নামকরণ:
(الْفُرْقَانَ) ফুরকান শব্দের অর্থ সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। ফুরকান শব্দটি অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ রয়েছে বিধায় এ সূরাটি উক্ত নামে নামকরণ করা হয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে সম্পূর্ণ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) ও কাতাদাহ (رضي الله عنه) বলেন: ৬৮-৭০ এ তিনটি আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে (কুরতুবী)। সূরায় কুরআনের মাহাত্ম্য, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতের সত্যতা এবং শত্র“দের পক্ষ থেকে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দেয়া হয়েছে।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
تَبٰرَكَ শব্দটি بركة থেকে উদ্ভূত। বরকতের অর্থন প্রভূত কল্যাণ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: প্রত্যেক কল্যাণ ও বরকত আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে, তাই তাঁর কাছেই বরকত কামনা করা উচিত। الْفُرْقَانَ শব্দের অর্থ সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, হিদায়াত-গুমরাহী, সৌভাগ্যশীল-দুর্ভাগার পার্থক্য নিরূপণকারী। এর দ্বারা “আল-কুরআন”-কে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু কুরআন হক ও বাতিল, তাওহীদ ও শির্ক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য স্থাপন করেছে তাই আল-কুরআনকে ফুরকান নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
(عَلٰی عَبْدِھ۪) ‘তাঁর বান্দার প্রতি’ অর্থাৎ এ কুরআন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করতে পারেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা পৃথিবীবাসীর জন্য প্রেরিত রাসূল। তাঁকে এ কুরআন দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে যাতে তিনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ প্রদান করেন আর অসৎকর্মশীলদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন। তাঁর পর আর কোন নাবী ও রাসূল আগমন করবেন না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعَا)
“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫৮)
হাদীসে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমাকে পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেয়া হয়নি। অতঃপর তার মধ্যে থেকে একটি উল্লেখ করেন যে, প্রত্যেক নাবী-রাসূলকে তার নিজ সম্প্রদায়ের নিকট পাঠানো হয়েছে। আর আমাকে পাঠানো হয়েছে সকল মানুষের জন্য। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৫, সহীহ মুসলিম হা: ৫২১)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর চারটি ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হল:
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
তিনি আকাশ ও জমিনের একমাত্র মালিক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللّٰهَ لَه۫ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)
“তুমি কি জান না যে, আসমান ও জমিনের আধিপত্য আল্লাহরই।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৪০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
( قُلِ اللّٰهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ)
“বলুন, হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমিই রাজত্বের মালিক।” (সূরা আল ইমরান ৩:২৬)
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
যারা আল্লাহ তা‘আলার অংশী সাব্যস্ত করেন যেমন ইয়াহূদীরা বলে, উযাইর আল্লাহ তা‘আলার ছেলে; খ্রিস্টানরা বলে, ঈসা আল্লাহ তা‘আলার ছেলে; মারইয়াম আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী; তাছাড়া আরবের মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করে। তাদের বিশ্বাসকে খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ ھُوَ اللہُ اَحَدٌﭐﺆ اَللہُ الصَّمَدُﭑﺆ لَمْ یَلِدْﺃ وَلَمْ یُوْلَدْﭒﺫ وَلَمْ یَکُنْ لَّھ۫ کُفُوًا اَحَدٌﭓﺟ)
“বল: তিনিই আল্লাহ, একক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” (সূরা ইখলাস ১১২:১-৪)
অন্যত্রে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّأَنَّه۫ تَعَالٰي جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَّلَا وَلَدًا)
“এবং নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা সমুচ্চ; তিনি কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং কোন সন্তানও।” (সূরা জিন ৭২:৩)
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
তিনি প্রত্যেকের তাকদীর বা ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, যার জন্য যা উপযোগী ও যা প্রয়োজন তিনি তা-ই দিয়ে দিয়েছেন। তাতে কোন প্রকার ঘাটতি রাখেননি।
আল্লাহর বাণী:
(الَّذِيْ خَلَقَ فَسَوّٰي وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰي)
“যিনি সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর পরিপূর্ণভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন, এবং যিনি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন, তারপর হিদায়াত দিয়েছেন।” (সূরা আলা ৮৭:২-৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنٰهُ بِقَدَرٍ)
“নিশ্চয়ই আমি সকল কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” (সূরা কামার ৪:৫৯)
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْ خَالِقُ کُلِّ شَیْءٍﺭ لَآ اِلٰھَ اِلَّا ھُوَﺇ فَاَنّٰی تُؤْفَکُوْنَﮍ کَذٰلِکَ یُؤْفَکُ الَّذِیْنَ کَانُوْا بِاٰیٰتِ اللہِ یَجْحَدُوْنَﮎ)
“তিনি আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সব কিছুর স্রষ্টা; তিনি ব্যতীত (সত্য) কোন মা‘বূদ নেই, সুতরাং তোমরা কোথায় পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরছ? এভাবেই পথভ্রষ্ট হয়ে তারা ঘুরে, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে।” (সূরা মু’মিন ৪০:৬২-৬৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর বাতিল ও ভ্রান্ত মা‘বূদের কিছু দুর্বলতার দিক তুলে ধরেছেন। আর তা হল:
১. তারা কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَنْ يَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَه۫)
“তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও।” (সূরা হজ্জ ২২:৭৩)
২. তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থাৎ তারা অপরের সৃষ্ট বস্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَا يَخْلُقُوْنَ شَيْئًا وَّهُمْ يُخْلَقُوْنَ)
“তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অপর যাদেরকে আহ্বান করে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না, তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়।’’ (সূরা নাহল ১৬:২০)
৩. তারা নিজেদের কোন উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ مَنْ رَّبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ط قُلِ اللّٰهُ ط قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِّنْ دُوْنِه۪ٓ أَوْلِيَا۬ءَ لَا يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا)
“বল: ‘কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক?’ বল: ‘আল্লাহ তা‘আলা।’ বল: ‘তবে কি তোমরা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছ আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে অপরকে যারা নিজেদের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়?’ (সূরা রাদ ১৩:১৬)
৪. তারা কাউকে মৃত্যু দান করতে পারে না আর না পারে জীবিত করতে এবং তারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান করতেও সক্ষম নয়। এ সকল বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ক্ষমতাবান, অন্য কেউ নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللّٰهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ج ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)
“কিভাবে তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পরে আবার জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারাহ ২:২৮)
অতএব ইবাদতের একমাত্র যোগ্য আল্লাহ তা‘আলা অন্য কেউ নয়। কারণ তাদের হাতে কোনই ক্ষমতা নেই। আর যাদের কোন ক্ষমতা নেই তারা ইবাদতের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। সুতরাং আমাদের উচিত যারা কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখে না তাদেরকে বর্জন করে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে নাযিলকৃত কিতাব।
২. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।
৩. কুরআন মানুষের জন্য সতর্কবাণীস্বরূপ।
৪. সমস্ত কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলা কোন সন্তান-সন্ততি গ্রহণ করেন না। তাঁর কোন শরীক নেই।
৬. পুনরুত্থানের মালিকও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৭. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যান্য বাতিল মা‘বূদ কোন ক্ষমতা রাখে না, এমনকি নিজেদের কোন উপকার ও ক্ষতি করতেও পারে না।