আল ইমরান আয়াত ৯
رَبَّنَآ اِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيْهِ ۗاِنَّ اللّٰهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيْعَادَ ࣖ ( آل عمران: ٩ )
Rabbanaaa innaka jaami 'un-naasi li Yawmil laa raibafeeh; innal laaha laa yukhliful mee'aad (ʾĀl ʿImrān ৩:৯)
English Sahih:
Our Lord, surely You will gather the people for a Day about which there is no doubt. Indeed, Allah does not fail in His promise." (Ali 'Imran [3] : 9)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি সমুদয় মানুষকে একদিন সমবেত করবে, যাতে কোনও সন্দেহ নাই। নিশ্চয়ই আল্লাহ অঙ্গীকারের খেলাফ করেন না। (আল ইমরান [৩] : ৯)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি মানবজাতিকে একদিন একত্রে সমাবেশ করবে -- এতে কোন সন্দেহ নেই; নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্ধারিত সময়ের ব্যতিক্রম (প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ) করেন না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
‘হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি সমস্ত মানুষকে একদিন একত্রে সমাবেত করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই [১]; নিশ্চয় আল্লাহ্ ওয়াদা খেলাফ করেন না। ’
[১] শাফাআতের বিখ্যাত হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা'আলা পূর্বাপর সকল মানুষকে কিয়ামতের দিন এক মাঠে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তাদের চক্ষু পরস্পরকে বেষ্টন করবে এবং তারা যে কোন আহবানকারীর আহবান শুনতে পাবে। আর সূর্য তাদের নিকটবর্তী করা হবে। " [বুখারী ৩৩৬১]
3 Tafsir Bayaan Foundation
হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি মানুষকে সমবেত করবেন এমন একদিন, যাতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
4 Muhiuddin Khan
হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি মানুষকে একদিন অবশ্যই একত্রিত করবেঃ এতে কোনই সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদার অন্যথা করেন না।
5 Zohurul Hoque
''আমাদের প্রভু! অবশ্যই তুমি লোকজনকে সমবেত করতে যাচ্ছো এমন এক দিনের প্রতি যার সন্বন্ধে কোনোও সন্দেহ নেই।’’ নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ ধার্য স্থান-কালের কখনো খেলাফ করেন না।
6 Mufti Taqi Usmani
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি সমস্ত মানুষকে এমন এক দিন একত্র করবে, যে দিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদার বিপরীত করেন না।
7 Mujibur Rahman
হে আমাদের রাব্ব! নিশ্চয়ই আপনি সকল মানুষকে সমবেতকারী, ঐ দিনে মোটেই সন্দেহ নেই, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী নন।
8 Tafsir Fathul Mazid
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি যে কিতাব অর্থাৎ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন তাতে দু’ ধরণের আয়াত রয়েছে, মুহকাম ও মুতাশাবিহ। মুহকাম ও মুতাশাবিহ এর দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআনের আয়াতগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়:
১. اَلْمُحْكُمُ الْعَامُ
অর্থাৎ কুরআনের শব্দ ও অর্থ সব কিছু বলিষ্ঠ, মজবুত ও উৎকৃষ্ট। ভাষা অলংকারে কুরআন সবার ঊর্ধ্বে, তার সকল সংবাদ সত্য ও উপকারী। এতে মিথ্যা, অনর্থক ও কোন প্রকার বৈপরিত্য নেই। তার সকল বিধান ন্যায়সঙ্গত ও হিকমতপূর্ণ, কোনরূপ জুলুম ও অবোধগম্যতা নেই। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ কুরআন মুহকাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(كِتٰبٌ أُحْكِمَتْ اٰيٰتُه۫ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَّدُنْ حَكِيْمٍ خَبِيْر)
“এটা এমন গ্রন্থ যার আয়াতগুলো সুদৃঢ়, অতঃপর বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের পক্ষ থেকে।” (সূরা হুদ ১১:১)
২. اَلْمُتَشَابِهُ الْعَامُ অর্থাৎ সম্পূর্ণ কুরআন এক অংশ অন্য অংশের সাথে পূর্ণতা, দৃঢ়তা ও প্রশংসনীয় উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَللہُ نَزَّلَ اَحْسَنَ الْحَدِیْثِ کِتٰبًا مُّتَشَابِھًا مَّثَانِیَ تَقْشَعِرُّ مِنْھُ جُلُوْدُ الَّذِیْنَ یَخْشَوْنَ رَبَّھُمْﺆ ثُمَّ تَلِیْنُ جُلُوْدُھُمْ وَقُلُوْبُھُمْ اِلٰی ذِکْرِ اللہِﺚ ذٰلِکَ ھُدَی اللہِ یَھْدِیْ بِھ۪ مَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَمَنْ یُّضْلِلِ اللہُ فَمَا لَھ۫ مِنْ ھَادٍ)
“আল্লাহ অতি উত্তম বাণী নাযিল করেছেন, তা এমন কিতাব যা সুসামঞ্জস্য, বার বার তেলাওয়াত করা হয়। এতে তাদের দেহ রোমাঞ্চিত হয় যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, অতঃপর তাদের দেহ ও তাদের অন্তর বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটাই আল্লাহর হিদায়াত, এর দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।” (সূরা যুমার ৩৯:২৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَﺚ وَلَوْ کَانَ مِنْ عِنْدِ غَیْرِ اللہِ لَوَجَدُوْا فِیْھِ اخْتِلَافًا کَثِیْرًا)
“তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট হতে আসত তবে তারা তাতে অবশ্যই অনেক অসঙ্গতি পেত।” (সূরা নিসা ৪:৮২)
৩. المحكم الخاص ببعضه
এ প্রকার মুহকাম অর্থ হল আয়াতের অর্থ সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার, কোন অস্পষ্টতা নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
“হে মানব মণ্ডলী! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বনকারী হও।” (সূরা বাকারাহ ২:২১) এরূপ উদাহরণ অনেক।
المتشابه الخاص ببعضه
এ প্রকার মুতাশাবিহ অর্থ হল- আয়াতের অর্থ দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট। এ আয়াতগুলো থেকে কোন ব্যক্তি এমন কিছু ধারণা করতে পারে যা আল্লাহ তা‘আলা বা তাঁর কিতাব অথবা তাঁর রাসূলের সাথে উপযোগী নয়। যারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী তারা সেগুলোর মর্ম অনেক ক্ষেত্রে অনুধাবন করতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পৃক্ত, যেমন কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার এ কথা থেকে ধারণা করতে পারে-
(بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتٰنِ)
“বরং আল্লাহর উভয় হাতই প্রসারিত।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৬৪)
আল্লাহ তা‘আলার দু’হাত মানুষের হাতের মত। মূলতঃ এমন ধারণা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার দু’টি হাত রয়েছে কিন্তু মানুষের হাতের মত নয়; বরং তাঁর জন্য যেমন শোভা পায় ও হওয়া উচিত তেমনই। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَيْسَ كَمِثْلِه۪ شَيْءٌ ﺆ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ)
“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা শুরা ৪২:১১)
আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন কোন ব্যক্তি ধারণা করতে পারে যে, কুরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক ও এক আয়াত অন্য আয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَآ اَصَابَکَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللہِﺑ وَمَآ اَصَابَکَ مِنْ سَیِّئَةٍ فَمِنْ نَّفْسِکَ)
“তোমার যা কল্যাণ হয় তা আল্লাহর নিকট হতে এবং তোমার যা অকল্যাণ হয় তা তোমার নিজের কারণে।” (সূরা নিসা ৪:৭৯) আল্লাহ অন্যত্র বলেন:
(وَاِنْ تُصِبْھُمْ حَسَنَةٌ یَّقُوْلُوْا ھٰذِھ۪ مِنْ عِنْدِ اللہِ)
“যদি তাদের কোন কল্যাণ হয় তবে তারা বলে ‘এটা আল্লাহর নিকট হতে।’ (সূরা নিসা ৪:৭৮)
এ আয়াতদ্বয় থেকে অনেকে ধারণা করতে পারে যে, কল্যাণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আসে আর অকল্যাণ মানুষের পক্ষ থেকে আসে। মূলতঃ তা নয়, বরং কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত তাকদীর। কিন্তু কল্যাণ বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ। অকল্যাণ আল্লাহ তা‘আলাই দিয়ে থাকেন কিন্তু তা বান্দার কর্মের কারণে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْكُمْ وَيَعْفُوْا عَنْ كَثِيْرٍ)
“তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদেরই হাতের কামাইয়ের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।” (সূরা শুরা ৪২:৩০)
রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন কেউ আল্লাহ তা‘আলার এ কথা থেকে ধারণা করতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি সন্দেহে ছিলেন।
(فَإِنْ كُنْتَ فِيْ شَكٍّ مِّمَّآ أَنْزَلْنَآ إِلَيْكَ فَسْأَلِ الَّذِيْنَ يَقْرَأُوْنَ الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِكَ)
“আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তুমি সন্দেহ করে থাক তবে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পাঠ করে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর; (সূরা ইউনুস ১০:৯৪) মূলত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি সন্দেহ করেননি, বরং তিনি কুরআন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِيْ شَكٍّ مِّنْ دِيْنِيْ فَلَآ أَعْبُدُ الَّذِيْنَ تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ)
“বল: ‘হে মানুষ! তোমরা যদি আমার দীনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ কর তবে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ‘ইবাদত কর আমি তাদের ‘ইবাদত করি না।” (সূরা ইউনুস ১০:১০৪) অর্থাৎ তোমরা যদি আমার দীনের ব্যাপারে সন্দেহ কর তাহলে জেনে রেখ! আমি আমার দীনের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া তোমরা যাদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না; বরং তাদের সাথে কুফরী করি এবং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করি। (শরহু মুকাদ্দামাহ ফী উসূলুত তাফসীর: ২৩৬-২৪৩ পৃ:)
محكمات মুহকামাত আয়াতগুলোই হল কুরআনের মূল বিষয়। কারণ এ আয়াতগুলো বুঝার জন্য কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না। আর
متشابهات
মুতাশাবিহাত আয়াতগুলো এ রকম নয়। অতএব যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, যারা চায় আল্লাহ তা‘আলার দীনকে পরিবর্তন করতে এবং মানুষকে গোমরাহ করতে, তারা এ সমস্ত আয়াত নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং বক্রতার দিকগুলো খুঁজে বের করে, যাতে তারা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে এবং তাদের বাতিল কথার স্বপক্ষে এ দলীল পেশ করে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
অথচ এ সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন, অন্য কেউ নয়। আর যারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী তারা এগুলোর ওপর বিশ্বাস রাখেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী তারাও ঐ সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানে না; বরং তারা বিশ্বাস রাখার সাথে সাথে এ কথাও বলে যে, সকল কিছুই মহান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এ সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানা সম্ভব নয়। আর যারা এ সমস্ত আয়াত নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে এবং তারা এর দ্বারা পথভ্রষ্ট হয় ও অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করতে চায়।
এ সম্পর্কে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
(أُولُوا الْأَلْبَابِ.......... هُوَ الَّذِيْٓ أَنْزَلَ)
আয়াতটি পাঠ করলেন। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন যে, যারা মুতাশাবিহাত আয়াতের পেছনে ছুটে তাদের যখন তুমি দেখবে তখন মনে করবে যে, তাদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৬৬৫)
(رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا)
“হে আমাদের রব! হিদায়াত দানের পর আমাদের অন্তরকে বক্র করে দেবেন না।” এটি একটি দু‘আ যা মু’মিনরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করে বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা হিদায়াত দান করার পর যেন পুনরায় তাদেরকে গুমরাহ না করেন। তাদেরকে যেন হক থেকে বাতিলের দিকে আবার ফিরিয়ে না দেন। আর এর দ্বারা যেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবস্থা ও আমল আখলাককে সুন্দর ও শুদ্ধ করে দেন। তাদেরকে যেন সরল-সোজা পথে, সুদৃঢ় ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং তাদের অন্তর থেকে যেন বক্রতা দূর করে দেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
يا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰي دِيْنِكَ
হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। (তিরমিযী হা: ২১৪০, সহীহ)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি একদিন তাদেরকে মৃত্যুর পর আবার সমবেত করবেন। তাদেরকে পুনরায় জীবিত করবেন, তাদের কাজের প্রতিদান দেবেন। প্রত্যেকে যে কাজ করবে সে তা-ই পাবে। কাউকে বিন্দু পরিমাণ কম-বেশি দেয়া হবে না। এ ওয়াদা তিনি বাস্তবায়িত করবেন এবং সকলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন। ঐ দিনের আগমনের এবং আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার- এর ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। একদিন তা বাস্তবায়িত হবেই।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্য সূরায় বলেন:
(اَللہُ لَآ اِلٰھَ اِلَّا ھُوَﺚ لَیَجْمَعَنَّکُمْ اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَةِ لَا رَیْبَ فِیْھِ)
“আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন মা‘বূদ নেই, তিনি তোমাদেরকে কিয়ামাতের দিন একত্র করবেনই, এতে কোন সন্দেহ নেই।” (সূরা নিসা ৪:৮৭)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআনে মুহকাম ও মুতাশাবিহ দু’ধরণের আয়াতই রয়েছে। মুহকাম আয়াতের ওপর ঈমান আনা ও আমল করা উভয়টা ওয়াজিব। আর মুতাশাবিহ আয়াতের প্রতি ঈমান আনব এবং তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার দিকে সোপর্দ করব।
২. যারা মুতাশাবিহ আয়াত অন্বেষণের চেষ্টা চালায় তাদেরকে পরিত্যাগ করা ওয়াজিব; কারণ তারা বিদআতী ও কুপ্রবৃত্তির অনুসারী।
৩. ফেতনা প্রকাশ পেলে অন্তরের বক্রতা থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাওয়া উচিত।
9 Fozlur Rahman
“হে আমাদের প্রভু! নিশ্চয়ই তুমি এমন এক দিনে (হাশরের দিন) সব মানুষ একত্রিত করবে যে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।”
10 Mokhtasar Bangla
৯. হে আমাদের প্রভু! নিশ্চয়ই আপনি সকল মানুষকে হিসাবের জন্য এমন এক দিন একত্র করবেন যা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সেটি সত্যিই একটি অনিবার্য বিষয়। হে প্রভু! নিশ্চয়ই আপনি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
11 Tafsir Ibn Kathir
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে বর্ণিত হচ্ছে যে, কুরআন মাজীদের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যেগুলোর বর্ণনা খুবই স্পষ্ট ও অত্যন্ত পরিষ্কার এবং সরল ও সহজ। প্রত্যেকেই ওগুলোর ভাবার্থ অনুধাবন করতে পারে। আবার কতগুলো আয়াত এরূপও রয়েছে যেগুলোর ভাবার্থ সাধারণতঃ বোধগম্য হয় না। এখন যারা দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতগুলোকে প্রথম প্রকারের আয়াত সমূহের দিকে ফিরিয়ে থাকে, অর্থাৎ যে জিজ্ঞাস্য বিষয়ের স্পষ্টতা যে আয়াতের মধ্যে প্রাপ্ত হয় তাই গ্রহণ করে থাকে, তারাই সঠিক পথের উপর রয়েছে। আর যারা স্পষ্ট আয়াতগুলোকে ছেড়ে এমন আয়াতগুলোকে দলীলরূপে গ্রহণ করে থাকে, যেগুলো তাদের জ্ঞানের ঊর্ধে এবং ওগুলোর মধ্যেই জড়িত হয়ে পড়ে, তারা ওরাই যারা মুখের ভরে পতিত হয়েছে। اُمُّ الْكِتٰبِ অর্থাৎ মূল ও ভিত্তি। ঐগুলো আল্লাহর কিতাবের পরিষ্কার ও স্পষ্ট আয়াতসমূহ।
‘তোমরা সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়ো না, বরং স্পষ্ট আয়াতসমূহের প্রতিই আমল কর,ঐগুলোকেই মীমাংসাকারী হিসেবে গ্রহণ কর। কতগুলো আয়াত এমনও রয়েছে যে, ঐগুলোর একটি অর্থ তো স্পষ্ট আয়াত সমূহের মতই কিন্তু ঐ অর্থ ছাড়া অন্য অর্থ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এরূপ অস্পষ্ট আয়াত সমূহের পিছনে পড়ো না।' পূর্ববর্তী মনীষীগণ হতে مُحْكَمْ ও مُتَشَابِه শব্দদ্বয়ের বহু অর্থ নকল করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, مُحْكَمَاتٌ হচ্ছে রহিতকারী আয়াতগুলো, যেগুলোর মধ্যে হালাল, হারাম, আদেশ, নিষেধ এবং আমল সমূহের বর্ণনা থাকে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, قُلْ تَعَالَوْا اَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَیْكُمْ اَلَّا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـئًـا (৬:১৫১) এবং এর পরবর্তী হুকুমের আয়াতগুলো হচ্ছে মুহকামাত এবং وَ قَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ (১৭:২৩) ও এর পরবর্তী তিনটি আয়াত মুহকামাত। হযরত আবু ফাকতাহ (রঃ) বলেন যে, এগুলো সূরাসমূহের সূচনা। হযরত ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার (রঃ) বলেন যে, এগুলো হচ্ছে ফরযসমূহ, নির্দেশাবলী, বাধা-নিষেধ এবং হালাল ও হারামের আয়াতসমূহ। হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ) বলেন, ‘এ আয়াতগুলোকে কিতাবের মূল বলার কারণ এই যে, এগুলো সমগ্র কিতাবের মধ্যে রয়েছে। হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, সমস্ত মাযহাবের লোক এগুলোকে স্বীকার করে বলে এগুলোকে কিতাবের মূল বলা হয়। مُتَشٰبِهَاتٌ ঐ আয়াতগুলোকে বলা হয় যেগুলো রহিত হয়ে গেছে। যেগুলোর পূর্বের ও পরের, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে দৃষ্টান্তসমূহ এবং যেগুলো দ্বারা শপথ করা হয়েছে।
ঐগুলোর উপর শুধুমাত্র বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। আমল করার জন্যে ঐগুলো আহকাম নয়। হযরত ইবনে আব্বাসেরও (রাঃ) উক্তি এটাই। হযরত মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, ঐগুলো হচ্ছে সূরাসমূহের প্রথমে লিখিত حُرُوْفٌ مُقَطَّعَاتٌ। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন, مُتَشَابِهَاتٌ আয়াতগুলো একে অপরের সত্যতা প্রতিপাদনকারী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে كِتٰبًا مُّتَشَابِهَا (৩৯:২৩) এবং এটাও উল্লিখিত হয়েছে যে, এটা এমন এক বাক্য যা একই রচনা রীতির অধীনস্থ হয়। আর مَثَانِى ওকেই বলা হয় যেখানে দুটি বিপরীতমুখী জিনিসের উল্লেখ থাকে। যেমন জান্নাত ও জাহান্নামের বিশেষণ বর্ণনা এবং পাপ-পুণ্যের অবস্থা বর্ণনা ইত্যাদি। এ আয়াতে مُتَشَابِه শব্দটি مُحْكَمْ শব্দের বিপরীত শব্দরূপে এসেছে। এ জন্যেই আমরা যে ভাবার্থ বর্ণনা করেছি ওটাই সঠিক। এটাই হযরত মুহাম্মদ ইবনে ইয়াসারেরও (রঃ) উক্তি। তিনি বলেন যে, এগুলো হচ্ছে প্রভুর দলীল স্বরূপ। ঐগুলোর মধ্যে বান্দাদের রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বিবাদ ও বাতিলের মীমাংসা রয়েছে। ঐগুলোর প্রকৃত ভাবার্থ কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। مُتَشٰبِهَاتٌ আয়াতগুলোর সত্যতার ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। ঐ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া উচিত নয়। ঐ আয়াতগুলো দ্বারা আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন, যেমন পরীক্ষা করে থাকেন হালাল ও হারাম দ্বারা। আয়াতগুলোকে সত্য হতে ফিরিয়ে দিয়ে অসত্যের দিকে নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিত নয়।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, অর্থাৎ যারা সত্য পথ ছেড়ে দিয়ে ভ্রান্তির পথে গমন করে তারাই এ অস্পষ্ট আয়াতগুলোর মাধ্যমে স্বীয় জঘন্য উদ্দেশ্যাবলী পুরো করতে চায় এবং শাব্দিক অনৈক্য হতে অবৈধ। উপকার গ্রহণ করতঃ নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। স্পষ্ট আয়াত সমূহ দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য পুরো হয় না। কেননা, ঐগুলোর শব্দসমূহ সম্পূর্ণ স্পষ্ট এবং একেবারে খোলাখুলি। তারা ঐগুলো সরাতেও পারে না এবং ওগুলোর মধ্যে নিজেদের অনুকূলে কোন দলীলও প্রাপ্ত হয় না। এ জন্যেই ঘোষণা হচ্ছে যে, এর দ্বারা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে অশান্তি উৎপাদন, যেন তারা স্বীয় অধীনস্থ লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারে। তারা নিজেদের বিদআতের দলীল কুরআন পাক থেকেই নিতে চায়, অথচ কুরআন মাজীদতো বিদআতকে খণ্ডন করে থাকে। যেমন খ্রীষ্টানেরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ তা'আলার পুত্র (নাউজুবিল্লাহ) সাব্যস্ত করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনের رُرْحُ اللهِ শব্দকে দলীল রূপে গ্রহণ করেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, তারা এ অস্পষ্ট আয়াতটিকে গ্রহণ করতঃ নিম্নলিখিত স্পষ্ট আয়াতগুলোকে পরিত্যাগ করেছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে বলেনঃ اِنْ هُوَ اِلَّا عَبْدٌ اَنْعَمْنَا عَلَیْهِ অর্থাৎ সে ঈসা (আঃ) একজন দাস ছাড়া কিছুই নয়, তাকে আমি পুরস্কৃত করেছি।' (৪৩:৫৯) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ اِنَّ مَثَلَ عِیْسٰى عِنْدَ اللّٰهِ كَمَثَلِ اٰدَمَ خَلَقَهٗ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهٗ كُنْ فَیَكُوْنُ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ঈসা (আঃ) এর দৃষ্টান্ত আদম (আঃ)-এর মতই, তাকে (আদম আঃ) তিনি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে বলেছেন- 'হও' তেমনই হয়ে গেছে।' (৩:৫৯) এ প্রকারের আরও বহু স্পষ্ট আয়াত রয়েছে। কিন্তু এসবকে ছেড়ে দিয়ে অভিশপ্ত খ্রীষ্টানেরা অস্পষ্ট আয়াত দ্বারা হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ পাকের পুত্র হওয়ার দলীল গ্রহণ করেছে। অথচ তিনি আল্লাহ তা'আলার সৃষ্ট, তাঁর বান্দা ও রাসূল। "
অতঃপর বলা হচ্ছে- ‘অস্পষ্ট আয়াতগুলোর পিছনে পড়ার তাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, অর্থ পরিবর্তন করা এবং ঐগুলোকে স্বীয় স্থান হতে সরিয়ে দেয়া। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “যখন তোমরা ঐ লোকদেরকে দেখ যারা অস্পষ্ট আয়াতগুলো নিয়ে ঝগড়া করে তখন তোমরা তাদেরকে পরিত্যাগ কর। এ আয়াতে ঐগুলোকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।' এ হাদীসটি বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ছহীহ বুখারী শরীফেও এ হাদীসটি কিতাবুল কাদরের মধ্যে এ আয়াতেরই তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, এগুলো খারেজী ছিল। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) এ হাদীসটিকে মাওকুফ' মনে করা হলেও এর বিষয়বস্তু বিশুদ্ধ। কেননা, প্রথম বিদআত তারাই ছড়িয়েছিল। এ দলটি শুধুমাত্র ইহলৌকিক দুঃখের কারণে মুসলমানগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন হুনাইন যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ দ্রব্য বন্টন করেন তখন ঐ লোকগুলো ঐ বন্টনকে অন্যায় মনে করেছিল। তাদের মধ্য হতে যুল খুয়াইসির নামক এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে এসে পরিষ্কারভাবে বলেই দেয়ঃ ন্যায়নীতি অবলম্বন করুন। এ বন্টনে আপনি সুবিচার প্রদর্শন করেননি। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তো আমাকে বিশ্বস্ত রূপে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমিই যদি সুবিচার না করি তবে তো তুমি ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' সে ফিরে গেলে হযরত উমার (রাঃ) আবেদন করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তাকে হত্যা করে ফেলি, আপনি আমাকে এ অনুমতি প্রদান করুন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘ছেড়ে দাও, তার বংশ হতে এমন এক সম্প্রদায় বের হবে যে, তোমরা তোমাদের নামাযকে তাদের নামাযের তুলনায় এবং তোমাদের কুরআন পাঠকে তাদের কুরআন পাঠের তুলনায় নিকৃষ্ট মনে করবে। প্রকৃতপক্ষে তারা ধর্ম হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার হতে বেরিয়ে যায়। তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে। যারা তাদেরকে হত্যা করবে তাদের জন্যে বড় পুণ্য রয়েছে। হযরত আলী (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগে তাদের আবির্ভাব ঘটে। তিনি তাদেরকে নাহরাওয়ানে হত্যা করেন। অতঃপর তাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদী দলের সৃষ্টি হয়। ধর্মের মধ্যে তারা নতুন বিদআত চালু করে এবং আল্লাহর পথ হতে বহু দূরে সরে পড়ে। তাদের পরে কাদরিয়্যাহ দলের আবির্ভাব হয়। তার পরে বের হয় মুতাযিলা সম্প্রদায়। তার পরে জাহমিয়্যাহ ইত্যাদি দলের উদ্ভব হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিম্ন বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়। তিনি বলেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে অতিসত্বরই তেহাত্তরটি দলের আবির্ভাব ঘটবে। একটি দল ছাড়া সবই জাহান্নামী হবে।' সাহাবীগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ঐটি কোন্ দল? তিনি বলেনঃ ‘তারা ওরাই যারা এমন জিনিসের উপর রয়েছে যার উপর আমি রয়েছি এবং আমার সাহাবীগণ (রাঃ) রয়েছে।' (মুসতাদরিক-ইহাকিম) আবূ ই'য়ালার হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে যারা কুরআন মাজীদ তো পাঠ করবে, কিন্তু ওটা এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলবে যেমন কেউ খেজুরের আঁটি খুঁড়ে ফেলে। ওর ভুল অর্থ বর্ণনা করবে।
অতঃপর বলা হচ্ছে- ‘ওর প্রকৃত ভাবার্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন। اَللهُ শব্দের উপর বিরতি আছে কি নেই, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘চার প্রকারের তাফসীর রয়েছে। (১) প্রথম হচ্ছে ঐ তাফসীর যা সবাই বুঝতে পারে। (২) দ্বিতীয় ঐ তাফসীর যা আরববাসী নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে অনুধাবন করে থাকে। (৩) তৃতীয় ঐ তাফসীর যা শুধুমাত্র বড় বড় পণ্ডিতগণই বুঝে থাকেন। (৪) চতুর্থ ঐ তাফসীর যা শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন, অন্য কেউ জানে না। এটা পূর্বেও বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রমুখেরও এটাই উক্তি। মু'জাম-ই-কাবীর গ্রন্থে হাদীস রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের উপর আমার শুধু তিনটি , জিনিসের ভয় রয়েছে। (১) প্রথম ভয় মালের আধিক্যে। কেননা, এরই কারণে হিংসা বিদ্বেষের সৃষ্টি হবে এবং পরস্পরের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে। (২) দ্বিতীয় ভয় এই যে, তারা আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যার পিছনে লেগে পড়বে, অথচ ওর প্রকৃত ভাবার্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন। আর যারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী তারা বলে ওর উপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। (৩) তৃতীয় ভয় এই যে, তারা বিদ্যা অর্জন করে তা নষ্ট করে দেবে এবং কোনই গ্রাহ্য করবে না।' এ হাদীসটি সম্পূর্ণ গারীব। অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কুরআন কারীম এ জন্যে অবতীর্ণ হয়নি যে, একটি আয়াত অন্য আয়াতের বিপরীত হবে। যা তোমরা বুঝতে পার তার উপর আমল কর এবং যা অস্পষ্ট তার উপর বিশ্বাস স্থাপন কর।' (তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) এবং হযরত মালিক ইবনে আনাস (রঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে যে, গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোকেরাও এর প্রকৃত অর্থ অবগত হন না। তবে তাঁরা ওর উপর বিশ্বাস রাখেন। হযরত ইবেন মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, এর জটিল ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিরা ঐ কথাই বলেন যে, ওগুলোর উপর তাদের ঈমান রয়েছে। হযরত উবাই ইবনে কা’বও (রাঃ) একথাই বলেন। ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই পছন্দ করেন। এ উক্তিগুলো হচ্ছে ঐ দলের যারা اِلَّااللهُ শব্দের উপর বিরতি আনয়ন করতঃ পরবর্তী বাক্যকে এর থেকে পৃথক করে থাকেন। অন্য একটি দল اِلَّااللهُ শব্দের উপর বিরতি না এনে فِى الْعِلْمِ শব্দের উপর বিরতি এনে থাকেন (ওয়াকফ করে থাকেন)।
অধিকাংশ ব্যাখ্যাতা ও শাস্ত্রের মূলনীতির উপর পাণ্ডিত্য অর্জনকারী ব্যক্তিগণও একথাই বলেন। তাঁদের বড় দলীল এই যে, যে কথা বোধগম্য নয় তা বলা ঠিক নয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলতেনঃ ‘জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণের মধ্যে আমি একজন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন, পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিগণও অস্পষ্ট আয়াত সমূহের ব্যাখ্যা জানেন। হযরত মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে যুবাইর (রঃ) বলেনঃ ‘প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং ভাবার্থ একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন এবং যারা জ্ঞানে পরিপক্ক তাঁরা বলেনঃ “আমরা ঐগুলোর উপর ঈমান এনেছি। অতঃপর তাঁরা স্পষ্ট আয়াতের দ্বারা অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা করে থাকেন। ফলে কারও মুখ খোলার প্রশ্নই উঠে না। অথচ কুরআন কারীমের বিষয়বস্তুও যথার্থ হয়ে যায়, দলীল চালু হয়, অন্যায় পরিত্যক্ত হয় এবং কুফর বিদূরতি হয়। হাদীস শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর জন্যে প্রার্থনা করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! তাকে আপনি ধর্মের বোধ এবং তাফসীরের জ্ঞান দান করুন। কতক আলেম এখানে বিশ্লেষণ করে বলেন যে, تَاْوِيْلٌ শব্দটি কুরআন মাজীদের মধ্যে দু’টি অর্থে এসেছে। একটি অর্থ হচ্ছে কোন জিনিসের মূলতত্ত্ব ও যথার্থতা। যেমন কুরআন কারীমের মধ্যে রয়েছেঃ یٰۤاَبَتِ هٰذَا تَاْوِیْلُ رُءْیَایَ অর্থাৎ হে পিতঃ! এটাই আমার স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা। (১২:১০০) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ هَلْ یَنْظُرُوْنَ اِلَّا تَاْوِیْلَهٗ یَوْمَ یَاْتِیْ تَاْوِیْلُهٗ অর্থাৎ তারা শুধু ওর যথার্থতারই অপেক্ষা করছে, যেদিন ওর যথার্থতা এসে যাবে। (৭:৫৩) সুতরাং এ দু' জায়গায় تَاْوِيْل শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে মূলতত্ত্ব বা যথার্থতা। যদি এ পবিত্র আয়াতের تَاْوِيْل শব্দের ভাবার্থ এটাই নেয়া হয় তবে اِلَّا الله শব্দের উপর ওয়াফ করা জরুরী। কেননা, কোন কার্যের মূলতত্ত্ব ও যথার্থতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। رَاسِخُوْنَ فِى الْعِلْمِ উদ্দেশ্য হবে এবং يَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا বিধেয় হবে আর এ বাক্যটি সম্পূর্ণরূপে পৃথক হবে। تَاْوِيْل শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা এবং একটি জিনিস দ্বারা অন্য জিনিসের ব্যাখ্যা করা। যেমন কুরআন মাজীদে রয়েছে نَبِّئْنَا بِتَاْوِيْلِهٖ অর্থাৎ, আমাদেরকে ওর تَاْوِيْل বা ব্যাখ্যা বলুন।' (১২:৩৬) যদি উপরোক্ত আয়াতে تَاْوِيْل শব্দের এ অর্থ নেয়া হয় তবে فِى الْعِلْمِ শব্দের উপর ওয়াকফ করা উচিত। কেননা, জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ জানেন ও বুঝেন। আর সম্বোধনও তাঁদেরকেই করা হয়েছে, যদিও মূলতত্ত্বের জ্ঞান তাদের নেই। এরূপ হলে اٰمَنَّا بِهٖ শব্দটি حَال হবে। আবার مَعْطُوْفٌ عَلَيْهِ ছাড়াই مَعْطُوْفٌ হতে পারে, যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِيْنَ হতে يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْلَنَا (৫৯:৮-১০) পর্যন্ত অন্য স্থানে রয়েছেঃ وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفَّا صَفَّا (৮৯:২২) অর্থাৎ وَجَاءَ الْمَلٰئِكَةُ صَفُوْفًا صَفُوْفًا এ রকম ছিল। জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের পক্ষ হতে এ সংবাদ প্রদান-'আমরা ওর উপর ঈমান এনেছি’ এর অর্থ এই যে, তারা অস্পষ্ট আয়াত সমূহের উপর ঈমান এনেছেন। অতঃপর তারা স্বীকার করেছেন যে, এ সবগুলোই অর্থাৎ স্পষ্ট ও অস্পষ্ট আয়াতসমূহ সবগুলোই সত্য এবং একে অপরের সত্যতা প্রতিপাদনকারী। আর তাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, সমস্ত আয়াতই আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে এসেছে। ঐগুলোর মধ্যে বৈপরীত্ব কিছুই নেই। যেমন এক জায়গায় রয়েছেঃ اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ وَ لَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَیْرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوْا فِیْهِ اخْتِلَافًا كَثِیْرًا অর্থাৎ তারা কি কুরআন সম্বন্ধে গবেষণা করে না? যদি এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে হতো তবে অবশ্যই তারা এর মধ্যে বহু মতভেদ পেতো।' (৪:৮২) এ জন্যেই এখানেও বলেছেন- এটা শুধুমাত্র জ্ঞানীরাই অনুধাবন করে থাকে, যারা এ সম্বন্ধে চিন্তা-গবেষণা করে, যাদের জ্ঞান সুপ্রতিষ্ঠিত এবং যারা স্থির মস্তিষ্ক সম্পন্ন।' রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ ‘পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী কে?' তিনি উত্তরে বলেনঃ যার শপথ সত্য, যে স্থির মস্তিষ্ক বিশিষ্ট, যার কথা সত্য, যার অন্তর পরিশুদ্ধ, যার পেট হারাম থেকে রক্ষিত এবং যার লজ্জাস্থান ব্যভিচার হতে মুক্ত সেই পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী।' (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম)।
অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কতক লোককে দেখেন যে, তারা কুরআন মাজীদ সম্বন্ধে ঝগড়ায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি তাদেরকে বলেনঃ ‘জেনে রেখো যে, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তারা আল্লাহর কিতাবের আয়াত সমূহকে পরস্পর বিরোধী বলতো। অথচ তাঁর কিতাবের প্রতিটি আয়াত অন্য আয়াতের সত্যতা প্রতিপন্ন করে। তোমরা আল্লাহ তা'আলার কিতাবের ব্যাপারে মতবিরোধ সৃষ্টি করে একটিকে অন্যটির বিপরীত বলো না। যা জান তা বল এবং যা জান না তা জ্ঞানীদের উপর সমর্পণ কর। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কুরআন সাত অক্ষরে অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআনের ব্যাপারে ঝগড়া করা কুফর। (এ কথা তিনবার বলেন) যা জান তার উপর আমল কর এবং যা জান না তা জ্ঞানীদের উপর সমর্পণ কর।' (আবু ইয়া’লা) হযরত নাফে' ইবনে ইয়াযীদ (রঃ) বলেন, ‘জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত তারাই যারা বিনয়ী, যারা নম্রতা প্রকাশ করেন, প্রভুর সন্তুষ্টি কামনা করেন, বড়দেরকে বশীভূত করেন না এবং ছোটদেরকে ঘৃণা করেন না।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা প্রার্থনা করে, “হে আমাদের প্রভু! সুপথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তরকে ওসব লোকের অন্তরের ন্যায় করবেন না যারা অস্পষ্ট আয়াত সমূহের পিছনে পড়ে বিপথগামী হয়ে থাকে। বরং আমাদেরকে সরল-সোজা পথে প্রতিষ্ঠিত রাখুন, দৃঢ় ধর্মের উপর কায়েম রাখুন, আমাদের উপর আপনার করুণা বর্ষণ করুন, আমাদের অন্তর ঠিক রাখুন, আমাদের বিক্ষিপ্ততা দূর করুন এবং আমাদের বিশ্বাস বাড়িয়ে দিন। নিশ্চয়ই আপনি সুপ্রচুর প্রদানকারী।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রার্থনা করতেনঃ يَا مُقَلِّبُ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلٰى دِيْنِكَ অর্থাৎ ‘হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। অতঃপর তিনি। رَبَّنَا لَاتُزِغْ قُلُوْبَنَا-এ আয়াতটি পাঠ করতেন। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রায়ই নিম্নের দু'আটি পাঠ করতেনঃ اَللّٰهُمَّ مُقَلِّبُ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلٰى دِيْنِكَ অর্থাৎ হে আল্লাহ! হে অন্তর সমূহের পরিবর্তন আনয়নকারী! আমার অন্তরকে আপনার ধর্মের উপর স্থির রাখুন। হযরত আসমা (রাঃ) একদা তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘অন্তরের কি পরিবর্তন হয়ে থাকে? তিনি বলেনঃ হ্যা, প্রত্যেক মানুষের অন্তর আল্লাহ তা'আলার অঙ্গুলি সমূহের দুই অঙ্গুলির মধ্যে রয়েছে। তিনি ইচ্ছে করলে ঠিক রাখেন এবং ইচ্ছে করলে বক্র করে দেন। আমাদের প্রার্থনা এই যে, আমাদের অন্তরকে সুপথ প্রদর্শনের পর আল্লাহ তাআলা যেন তা বক্র না করেন এবং তিনি যেন আমাদের উপর করুণা বর্ষণ করেন। তিনি প্রচুর প্রদানকারী।' অন্য বর্ণনায় এও রয়েছে, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে এমন একটি দু'আ শিখিয়ে দিন যা আমি নিজের জন্যে করতে থাকবো। তিনি বলেনঃ “এই প্রার্থনা করঃ اَللّٰهُمَّ رَبَّ مُحَمَّدِنِ النَّبِىِّ اِغْفِرْلِىْ ذَنْبِىْ وَاَذْهِبْ غَيْظَ قَلْبِىْ وَاَجِرْنِىْ مِنْ مُضِلَّاتِ الْفِتَنِ অর্থাৎ হে আল্লাহ, হে নবী মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রভু! আমার পাপ মার্জনা। করুন, আমার অন্তরের ক্রোধ, দুঃখ কাঠিন্য দূর করুন এবং আমাকে পথভ্রষ্টকারী ফিতনা হতে বাঁচিয়ে নিন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর يَا مُقَلِّبُ الْقُلُوْبِ -এ প্রার্থনাটি শুনে হযরত আসমা (রাঃ)-এর মত তিনিও প্রশ্ন করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ উত্তরই দেন। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করে শুনান। এ হাদীসটি গারীব। কিন্তু সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে, তবে কুরআন কারীমের এ আয়াতটি পাঠ করার উল্লেখ নেই। সুনান-ই-নাসাঈ ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন রাত্রে জাগরিত হতেন তখন তিনি নিম্নের দু'আটি পড়তেনঃ لَااِلٰهَ اِلَّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اَسْتَغْفِرُكَ لِذَنْبِىْ وَاَسْاَلُكَ رَحْمَةً ـ اَللّٰهُمَّ زِدْنِىْ عِلْمًا وَّلَا تُزِغْ قَلْبِىْ بَعْدَ اِذْ هَدَيْتَنِىْ وَهَبْ لِىْ مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া কেউ উপাস্য নেই। আমি আপনার নিকট আমার পাপের ক্ষমা চাচ্ছি এবং আপনার নিকট করুণা যাঞা করছি। হে আল্লাহ! আমার বিদ্যা বাড়িয়ে দিন এবং সুপথ প্রদর্শনের পর আমার অন্তরকে বক্র করবেন না ও আপনার নিকট হতে আমাকে রহমত দান করুন, আপনি সুপ্রচুর দানকারী'। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মাগরিবের নামায পড়ান। প্রথম দু'রাক'আতে আলহামদু শরীফের পর তিনি মুফাসসালের ছোট দু'টি সূরা পাঠ করেন এবং তৃতীয় রাকআতে আলহামদু শরীফের পর এ আয়াতটি পাঠ করেন। হযরত আবু আবদুল্লাহ (রঃ) বলেন, “আমি সে সময় তার নিকটেই চলে গিয়েছিলাম, এমন কি আমার কাপড় তার কাপড়ের সাথে লেগে গিয়েছিল এবং আমি স্বয়ং তাঁকে এ আয়াতটি পড়তে শুনেছি। (মুসনাদ-ই-আবদুর রাজ্জাক) হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) এ হাদীসটি শুনার পূর্ব পর্যন্ত মাগরিবের তৃতীয় রাক'আতে قُلْ هُوَ اللهُ পাঠ করতেন। কিন্তু এ হাদীসটি শ্রবণের পর তিনিও এ রাকআতে এ আয়াতটি পড়তে আরম্ভ করেন এবং কখনও পরিত্যাগ করেননি।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তারা বলে, হে আমাদের প্রভু! নিশ্চয়ই আপনি কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষকে সমবেতকারী এবং তাদের মধ্যে হুকুম ও ফায়সালাকারী। আপনিই সকলকে তাদের ভাল-মন্দ কার্যের বিনিময় প্রদানকারী। ঐদিনের আগমনে এবং আপনার অঙ্গীকারের সত্যতায় কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।