৩৭-৩৮ নং আয়াতের তাফসীর:
কুরবানী করা একটি ইবাদত যা একমাত্র আল্লাকে খুশি করার জন্য করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে না হয়ে যদি মানুষের প্রশংসা পাওয়া, এভাবে যে, অমুক এত বড় কুরবানী করছে, অমুক এতটা কুরবানী করেছে বা এত টাকার পশু কুরবানী দিয়েছে বা না করলে মানুষ কী বলবে এ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তা কুরবানী হবে না, সে ব্যক্তির কেবল গোশত খাওয়া হবে। কারণ তার উদ্দেশ্য হল মানুষের প্রশংসা পাওয়া। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: তোমরা কত বড় কুরবানী করছো, কত দামের কুরবানী করছো সেটা দেখার বিষয় নয়, কারণ আল্লাহ তা‘আলার কাছে সে কুরবানীর গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও পৌঁছে না, বরং তোমরা কোন্ উদ্দেশ্যে কুরবানী করেছ সেটা দেখার বিষয়। মানুষের প্রশংসা পাওয়া বা মানুষের নিন্দা থেকে বাঁচার জন্য কুরবানী করেছো, নাকি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য কুরবানী করেছো। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কুরবানী করলে তা কবূল হবে অন্যথায় হবে না। তাই কুরবানীসহ সকল ইবাদত আল্লাহ তা‘আলাকে খুশী করার জন্য করতে হবে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাযার, দরগাহ, ওরশ ও পীর বাবার জন্য উৎসর্গ করা বা তাদের খুশীর জন্য করা যাবে না, করলে শির্ক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمٰتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ)
“বল: ‘আমার সলাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ শুধুমাত্র জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।’’ (সূরা আন‘আম ৬:১৬২)
কুরবানীর ক্ষেত্রে তাক্বওয়ার অন্যতম একটি বহিঃপ্রকাশ হল কুরবানী করে শুধু নিজে না খাওয়া বরং আত্মীয়-স্বজন, গরীব ও মিসকিনদের হক আদায় করা। যেমন সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إِنَّ اللّٰهَ لَا يَنْظُرُ إِلَي صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَي قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের দিকে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৫৬৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করতে হলে প্রথমে অন্তর বিশুদ্ধ ও একনিষ্ঠ করতে হবে। অন্যথায় মোটা তাজা কুরবানী এবং পাহাড় সমান আমল করেও কোনই লাভ হবে না।
(سَخَّرَهَا لَكُمْ)
অর্থাৎ এ বিশাল বড় বড় প্রাণী তোমাদের অধীন করে দিয়ে তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। নচেৎ এ বড় প্রাণীগুলো যারা তোমাদের চেয়ে শক্তিশালী তাদেরকে কিভাবে জবাই করতে পারতে।
(لِتُكَبِّرُوا اللّٰهَ) ‘তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর’ পূর্বে ৩৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এসব পশু জবাই করার সময় যাতে আল্লাহ তা‘আলার নাম উচ্চারণ কর। এখানে বললেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। এ দুয়ের সমন্বয় করে ইবনু উমার (রাঃ) বলেন: যখন কুরবানী করবে তখন বলবে: (بِسْمِ اللّٰهِ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ) আনাস (رضي الله عنه) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিশ্রিত রঙের শিংবিশিষ্ট দুটি দুম্বা কুরবানী করলেন। বর্ণনাকারী বলছেন: আমি তাঁকে দেখেছি, তিনি স্বহস্তে তা জবাই করছেন, আরো দেখেছি, জবাই করার সময় তাঁর পা পশুর পার্শ্বে রাখা ছিল। আল্লাহ তা‘আলার নাম নিলেন এবং তাকবীর বলে জবাই করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৫৬৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৯৬৬)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তিনি তাঁর মু’মিন বান্দা হতে দুঃখ-কষ্ট, শত্র“র আক্রমণ, অনিষ্টতা ইত্যাদি প্রতিহত করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ)
“আর মু’মিনদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য।” (সূরা রূম ৩০:৪৭) বর্ণিত আছে, এ আয়াতটি নাযিল হয় মক্কার মু’মিনদেরকে কেন্দ্র করে। যখন তাদের ওপর কাফিররা অধিকহারে অত্যাচার চালাতে লাগল তখন কিছু মু’মিন হাবশায় হিজরত করল। আর যারা মক্কায় ছিল তারা পরিকল্পনা করল যে, আমরা যে সকল কাফিরদেরকে করায়ত্ত করতে পারব তাদেরকে হত্যা করব, তাদেরকে ধোঁকা ও প্রতারণা দিব। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা দেন যে, তিনি তাদের পক্ষ থেকে সকল নির্যাতন প্রতিহত করবেন। মু’মিনদেরকে খিয়ানত ও প্রতারণা করা থেকে বারণ করলেন।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إِنَّ الغَادِرَ يُرْفَعُ لَهُ لِوَاءٌ يَوْمَ القِيَامَةِ، يُقَالُ: هَذِهِ غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ
কিয়ামতের দিন খিয়ানতকারীর কোমরে একটি ঝাণ্ডা লাগিয়ে দেয়া হবে। এটা হবে, তার খিয়ানতের পরিচয়। বলা হবেন এ ব্যক্তি অমুকের সাথে খিয়ানত করেছে। (সহীহ বুখারী হা: ১)
সুতরাং মু’মিনরা যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সঠিকভাবে ঈমান আনে, সৎ আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সকল বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন, কাফিরদের ওপর বিজয় দান করবেন। “خوان” শব্দের অর্থ বিশ্বাসঘাতকতা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য পেতে হলে নিয়ত বিশুদ্ধ করতে হবে।
২. অন্যকে খুশী করার জন্য কোন আমল করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হবে না।
৩. কোন মাযার, দরগাহ, ওলী-আওলিয়া ও পীর বাবার নামে বা তাদের সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করলে বা পশু দান করলে শির্ক হবে।
৪. সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের শত্র“কে প্রতিহত করবেন।