাফিরদের সৈন্য বাহিনীর উপর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ চালান এবং তাদের ব্যুহ ভেদ করে শত্রু সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে পড়েন। তখন কতকগুলো লোক পরস্পর বলাবলি করে, দেখ! এই ব্যক্তি স্বীয় হস্তদ্বয় ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করছে।' হযরত আবু আইউব (রঃ) একথা শুনে বলেনঃ “এই আয়াতের সঠিক ভাবার্থ আমরাই ভাল জানি। জেনে রেখো যে, এই আয়াতটি আমাদের সম্বন্ধেই অবতীর্ণ হয়। আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহচর্যে থেকেছি, তার সাথে যুদ্ধ জিহাদেও অংশগ্রহণ করেছি এবং সদা তার সাহায্যের কাজেই থেকেছি। অবশেষে ইসলাম বিজয়ীর বেশে প্রকাশিত হয় এবং মুসলমানেরা জয় লাভ করে। তখন আমরা আনসারগণ একদা একত্রিত হয়ে এই পরামর্শ করি যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবীর (সঃ) সাহচর্যের মাধ্যমে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। আমরা তাঁর সেবার কার্যে নিযুক্ত থেকেছি এবং তার সাথে যুদ্ধে যোগদান করেছি। এখন আল্লাহর ফলে ইসলাম বিস্তারলাভ করেছে, মুসলমানগণ বিজয়ী হয়েছেন এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। এতদিন ধরে না আমরা আমাদের সন্তানাদির খবরা-খবর নিতে পেরেছি, না মাল-ধন, জমি-জমা ও বাগ-বাগিচার দেখাশুনা করতে পেরেছি। সুতরাং এখন আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া উচিত। তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। সুতরাং জিহাদ ছেড়ে দিয়ে ছেলে-মেয়ে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি মনোযোগ দেয়া যেন নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ারই শামিল। (সুনান-ই-আবু দাউদ, তিরমিযী, সুনান-ই-নাসায়ী ইত্যাদি)। অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, কনস্টান্টিনোপলের যুদ্ধের সময় মিশরীয়দের নেতা ছিলেন হযরত উকবা বিন আমের এবং সিরীয়দের নেতা ছিলেন হযরত ইয়াযীদ বিন ফুযালাহ বিন উবাইদ। হযরত বারা' বিন আযীব (রাঃ) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেনঃ যদি আমি একাকী শত্রু সারির মধ্যে ঢুকে পড়ি এবং তথায় শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ি ও নিহত হয়ে যাই তবে কি এই আয়াত অনুসারে আমি নিজের জীবনকে নিজেই ধ্বংসকারীরূপে পরিগণিত হবো: তিনি উত্তরে বলেনঃ না না; আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেনঃ فَقَاتِلْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ لَا تُكَلَّفُ اِلَّا نَفْسَكَ
অর্থাৎ “(হে নবী সঃ!) তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, তুমি শুধু তোমার জীবনেরই মালিক; সুতরাং শুধুমাত্র তোমার জীবনকেই কষ্ট দেয়া হবে।' বরং ঐ আয়াতটি তো তাদেরই ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল যারা আল্লাহ তাআলার পথে খরচ করা হতে বিরত রয়েছিল (তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই ইত্যাদি)।
জামেউত্ তিরমিযীর অন্য একটি বর্ণনায় এটুকু বেশীও রয়েছে যে, মানুষের পাপের উপর পাপ কাজ করে যাওয়া এবং তওবা না করাই হচ্ছে নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংস করা। মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমের মধ্যে রয়েছে যে, মুসলমানগণ দামেস্ক অবরোধ করেন। ইদিশনাওআহ্' নামক গোত্রের এক ব্যক্তি বীরত্ব দেখিয়ে শত্রুদের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তাদের ব্যুহ ভেদ করে ভিতরে চলে যায়। জনগণ তাকে খারাপ মনে করে এবং হযরত আমর বিন আল আসের (রাঃ) নিকট অভিযোগ পেশ করে। হযরত আমর (রাঃ) তাকে ডেকে নেন এবং বলেনঃ কুরআন মাজীদের মধ্যে রয়েছে-‘নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।' হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন ‘যুদ্ধের মধ্যে এইরূপ বীরত্ব দেখানো জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করা নয় বরং আল্লাহর পথে মাল খরচ না করাই হচ্ছে ধ্বংসের মধ্যে পতিত হওয়া। হযরত যহ্হাক বিন আবু জাবিরাহ (রঃ)বলেন যে, আনসারগণ নিজেদের ধন-মাল আল্লাহ তাআলার পথে খরচ করতে থাকতেন। কিন্তু এই বছর দুর্ভিক্ষ হওয়ায় তারা খরচ হতে বিরত থাকেন। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। হযরত ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে কার্পণ্য করা। হযরত নুমান বিন বাশীর (রঃ) বলেন যে, পাপীদের আল্লাহর দয়া হতে নিরাশ হওয়াই হচ্ছে ধ্বংস হওয়া। আর মুফাসসিরগণও বলেন যে, পাপ করার পর ক্ষমা হতে নিরাশ হয়ে গিয়ে পুনরায় পাপ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়াই হচ্ছে স্বীয় হস্তগুলোকে ধ্বংস করা।
تهلكه শব্দের ভাবার্থ আল্লাহর শাস্তিও বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত কারাযী। (রঃ) প্রভৃতি মনীষী হতে বর্ণিত আছে যে, জনগণ রাসূলুল্লাহ (স)-এর সাথে যুদ্ধে যেতো এবং সাথে কোন খরচ নিয়ে যেতো না। তখন হয় তারা ক্ষুধায় মারা যাবে না হয় তাদের বোঝা অন্যদের ঘাড়ে চেপে বসবে। তাই এই আয়াতে তাদেরকে বলা হচ্ছে-আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন। তা হতে তাঁর পথে খরচ কর এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না। যে ক্ষুধা পিপাসায় বা পায়ে হেঁটে হেঁটে মরে যাবে। এর সাথে সাথে যাদের কাছে কিছু রয়েছে তাদেরকেও নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তোমরা মানুষের হিতসাধন করতে থাকো তাহলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে ভালবাসবেন। তোমরা পুণ্যের প্রত্যেক কাজে খরচ করতে থাকো। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় আল্লাহর পথে খরচ করা হতে বিরত থেকো না, এটা প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরই ধ্বংস টেনে আনবে। সুতরাং হিতসাধন করা হচ্ছে বড় রকমের আনুগত্য যার নির্দেশ এখানে হচ্ছে যে, হিতসাধনকারীগণ আল্লাহ তা'আলার বন্ধু।