৯-১১ নং আয়াতের তাফসীর:
৫ম হিজরীতে মুসলিম ও মক্কার কুরাইশসহ মদীনার ইয়াহুদী আর আশপাশের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে আহযাব অর্থাৎ খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তাদের মুকাবেলা করা ছিল খুবই কঠিন। এ কঠিন মুহূর্তে মুসলিম বাহিনীকে আল্লাহ তা‘আলা যে গায়েবী মদদ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন সে নেয়ামতের কথা স্মরণ করার জন্য মু’মিনদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আয়াতে প্রথমত ‘جنود’ বলতে শত্র“বাহনীদেরকে বুঝানো হয়েছে। যখন শত্র“বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার উপক্রম হয়েছিল তখনই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর গায়েবী মদদ দ্বারা মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করলেন। আল্লাহ তা‘আলার সে সময় যে নেয়ামতসমূহ দিয়েছিলেন তা হলন
১. বাতাস বা ঝড়। এর দ্বারা ঐ প্রবল হওয়াকে বুঝানো হয়েছে, যা তুফানরূপে এসে শত্র“দের তাঁবু উড়িয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, পশুর দল রশি ছিঁড়ে পালিয়েছিল, হাড়ি-পাতিল উল্টে গিয়েছিল এবং তারা সকলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এ ঝড় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমাকে পূবালী হাওয়া দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে এবং আ‘দ জাতিকে পশ্চিমা হওয়া দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ১০৩৫, সহীহ মুসলিম হা: ৯০০)
২. দ্বিতীয় ‘جنود’ বা সৈন্য দ্বারা ফেরেশতাদের বাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। তারা শত্র“দের মনে এমন ভয় ও ত্রাস সঞ্চার করে দিয়েছে যে, তারা (শত্র“ বাহিনী) সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিল।
‘من فوقكم’ দ্বারা উচ্চাঞ্চল অর্থাৎ গাতফান, হওয়াযিন এবং নাজদের অন্যান্য মুশরিক বাহিনীরা উদ্দেশ্য, তারাও মুসলিমদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এসেছিল।
من أسفل منكم এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুরাইশ এবং তাদের সাহায্যকারীরা।
আহযাব যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ঘটনা:
ইয়াহূদী গোত্র বানু নাযীর; যাদেরকে বার বার অঙ্গীকার ভঙ্গ করার ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারা খায়বারে গিয়ে বসবাস শুরু করে। তারা মক্কার কাফিরদেরকে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করার জন্য তৈরী করল। অনুরূপ গাতফান, নাজদের গোত্রসহ অন্যান্য গোত্রগুলোকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করল। সুতরাং ইয়াহূদীরা অনায়াসে ইসলাম ও মুসলিমদের সকল শত্র“দেরকে একত্রিত করে মদীনায় আক্রমণ করতে সাহস পেল।
মক্কার মুশরিকদের কমান্ডার ছিল আবূ সফিয়ান। সে উহূদ পর্বতের আশেপাশে শিবির স্থাপন করে প্রায় পুরো মদীনা পরিবেষ্টন করে নিল। তাদের সম্মিলিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। আর মুসলিমগণ ছিলেন মাত্র তিন হাজার। এ ছাড়াও মদীনার দক্ষিণ দিকে ইয়াহূদীদের তৃতীয় গোত্র বানু কুরাইযা বাস করত; যাদের সাথে তখনও মুসলিদের চুক্তি ছিল এবং তারা মুসলিমদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বানু নাযীরের ইয়াহূদী সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব মুসলিমদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে ফুসলিয়ে নিজেদের সাথে করে নিল। এদিকে মুসলিম বাহিনী সর্বদিক দিয়ে শত্র“ বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ল।
সেই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সালমান ফারসীর (রাঃ) পরামর্শে পরিখা খনন করা হল। যার ফলে শত্র“ বাহিনী মদীনার ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হল না। বরং মদীনার বাইরেই থাকতে বাধ্য হল। তখন মুসলিম বাহিনী তাদের এ পরিবেষ্টনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল এবং তারা এ বিপদের সম্মুখীন হয়ে আল্লাহ তা‘আলা সম্বন্ধে নানাবিধ কু-ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল। ঠিক ঐ মুর্হূতেই মহান আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম বাহিনীকে গায়েবী সাহায্যস্বরূপ বাতাস ও সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।
আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খন্দকের দিকে আগমন করলেন তখন প্রত্যক্ষ করলেন যে, শীতের সকালে আনসার ও মুহাজিরগণ পরিখা খনন করছেন। তাদের নিকট এমন কোন দাস নেই যে, তাদের পরিবর্তে দাসগণ ঐ কাজ করবে। তাদের কষ্ট এবং ক্ষুধার ভাব দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:
اللَّهُمَّ إِنَّ العَيْشَ عَيْشُ الآخِرَهْ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالمُهَاجِرَهْ
হে আল্লাহ তা‘আলা! পরকালের জীবনই তো প্রকৃত জীবন, অতএব আনসার ও মুহাজিরদেরকে ক্ষমা করে দাও। আনসার ও মুহাজিররা প্রত্যুত্তরে বললেন:
نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا ... عَلَي الجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا
আমরা সেই ব্যক্তি যারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হস্তে বাইয়াত করেছি যে, যতদিন জীবিত থাকব ততদিন জিহাদ করব। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৩৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে বিপদ-আপদের মাধ্যমে ঈমান পরীক্ষা করেন ।
২. মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য করা কর্তব্য।
৩. সংখ্যা বেশি হলেই যে বিজয়ী হওয়া যাবে এমনটি মনে করা ঠিক নয়।
৪. পূবালী বাতাস রহমতস্বরূপ আর পশ্চিমা বাতাস হল আযাবস্বরূপ।