আল বাকারা আয়াত ৪৩
وَاَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ ( البقرة: ٤٣ )
Wa aqeemus salaata wa aatuz zakaata warka'oo ma'ar raaki'een (al-Baq̈arah ২:৪৩)
English Sahih:
And establish prayer and give Zakah and bow with those who bow [in worship and obedience]. (Al-Baqarah [2] : 43)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তোমরা নামায কায়িম কর, যাকাত দাও এবং রুকূ‘কারীদের সঙ্গে রুকূ‘ কর। (আল বাকারা [২] : ৪৩)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
তোমরা যথাযথভাবে নামায পড় ও যাকাত দাও এবং নামাযীদের সঙ্গে নামায আদায় কর।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও যাকাত দাও এবং রুকূ’কারীদের সাথে রুকূ করো [১]।
[১] হাসান বলেন, সালাত এমন এক ফরয যা না পাওয়া গেলে অন্য কোন আমলই কবুল করা হয় না। অনুরূপভাবে যাকাতও। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আয়াতে বর্ণিত রুকূ’ এর শাব্দিক অর্থ ঝুঁকা বা প্রণত হওয়া। এ অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এ শব্দ সিজদার স্থলেও ব্যবহৃত হয়। কেননা, সেটাও ঝুঁকারই সর্বশেষ স্তর। কিন্তু শরীআতের পরিভাষায় ঐ বিশেষ ঝুঁকাকে রুকূ’ বলা হয়, যা সালাতের মধ্যে প্রচলিত ও পরিচিত। আয়াতের অর্থ এই যে, রুকূ’কারীগণের সাথে রুকূ কর। এখানে প্রণিধানযোগ্য এই যে, সালাতের সমগ্ৰ অংগ-প্রত্যংগের মধ্যে রুকূ’কে বিশেষভাবে কেন উল্লেখ করা হলো? উত্তর এই যে, এখানে সালাতের একটি অংশ উল্লেখ করে গোটা সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন, কুরআনুল কারীমের এক জায়গায় (وَقُرْاٰنَ الْفَجْرِ) ‘ফজর সালাতের কুরআন পাঠ' বলে সম্পূর্ণ ফজরের সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া হাদীসের কোন কোন রেওয়াতে ‘সিজদা’ শব্দ ব্যবহার করে পূর্ণ এক রাকাআত বা গোটা সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এর মর্ম এই যে, সালাত আদায়কারীগণের সাথে সালাত আদায় কর। অর্থাৎ "রুকূ’কারীদের সাথে শব্দদ্বয়ের দ্বারা জামা'আতের সাথে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।
4 Muhiuddin Khan
আর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়।
5 Zohurul Hoque
আর তোমরা নামায কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো, আর রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।
6 Mufti Taqi Usmani
এবং তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর ও রুকূ‘কারীদের সাথে রুকূ‘ কর।
7 Mujibur Rahman
আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠিত কর ও যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।
8 Tafsir Fathul Mazid
৪০ হতে ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি, জান্নাতে বসবাস, অপরাধের কারণে দুনিয়াতে প্রেরণের আলোচনা করার পর বানী ইসরাঈলের ওপর তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ও দয়ার আলোচনা শুরু করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “হে বানী ইসরাঈল” বানী ইসরাঈল দ্বারা উদ্দেশ্য ইয়া‘কূব (আঃ)-এর বংশধর। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সকল দলকে যারা মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এবং পরবর্তীতে যারা এসেছে সকলকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহকে স্মরণ কর। এখানে স্মরণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরে স্বীকার করা, মুখে প্রশংসা করা। আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা কাজে পরিণত করা। (তাফসীরে সা‘দী: ২৮)
نِعْمَةُ اللّٰهِ বা আল্লাহর নেয়ামত দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত পেশ করেছেন।
আল্লামা শানক্বিতী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوٰي)
“আর আমি তোমাদের ওপর মেঘমালার ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের প্রতি ‘মান্না’ও ‘সালওয়া’অবতীর্ণ করেছিলাম।”(সূরা বাকারাহ ২:৫৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاِذْ نَجَّیْنٰکُمْ مِّنْ اٰلِ فِرْعَوْنَ یَسُوْمُوْنَکُمْ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ یُذَبِّحُوْنَ اَبْنَا۬ءَکُمْ وَیَسْتَحْیُوْنَ نِسَا۬ءَکُمْﺚ وَفِیْ ذٰلِکُمْ بَلَا۬ئٌ مِّنْ رَّبِّکُمْ عَظِیْمٌﮀوَاِذْ فَرَقْنَا بِکُمُ الْبَحْرَ فَاَنْجَیْنٰکُمْ وَاَغْرَقْنَآ اٰلَ فِرْعَوْنَ وَاَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ)
“আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের সম্প্রদায় হতে মুক্ত করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করত ও তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যাগণকে জীবিত রাখত এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের জন্য মহাপরীক্ষা ছিল। এবং যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে (সেখান থেকে) উদ্ধার করেছিলাম। আর ফিরাউনের স্বজনবৃন্দকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম এমতাবস্থায় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।”(বাকারাহ ২:৪৯-৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنُرِیْدُ اَنْ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِی الْاَرْضِ وَنَجْعَلَھُمْ اَئِمَّةً وَّنَجْعَلَھُمُ الْوٰرِثِیْنَﭔﺫوَنُمَکِّنَ لَھُمْ فِی الْاَرْضِ وَنُرِیَ فِرْعَوْنَ وَھَامٰنَ وَجُنُوْدَھُمَا مِنْھُمْ مَّا کَانُوْا یَحْذَرُوْنَ)
“আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট হতে তারা আশঙ্কা করত।”(সূরা কাসাস ২৮:৫-৬)
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ ও আবূল আলিয়া (রহঃ) এ কথা বলেছেন। (আযউয়াউল বায়ান, ১/ ৮১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশুরার দিবসে সিয়াম পালন করছে। তখন তিনি বললেন, এ দিনে তোমরা সিয়াম পালন কর কেন? তারা বলল, এ কল্যাণময় দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“দের কবল হতে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে মূসা (আঃ) সে দিনটি শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছেন (আমরাও তার অনুরসণ করে সিয়াম পালন করছি)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা আমিই মূসার ব্যাপারে অধিক হকদার। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম রাখলেন এবং সিয়াম রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০০৪, সহীহ মুসলিম হা: ১১৩০)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের উদ্দেশ্য হল, মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে যেমন বলেছিলেন:
(یٰقَوْمِ اذْکُرُوْا نِعْمَةَ اللہِ عَلَیْکُمْ اِذْ جَعَلَ فِیْکُمْ اَنْۭبِیَا۬ئَ وَجَعَلَکُمْ مُّلُوْکًا ﺠ وَّاٰتٰٿکُمْ مَّا لَمْ یُؤْتِ اَحَدًا مِّنَ الْعٰلَمِیْنَ)
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্য হতে নাবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে শাসক করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়াছিলেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:২০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সে কৃত ওয়াদা হল আল্লাহ তা‘আলাও, তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর তবে আমিও তোমাদেরকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেব। আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার হল, তাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া, দুনিয়াতে রহমত ও পরকালে নাজাত দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মাঝে যে ওয়াদাসমূহ হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদায় উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اَخَذَ اللہُ مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺆ وَبَعَثْنَا مِنْھُمُ اثْنَیْ عَشَرَ نَقِیْبًاﺚ وَقَالَ اللہُ اِنِّیْ مَعَکُمْﺚ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلٰوةَ وَاٰتَیْتُمُ الزَّکٰوةَ وَاٰمَنْتُمْ بِرُسُلِیْ وَعَزَّرْتُمُوْھُمْ وَاَقْرَضْتُمُ اللہَ قَرْضًا حَسَنًا لَّاُکَفِّرَنَّ عَنْکُمْ سَیِّاٰتِکُمْ وَلَاُدْخِلَنَّکُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِھَا الْاَنْھٰرُﺆ فَمَنْ کَفَرَ بَعْدَ ذٰلِکَ مِنْکُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَا۬ئَ السَّبِیْلِ)
“আর আল্লাহ তো বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে হতে বার জন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়িম কর, যাকাত দাও এবং আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করবে এবং নিশ্চয় তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে তো সরল পথ হারাবে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১২)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথ নির্দেশনা দিয়ে বলেন: তোমরা আমাকে ভয় কর! অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরো বিশেষভাবে এমন নির্দেশ দিচ্ছেন যা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং সঠিক হবে না, তা হল “আমি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা তার প্রতি ঈমান আন” অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনুল কারীমের প্রতি ঈমান আন।
(مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ)
‘তোমাদের সাথে যা আছে তা তাঁরই সত্যতা প্রমাণকারী’অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ কুরআন তোমাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থনকারী, তার পরিপন্থী নয়।
অতএব যেহেতু কুরআন তোমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে তার সমর্থনকারী তাহলে তার প্রতি ঈমান আনায় তোমাদের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই নিয়ে এসেছেন যা অন্যান্য নাবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। অতএব তোমরাই তার প্রতি ঈমান আনার অধিক হকদার। কারণ তোমরা হলে কিতাবপ্রাপ্ত। আর যদি তোমরা তার প্রতি ঈমান না আন, তাহলে তোমাদের নিকট যা আছে তা মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। কেননা তিনি যা নিয়ে এসেছেন অন্যান্য নাবীরাও তা-ই নিয়ে এসেছেন। অতএব তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হল তোমাদের নিকট যা আছে তাকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
( وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍۭ بِۭه۪)
‘এতে তোমরাই প্রথম অবিশ্বাসী হয়ো না’এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা তাঁর প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। কারণ তোমাদের নিকট এমন জ্ঞান আছে যা অন্যদের নিকট নেই।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তোমরা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। এরূপ বলেছেন হাসান বসরী, সুদ্দী, রাবী বিন আনাস।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কথা হল, তোমরা কুরআনের প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ১৯৯)
আহলে কিতাবদেরকে এ কথা বলার কারণ হল, তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মুহাম্মাদ ও কুরআনের ব্যাপারে জ্ঞান ছিল, তাই তারাই যদি প্রথম অস্বীকারকারী হয় তাহলে যাদের কিতাব দেয়া হয়নি তারা কখনোই ঈমান আনবে না।
(وَلَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا)
‘আর আমার আয়াতসমূহের পরিবর্তে সামান্য মূল্য গ্রহণ কর না’এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম সুদ্দী বলেন: এর ভাবার্থ হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে অল্প মূল্য গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট তাবেয়ী রাবী বিন আনাস এবং আবুল আলিয়া বলেন: আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ কর না।
সঠিক কথা হল বানী ইসরাঈলরা যেন আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলের সত্যতার স্বীকার পরিত্যাগ না করে। যদিও এর বিনিময়ে সারা দুনিয়াও তারা পেয়ে যায়। আখিরাতের তুলনায় তা অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। স্বয়ং এটা তাদের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَي بِهِ وَجْهُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে বিদ্যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা যদি কেউ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করে তবে সে কিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ হা: ২৫২ সহীহ)
এর অর্থ এমন নয় যে, কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়। বরং শিক্ষা গ্রহণ করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তবে তা শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নির্ধারিত মজুরী নিয়ে একটি সাপে কাটা রোগীকে কুরআন দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছেন। এ ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি হকদার। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৫, ৫৭৩৭)
অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মহিলা সাহাবীর সাথে অপর সাহাবীকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে বলেছেন: তোমার সাথে এই নারীর বিয়ে দিলাম এ মোহরের বিনিময়ে যে, তোমার যতটুকু কুরআন মাজীদ মুখস্ত আছে তা তুমি তাকে মুখস্ত করিয়ে দেবে।
অতএব ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয়ের বিনিময় নেয়া বৈধ। শিক্ষক যেন সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং স্বীয় প্রয়োজনাদি পূরণ করতে পারে এজন্য বায়তুল মাল হতে গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ। যদি বায়তুল মাল হতে কিছুই পাওয়া না যায় এবং বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার কারণে অন্য কাজ করার সুযোগ না পান তবে তার জন্য বেতন নির্ধারণ করাও বৈধ।
ইমাম মালিক, শাফিঈ, আহমাদ বিন হাম্বাল ও জমহুর উলামার এটাই মতামত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদেরকে নিষেধ করে বলছেন- “তোমরা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ কর না এবং সত্য গোপন কর না।”
আল্লাহ তা‘আলা সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও সত্য গোপন উভয়কে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের কাছে এটাই কামনা।
তাই যারা এ সত্যকে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ও গোপন করবে না তারাই নাবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ও উম্মাতের পথপ্রদর্শক। পক্ষান্তরে এর বিপরীত যারা করে তারাই হল জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সালাত কায়িম ও যাকাত প্রদান ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
(وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِيْنَ)
“এবং রুকুকারীদের সাথে রুকূ কর”আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে।
এ ব্যাপারে হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব তাগিদ দিয়ে বলেন: আমার ইচ্ছা হয় কতক যুবকদের নির্দেশ দিই তারা কিছু কাঠ একত্রিত করুক, তারপর ঐ সকল ব্যক্তিদের বাড়িতে যাই যারা বিনা কারণে বাড়িতে সালাত আদায় করেছে, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৬৫১.)
এ কঠিন নির্দেশমূলক কথা হতে প্রমাণিত হয় যে, সুস্থ পুরুষদের জামাতে সালাত আদায় করা অপরিহার্য বিষয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলছেন, এ কথার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে, রাসূলের সাথে সালাত আদায়, রাসূলের কাছে যাকাত প্রদান ও উম্মাতে মুহাম্মাদীর সাথে রুকু করার নির্দেশ প্রদান করছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরীয়া করা ওয়াজিব।
২. ওয়াদা পূর্ণ করা ওয়াজিব, বিশেষ করে বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যে সব ওয়াদা হয়েছে।
৩. সত্য বিষয় বর্ণনা করা ওয়াজিব এবং তা গোপন করা হারাম।
৪. জ্ঞানার্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
৫. কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ, তবে তা যেন মূল লক্ষ্য না হয়।
৬. হকের সাথে বাতিল মিশ্রণ করা হারাম।
9 Fozlur Rahman
আর নামায আদায় করো, যাকাত দাও ও রুকুকারীদের সাথে রুকু করো (দলবদ্ধভাবে নামায পড়)।
10 Mokhtasar Bangla
৪৩. আর তোমরা রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নতসহ পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায় করো। উপরন্তু তোমাদের অধীনে থাকা সম্পদগুলোর যাকাত দাও। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উম্মতদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর সামনে বিনয়ী হয় তাদের মতো তোমরাও তাঁর সামনে বিনয়ী হও।
11 Tafsir Ibn Kathir
৪২-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর
তিরস্কারঃ
ইয়াহূদীদেরকে এ বদ অভ্যাসের জন্যে তিরস্কার করা হচ্ছে যে, তারা জানা সত্ত্বেও কখনও তো সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত করতো, আবার কখনও সত্যকে গোপন করতো এবং মিথ্যাকে প্রকাশ করতো। তাদেরকে এ কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে এবং উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন সত্যকে প্রকাশ করে ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। আর তারা যেন ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত না করে, আল্লাহর বান্দাদের মঙ্গল কামনা করে, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের বিদ'আতকে ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে মিশ্রিত না করে। আর তারা তাদের কিতাবে মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী পাচ্ছে তা যে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশ করতে কার্পণ্য না করে।
تَكْتُمُوْا শব্দটি জযম বিশিষ্ট ও যবর বিশিষ্ট দুই-ই হতে পারে। অর্থাৎ এটা ওটার মধ্যে একত্রিত করো না। হযরত ইবনে মাসউদের (রাঃ) পঠন تَكْتُمُوْا ও আছে। তখন এটা حَال হবে এবং পরের বাক্যটিও حَال হবে। তখন অর্থ হবে এইঃ সত্যকে সত্য জেনে এ রকম নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ করো না এবং অর্থ এও হবেঃ এই গোপন করা ও মিশ্রিত করার শাস্তি যে কি হতে পারে তা জানা সত্তেও তোমরা এই পাপের কাজ করতে রয়েছে!’ অতঃপর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে নামায পড়ে, তাঁকে যাকাত প্রদান করে, তার উম্মতের সাথে রুকু ও সিজদায় অংশগ্রহণ করতে থাকে, তাদের সাথে মিলেমিশে থাকে এবং তারা নিজেরাও যেন তাঁরই উম্মত হয়ে যায়। আনুগত্য ও অন্তরঙ্গতাকেও যাকাত বলা হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে এটাই বলেছেন। দু'শ ও ততোধিক দিরহামের উপর যাকাত ওয়াজিব হয়ে থাকে। নামায ও যাকাত ফরয ও ওয়াজিব। এ দু'টো ছাড়া আমল ব্যর্থ হয়ে যায়। কেউ কেউ যাকাতের অর্থ ফিত্রাও নিয়েছেন।
রুকুকারীদের সাথে রুকু কর, এর অর্থ এই যে, তারা যেন ভাল কাজে মুমিনদের সাথে অংশগ্রহণ করে। আর ঐ কাজগুলোর মধ্যে নামাযই হলো সর্বোত্তম। এ আয়াত দ্বারা অধিকাংশ ‘আলিম জামা'আতের সাথে নামায ফরয হওয়ার দলীল গ্রহণ করেছেন। এখানে ইমাম কুরতবী (রঃ) জামা'আত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।